ইট পাটকেল | পর্ব – ৩২

8 Min Read

নূরের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই নূর অস্থির হয়ে আছে বাচ্চাদের জন্য। আশমিন বুঝিয়ে ও রাখতে পারছে না। অপারেশনের পর নূরের বেশি নড়াচড়া করা নিষেধ। সে মেয়ে এখন চিংড়ি মাছের মতো তিরিং বিরিং করছে।প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো আশমিনের।জোড়ে ধমক দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। মুখে হালকা হাসি টেনে দাতে দাত চেপে বললো,
— চুপচাপ শুয়ে থাকো বউ।আমার মেজাজ খারাপ হলে খুব খারাপ হবে।মেয়েদের জন্য এতো উতলা হয়ো না।বছর বছর এই অনুভূতি পাওয়ার সুযোগ পাবে তো তুমি।তোমার বরের মন অনেক বড়। সে তোমাকে টুইনস বেবির মা বানাবে।এবার চুপ করে ঘুমাও সোনা।একটু সুস্থ হলে পরিদের কাছে নিয়ে যাবো। এখন আমাকে একটা চুমু খাও।আমি চুমু শূন্যতায় ভুগছি।
নূর ব্যথা অস্থিরতা বাদ দিয়ে আশমিনের দিকে কটমট করে তাকালো। কোমরের নিচের অংশ এখনো অবস হয়ে আছে। সুস্থ হলে সবার আগে এই লোক কে পিটিয়ে হাতের সুখ করে নিবে।অসহ্য মানুষ একটা।
নূরের খেয়ে ফেলা লুক দেখে আশমিন এদিক ওদিক তাকিতুকি করলো।গলা ঝেড়ে দুঃখী গলায় বলল,
— এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমি কতো টেনশনে ছিলাম জানো? এই বারান্দায় কতো বার চক্কর লাগিয়েছি ধারণা আছে? তোমার জন্য আমার ব্যক্তিগত বুকে পোষা মীরজাফর কলিজা লাফিয়ে বাইরে চলে আসছিল প্রায়!কতো কষ্টে চেপে চুপে আটকে রেখেছি হিসেব আছে! আর এখন তুমি আমাকে চোখ দেখাচ্ছো! মানবতা আজ কোথায়? আজকেই মানবাধিকার কমিশনে একটা লিখিত অভিযোগ জানাতে হবে। আমি গাল এগিয়ে দিচ্ছি চুপচাপ চুমু খাও।নাহলে আমি জোর করে ও নিতে পারি।
নূর চোখ বুজে রইলো। কথা বলার ইচ্ছা আগ্রহ কোনটাই নেই।এই লোকের রেললাইনের মতো মুখ লাগাম ছাড়া চলতেই থাকে।
নূর কে চোখ বন্ধ করতে দেখে বিজয়ের হাসি হাসলো আশমিন। যাক, আপাতত শান্ত করা গেছে।এটা কে বলে প্রতিভা। বউ কে চুপ করানো তার কাছ থেকে শিখা উচিত। সময় থাকলে একটা কোচিং সেন্টার খোলা যেতো। আহা!কতো অসহায় স্বামীদের উপকার হতো। এটা ও একপ্রকার জনসেবা।
সানভি আশমিন কে ম্যাসেজ করলো বাইরে আসার জন্য। আশমিন আজ দুই দিন কিছুই মুখে দেয়নি।তার উপর তার বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট দিয়েছে।কিন্তু আশমিন নূরের কেবিনে ঘাপটি মেরে বসে আছে। অমি কাল সারাক্ষণ এখানে ছিল।সকালে লুবানা কে নিয়ে বাসায় গিয়েছে। একেবারে অফিস করে বিকেলে আসবে।আগামী কয়েকদিনের দলীয় সমস্ত মিটিং ক্যানসেল করেছে আশমিন।অফিস আমজাদ চৌধুরী সামলে নিবেন।
সানভির মেসেজ পেয়ে বেরিয়ে এলো আশমিন। চোখে মুখে ক্লান্তি চেপে ধরেছে।সানভি নিজেও ক্লান্ত।
— আপনার পোশাক নিয়ে এসেছি স্যার।ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিন। খাবার রেডি আছে।একবার টেস্ট করিয়ে নিতে হবে।আর না করবেন না স্যার প্লিজ।
সানভির করুন গলা শুনে মলিন হাসলো আশমিন। উদাশ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে মলিন গলায় বলল,
— মানুষ চোখের ভালবাসা কেন অনুভব করে না সান?চোখ তো মনের আয়না। ভালবাসার মানুষ টা আমার চোখে থাকা ভালবাসা, অভিমান, কষ্ট অনুভব করতে পারে না এই পরাজয় আমি কিভাবে মেনে নেই সান? সে আমাকে কষ্ট দেক।আঘাত করুক।আমি মেনে নিবো।কিন্তু সে আমার চোখের ভাষা বোঝে না এটা আমি কিভাবে সহ্য করি বলো তো? আমার মনে রাজ করা মানুষ টার ভালবাসায় এতো ক্ষাদ আমার সহ্য হচ্ছে না। ছোট বেলা থেকেই আমি শুধু অবহেলা পেয়ে গেলাম বুঝলে? আপনজনদের অবহেলা নিতে নিতে আমি ক্লান্ত।তুমি কোন ব্যথা সারাবে সান? এই বুকে সারাক্ষণ আমার প্রিয় মানুষ গুলো আঘাত করে চলেছে। ক্ষত সারাতে মলম দিতে হয়।পুনোরায় একই জায়গায় আঘাত করলে কি ক্ষত সারবে? এসব বাদ দাও। বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। প্রয়োজন হলে আমি ডেকে নিবো।
