ফ্লোরেনসিয়া – ৪৯

24 Min Read

অসামান্য রাগের বশবর্তী হয়ে এদুয়ার্দোর বলশালী শক্ত প্রশস্ত বুকে দু’হাতে এলোপাথাড়ি কিল বসিয়ে দেয় সিয়া। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বারবার জিজ্ঞেস করে,,,,

– ইনায়া কোথায়? বলো এদুয়ার্দো। ইনায়া কোথায়?

এদুয়ার্দো নিশ্চুপ নির্বাক হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রয়। সিয়ার বিধ্বস্ত মুখখানার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সিয়া ক্রমশই আরও অস্থির হয়ে উঠে। পাশ থেকে অদৃশ্য মেয়েটা বলে,,,

– শান্ত হও ফ্লোরেনসিয়া। এই শেষবারের মতো তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি। সবসময়ই শান্ত থাকবে। বুদ্ধি খাটাবে। রেগে গেলে কোনো কিছুর সমাধান হবে না। এদুয়ার্দো জানে না ইনায়া কোথায় আছে। ওকে তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। প্রথমে ভাবো, এই বদ্ধ কামরা থেকে কিভাবে বাড়িতে ফিরে যাবে।

শান্ত হয়ে যায় সিয়া। এদুয়ার্দো থমথমে ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওকে,,,

– উন্মাদ হয়ে গেছ? কিসব বাজে বকছো?

– হ্যাঁ। এই বদ্ধ কামরা ধীরে ধীরে আমাকে উন্মাদ বানিয়ে দিচ্ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাইরে যেতে চাই। পৃথিবীর মুক্ত আলো বাতাসে প্রানখুলে নিঃশ্বাস নিতে চাই। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। পুনরায় না হয় এখানেই বন্দি করে রেখো।____সিয়ার কন্ঠে স্পষ্ট অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়।

এদুয়ার্দোর দু’চোখে বিস্ময়। এ কোন সিয়াকে দেখছে সে? কখনো শান্ত, কখনো নিষ্প্রাণ পাথরের মতো, কখনো বা তেজস্বী রাগান্বিত মুখশ্রীর পেছনে ভয়াল হিংস্রতা ছিলো। কিন্তু আজ এই প্রথম সিয়াকে এদুয়ার্দোর কাছে অত্যন্ত অসহায় মনে হয়। ওর নির্জীব মুখশ্রীর অনিন্দ্য সুন্দর গাল দু’টো ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। অনুভূতিটা অদ্ভুত। এই অনুভূতির সাথে এদুয়ার্দো পূর্ব পরিচিত নয়। নিজের অজান্তেই সিয়ার দু’গালে দু’হাত রাখে সে। তার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠে। অস্বাভাবিকভাবে হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়ে। বক্ষস্থলে অতি আশ্চর্যজনক প্রশান্তি অনুভব করে। দু’হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির দ্বারা আলতো স্পর্শে পরপর দু’বার সিয়ার গাল ঘষে সে। যেন ময়লা লেগে আছে।

– এদুয়ার্দো।___সিয়া কোমল কন্ঠে ডাকে।

এদুয়ার্দো সম্বিত ফিরে পায়। যেন কোনো অপরূপ অপ্রাকৃত সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলো সে। সিয়াকে আদি-অন্ত কোমলমতি মনে হয়। সিয়ার এই রুপ ভয়ংকর সুন্দর। এদুয়ার্দো চোখ সরিয়ে নেয়। লাল টুকটুকে ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,,

– বাইরে যেতে চাও?

সিয়া উপর নিচ মাথায় ঝাঁকায়। এদুয়ার্দো প্যান্টের পকেট থেকে এক টুকরো কালো কাপড় বের করে আনে। সে সিয়ার পেছনে গিয়ে দাড়ায়। ওর ডান কাঁধের কাছে মু্খ রেখে অনুচ্চস্বরে বলে,,,

– চোখ বন্ধ করো।

সিয়া দু’চোখের পল্লব বুজে নেয়। এদুয়ার্দো আলগোছে ওর আঁখি যুগল বেঁধে দেয়। কিন্তু তার মন কেমন করে উঠে। কিছু একটা হারিয়ে ফেলার ভয়। যেন খুব কাছের কেউ দুরে সরে যাবে। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ধীর হয়ে আসে। বুকের ভেতর অজানা আতংকের উদ্বেলিত দামামা বাজে। বেশ অস্বস্তি বোধ করে। কয়েকপল সময় গড়ায়। সিয়া উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,

– আমার চোখ বেঁধে দিলে কেনো? কামরার বাইরে নিয়ে যাবে?

