আম, কাঁঠালের দিন শেষ হবার আগেই বাবা আসেন। সঙ্গে অরু আর আমার চাচাতো ভাই হাসান। বাবা ঝুড়ি ভর্তি করে আম, লিচু নিয়ে আসেন। আম্মা ভীষণ খুশি হন। অনেক দিন পর আমাকে দেখে অরু কেঁদে ফেলে। বলে,
“এমন নিষ্ঠুর কেন তুমি মেজপা, সেই যে বিয়ের পর একবার গেলে আর তো গেলে না। ”
আমি হাসি। বাবা আমাদের এখানে একটা দিন থেকে পরী আপার ওখানে যান। অরু আমার কাছে থাকে। অনেক দিন পর বোন কে পেয়ে আমারও ভালো লাগে। অরু আমাকে বলে,
“বাড়িতে সবাই ভাবতেছে তুমি রেগে আছ?”
আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করি,
“কিসের রাগ?”
“তোমার সাদামাটা বিয়া হইছে। তেমন কিছু দেয় নাই তোমারে এইজন্য। ”
আমি হাসি। বলি,
“কারা বলে এমন কথা?”
“মা, চাচীমা সবাই। চাচাজানের সাথে তো মায়ের একদিন তর্ক পর্যন্ত হলো। ”
আমি হাসি। অরুর পছন্দের রুই মাছের তরকারি রান্না হয়। তেতুলের টক দিয়ে রুই মাছের এই তরকারি টা ভীষণ পছন্দ করে অরু। মামাবাড়িতে গেলে ছোট মামী তখন এই রান্নাটা করে খাওয়াতেন। আমাদের বাড়িতে কখনো কারোর পছন্দের রান্না হতো না, যা রাঁধবে তাই খেতে হবে। না খেলে পিয়াজ, মরিচ দিয়ে খেয়ে নাও।
দুপুরে আমি অরুকে নিয়ে খেতে বসি। এক লোকমা খাবার মুখে দিয়ে অরু বলে,
“খুব মজা হয়েছে মেজপা। তোমার এমন সুন্দর গোছানো সংসার দেখলে মা খুব খুশি হতো। মা সারাদিন চিন্তায় থাকে। ”
অরুর কথা শুনে আমি হাসি। মফস্বল, কিংবা গ্রাম থেকে যারা আসে তাদের কাছে শহর কে প্রথমে রঙিন লাগে। বিকেলের টিউশন বাদ দিয়ে আমি অরু, টাপুর, টুপুর আর মুক্তাকে নিয়ে ঘুরতে যাই। অরু সবকিছু তে অবাক হয়। রাস্তায় ঝালমুড়ি খেয়ে ঝালে চোখ মুখ লাল করে ফেলে তবুও মুগ্ধতা কমে না। ফুচকা, ভেলপুড়ি, টিক্কা, আচার খাওয়া শেষে বাড়িতে ফিরি। অরুর চোখ, মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়।
বাবা বাড়ি ফেরার আগে আমাকে নিয়ে যেতে চান। শ্বশুরের কাছে অনুমতি চান, তিনি খুশিমনে অনুমতি দেন। নাবিদও বারন করে না। শুধু আড়ালে আমাকে জিজ্ঞেস করে,
“কতদিন থাকবা জরী। ”
আমি নাবিদ কে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করি। বলি,
“অনেক দিন পর যাচ্ছি তো, ক’টা দিন বেশী থেকে আসি। ”
নাবিদ অসহায় গলায় বলে,
“সপ্তাহ খানেকের বেশী থেকো না, প্লিজ।”
আমি হেয়ালি করি, নাবিদ আরও মন খারাপ করে। আমার বলতে ইচ্ছে করে, এই যে এতগুলো মাস বাড়িতে যাই নি সেটা কেন জানো? তোমার জন্য। আমি চলে গেলে তোমার খাবারে অনিয়ম হবে, বড্ড কষ্ট হবে।
***
পলাশবাড়ীতে যাওয়া হয় অনেক দিন পর। মনেই হয় না যে এতদিন হয়ে গেছে। এই তো সেদিন লক্কর ঝক্কর টাইপের গাড়িতে জবরজং বউ সেজে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম।
বাড়িতেই ঢুকতেই মা, চাচীরা সবাই যেন ঝাপিয়ে পড়লেন। তাদের ধারণা এক সমুদ্র অভিমান পুষে রেখেছি মনে। মা’কে কেমন যেন অচেনা লাগে। এমন আদর, যত্ন এর আগে সে করে নি। পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হয়। বড় কাতলা মাছ টা আমার জন্য রাখা হয়েছে। চাচাজান নিজ হাতে বাজার করেন। নিরু আপার সঙ্গে দেখা হয় অনেক দিন পর। ফুটফুটে সুন্দর একটা ছেলে হয়েছে। নিরু আপা বিশ্রী এক অভ্যাস বানিয়েছে। সারাক্ষণ মুখে পান, সুপুরি থাকে। আঙুলের ডগায় চুন। আবার বলে,
