কাস্ত্রোরুজ থর্প।
যতদুর চোখ যায় সমাধিক্ষেত্রের চারদিকে নিগূঢ় নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিলো। জনমানবহীন এই জায়গাটা যেন ধূ-ধূ মরুভূমির সমতুল্য। পল্লবহীন জরাজীর্ণ পুরনো বৃক্ষ, মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া লোহার গেট, পায়ের নিচে শুকনো পাতার মরমরে শব্দ। ক্ষয়প্রাপ্ত সমাধিগুলোতে থাকা মৃত ব্যক্তিরা যেন তাদের নিরব কান্নায় আকুল আর্তনাদ করে সিয়াকে কিছু বলতে চায়ছিলো। কিন্তু এসবের কোনো দিকেই খেয়াল ছিলো না সিয়ার। ও একমনে নিজের মায়ের সাথে কথা বলছিলো। মনের গহীনে কতশত অব্যক্ত কথা জমা ছিলো, যা ইলহামাকে অকপটে শোনাতে চেয়েছিলো। অনেকক্ষণ সময় ধরে মায়ের সাথে গল্প করার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো ওর। কিন্তু শ’য়তানগুলো এখানেও পৌঁছে গেলো। সিয়ার চারপাশে ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করলো।
রাত গভীর থেকে আরও গভীর হয়। উৎ পেতে থাকা অতৃপ্ত আত্মাগুলো সুযোগ খুঁজে পায়। যেন ওরা বহুদিন ধরে প্রহর গুনছিলো সিয়ার অপেক্ষায়। ক্ষণকাল সময় গড়ায়। বীভৎস, রাক্ষুসে কালো বাদুড়গুলো দলবেঁধে সিয়াকে আক্রমণ করে বসে। তীক্ষ্ণ ধারালো নখ দাবিয়ে দেয় শরীরে। ক্ষতবিক্ষত করে। বিদঘুটে দাঁত খিঁচিয়ে কামড়ে ধরে হাতে, গলায় আর কাঁধে।
সিয়ার পক্ষে বাদুড়গুলোকে প্রতিহত করা কঠিন হয়ে দাড়ায়। নিজের অজ্ঞাতেই ব্যথাতুর কন্ঠে করুন আর্তনাদ করে উঠে। কালো ধোঁয়ার কুন্ডলীগুলো মানুষের অবয়ব ধারন করে। কতগুলো ফ্যাকাশে কালচে ঠোঁটের মুখশ্রী নজরে আসে। কাউকে চিনতে পারে না ও। সবগুলো অচেনা, অপরিচিত কমবয়সী পুরুষ ছিলো। তন্মধ্যে একজন পুরুষ মধ্যবয়স্ক। প্রত্যেকে হিংস্র হায়েনার মতো লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সিয়ার দিকে। যেন একসাথে হামলে পড়বে ওর রক্ত চুষে খেতে। সিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে। উচ্চ আওয়াজে ক্রোধিত কন্ঠে বলে,,,,
– জা’নোয়ারের দল। এই নিকৃষ্ট বাদুড়গুলোকে দিয়ে আক্রমণ করিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করছিস?