এদুয়ার্দো নিজের দু’হাত সিয়ার দু’কাধে রাখে। রাশভারী কন্ঠে বলে,,,

– হুম। বাইরে নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে। আই হোপ তুমি কোনো ভুল করবে না।

কাঁধ ছেড়ে দিয়ে সিয়ার ডান হাতটা নিজের শক্তহাতে মুঠোবন্দি করে ধরে। দ্রুতপায়ে হেঁটে যায় দরজার দিকে। ভেতর থেকে হাত দিয়ে দরজায় করাঘাত করে এদুয়ার্দো। বাইরে থেকে দ্বাররক্ষীরা দরজা খুলে দেয়। সিয়াকে সাথে নিয়ে করিডোর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। পুনরায় দরজায় করাঘাত করে সে। সিয়া উৎকর্ন কানে শোনে। ক্ষণকাল সময় গড়ায়। একে একে চারটে দরজা পেরিয়ে যায় ওরা। সিয়া খালি পায়ে ছিলো। খেয়াল করেনি এদুয়ার্দো। তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে বেগ পেতে হয় সিয়ার। শরীর দুর্বল। একরাত দু’দিন ধরে অভুক্ত ও। ইনায়ার দুশ্চিন্তায় বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো।

কিঞ্চিত মাথা ঘোরায়। অবশ হয়ে আসা শরীরে দ্রুতপায়ে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় সিয়া। ওকে বাম হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে এদুয়ার্দো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কপট রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে,,,

– চোখে দেখতে পাও না।…..।

কথাটুকু শেষ করার আগেই সিয়ার মুখখানার দিকে তাকায়। আরক্তিম ঠোঁট জোড়া কুঁচকে গেছে। এদুয়ার্দোর দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে আসে। সিয়া বেশ ব্যথা পেয়েছে পায়ে। অস্পষ্ট স্বরে বলে,,,

– চোখ বাঁধা থাকলে দেখবো কি করে?

– হাঁটতে পারবে? জুতো পড়োনি কেনো?___এদুয়ার্দো অকপটে জিজ্ঞেস করে।

– আপনি সুযোগ দিয়েছিলেন? হাঁটতে পারবো। সমস্যা নেই।

সিয়ার শান্ত কন্ঠস্বর, সম্মান দিয়ে কথা বলা। এদুয়ার্দোর কাছে সবটাই কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়। সিয়ার মাথায় কিছু একটা চলছে। কিন্তু সেটা কি?

– ও কি পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে?____এদুয়ার্দো মনে মনে ভাবে।

নিজের ভাবনার ইতি টেনে এদুয়ার্দো পুনরায় হাঁটতে শুরু করে। আগের তুলনায় এখন আরও বেশি কষ্ট হয় সিয়ার। হাঁটতে পারছে না ও। খোড়াচ্ছিলো। হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়ে এদুয়ার্দো। শক্ত পেশিবহুল দু’হাতে সিয়াকে কোলে তুলে নেয়। ভড়কে যায় সিয়া। দু’হাতে এদুয়ার্দোর গলা জড়িয়ে ধরে। একেতো চোখ দু’টো কালো কাপড়ে বাঁধা ছিলো। তন্মধ্যে এদুয়ার্দো কোলে তুলে নেওয়ায় সিয়ার হৃদয় কোণে বিন্দু বিন্দু ভয় সঞ্চিত হয়। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেয় ও। ওর ভয়ার্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে এদুয়ার্দো কপাল কুঁচকায়। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ফ্রক পড়ায় সিয়া ওর চুলগুলো ঘাড়ের উপর পরিপাটি করে খোঁপা বেঁধে রেখেছিলো। খুলে গেলেই ঝামেলা। অস্বাভাবিক বড় খোঁপা। চুলের ভারে ওর মাথাটা যেন নিচের দিকে নুয়ে পড়ছিলো।

এদুয়ার্দো বাতাসের বেগে আরও একটি দরজার সামনে গিয়ে দাড়ায়। দরজা খুলে যায়। সিয়া গুনেছিলো। মোট আটটা দরজা পেরিয়ে এদুয়ার্দো ওকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। সিয়া উৎকর্ণ কানে শোনে। মনে মনে ভাবে,,

-আমি নিচ তলায় ছিলাম? আমাকে যে কামরায় রাখা হয়েছিলো, সেখানে পৌঁছাতে আটটা দরজার সম্মুখীন হতে হয়? আমার পক্ষে নিজে থেকে বাইরে বেরিয়ে আসা অসম্ভব ছিলো।

অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে স্প্রিংয়ের মতো গোলকার সিঁড়ি বেয়ে এদুয়ার্দো বেসমেন্ট থেকে উপরে উঠে আসে। ছুটে যায় ফ্রন্ট ডোরের দিকে। তারপর সবুজ ঘাসে ঘেরা খোলা মাঠে। ভিতরে ঠান্ডা আবহাওয়া ছিলো। কিন্তু বাইরে বের হতেই হিম শীতল বাতাসে সিয়ার মন জুড়িয়ে যায়। মনে হয় অনেকগুলো বছর পর প্রকৃতির স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়া ওকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ও বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নেয়।

এদুয়ার্দো সিয়াকে বুকের কাছে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। সিয়া তার বেসামাল হৃদস্পনের শব্দ শুনতে পায়। এদুয়ার্দোর পিঠের দু’পাশ থেকে কুচকুচে কালো রঙের বিশালাকৃতির দু’টো ডানা বেরিয়ে আসে। সিয়া উৎকর্ণ কানে ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ শুনতে পায়। কিছু দেখতে না পাওয়ায় ওর একটাই কাজ। সবকিছুর শব্দ শোনা। অদুরে ঝর্নার পানি প্রবাহের কলকল শব্দ ভেসে আসে। এদুয়ার্দো আচমকাই ধীরে ধীরে উড়তে শুরু করে। ভূমি থেকে উপরের দিকে। অতঃপর সিয়াকে নিয়ে সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারের ছাদে গিয়ে পৌঁছায়। যেখানে জোসেফাইনের পাশে অ্যাভোগ্রেডো দাঁড়িয়ে আছে।

জোসেফাইন ভয়ার্ত চেহারায় স্তব্ধ দৃষ্টিতে অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। এদুয়ার্দো সিয়াকে আলগোছে নামিয়ে দেয়। গম্ভীর গলায় বলে,,,

– স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

সিয়া সুবোধ বালিকার ন্যায় উপর নিচ মাথা ঝাঁকায়। এদুয়ার্দো ওর দু’চোখের বাঁধন খুলে দেয়। সিয়া চোখ পিটপিট করে তাকায়। দৃষ্টির সম্মুখে জোসেফাইনকে দেখে ওর ভীষণ রাগ হয়। কিন্তু নিজেকে সংযত করে নেয়। পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজে ও।

কোমর পর্যন্ত লম্বা রেলিঙে ঘেরা বিস্তৃত ছাদ। এই ছাদের উপর অনায়াসেই কতগুলো থ্যাসোর জায়গা হয়ে যাবে। সিয়া চিন্তা করে। থ্যাসোকে ডেকে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। শুধুমাত্র একটা সুযোগ, তারপরই এদুয়ার্দো নামক শ’য়তানটার থেকে মুক্তি পাবে ও। চারদিকে নজর বুলিয়ে যা বুঝতে পারে, এটা সুউচ্চ পাঁচ টাওয়ার বিশিষ্ট কোনো এক প্রাচীন দুর্গ। কিন্তু এখনো বেশ রাজকীয় সৌন্দর্য বহন করছে। যতদুর চোখ যায় চারদিকে শুধু প্রগাঢ় অন্ধকার। শুধুমাত্র টাওয়ারের ছাদগুলোতে রঙ বেরঙের অসংখ্য বাতিদান জ্বলছিলো।

– জনাব জোসেফাইন। ও ফ্লোরেনসিয়া। ওকে চিনতে পারছেন?____সিয়াকে দেখিয়ে এদুয়ার্দো থমথমে ভরাট কন্ঠে বলে।

জোসেফাইন শুকনো একটা ঢোক গিলে নেয়। সিয়ার হাঁটুর নিচ থেকে ধবধবে ফর্সা পা দু’টো দেখা যাচ্ছিলো। অ্যাভোগ্রেডো না চাইতেও একনজর তাকিয়ে ত্বরিত চোখ সরিয়ে নেয়। মেঝের দিকে দৃষ্টি স্থির রাখে সে। এদুয়ার্দো বুঝতে পেরে সিয়াকে আড়াল করে ওর সামনে গিয়ে দাড়ায়। রক্ত হিম করে দেওয়া ক্রুদ্ধ কন্ঠে ডাকে,,,,

– জোসেফাইন।

জোসেফাইনের কলিজা শুকিয়ে যায়। অবিরত বুক কাঁপতে শুরু করে। ভীত ভীত কন্ঠস্বরে বলে,,,,

– না। আমি আগে কখনো এই মেয়েটাকে দেখিনি।

– এই মেয়েটা নয়। ওর নাম ফ্লোরেনসিয়া। আপনি মিস সিয়া বলে সম্বোধন করতে পারেন।____এদুয়ার্দো শান্ত গলায় বলে।

