ফ্লোরেনসিয়া – ৩৯

19 Min Read

মাটির নিচে একটি গুহার মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন ক্রিসক্রিংগল। তার থেকে বেশ কিছুটা দুরে জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে মার্কস। দু’জনেই অচেতন। ক্রিসক্রিংগলের পিঠের উপর এখনো ঝুলে আছে তার কাপড়ের ব্যাগ। কতক্ষণ সময় গড়িয়েছে কে জানে। মৃদু গোঙ্গানি দিয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় মার্কস। হাতে পায়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। বুকের পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙ্গে গেছে বোধ হয়। হাঁটু আর কনুইয়ের অবস্থা ভীষণ শোচনীয়। চামড়া ছিলে গেছে। রক্ত ঝড়ে সেগুলো জমাট বেঁধে গেছে আবার। সম্পূর্ণ চোখ খুলতেই চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার দেখে মার্কস। শরীর নাড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। ডান হাত নাড়িয়ে চোখ কচলাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়। মাটি ধসে নিচে পড়ে যাওয়ার ঘটনা মনে পড়ে যায়। সর্বাঙ্গ শিঁউরে উঠে। মরুভূমির শুষ্ক বালির মতো গলা শুকিয়ে যায়। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেঁজায়। অস্ফুট স্বরে বলে,,,

– আমি কি বেঁচে আছি এখনো? নাকি ম’রে গেছি? এখানে এতো অন্ধকার কেনো? এটা কি কোনো সমাধি?

ম’রে গেছে ভেবে মার্কসের দুঃখের শেষ নেই। এতো তাড়াতাড়ি ম’রতে চায়নি সে। তবুও কেনো এরকম হলো? বাঁচার জন্য কতই না চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু এই অতিপ্রাকৃত রহস্যে ঘেরা প্রায়কোভিয়ায় তার মৃ’ত্যু লেখা ছিলো তা কে জানতো? মার্কস মনে মনে নানান কথা ভাবে। অনুচ্চস্বর স্বরে বিরবিরিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে,,

-জনাব ক্রিসক্রিংগল কোথায়? তিনি বেঁচে আছেন নিশ্চয়ই! আমাকে একবার বাঁচানোর চেষ্টা পর্যন্ত করলেন না?

মার্কস ব্যথিত হয়। চোখজোড়া ভিঁজে উঠে তার। অতি কষ্টে উঠে বসার চেষ্টা করে। দু’বারের সময় সফল হয়। ভয় করে। কেমন গাঁ ছমছমে ভাব এই গাঢ় অন্ধকারে। কেনো যে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এই মৃ’ত্যুপুরীতে ঘুরতে এসেছিলো। ওরা সবাই বাড়িতে ফিরে গেছে হয়তো, শুধু বাড়িতে ফিরতে পারেনি মার্কস। প্রচণ্ড পানি পিপাসা পায়। মনে হয় এই মুহূর্তে গলা ভিঁজাতে না পারলে মা’রা যাবে সে।

– মৃ’ত মানুষের আবার দ্বিতীয় বার মৃ’ত্যু হয় কিভাবে?

প্রশ্ন টা নিজেই নিজেকে করে। অতঃপর অসহায়ভাবে দু’চোখের পাপড়ি নাড়ায়। ঈশ্বর তাকে আরো একবার বাঁচার সুযোগ দিতে পারতেন। এই সুন্দর ভূখণ্ডের এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি ছিলো তার। বিয়ে করা হয়নি। প্রেমে পড়া হয়নি। এতো এতো না হওয়ার মাঝে এভাবে ম’রে যাওয়ার কোনো মানে হয়?

– জনাব ক্রিসক্রিংগল, আমি এভাবে ম’রে যেতে চাইনি। আপনার উপর ভরসা ছিলো। ভেবেছিলাম আপনার সাহায্যে বাড়িতে ফিরে যেতে পারবো।

অনেকক্ষণ সময় গড়ায়। নিশ্চুপ নির্বাক হয়ে বসে থাকে মার্কস। ক্ষুধায় পেট মোচড়াতে শুরু করে। হঠাৎই তার মনে হয়,,,

– ম’রে যাওয়ার পর কি কারো ক্ষিধে পায়? আমি তো আত্মা। আত্মাদের ক্ষুধা লাগে না।

কিসব অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করে মার্কস। হৃদয় মুষড়ে উঠে। আর কতক্ষণ বসে থাকবে এভাবে? এরপর কি হবে? স্বর্গ নরক সম্পর্কে সে জানে। কিন্তু এই জায়গাটাতো স্বর্গ নরকের কোনো পর্যায়েই পড়ে না। তাহলে সে আছে কোথায়?