একজন হিংস্র ভঙ্গিতে তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত বের করে তেড়ে যায় সিয়ার দিকে। তাকে দু’হাতে জাপ্টে ধরে অন্যজন। মধ্যবয়স্ক পুরুষটার হাতের ইশারায় বাদুড়গুলো কেমন শান্ত হয়ে যায়। সিয়ার মাথার উপরে অনেকটা উঁচুতে চক্রাকারে উড়তে শুরু করে। লোকটা ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসে। সিয়ার দিকে কয়েক পা এগিয়ে যায়। সহাস্যে বলে,,,
– তুমি উইজার্ড ডিয়েটসের নাতনি তাইনা? আমার নাম জোসেফাইন। তোমার দাদুর বন্ধু ছিলাম একসময়। সুতরাং ভয় পেয়ো না। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না।
সিয়া উৎকর্ণ কানে নিশ্চুপ হয়ে শোনে। জোসেফাইন থ্যাসোর দিকে তাকায়। নিমেষেই যেন তার দৃষ্টি ঝলসে যেতে চায়। ত্বরিত চোখ সরিয়ে নেয়। থ্যাসোর শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়া তীব্র সাদা আলোয়, আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো শরীরে জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করে। তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি র’ক্তচোষাদেরও একই অবস্থা হয়। জোসেফাইন ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলে,,,
– তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। প্রথমে এটাকে চলে যেতে বলো।
সিয়া কিছু একটা আন্দাজ করে নেয়। হয়তো থ্যাসোর জন্য ওদের কোনো সমস্যা হচ্ছে। ও কিঞ্চিত ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্রুর হাসে। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,
– কেনো? কোনো সমস্যা হচ্ছে? ও চলে গেলেই আমার রক্ত খেতে পারবি তাই? আয়, খা,, খা । যত খুশি আমার শরীর থেকে রক্ত চুষে খা।
সিয়ার দু’চোখ থেকে আগুনের ফুলিঙ্গ ঝড়ে পড়ে। ও উচ্চস্বরে ডাকে,,,
– থ্যাসো।
থ্যাসো ত্বরিত সিয়ার সামনে গিয়ে দাড়ায়। ওর প্যাচানো শিং থেকে সোনালী রঙের দ্যুতি ছড়ায়। শরীর থেকে পূর্বের তুলনায় আরো দ্বিগুন সাদা রঙের আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে। শয়তানগুলো কেমন ছটফট করতে শুরু করে। জোসেফাইন দ্রুত অনেকটা দুরে সরে দাড়ায়। আর্ত কন্ঠে বলে,,,
– এই ইউনিকর্ন টা তোমার নয়। এটা অন্যকারো। যদি এটার মালিক সত্যিই তুমি হও, তাহলে তুমি অন্যকেউ। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?
জোসেফাইন আবোল তাবোল বকে। সিয়া রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,
– এখানে আসার আগে কি আফিম খেয়েছিস? নাকি রক্ত খেয়েই মাতাল হয়ে গেছিস? মুর্খ পি’শাচ। আমি ফ্লোরেনসিয়া। উইজার্ড ডিয়েটসের নাতনি এবং রবার্ট ক্রিসক্রিংগলের ছোট মেয়ে।
– ঠিক আছে। তুমি কি তোমার দাদুর কাছে পৌঁছাতে চাও? আমি তার কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো। সব ভাম্পায়ার খারাপ হয়না। আমাকে বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে সাহায্য করবো।
-শ’য়তানের দল। আমাকে মুর্খ ভেবেছিস?
সিয়ার ক্রুদ্ধ কন্ঠস্বর। থ্যাসো যেন ওর মনোবল বাড়িয়ে দেয়। ভয় পায়না ও। জোসেফাইন বুঝতে পারে, সহজ কথায় ভুলিয়ে সিয়াকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। সে বাকি ভাম্পায়ারদের চোখের ইশারায় কিছু বলে। আদেশ পেয়ে শয়তানে গুলো সিয়ার দিকে তীব্র বেগে ছুটে যায়। সিয়া থ্যাসোর পিঠে চড়ে বসে। শক্তহাতে লাগাম টেনে ধরে। দৃঢ় গলায় বলে,,,
– থ্যাসো। ওরা যেন আমাদের ধরতে না পারে।
থ্যাসো আলোর বেগে ছুটে। কতগুলো কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী বাতাসের বেগে ওদের পেছনে ধাওয়া করে। জোসেফাইন আহম্মকের মতো স্থির দাঁড়িয়ে রয়। তার কাছে সবটাই কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার কথা পিদর্কা স্যাভেরিনকে জানাতে হবে।
ক্ষণকাল সময় গড়ায়। চোখের পলকে ইম্যুভিলে পৌঁছে যায় থ্যাসো। ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ির সীমানায় প্রবেশ করে। জলাশয়ের পাশে মাটিতে নেমে দাড়ায়। সিয়া নিশ্চিন্ত। বাড়ির চারদিকে শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যারিয়ার থাকায় শ’য়তানগুলো সিয়ার ধারে কাছে আসতে পারবে না। কিন্তু ও বুঝতে পারে না, রক্তচোষা জানোয়ারগুলো কাস্ত্রোরুজ থর্পে ওর কাছে কিভাবে পৌঁছালো?