আশমিন আবার নূরের কেবিনে চলে গেলো। সানভি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আশমিনের কষ্ট সে বোঝে।এতো বছর ছায়ার মতো লেগে আছে তার পিছনে। আশমিনের প্রতিটি নির্ঘুম রাতের সাক্ষী সে।কি গভীর যন্ত্রণায় মাঝ রাতে বারান্দায় ডুকরে কেদে উঠতো আশমিন। এমন শক্ত পোক্ত গম্ভীর মানুষ টা কে রাতের আধারে কাদতে দেখে নিজের চোখ ও ভিজে উঠতো সানভির।নূরের প্রতিটি কথা আশমিন কে গভীর ভাবে আঘাত করে। আশমিন হাসি মুখে এড়িয়ে যাওয়ার ভান করলেও সানভি বোঝে তার স্যার হাসি মুখে আঘাতের বি*ষ পান করছে। মাঝে মাঝে সানভির খুব আফসোস হয় নূরের জন্য। এমন একটা ভালবাসার মানুষ পেয়ে ও সে অবহেলা করছে।যদি কখনো হারিয়ে যায় কেদেও কুল পাবে না।
পনের দিন পরে আজ নিজের মেয়েদের কাছে পেয়েছে নূর।সে নিজেও পুরো পুরি সুস্থ না।তাই এখনো হসপিটালে আছে।আমজাদ চৌধুরী প্রতিদিন এসে নাতনিদের দেখে যান।কামিনী চৌধুরী একবার ও আসেনি।মায়া বেগম কয়েকবার এসেছে।আশমিন কড়া গলায় তাকে বাসায় থাকতে বলেছে।তার একমাত্র কাজ হচ্ছে কামিনী চৌধুরীর উপর নজর রাখা। আর কোন ছাড় দেয়া হবে না কামিনী চৌধুরী কে।
বাচ্চাদের নিজের কোলে নিয়ে কেদে ফেললো নূর।আশমিন চোখ ভরে দেখছে তার রাজকুমারীদের। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের মুহুর্ত বুঝি এটাই।একজন নার্স এসে নূর কে ফিডিং করাতে বললে নূর উসখুস করতে লাগলো। আড় চোখে আশমিনের কয়েকবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। নার্স আবার তারা দিতেই নূর আমতা আমতা করে বললো,
— ওনাকে বাইরে যেতে বলুন।
আশমিন যেন এই কথার অপেক্ষায় ই ছিল।সাথে সাথে গম্ভীর গলায় নার্স কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— আউট।
নার্স কোন দিরুক্তি না করেই বেরিয়ে গেল। নূর হতভম্ব গলায় বলল,
— আরে আমি আপনাকে বলেছি।
— আমি থাকতে তাকে কেন লাগবে? আমি হেল্প করছি। আমাদের মধ্যে প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই।এই মুহুর্ত গুলো খুব অমূল্য নূর। তোমার এই সুখের কষ্টে আমি তোমার সহযোদ্ধা।তোমার জন্য আমি ই যথেষ্ট।
কথা বলতে বলতেই নূর কে হেল্প করে মাথার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো আশমিন।
— বসতে কষ্ট হচ্ছে?
নূর মাথা নাড়িয়ে না বললো। আশমিনের চোখের দিকে তাকালে তার বিশ্বাস হয়না সে তার বাবাকে খু*ন করেছে।তবে আশমিনের খাপছাড়া ভাব আর স্বিকারউক্তি তার ভাবনা গুলুকে বারবার এলোমেলো করে দেয়। এই দোটানায় সে নিজেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আশমিন যদি সত্যি তার বাবাকে খু*ন করে থাকে তাহলে তাকে মরণ যন্ত্রণা দিবে সে। একবার সঠিক তথ্য তার হাতে আসুক। একটা ডায়েরির উপর ভিত্তি করে কোন পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না। আর রইলো আশমিনের স্বিকার উক্তি,আশমিনের মতো বদ লোকের কোন কথা ধরা মানে নিজের মাথা দেয়ালে মারা।আস্তো ইতর একটা।
— আমার ডাক্তার হওয়া উচিত ছিল বউ।ওই ডাক্তার আমার বউয়ের পেট কেটে দুই ভাগ করে ফেললো আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম! ডাক্তার হলে কি এই দিন দেখতে হতো বলো? বউ ও আমার বউয়ের পেট ও আমার।আর কাটলো কি না ডাক্তার! শুধু আমার রাজকন্যা গুলোর জন্য কিছু বললাম না। নাহলে আমিও ওই ডাক্তারের পেট কেটে দিতাম। মিনিস্টার আশমিন জায়িন চৌধুরীর বউয়ের পেট কেটে ফেলে! কি সাহস ভাবা যায়?
নূর ক্লান্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। লোকটা আবার বাজে কথা বলা শুরু করেছে।কাছের মানুষের কাছে আশমিনের এই অসহ্য কথা গুলো বের হয়।বাইরের মানুষের কাছে আশমিন মানেই একজন গম্ভীর রাগী নেতা।নূর কিছু না বলে চুপ করে থাকল।বাচ্চাদের খাওয়ানো হলে তাদের নিয়ে দোলনায় শুয়িয়ে দিলো আশমিন। তার লোক কল করছে তাকে।নূরের সারপ্রাইজ আনতে যাবে সে। ফোনে চোখ বুলিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো আশমিন। নূর তার এই নির্জিব হাসি ও যে কেড়ে নিবে তা হয়তো তার ধারণা তে ও ছিল না।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।