মার্কস বিষন্ন চিত্তে নিরলস বসে থাকে। কতক্ষণ সময় পেরিয়ে যায় জানা নেই। সহসা কারো গোঙ্গানির শব্দ শুনতে পায়। কেউ মৃদু কন্ঠে গোঙ্গাছে। না, না। অস্পষ্ট আওয়াজে কিছু বলছে।

– এখানে কি আরও কেউ আছে? কোনো ভালো আত্মা নাকি অতৃপ্ত আত্মা ?

মার্কসের চিত্তচঞ্চল হয়ে উঠে। বক্ষস্থলে অজানা ভয়। হৃদয় কম্পিত হয়। ভয়াবহ আতংকে গায়ের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে যায়। মার্কস উঠে দাড়ায়। বুকের অভ্যন্তরে জেঁকে বসা তীব্র ভয়ের কাছে শরীরের ব্যথা যন্ত্রণা তুচ্ছ মনে হয়। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পা টিপে টিপে হাঁটে। গোঙ্গানির শব্দটা সামনে থেকে আসছে। মস্তিষ্ক বলে, পালিয়ে যেতে। কিন্তু মন বলে সামনে এগিয়ে যা। দেখ কে আছে। মন বড় শয়তান যে! সবসময়ই বিপদে ফেলার পায়তারা খুঁজে।

মার্কস মনের কথা শুনে। ম’রেই তো গেছে। মৃ’ত্যু ভয় নেই। তাহলে কিসের ভয়? আত্মাকে কি কেউ ধরে বেঁধে রাখতে পারে? নাকি পুনরায় মে’রে ফেলতে পারে? ব্যথা অনুভব করে শরীর। সে তো কেবলই আত্মা। বোকা মার্কস। কি সব ভাবে। কি বলে, কি করে নিজেই বুজতে পারে না। কিন্তু প্রতিটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে তার আফসোস হয়। এভাবে মৃ’ত্যু না হলেও পারতো। হায়! নিয়তি তাকে কত নিষ্ঠুরতম পরিণতি দেখালো।

মার্কস ভাবে। গোঙ্গানির শব্দ শুনে ধীরপায়ে হাটঁতে থাকে সে। নিকষকালো অন্ধকারে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে হাঁটে। হৃদযন্ত্রটা অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে।

-হৃদযন্ত্র!! আত্মাদের হৃদয় থাকে কি? তাদের তো শরীরই নেই।

মার্কসের মনে হয় সে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে প্রশ্ন জাগে,,

– আত্মারাও বুঝি পাগল হয়?

না, আর ভাবতে পারে না মার্কস। যন্ত্রণায় মাথার ঘিলু শুকিয়ে যাচ্ছে। মৃদু মৃদু পা কাঁপছে। গোঙ্গানির শব্দটা আরও স্পষ্ট হয়ে আসে। এই তো, মনে হয় আর কয়েক পা বাড়ালেই কাছে পৌঁছে যাবে। হাঁটুও কাঁপছে। মৃ’ত্যুর পরেও এতো কিসের ভয়? সর্বাঙ্গজুড়ে কেনো এতো কাঁপাকাঁপি হয়? একপা দু’পা করে চারপা বাড়াতেই মার্কস হোটচ খায় কোনো কিছুর সাথে। মুখ থুবড়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। ভয়!! কোনো লাশ মনে হয়। যেন কেউ শুয়ে আছে মেঝেতে। আত্মাদের এই জগতে লাশ কিভাবে আসবে? মার্কসের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। শরীরে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা অনুভব করে। দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করে। গালে হাত রাখে। কপালে আর চিবুকের নিচে। ইতোমধ্যে জ্বর এসে গেছে। কিন্তু কিভাবে? অত্যাধিক ভয় থেকে নাকি শরীরের তীব্র ব্যথায়? চিৎকার করতে বলতে চায়,,,,

-কেউ আছো? এই জায়গাটা কোথায়?