________
খারকিভ, ওয়াভেল কোট।
টেবিলের উপর পেপারওয়েট দিয়ে চেপে রাখা পিদর্কা স্যাভেরিনের চিঠি। ভোরবেলা এসে পৌঁছেছে ওয়ালভেল কোটে। চিঠিটা এদুয়ার্দোর হাতে তুলে দিয়েছিলো ইজাবেল। সে জানে না ওভারলর্ডের হঠাৎ কি এমন হয়েছে? কেনো এতো বেশি গম্ভীর দেখাচ্ছে তাকে? যেন প্রাণহীন পাথরের মতো। কন্ঠস্বর ছিলো অদ্ভুত রকম ভারী আর মুখখানা ছিলো ভয়াবহ থমথমে। ইজাবেল নিঃশব্দে কামরাজুড়ে পায়চারি করে। সোফার উপর গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকে এদুয়ার্দো। বুকের অভ্যন্তরে গভীর ক্ষত। মনের কোণে জেগে উঠে কতশত প্রশ্ন।
ভাম্পায়ার সত্তার ধর্মই হলো মা’নুষ হ’ত্যা। মানুষের রক্ত পান করা। পি’শাচদের জীবনে ন্যায় অন্যায় বলে কিছু নেই। তারা অপদেবতা লুসিফারের অনুসারী। যাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো পৃথিবী থেকে ঈশ্বরের নাম মুছে দিয়ে শ’য়তানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। লুসিফার, নরকের দেবতা। সমস্ত অশুভ শক্তির স্রষ্টা।
যেখানে রক্তপিপাসুদের জীবনে মানুষ হ’ত্যা নিছকই সাধারণ ঘটনা, সেখানে তার মা মাত্র তিনজন মানুষ হত্যা করায় তার এতো যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে? এই যন্ত্রণাটা কি শুধু বিশ্বাস ভাঙ্গার?
ডিয়েটসের পরিবারের কে মা’রা গেলো, কে বেঁচে রইলো তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবার প্রয়োজন মনে করেনা এদুয়ার্দো। সে কেবলই নিজের মায়ের পাঠানো চিঠির কথাগুলো ভাবে।
বাবা এদুয়ার্দো,,,
তুখোড় বুদ্ধি সম্পন্ন বড় রাজপুত্র আমার। দয়া করে মায়ের উপর রেগে থেকো না। আশা করি মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবলে তুমি সবটা বুঝতে পারবে। সেদিন আমার ওদেরকে মে’রে ফেলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু আমি নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারিনি। সন্তানদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমাকে নিষ্ঠুর হতে হয়েছিলো। তুমি কি বুঝতে পারবে, একজন মায়ের সন্তান হারানোর ভয় কতটা তীব্র আর যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে? আমিই একদিন তোমাকে বলেছিলাম, বাবা এদুয়ার্দো,,,কখনো কোনো নিরীহ মানুষকে হ’ত্যা করো না। শুধুমাত্র আমার কথাতেই তুমি নিরীহ মানুষ হ’ত্যা করা থেকে বিরত থেকেছিলে। তারপর থেকে তুমি মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে, কিন্তু কোনো নির্দোষ নিরপরাধ মানুষকে হ’ত্যা করতে না।
তোমাকে কিছু না জানিয়ে এসব করেছি বলে তুমি ভাবছো, আমি তোমার বিশ্বাস ভেঙ্গেছি। কিন্তু আমিতো ভেবেছিলাম ওদের ভয় দেখিয়ে জিনিষগুলো নিয়ে আসবো। নিজের কাছে সযত্নে রেখে দিবো। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেছে কিছুই বুঝতে পারিনি। মাতৃত্ববোধ আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিলো। জানিনা সেদিন কিভাবে আমি এতবড় অপরাধ করেছিলাম। তবে আমি অনুতপ্ত হয়েছিলাম। কিন্তু তোমার কাছে স্বীকার করতে পারিনি। ভয় পেয়েছিলাম। তোমাকে হারানোর ভয়। আমাকে ঘৃণা আর অবিশ্বাস্য করবে সেই ভয়। দেখো, ভয় সত্যিতে বদলে গেলো।
তুমি আমাকে অবিশ্বাস্য করলে। আমার সম্পূর্ণ কথা না শুনেই আমার থেকে দুরে সরে গেলে। আমাকে শাস্তি দিতে চাইছো। তুমি আমাকে অবিশ্বাস করেছ, এর থেকে বড় শাস্তি আমার জন্য আর কি হতে পারে? তুমিতো জানো তুমি আমার জীবনে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তুমি সমগ্র ভাম্পায়ার জাতির ওভারলর্ড হতে পারো। কিন্তু আমার কাছে তুমি, আমার সবচেয়ে আদরের সুদর্শন রাজপুত্র। তোমাকে না জানিয়ে তোমার মা কি কোনো কাজই করতে পারে না? তাহলে সে ভাম্পায়ার সাম্রাজ্যের অনারেবল এমপ্রেস কিভাবে হলো?