– জ্বি। মিস সিয়া।

– হ্যাঁ। ওর অভিযোগ ছিলো, আজ থেকে ঠিক দু’দিন আগে রাতের অন্ধকারে ওকে মে’রে ফেলার জন্য কাস্ত্রোরুজ থর্পে আমি আপনাকেসহ আমার আরও কিছু ভ্যাম্পায়ার সেনা পাঠিয়েছিলাম। আপনি কিছু বাদুড়কে দিয়ে ওকে ক্ষতবিক্ষত করেছিলেন। ওর ধারণা ওকে তুলে আনার জন্য আমি আপনাকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আপনি যদি ফ্লোরেনসিয়াকে না-ই চিনে থাকেন, তাহলে ও আপনার নাম কিভাবে জানলো?

– মিস সিয়া মিথ্যা বলছে। তার মা আর দাদিনের মৃত্যুর পরের দিন ক্রিসক্রিংগল সবাইকে নিয়ে কাস্ত্রোরুজ ছেড়ে কোথাও পালিয়ে গিয়েছিলো। আজ পর্যন্ত সেই গ্রামে কুরী বা ডিয়েটস পরিবারের কাউকে দেখা যায়নি। তাহলে আমার সাথে মিস সিয়ার কিভাবে দেখা হতে পারে?

সিয়া সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বুড়োটা মিথ্যা বলছে কেনো? এদুয়ার্দো আর এই জোসেফাইন বুড়ো। দু’জনে মিলে এই নাটক করছে কোন উদ্দেশ্যে? কিছুই বুঝতে পারে না ও। এরইমাঝে এদুয়ার্দো জিজ্ঞেস করে,,,,

– এতোটা নিশ্চিত হয়ে কিভাবে বলছেন? ওরা সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, আপনি কি কাস্ত্রোরুজ থর্পে অব্যহত নজরদারি চালিয়ে গেছেন?

জোসেফাইন থতমত খায়। কোনো প্রত্যুত্তর দিতে পারে না সে। আমতা আমতা করে। এদুয়ার্দোর সন্দেহ গাঢ় হয়। কোনো না কোনো ভাবে জোসেফাইনও কি তার মায়ের সাথে এইসব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত? শক্তপোক্ত প্রমাণ ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।

সম্পূর্ণ ছাদ জুড়ে হঠাৎ পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। সিয়া দুর্দান্ত সুযোগ খুঁজে পায়। উচ্চস্বরে ডাকে,,,

– থ্যাসো।

এদুয়ার্দো ওর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পেছনে ফিরে তাকায়। জোসেফাইন যেন বুকের গভীরে মৃ’ত্যুর হিমেল স্পর্শ অনুভব করে। কয়েক সেকেন্ড সময় গড়ায়। চারদিকের ভয়াবহ অন্ধকার বিদীর্ণ করে একটা শ্বেত রঙা ঘোড়া ছুটে আসে। ঘোড়াটার শরীর থেকে অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ে। সম্পূর্ন ওয়াভেল কোটে যেন নিমেষেই ভোর নেমে আসে। এতটাই তীব্র সাদা আলো ছড়ায় ঘোড়াটার দেহ থেকে। এদুয়ার্দো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে। ঘোড়া নয়, ইউনিকর্ন। তাহলে সেদিন অ্যাভোগ্রেডো ঠিক বলেছিলো। সিয়া পুনরায় ডাকে,,,

– থ্যাসো।

থ্যাসো ছাদের মেঝেতে নেমে দাড়ায়। ওর শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়া সাদা রঙের আলোয় জোসেফাইন আর অ্যাভোগ্রেডোর অস্বস্তি হয়। দেহের চামড়া পুড়ে যাওয়ার মতো জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করে। অথচ এদুয়ার্দো! তার কোনো অস্বস্তি হয়না। অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। সে বিস্ময়াভিভূত, নিশ্চুপ নির্বাক। সিয়া দৌড়ে যায়। থ্যাসোর পিঠে চেপে বসে। উচ্চস্বরে বলে,,,

– এদুয়ার্দো। ওর নাম থ্যাসো। আমার ইউনিকর্ন। বলতে পারো স্বর্গীয় ঘোড়া। সেদিন রাতে থ্যাসোই আমাকে কাস্ত্রোরুজ থর্পে পৌঁছে দিয়েছিলো। আমি আমার মা-দাদিনের সমাধি দেখতে গিয়েছিলাম। তখন এই জোসেফাইনসহ আরও কিছু র’ক্তপিপাসু আমাকে আক্রমণ করেছিলো। অসংখ্য বাদুড় দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছিলো। আমাকে ওদের থেকে রক্ষা করে ইম্যুভিলে পুনরায় ফ্রাঙ্কলিন দাদুর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলো থ্যাসো। আমার শরীরে বাদুড়গুলোর আঁচড় কামড়ের দাগ নেই কেনো জানো? কারন থ্যাসোর শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়া এক ধরনের অপার্থিব আলো আমার দেহের সমস্ত দাগ মিলিয়ে দিয়েছিলো।