মার্কস বলতে চেয়েও বলতে পারে না। তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয় না। আত্মা শুকিয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে মেঝেতে দু’হাত রাখে। আবার! তার মানে সত্যিই এখানে উপুর হয়ে শুয়ে থাকা কোনো লাশ পড়ে আছে। পিঠের উপর ভারী কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পায়। কাপড়ের ব্যাগের মতো।

-এটা কি ক্রিসক্রিংগল? তিনি কি মা’রা গেছেন? যদি মা’রা গিয়ে থাকেন, তবে তার আত্মা কোথায়?

আতংক বেড়ে যায়। মার্কস ভীত ভীত গলায় মৃদুস্বরে ডাকে,,,

– জনাব ক্রিসক্রিংগল? জনাব ক্রিসক্রিংগল?

পরপর কয়েকবার ডাকে মার্কস। অতঃপর ক্রিসক্রিংগলের গা ঝাঁকাতে শুরু করে। পিঠের পেছন থেকে ব্যাগ নামিয়ে কোলের উপর রাখে। ক্রিসক্রিংগলের দেহটাকে ঠেলে উল্টো থেকে সোজা করে দেয়। অন্ধকারে হাতরাতে হাতরাতে মুখ স্পর্শ করে। গালে চাপড় দিয়ে ডাকে,,,

-জনাব, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?

ধীরে ধীরে ক্রিসক্রিংগলের জ্ঞান ফিরে আসে। অস্পষ্ট স্বরে প্রত্যুত্তর দেন। তার কন্ঠস্বর চিনতে পারে মার্কস। উচ্ছ্বসিত হয়ে যায় মুখাবয়ব। আনন্দিত কন্ঠে বলে,,,

-জনাব,,উঠে বসুন। আমার একা একা ভয় লাগছে। এখানে গাঢ় অন্ধকার। চোখের সামনে নিজের হাত দু’টোও দেখা যাচ্ছে না।

ক্রিসক্রিংগল উঠে বসেন। চারদিকে তিমির অমানিশা। প্রথমে আলো জ্বালানো দরকার। পিঠের পেছনে হাত দিয়ে বুঝতে পারেন, কাপড়ের ব্যাগটা নেই। তিনি বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,

– আমার ব্যাগ?

– এইতো। এইযে আপনার ব্যাগ। নিন, ধরুন।

কোলের উপর থেকে ব্যাগটা নিয়ে ক্রিসক্রিংগলের দিকে বাড়িয়ে দেয় মার্কস। দু’হাতে ব্যাগটা ধরেন ক্রিসক্রিংগল। প্রথমেই দেশলাই বের করে আনেন। আগুন জ্বালাতেই তার মুখখানা স্পষ্ট দেখা যায়। আগুনের শিখায় ক্রিসক্রিংগলের মাথায় লাগা আঘাতের ক্ষতস্থান থেকে গড়িয়ে যাওয়া রক্ত নজরে আসে। শিউরে উঠে মার্কস। কিন্তু সে বিস্মতি হয়। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,

-আমরা তো ম’রে গেছি। আপনি আগুন জ্বালালেন কিভাবে?

কিঞ্চিত কপাল কুঁচকে নেন ক্রিসক্রিংগল। ছেলেটা এতো বোকা বোকা কথা বলে, মাঝে মাঝে সামান্য বিরক্তবোধ করেন। দ্রুত উঠে দাড়ান। আগুন ধরানোর জন্য কোনো কিছু লাগবে। কোনো শুকনো ডাল বা মশাল। চারদিকে নজর বুলান। ঠিক যেন পাথুরে গুহা। উপর থেকে পড়ে সোজা এখানে কিভাবে পৌঁছালেন? মাথার উপরে শক্তপোক্ত পাথুরে ছাদ। জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে যখন পড়ে গিয়েছিলেন তখন পায়ের নিচে আলগা মাটি ছিলো। হিসাব মিলাতে পারেন না। বড়সড় গন্ডগোল আছে কোথাও। কেউ কি তাহলে জেনে বুঝেই এখানে নিয়ে এসেছে তাদের?