যাই হোক, তোমার এই অপরাধী মা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে এদুয়ার্দো। আমি অনুতপ্ত। তুমি আমাকে যতবড় শাস্তিই দাওনা কেনো। আমি মাথা পেতে নিবো। শুধুমাত্র তোমাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে চাই। তোমার কপালে চুমু খেতে চাই। তুমি কি একবার আমার কোলের উপর মাথা রাখবে এদুয়ার্দো?
এদুয়ার্দো ত্বরিত চোখ মেলে তাকায়। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। মায়ের সাথে কাটানো সমস্ত আনন্দঘন মুহূর্তগুলো দু’চোখের সামনে ভেসে উঠে। ভীষণ গলা শুকিয়ে যায়। তীব্র রক্ত পিপাসা জাগে। পায়চারি থামিয়ে ইজাবেল দৌড়ে আসে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,
– অনারেবল ওভারলর্ড। কি হয়েছে আপনার? এরকম করছেন কেনো?
– কামরায় যাও।____ এদুয়ার্দো থমথমে ভরাট কন্ঠে বলে।
ইজাবেল কর্নপাত করেনা। বিচলিত গলায় বলে,,,,
– ভাই! দয়া করে বলুন আমাকে।
এদুয়ার্দো ত্বরিত উঠে দাড়ায়। ঝড়ের বেগে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়। ইজাবেল তার পিছু নেয়। টাওয়ারের রুফটপে উঠে আসে। ছাদের চারদিকে নজর বুলিয়ে এদুয়ার্দোকে খোঁজে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না সে। ইজাবেলের ডুকরে কান্না পায়। দু’চোখের কার্নিশ গড়িয়ে অবাধ নোনাজল গড়িয়ে যায়।
কয়েকপল সময় গড়ায়। সহসা পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পায়। ইজাবেল অশ্রুসিক্ত চোখে পেছন ফিরে দেখে। চকিত কন্ঠে ডাকে,,,
– ভাই!
এদুয়ার্দো নয়, অ্যাভোগ্রেডো দাঁড়িয়ে আছে। ইজাবেলের কৃষ্ণ কালো চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত দেখে, অ্যাভোগ্রেডোর হৃদয় মুষড়ে উঠে। বুক পোড়া জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করে। হৃৎস্পন্দন ধীর হয়ে আসে। ইজাবেল বিষন্ন বদনে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। অ্যাভোগ্রেডো নিঃশব্দে পা ফেলে তার সামনে গিয়ে দাড়ায়। আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,
– কি হয়ছে? আপনি ছোট বাচ্চাদের মতো এভাবে কাঁদছেন কেনো?
– ওভারলর্ডের কি হয়েছে অ্যাভেগ্রেডো?___কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ইজাবেল।
– মহারাজের কি হবে? কিছুই হয়নি।
– কিছু একটা হয়েছে। আজকের আগে কখনো আমি তাকে এতোটা বিষন্ন থাকতে দেখিনি।
– তিনি হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে ভাবছেন। আপনি একদম দুশ্চিন্তা করবেন না। ঠিক হয়ে যাবে।
ইজাবেল ছাঁদের কিনারায় গিয়ে দাড়ায়। অ্যাভোগ্রেডো চাঞ্চল্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,
– একাডেমিতে যাবেন না আজকে?
– না। রুলার কেমন আছেন?
– এখন পুরোপুরি সুস্থ।
ইজাবেল বেশ আশ্চর্য হয়। আব্রাহামের প্রতি প্রগাঢ় অভিমান জন্মায়। চমকে পেছনে ফিরে। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,
-সুস্থ হয়ে উঠেছেন, অথচ আমার সাথে একবারও দেখা করতে এলেন না?