এদুয়ার্দোর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সিয়া থ্যাসোর দিকে তাকায়। ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলে,,,

– আমাকে ইম্যুভিলে নিয়ে চলো। যতদ্রুত সম্ভব ফ্রাঙ্কলিন দাদুর বাড়িতে পৌঁছে দাও।

থ্যাসো দু’ডানা মেলে ছাদ থেকে উঁচুতে উঠে শূন্যে ভেসে রয়। যেন ও বুঝতে পারে ওর মালকিনের কথা এখানেই শেষ নয়। সিয়া শক্ত হাতে থ্যাসোর লাগাম টেনে ধরে। এদুয়ার্দোকে উদ্দেশ্য করে দৃঢ় গলায় বলে,,,

– আমি বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি। যদি পারো, আঁটকে দেখাও। সম্পূর্ন সুস্থ মস্তিষ্কে বলছি, তোমার ভাই ইনায়াকে তুলে নিয়ে গেছে। অথচ তুমি কিছু জানো না, আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করিনা।

এদুয়ার্দোর গাম্ভীর্য মুখে সিয়ার কথাগুলো শুনে। ওকে আঁটাকানোর চেষ্টা করে না সে। সিয়ার কথা শেষ হতেই থ্যাসো আলোর গতিতে ছুটে যায় ইম্যুভিলের দিকে। এদুয়ার্দো নিষ্পলক চোখে দেখে। বক্ষস্থলে অথৈয় অতল শূন্যতা অনুভব করে। তার মনে হয়, সবচেয়ে কাছের কেউ তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি।

সিয়া দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যাওয়ার পর এদুয়ার্দো হতভম্ব অ্যাভোগ্রেডোর দিকে তাকায়। হিংস্রাত্মক শীতল কন্ঠে বলে,,,,

– কোথায় ছিলে? নজর রাখোনি কেনো? ফ্রাঙ্কলিনের পরিবারের সবার দায়িত্ব তোমার উপর ন্যস্ত ছিলো।

– সবাই দুর্গে বন্দি। তাই খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তাছাড়া আমি ভাবতেও পারিনি, এই পরিস্থিতিতে ওরা একাডেমিতে যেতে পারে।___অ্যাভোগ্রেডো অপরাধী কন্ঠে বলে।

– নিয়ে যাও জনাব জোসেফাইনকে। যেন পালিয়ে যেতে না পারে। আমি ফিরে আসা পর্যন্ত ভালোভাবে আপ্যায়ন করবে।

জোসেফাইন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায়। অ্যাভোগ্রেডো শ্রদ্ধাভরে সম্মান জানিয়ে দৃঢ় গলায় বলে,,,

– জ্বি অনারেবল ওভারলর্ড।

এদুয়ার্দো বাতাসের বেগে ছুটে যায়। ধীরে ধীরে গতি বাড়ায়। একসময় আলোর গতিতে ছুটতে থাকে সে। সিয়া যেদিকে গেছে। ক্ষণকাল সময় গড়ায়। থ্যাসে ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ির সীমানা পেরিয়ে জলাশয়ের পাশে গিয়ে দাড়ায়। এদুয়ার্দো দুর থেকে দেখে। অতঃপর কিয়েভের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে সে।

_______

ইম্যুভিল, ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ি।

কামরাজুড়ে বিস্ময়কর নীরবতা বিরাজ করছিলো। আর্নি আর ক্রিস্তিয়ানের শরীরে বাদুড়গুলোর দাঁত আর নখের দ্বারা হওয়া অসংখ্য ক্ষতের চিহ্ন। বিছানায় জবুথবু হয়ে বসে আছে আর্নি। চোখের অশ্রুকনা শুকিয়ে গেছে ওর। ক্রিস্তিয়ান প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় ছটফট করছিলো। তন্মধ্যে হঠাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। অজ্ঞাতেই কেঁপে ওঠেন কামরায় উপস্থিত থাকা সবাই। দরজা খুলে দিতে ভয় হয়। এ বাড়িতে কে আসতে পারে এই অসময়? সহসা বিধ্বস্ত কন্ঠে উচ্চস্বরে ডেকে উঠে কেউ,,,