বিষয়টা ভাবতেই সতর্ক হয়ে উঠেন ক্রিসক্রিংগল। পাথুরে গুহার দেয়ালে দেয়ালে মশাল খুঁজতে শুরু করেন। মার্কস বিস্ময় ভরা চোখে দেখে। ক্রিসক্রিংগল দেয়ালে আঁটকে রাখা দু’তিনটে মশাল দেখতে পান। সৌভাগ্যক্রমে একটা মশাল আগুন জ্বালানোর উপযোগী ছিলো।

– আমরা এখন কোথায় আছি জানেন? মৃ’ত্যুপুরীতে।____সহসা মার্কস বলে উঠে।

– তোমার এরকম কেনো মনে হলো?____ক্রিসক্রিংগল অকপটে জিজ্ঞেস করেন।

– মা’রা গেছি তাই।

– আচ্ছা চলো। পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার রাস্তা খোঁজা যাক।

মশাল হাতে একপা সামনে বাড়িয়ে কথাটা বলেন ক্রিসক্রিংগল।

– তা কিভাবে সম্ভব?_____ মার্কসের কন্ঠে বিস্ময়। চোখগুলো অস্বাভাবিক রকম বড়বড় হয়ে যায়।

– আমরা এখনো বেঁচে আছি মার্কস। অন্তত একটু মাথা খাটাও। এতোটা বোকা হলে তোমাকে এভাবেই পদে পদে বিপদে পড়তে হবে।

– আপনি সত্যি বলছেন? আমরা বেঁচে আছি!!__মার্কস উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে।

ক্রিসক্রিংগল কোনো প্রত্যুত্তর দেন না। বড় বড় পা ফেলে হাঁটতে শুরু করেন। তার পেছনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে মার্কস। যেন তার বিশ্বাস হয়না। ক্রিসক্রিংগল অনেকটা এগিয়ে গেছেন দেখে সে এক প্রকার ছুটতে শুরু করে। উচ্চস্বরে ডাকে,,,

– জনাব ক্রিসক্রিংগল। দাড়ান।

দাঁড়িয়ে পড়েন ক্রিসক্রিংগল। থমথমে মুখে তাকান। সতর্ক করে বলেন,,,

-আমরা এখানে এমনি এমনি পৌঁছে যায়নি। কেউ জেনে বুঝে এখানে নিয়ে এসেছে। সতর্ক থাকা ভালো। তুমি নিচু আওয়াজে কথা বললে আমি খুশি হবো।

বেঁচে আছে জেনে যতটা আনন্দিত হয়েছিলো, কেউ জেনে বুঝে এখানে নিয়ে এসেছে শুনে, তার থেকেও বেশি ভীত হয়ে যায় মার্কস। শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করে,,,

– ওরা কি আমাদের মে’রে ফেলবে?

ক্রিসক্রিংগল কথা বাড়ান না। দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করেন। পেছনে মার্কস। সুদীর্ঘ লম্বা গুহায় কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা খোলা দরজার মতো দেখেন। যতদুর মশালের আলো পৌঁছায় দরজাটাকে একটা সুরঙ্গের মতো মনে হয়। তিনি সতর্ক হয়ে উঠেন। দ্বারপ্রান্তে যদি কোনো অচেনা অজানা বিপদ লুকিয়ে থাকে! দুর থেকে মশাল দিয়ে সামনের রাস্তাটা পর্যবেক্ষণ করেন। সাত ফুট উঁচু আর ছ’ফুট প্রস্থের সুরঙ্গটার দৈঘ্যের যেন শেষ নেই। মার্কসের দম বন্ধ হয়ে আসে। শতবর্ষ পুরনো সুরঙ্গের শক্ত পাথুরে দেয়াল দু’দিক থেকে যেন তাকে চাপ দিতে চাইছে। মার্কস অনুচ্চস্বরে বলে,,,