– আসবেন।___অ্যাভোগ্রেডো ম্লান হেসে বলে।
– উনাকে আসতে হবে না। আমি নিজেই যাবো। বলো দাও তিনি কোথায় আছেন।
ইজাবেল অভিমানী কন্ঠে বলে। ছাঁদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, সেকথা বেমালুম ভুলে যায়। এক পা পিছতেই ছাঁদ থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ে। দ্রুতবেগে ছুটে গিয়ে তার একহাত ধরে ফেলে অ্যাভোগ্রেডো। টান দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। যেন তার কলিজা শুঁকিয়ে যায়। হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়ে। অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে হৃদপিণ্ড। ইজাবেল হতভম্ব। কান পেতে অ্যাভোগ্রেডোর হৃৎস্পন্দন শোনে। হতবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,
– কি হলো? এরকম করলে কেনো? পড়ে গেলেই কি এমন হতো?
অ্যাভোগ্রেডো সম্বিত ফিরে পায়। ইজাবেলকে ছেড়ে দিয়ে দুরে সরে দাড়ায়। ইতস্তত করে বলে,,,
– আমি দুঃখীত। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
– ভয়? কিসের ভয়?____ইজাবেলের কন্ঠে বিস্ময়।
– আপনাকে হারানোর ভয়। ______নিজের অজান্তেই মুখ ফুটে কথাটা বলে ফেলে অ্যাভোগ্রেডো।
ইজাবেল ভ্রু কুঞ্চিত করে সরু দৃষ্টিতে তাকায়। নিজের বলা কথাটা বুঝতে পেরে অ্যাভোগ্রেডো থতমত খায়। অস্বস্তি বোধ করে। ইজাবেল মিটমিটিয়ে হাসে। পরমুহূর্তেই দু’ঠোঁটের ভাঁজে হাসিটুকু লুকিয়ে ফেলে সে। মুখখানা থমথমে করে তুলে।
অ্যাভোগ্রেডোর অব্যক্ত অনুভূতিগুলো ইজাবেল বেশ ভালো করেই বুঝতে পারে। কিন্তু তার অভিমান হয়। কেনো প্রকাশ করে না অ্যাভোগ্রেডো? প্রিন্সেস বলে কি তাকে ভালবাসার কথা জানানো অন্যায়? সে কি জানে না, মেয়েরা নিজে থেকে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনা?
_____
ইম্যুভিল।
ইম্যুভিলের আকাশ সবসময়ই গাঢ় কুয়াশাচ্ছন্ন। হাড়মজ্জা কাঁপানো শীত। হিমশীতল বাতাস প্রবাহিত হয়। আবহাওয়া সতেজ। ধীরে ধীরে অনবরত তুষার পড়তে থাকে। এখানকার অধিবাসীরা এই আবহাওয়ার সাথে নিজেদেরকে খুব সহজে মানিতে নিতে পারে। বৃষ্টির দিনগুলো হয় ভীষণ সুন্দর এবং মনোমুগ্ধকর।
সিয়ার সাথে দ্বন্দযুদ্ধ শেষে, ইনায়া বরফে ঢাকা বিস্তর প্রান্তরে সটান শুয়ে পড়ে। ওর সাথে সঙ্গ দেয় কিচ। লাফালাফি করে। ইনায়া দু’হাত ভর্তি বরফ গুঁড়ো নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা সিয়ার দিকে সজোরে ছুঁড়ে মা’রে। সিয়ার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। গতকাল রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার কথা ভাবছিলো ও। ইনায়া ওর মন বিষন্ন দেখে একটুখানি স্বাভাবিক করতে চেয়েছিলো। কিন্তু ও ব্যর্থ হয়। ইনায়ার ম্লান মুখখানা সিয়া নির্জীব চোখে দেখে। ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে কিচকে কোলে তুলে নেয়। ইনায়াকে উদ্দেশ্য করে শান্ত কন্ঠে বলে,,,
– তুমি কি নিজে স্বাভাবিক হতে পেরেছ? আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝি। ঠান্ডা লেগে যাবে। বাড়িতে ফিরে চলো।
ইনায়ার মুখখানা শুকনো। কিছুদিন ধরে ঠিকঠাক খাবার খায়না। সিয়াকে বোঝাতে চায়, বেশ স্বাভাবিক আছে ও। কিন্তু সিয়া জানে, শুনতে পায় প্রতিরাতে ইনায়ার ফুঁপিয়ে করা কান্নার শব্দ।
ইনায়া ম্লান হাসে। সিয়ার একহাত ধরে। হাঁটতে থাকে বাড়ির দিকে। ফ্রাঙ্কলিন বারান্দায় থাকা বেতের তৈরী আরাম কেদারায় বসে। সামনে একটি গোলাকৃতির ছোট টেবিলও আছে। ইনায়া তাকে এক ঝলক মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে সবিনয়ে বলে,,
– সুপ্রভাত দাদু।
– সুপ্রভাত। আজকে তোমাদের একাডেমিতে প্রতিযোগিতা আছে তাইনা?____উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন ফ্রাঙ্কলিন।
-জ্বি।
– ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোক। আমার বিশ্বাস তুমি জিতবে।
– আমেন।
সিয়া গোসলখানায় চলে যায়। ইনায়া মাদাম ল্যারিকে সাহায্য করতে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ফ্রাঙ্কলিন মুগ্ধ দৃষ্টিতে অনিমেষ তাকিয়ে দেখেন। দু’বোনের ভালবাসা দেখে তার চোখ জুড়িয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর গোসল শেষ করে কামরায় প্রবেশ করে সিয়া। কাঠের টুলে ক্রিস্তিয়ানকে বসে থাকতে দেখে সামান্য বিস্মিত হয়। শীর্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,
– কিছু বলবে?