– দরজা খোলো। আমি ফ্লোরেনসিয়া।

অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে তারা। সিয়া পুনরায় ব্যতিব্যস্ত কন্ঠস্বরে ডাকে,,,

– দরজা খুলে দাও। আমি ফিরে এসেছি।

উদ্বিগ্ন চিত্তে দরজার দিকে এগিয়ে যায় ক্রিস্তিয়ান। স্ট্রিকল্যান্ড কুরী সাবধান করে বলেন,,,,

– দরজা খুলবে না ক্রিস্তিয়ান। হতে পারে এটা ঐ শ’য়তানদের কোনো চাল।

ক্রিস্তিয়ানের মন মানে না। স্ট্রিকল্যান্ডের বারণ শোনে না। দ্রুত হাতে দরজা খুলে দেয়। হুড়মুড়িয়ে কামরায় প্রবেশ করে সিয়া। ব্যাকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,

– ইনায়া কোথায়?

– তুমি কি সত্যিই সিয়া?____মাদাম ল্যারি অকপটে জিজ্ঞেস করেন।

– ইনায়া? ইনায়াকে কি সত্যিই নিয়ে গেছে আব্রাহাম?

– তুমি কিভাবে জানো?____কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন ফ্রাঙ্কলিন পিয়ারসন।

– আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।___সিয়া অধৈর্য কন্ঠে বলে।

আর্নি হতবাক চোখে দেখে। প্রত্যেকের চোখে বিস্ময়। সবটাই কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়। ক্রিস্তিয়ান যেন দেহে প্রাণ ফিরে পায়। তার বিশ্বাস হয়। হ্যাঁ, এইতো তার সিয়া। কিন্তু কিভাবে ফিরে এলো ও?

– হ্যাঁ। ইনায়াকে নিজের সাথে করে নিয়ে গেছে আব্রাহাম।___ক্রিস্তিয়ান বিষন্ন বদনে ম্লান কন্ঠে বলে।

এতটুকুই নিশ্চিত হতে চেয়েছিলো সিয়া। কাউকে কিছু না বলে উদ্ভ্রান্তের মতো হেঁটে দরজা খুলে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়। ওর পেছন পেছন ছুটে যায় ক্রিস্তিয়ান। উচ্চস্বরে ডাকে,,

– সিয়া শোনো। কোথায় যাচ্ছো?

– ইনায়াকে খুঁজতে।

– এই মাঝরাতে কোথায় খুঁজবে ওকে?

– সব জায়গায়। সবখানে। আমি ওকে খুঁজে বের করবো।

ক্রিস্তিয়ানের পেছন পেছন বাকিরাও কামরার বাইরে বেরিয়ে আসে। পরনে শীতবস্ত্র নেই সিয়ার। সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই ওর। পশ্চাদ্ভাগের উঠোন পেরুতেই হঠাৎ তিনজন মানুষের অবয়ব দেখতে পায়। সিয়া সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায়। একটা অতি পরিচিত মুখ। খুব কাছের, ভীষণ প্রিয় আর সবচেয়ে আপন জন। সিয়ার বিশ্বাস হয় না। প্রাণপ্রিয় মানুষটার পাশে আরো অপরিচিত দু’জন। সিয়া নিজের চোখ দু’টোকেও যেন বিশ্বাস করতে পারে না। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। ক্রিসক্রিংগল উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ডাকে,,,,

– সিয়া। মা আমার।

সিয়া সম্বিত ফিরে পায়। এক ছুটে গিয়ে ক্রিসক্রিংগলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খোঁপা খুলে চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে পড়ে। হাঁটু ছাড়িয়ে আরও অনেকটা নিচে নেমে যায়। সেদিকে খেয়াল নেই সিয়ার। ও অস্পষ্ট স্বরে ডাকে,,,,

– বাবা।

মার্টিনের দৃষ্টি আঁটকে রয়। তার চিত্ত পুলকিত হয়। দু’চোখে আনন্দাশ্রু চিকচিক করে। একদম আরিনা ফোসিয়ার মতো দেখতে। সেই চোখ, চুল আর মুখের আদল। তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। ক্লারেসিয়া। প্রিন্সেস ক্লারেসিয়া স্যাভেরিন। মেয়েকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। মুহূর্তেই পিতৃত্ব বোধের অধিকার থেকে সিয়াকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে,,,

– আমি তোমার বাবা। তুমি আমার মেয়ে।

– বাবা। আপনি ফিরে এসেছেন? এতো দেরি করে কেনো ফিরলেন? ওরা, ওরা ইনায়াকে নিয়ে গেছে বাবা। আমি পারিনি ওর পাশে থাকতে। ওকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি বাবা।___সিয়া অসহায় কন্ঠে বলে।