– আমার ভীষণ ভয় করছে।

দু’জনের কারো হাতেই কোনো অস্ত্র নেই। এই মুহূর্তে অস্ত্রধারী কোনো শক্তিশালী দলের সম্মুখীন হলে মার্কস সহ নিজেকে রক্ষা করা মুশকিল হয়ে যাবে। তবুও নিজের মনোবল দৃঢ় রাখেন ক্রিসক্রিংগল। বেশ কয়েক মিনিট হেঁটে সুরঙ্গ থেকে বের হওয়ার দরজার কাছাকাছি পৌঁছে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্য। গোলাকৃতির পাথুরে দরজাটা বাইরে থেকে আঁটকে রাখা ছিলো। ক্রিসক্রিংগল পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যান। নিঃসন্দেহে তাদের জেনে বুঝে এই গুহায় আঁটকে রাখা হয়েছে, কিন্তু কে বা কারা আঁটকে রেখেছে? তাদের উদ্দেশ্য কি?

_____

মার্শাল আর্ট একাডেমি।

ঘড়িতে তিনটা বাজতে তখনো দু’ মিনিট বাকি। দ্বিতীয় শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ চলছিলো। একজন মাস্টার শিক্ষার্থীদের মার্শাল আর্টের কিছু রণকৌশন শিখিয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎই শ্রেণীকক্ষের সামনে এসে দাড়ান মাস্টার জোডিথ। শৈলী শেখানো মাস্টার পেছনে দু’হাত বেঁধে দাড়ান। ঠিক তিনটা বাজতেই মাস্টার জোডিথ কামরায় প্রবেশ করেন। গলা খাকারি দিয়ে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। অতঃপর সকল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলেন,,,

– ডিয়ার স্টুডেন্টস। আমি তোমাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই।

তার বলা কথায় শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে তাকায়। উৎকর্ণ কানে মনোযোগ দিয়ে শোনে। মাস্টার জোডিথ দৃঢ় গলায় বলেন,,,

– একাডেমির রুলস অনুযায়ী প্রতি তিনমাস পর প্রথম শ্রেণীর সেরা শিক্ষার্থীদের সাথে দ্বিতীয় শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় শ্রেনীর যে শিক্ষার্থীগুলো যুদ্ধে জয়ী হয়, তারা প্রথম শ্রেনীতে প্রমোশন পায়। আগামী ক্লাস থেকে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হবে। তোমাদের মধ্যে থেকে শুধুমাত্র বিশ জন সেরা শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেনীতে প্রমোশন পাবে। আশা করি বুঝতে পেরেছো সবাই?

– জ্বি মাস্টার।______জোর গলায় সমস্বরে বলে উঠে সবাই।

– ওয়েট। আরও একটা বিষয়। তোমরা যারা গতকাল মিলনায়তন ভবনে চিফ মাস্টারের ক্লাসে উপস্থিত ছিলে, তারা সবাই দেখেছো। প্রথম শ্রেণীর একজন সেরা ছাত্রী ডোনা, দ্বিতীয় শ্রেণীর সিয়ার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে হেরে গিয়েছিলো। সুতরাং বিজয়ী ছাত্রী হিসাবে সিয়াকে প্রথম শ্রেনীতে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। ওর আলাদা করে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার কোনো প্রয়োজন নেই।

মাস্টার জোডিথের বলা শেষ কথাটুকু শুনে কামরায় শোরগোল পড়ে যায়। ইনায়া আর আর্নি ভীষণ খুশি হয়। সিয়ার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ও মাস্টার জোডিথের পরবর্তী কথাটুকু শোনার অপেক্ষায়। বাকিরা ফিসফিসিয়ে একে অপরের সাথে কথা বলতে শুরু করে। মাস্টার জোডিথ তাদের থামানোর উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলেন,,,

– প্লিজ সাইলেন্স।

কামরা পুনরায় নিস্তব্ধ হয়ে উঠে। মাস্টার জো দৃঢ় কন্ঠে বলেন,,,

– এখনো কি তোমাদের শৃঙ্খলা শেখাতে হবে? এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ম থাকলে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারো। অবশ্য এটা প্রিন্সিপালের সিদ্ধান্ত। আমি শুধু তোমাদের জানিয়ে দিলাম।

শিক্ষার্থীদের কেউ কোনো কথা বলে না। পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড স্থির দাঁড়িয়ে থেকে কামরার বাইরে বেরিয়ে যান মাস্টার জো। তার পেছনে অন্য মাস্টার। হাঁটতে হাঁটতে তিনি মাস্টার জোডিথকে জিজ্ঞেস করেন,,,

-মাস্টার জো। হঠাৎ করে প্রিন্সিপাল এরকম সিদ্ধান্ত কেনো নিলেন?