ক্রিস্তিয়ানের মুখখানা কেমন ফ্যাকাশে দেখায়। ওর হাতে ছিলো ফিদেল আলেকজান্দ্রোর দিনলিপি। ক্রিস্তিয়ান জিহ্বা দিয়ে গলা ভেঁজায়। হাতের দিনলিপিটা সিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করে,,,
– তুমি কি এটা পড়বে?
সিয়া দিনলিপিটা হাতে নেয়। শান্ত গলায় বলে,,,
– হ্যাঁ। একাডেমি থেকে এসে।
ক্রিস্তিয়ানের ভয় হয়। ভীষণ ভয় পায় সে। না জানি এই দিনলিপিটা পড়ে সিয়ার মানসিক অবস্থা আরও কতটা খারাপ হতে পারে। ভেঙ্গে পড়বে? নাকি আরও শক্ত হয়ে উঠবে?
______
প্রাসকোভিয়া।
ঘুম থেকে জেগে উঠে মার্কসকে কোথাও খুঁজে পাননা ক্রিসক্রিংগল। রাতে শোয়ার আগে ছেলেটা তার পাশেই ছিলো। মধ্য রাত পর্যন্ত দুশ্চিন্তা শেষে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, ঠিক মনে নেই তার। মার্টিন নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। ফিরে যাবেন না তিনি। আজই ক্রিসক্রিংগলকে ইম্যুভিলে পৌঁছে দেওয়া হবে। তবুও ক্রিসক্রিংগল শেষবারের মতো চেষ্টা করে দেখতে চান। যদি মার্টিনের মন নরম হয়। সিদ্ধান্ত বদলে যায়।
ক্রিসক্রিংগল সুরঙ্গ ধরে হাঁটেন। হাঁটতে হাঁটতে কতগুলো সুরঙ্গ একসাথে দেখতে পান। এই জায়গাটা যেন ভুলভুলাইয়া। স্থির দাঁড়িয়ে থেকে তিনি ঠিক করেন, কোন সুরঙ্গ ধরে হাঁটবেন। আশে পাশে কেউ নেই। ক্রিসক্রিংগলের দম বন্ধ হয়ে আসে। মার্কস কোনো বিপদে পড়লো কিনা কে জানে। ছেলেটার প্রতি মায়া জন্মে গেছে। ওর কোনো ক্ষতি সহ্য করতে পারবেন না ক্রিসক্রিংগল।
ভাবতে ভাবতে একটা সুরঙ্গ ধরে হাঁটতে শুরু করেন। বেশকিছুক্ষন হাঁটার পর আরও একটি বিশালাকৃতির গুহায় প্রবেশ করেন। যার মাঝখানে একটা ছোটখাটো জলাশয় দেখতে পান। ক্রিসক্রিংগল দৃষ্টি সরিয়ে জলাশয়ের ডানদিকে তাকান। যেখানে একসাথে কতগুলো পুরুষ যুদ্ধবিদ্যার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো। সহসা একজন পুরুষকে দেখে ক্রিসক্রিংগল স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটস্বরে ডাকেন,,,
– মার্কস।