মার্টিন নিজের মনকে যথেষ্ট দৃঢ় রাখেন। ভয়াবহ থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থেকে সিয়ার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করেন। মার্কস অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সিয়ার উদ্বিগ্নতা দেখে। মেয়েটাকে দেখে সে যেন দু’চোখের পল্লব নাড়াতে ভুলে গিয়েছিলো। কিন্তু ওর উদ্বিগ্নতায় মার্কসের হুশ ফিরে আসে।

– কি বলছো? কা’রা নিয়ে গেছে ওকে?__ শঙ্কিত কন্ঠে সিয়াকে জিজ্ঞেস করেন ক্রিসক্রিংগল।

– ঐ র’ক্তপিপাসুগুলো।

সিয়ার বলা কথাটা শুনে ক্রিসক্রিংগলের মুখখানা মাত্রারিক্ত ফ্যাকাশে হয়ে যায়। যেন তার সমগ্র দুনিয়া দুলে উঠে। হিমেল আতংকে কাঁপতে শুরু করে তার সমস্ত শরীর। বুকের অভ্যন্তরে থাকা হৃদপিণ্ডটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। মেয়ে হারানোর ভয় তাকে ক্রমশ অস্থির করে তুলে। দম বন্ধ হয়ে আসে। বাড়ির বাকিরা এসে তাদের কাছাকাছি দাড়ায়। ফ্রাঙ্কলিনের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। তিনি অস্পষ্ট স্বরে ডাকেন,,,,

– মার্টিন লরেন্স।

_________

কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।

অদুরে বাজানো গির্জার ঘন্টাধ্বনি শোনা যায়। আধো ঘুম আধো জাগরনে কামরায় বন্দি থাকা রমনী চোখ মেলে তাকায়। এক ছুটে দরজার সামনে গিয়ে দাড়ায়। করাঘাত করে ডাকে,,,

– দয়া করে দরজা খুলো। আমাকে মুক্ত করে দাও। আমার পাওলোর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দয়া করো। মুক্ত করে দাও।

সারারাত এভাবেই চিৎকার চেঁচামেচি করে ভোর বেলার দিকে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙ্গতেই পুনরায় আর্তনাদ করতে শুরু করেন। করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিদর্কা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসেন। আব্রাহামের দরজার সামনে গিয়ে দাড়ান। দ্বাররক্ষীরা মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানায় তাকে। সশব্দে দরজা খুলে দেয়। পিদর্কা কামরায় প্রবেশ করেন। পেছনে আরও দু’জন লোক। তারা কফিনের তালা খুলে পাটা তুলে দেয়। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পায় আব্রাহাম। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে। চোখের সামনে পিদর্কাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে যায়। কাতর কন্ঠে ডাকে,,,,

– মা। আপনি এসেছেন?

– আব্রাহাম, আমার বাবা। তুমি সুস্থ হয়ে গেছ?

– হ্যাঁ। কিন্তু আমাকে কফিনে বন্দি করে রাখা হয়েছিলো কেনো?

– এদুয়ার্দোর নির্দেশ ছিলো। তুমি ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে গিয়ে ভুল করেছিলে। তারই শাস্তি ভোগ করছো।

– আমিতো কোনো অপরাধ করিনি।

সহসা আব্রাহামকে বুকে জড়িয়ে নেন পিদর্কা স্যাভেরিন। অশ্রুসিক্ত চোখে বেদনার্ত কন্ঠে বলেন,,,

– আমি জানি। তুমি কোনো অপরাধ করোনি। কিন্তু এদুয়ার্দো তোমাকে ভুল বুঝেছিলো। আমি তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। তুমি দুভিল কোটে ফিরে যাও।

– ওভারর্লডের দেওয়া শাস্তি শেষ? তিনি কি অনুমতি দিয়েছেন দুভিল কোটে ফিরে যাওয়ার?__কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে আব্রাহাম।

– না। সে তোমার শাস্তি মওকুফ করেনি। কিন্তু আমিতো মা। তোমার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি ফিরে যাও বাবা।

আব্রাহামের মন অস্থির হয়ে উঠে। দুভিল কোটে ফিরে যাওয়ার জন্য নয়, ইনায়াকে দেখার জন্য। সে লাল টুকটুকে ঠোঁটে হাসে। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। তার একহাত ধরে কামরার বাইরে বেরিয়ে আসেন পিদর্কা স্যাভেরিন। করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আব্রাহাম একটা কামরার দরজার কাছে সেই রমনীর কন্ঠস্বর শুনতে পায়। অকপটে জিজ্ঞেস করে,,,