– কারন এরকমটা চিফ মাস্টার চেয়েছিলেন।

– ও আচ্ছা।

মাস্টার দু’জন বেরিয়ে যেতেই একে একে সকল শিক্ষার্থীরাও কামরা থেকে বেরিয়ে যায়। ওরা সবাই সিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন দু’চোখের দৃষ্টি দিয়েই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিবে ওকে। ইনায়া,সিয়া আর আর্নি দ্রুত পায়ে হাঁটে। অদুরে একাডেমির মাঠে ওদের তিনজনের অপেক্ষায় ক্রিস্তিয়ান দাঁড়িয়ে আছে।

______

খারকিভ, ওয়াভেল কোট।

সন্ধ্যাবেলা। বিছানায় শায়িত অচেতন আব্রাহাম। তার পাশে কাঠের উঁচু টুল পেতে বসে আছে ইজাবেল। সারাদিন ফুরিয়ে গেছে এখনো চেতনা ফিরে পাননি এস্টীম রুলার। এদুয়ার্দো থমথমে পায়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়। আব্রাহামের বুক আর হাতে এখনো গাঢ় ক্ষত। তাকে আহত করতে বা মে’রে ফেলতে ক্রুশ ব্যবহার করা হয়েছিলো। ম’রবে না সে। কিন্তু শরীরে পুনরায় শক্তি ফিরে পেতে সময় লাগবে। ভাবতে ভাবতেই এদুয়ার্দো নিজের কামরায় প্রবেশ করে। সোফার উপর বসে। চোখ দু’টো আগুনের মতো জ্বলছে।

ক্ষণকাল সময় গড়ায়। দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। এদুয়ার্দো অনুমতি দেয়,,,

– এসো।

দরজা ঠেলে নিঃশব্দে কামরায় প্রবেশ করে অ্যাভোগ্রেডো।এদুয়ার্দোকে শ্রদ্ধা ভরে সম্মান জানিয়ে বলে,,,,

– অনারেবল ওভারলর্ড। স্ট্রিকল্যান্ড বাজারে আসেননি আজ।

এদুয়ার্দো নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে। এই লোকটা জানে সেদিন কাস্ত্রোরুজ থর্পে কি হয়েছিলো। ফ্লোরেনসিয়ার মা-দাদিনকে কে বা কারা হ’ত্যা করেছিলো। স্ট্রিকল্যান্ডের মস্তিষ্ক পড়লেই সবটা জানতে পারবে সে। কিন্তু এর জন্য তাকে যেতে হবে। লোকটার সম্মুখীন হতে হবে।

– আচ্ছা যাও।

অ্যাভোগ্রেডো পেছন ফিরে কেবলই এক পা বাড়ায়। কিন্তু এদুয়ার্দোর কন্ঠস্বর শুনে থেমে যায়।

-দাড়াও।

-জ্বি অনারেবল ওভারলর্ড।

– আমি যেদিন প্রথম কাস্ত্রোরুজ গিয়েছিলাম, সেদিন সেখানে আব্রাহাম উপস্থিত ছিলো। আমি ওকে দেখেছিলাম। পরদিন সকালে কোনো এক রক্তপিপাসুর দ্বারা এমিল এবং আন্দ্রেয়া নামের দু’জন মানুষের মৃ’ত্যুর খবর জানতে পারি। দু’জনেই ছিলো উইজার্ড পরিবারের সদস্য। আমি যেহেতু আব্রাহামকে দেখেছিলাম, তাই নিশ্চিত ছিলাম এমিল এবং তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আন্দ্রেয়াকে আব্রাহাম হ’ত্যা করেছিলো।

– অনারেবল ওভারলর্ড। রুলারের সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তিনি কখনো কোনো নিরীহ মানুষ’কে হ’ত্যা করেননি।

– তুমি কি বলতে চাইছো আমি ভুল দেখেছি?______এদুয়ার্দোর থমথমে ভরাট কন্ঠ।

দু’হাটু ভেঙ্গে বসে পড়ে অ্যাভোগ্রেডো। নত মস্তকে বুকের কাছে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ রেখে বলে,,,

– ক্ষমা করবেন। আমি তা বলতে চাইনি।

– ঠিক আছে। তুমি এখন যাও।

অ্যাভোগ্রেডো ত্বরিত উঠে দাড়ায়। দ্রুতপায়ে হেঁটে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়। এদুয়ার্দো দু’হাতে মাথা চেপে ধরে। অনেক কিছু ভাবে। তার মনের মধ্যে জাগা সবগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে বেরিয়ে আসবে।

___________

ইম্যুভিল।

রাত সাড়ে দশটা বাজে। রাতের খাবার খাওয়া শেষ করে সিয়া,ইনায়া আর আর্নি কামরায় ফিরে আসে। আর্নি বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ইনায়া কামরায় কিছুক্ষণ ইতস্তত পায়চারি করে। আর্নিকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,,

– যার সাথেই দ্বন্দ্বযুদ্ধ হোক, তোমাকে যুদ্ধে বিজয়ী হতে হবে। আমরা তিনজন একসাথে প্রথম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হবো। মনে থাকবে?

লম্বা একটা হাই তুলে আর্নি। ঘুমের প্রকোপে ওর দু’চোখ বুজে আসে। ভাবলেশহীন কন্ঠে অকপটে বলে,,,,

– আমার দ্বারা ওসব হবে না। ভুলে যাও।

– হবে। চেষ্টা করলে তুমি অবশ্যই পারবে।

আর্নির থেকে কোনো উত্তর আসে না। ইনায়া বুঝতে পারে আর্নি ঘুমিয়ে গেছে। সিয়া বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। ইনায়া শাসনের স্বরে বলে,,,,

– একদম বারান্দায় যাবে না। এখনই শুয়ে পড়বে। আজ থেকে তোমার রাতের বেলা বই পড়া বন্ধ।

সিয়া দাঁড়িয়ে পড়ে। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,,,

– তাহলে কি করবো বলো?

– ঘুমাবে।

– তুমিতো জানো, আমি এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারি না।

– আজ থেকে চেষ্টা করো। ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।

– ঠিক আছে।____ সিয়া ম্লান কন্ঠে বলে।

ইনায়া খুশি হয়। সিয়া বিছানায় শুয়ে পড়ে। ইনায়া সিয়া আর আর্নির গলা অবদি মোটা কম্বল টেনে দেয়। কামরার সবগুলো মোমবাতি নিভিয়ে শুধু এককোণায় একটা মোম জ্বালিয়ে রাখে। সিয়াকে মাঝখানে রেখে একপাশে নিজেও শুয়ে পড়ে। সিয়াকে একটুও ভরসা করতে পারে না। একপাশে শুয়ে ঘুমালে যদি মাঝরাতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়।

শুয়ে থেকে দু’বোনে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে ওরা। ইনায়া কথা বলে, সিয়া শুধু হ্যাঁ,হু শব্দ করে উত্তর দেয়। গল্প করতে করতেই আচমকা ঘুমিয়ে পড়ে ইনায়া। ওর ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। ঘুম আসে না সিয়ার দু’চোখের পাতায়। ও মনে মনে ভাবে,,,

-কিয়েভের সেই দেশড় বছরের প্রাচীন দুর্গ, স্যাভেরিন ক্যাসলের সাথে এদুয়ার্দো স্যাভেরিনের কি কোনো যোগসূত্র আছে?

ধীরে ধীরে সময় গড়ায়। আচমকা বাড়ির বাইরে খুব জোর বাতাস বইতে শুরু করে। পশ্চাদ্ভাগের উঠানের দিকে। বাতাসের দাপটে মটমট শব্দে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে। যেন প্রলংকারী ঝড়ের পূর্বাভাস। সিয়ার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠে। বাইরে কিছু অশুভ শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করে। ওরা একজন নয়, কয়েকজন হবে।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।