– এখানে কাকে বন্দি করে রেখেছেন? সারাক্ষণ শুধু পাওলো পাওলো বলে চিৎকার করতে থাকে। আমার খুব কষ্ট হতো তার চিৎকার শুনতে পেয়ে।

– আমার বান্ধবী। মানসিক ভারসাম্যহীন। ওর কেউ নেই। তাই নিজের কাছে রেখেছি। পাওলো ওর ছেলের নাম। ছেলে মৃ’ত্যুর শোকে পাগল হয়ে গেছে ও।

– আপনার বান্ধবীও ছিলো?____চাঞ্চল্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করে আব্রাহাম।

– হুম। তাড়াতাড়ি চলো।

করিডোরের কতগুলো বাঁক ঘুরে একটা কামরার সামনে এসে দাড়ায় দু’জনে। আব্রাহাম অন্যমনস্ক ছিলো। চারপাশের কোনো কিছুই খেয়াল করেনি সে। তার মন মস্তিষ্ক জুড়ে ইনায়া বিচরণ করে। এইতো আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তারপর আবারও ইনায়াকে দেখতে পাবে।

– এখানেই একটা কামরায় সুরঙ্গ পথ আছে। আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি। তুমি চলে যাও সেখান দিয়ে।

– হুম। ____ভাবলেশহীন কন্ঠে প্রত্যুত্তর দেয় আব্রাহাম।

কামরায় প্রবেশ করে সুড়ঙ্গের কাছে এসে দাড়ায় পিদর্কা স্যাভেরিন। ঠিক তখনই দরজা খুলে কামরায় প্রবেশ করে উড্রো উইলসন। নত মস্তকে সম্মান জানিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বলে,,,

– অনারেবল এমপ্রেস। আপনাকে একটা জরুরি সংবাদ জানানোর ছিলো।

– এখানেই কেনো? চলো কামরায় গিয়ে বসি।

– বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

– আচ্ছা। বলো।

– কিছুক্ষণ আগে একজন ভ্যাম্পায়ার সেনা সংবাদ নিয়ে আসে। মহামান্য মহারাজ ক্রিসক্রিংগলের বড় মেয়ে ইনায়াকে তুলে নিয়ে গেছেন।

– কি বলো? কোথায় নিয়ে গেছে মেয়েটাকে?

– প্রাসকোভিয়া জঙ্গলে। দক্ষিণের দিকে।

– কিন্তু কেনো?

– দুঃখিত। কেনো নিয়ে গেছেন। আমি জানিনা।

– অসম্ভব। হয়তো আপনি ভুল শুনেছেন। ওভারলর্ড এরকম কেনো করবেন? বরং তিনি ওদের সবাইকে সুরক্ষা দিতে ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে নিজের সেনা নিযুক্ত করেছিলেন। _____আব্রাহাম দৃঢ় কন্ঠে বলে।

– ঘটনা সত্যি । ___উইলসন আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলে।

পিদর্কা একবার উইলসনের দিকে তাকান, তো একবার আব্রাহামের দিকে। অতঃপর দৃঢ় গলায় বলেন,,

– নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। অহেতুক কিছু করেনা আমার এদুয়ার্দো।

আব্রাহাম আর এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারে না। প্রথমে ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিবে। তারপর ইনায়াকে খুঁজতে যাবে সে। চোখের পলকে ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে সুরঙ্গের ভিতরে প্রবেশ করে। পিদর্কা স্যাভেরিন উচ্চস্বরে ডাকেন,,,

– আব্রাহাম, যেও না। দাড়াও। আমার কথা শোনো।

আব্রাহাম দাড়ায় না। সে চলে যেতেই পিদর্কা রহস্যময় হাসেন। দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করেন। পেছনে উড্রো উইলসন। বেসমেন্ট থেকে বেরিয়ে হলরুমে আসতেই এদুয়ার্দোর মুখোমুখি হন। অকস্মাৎ এদুয়ার্দোকে দেখে খানিকটা ভড়কে যান। মৃদু কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,

– এদুয়ার্দো? এই ভোরবেলায় তুমি এখানে?

– আপনার ছোট ছেলে কোথায় মা?

– ক্যাসলেই। হয়তো নিজের কামরায় আছে।

এদুয়ার্দো দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করে না। আব্রাহামের কামরার দিকে যায়। সে চলে যাওয়ার পর পিদর্কা স্যাভেরিন ঠোঁট ছড়িয়ে হাসেন। মনে মনে ভাবেন,,,

– একটা সাধারন মেয়ের মৃ’ত্যুতে ওরা একে অপরের চরম শত্রু হয়ে উঠবে।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।