“বাবু পেটে থাকতে অভ্যাস হইছে রে। এখন আর ছাড়তে পারি না। ”
আমি সবার জন্য কিনে আনা জামা কাপড় গুলো দেই। এই জামাকাপড় গুলো আমার আর নাবিদের টাকায় কেনা হয়েছে। আম্মা সরু চোখে একবার দেখেছিলেন কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে নি। জামাকাপড় গুলো পেয়ে সবাই খুব খুশি।
আমার সঙ্গে টাপুর টুপুরও এসেছে। আমি মুক্তাকেও বলেছিলাম। মুক্তাও রাজি ছিল। নাবিদ কঠিন গলায় বলল,
“মুক্তার যাবার দরকার নাই। এদের স্বভাব ভালো না। একটা না একটা ঝামেলা করবে তারপর জরীকে দোষের বোঝা বইতে হবে। ”
জামিল ভাইও সেই কথায় তাল দিলেন। বললেন,
“ঠিক ই তো। একজন মাছওয়ালার সাথে ভাগছে, আরেকজন গাছওয়ালার সাথে ভাগবে। ”
মুক্তার মুখ ছোট হয়ে গেছে। আমি আর ও’কে জোর করতে পারলাম না। তবে বেচারির জন্য আমারও খারাপ লাগছিল।
***
নাবিদ আমাকে সারাদিনে অনেক বার ফোন করে। সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায়, রাতে। নিরু আপা চোখ কপালে তুলে বলে,
“তোরে তো জামাই মাথায় করে রাখেরে জরী! কী জাদুটোনা করলি রে!”
আমি আপার বোকা বোকা কথাগুলোকে মজা ভেবে হেসে উড়িয়ে দেই। নিরু আপা আমার হাতের ফোন টা দেখেও চোখ বড় করে।
“দাম কত রে… এতো দামী মোবাইল দিয়া তুই কী করবি?”
আমার পড়াশোনার ব্যাপার টা মা এখন মেনে নিয়েছে। পরী আপা মা’কে বুঝিয়েছে। বাড়ির অন্যান্য রা ব্যাপার টা ভালো চোখে দেখে নি। পড়াশোনার কী দরকার! চাকরির চিন্তা যেন ভুলেও না করি, চাকরি আর সংসার একসঙ্গে হয় না।
এসব কথা শুনে বরাবরের মতোই আমি চুপ থাকি। কাউকে কিছু বলি না। ম্যাট্রিকে সায়েন্স পড়তে গিয়েও অনেক কথা শুনেছি লোকের। তুই সায়েন্স পড়ে কী করবি, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবি। আবার ফেল করিস না যেন। সেই সময়গুলোও চুপ করে থেকেছে। আমি বিশ্বাস করি, একদিন আমার সময়ও আসবে। সেইদিন সবাই সবার জবাব পেয়ে যাবে। কাউকে কিছু আলাদা করে বোঝাতে হবে না।
***
ঘর, সংসার নিয়ে আলাদা করে ভাবনা কিংবা স্বপ্ন কোনোটাই ছিলো না আমার। কিন্তু এখন যেন কি হয়ে গেছে। পলাশবাড়ী তে আসার পরও সারাক্ষণ আমার ঢাকার বাসার কথা মনে পড়ে। নাবিদ কে বলে এসেছিলাম বারান্দার গাছগুলোয় পানি দিতে। ঠিকঠাক ভাবে দেয় কী না কে জানে। বাচ্চাগুলোকে পড়া দিয়ে এসেছি, ঠিকঠাক পড়ছে তো! সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষায় আবার খারাপ করবে না তো! সুবর্না ফোন করে খোঁজ নেয়। অনেকগুলো খাতা আমার জন্য জমিয়ে রেখেছে। নাবিদ সকালে ডাল, ভাত খেয়ে বেরিয়ে যায়! আম্মা যদি একটু মাছ টা হলুদ, লবন দিয়ে ভেজে দিতো তাও একটু ভালো হতো। বাবা বিকেলের চা টা বাইরে খেয়ে পেটের অসুখ বাঁধাচ্ছেন কি না কে জানে!
আমি কখনো এমন জীবন চাই নি। যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি ব্যস্ততা থাকবে। তবুও এই জীবন টা ভালো লাগছে। সবশেষে এটাই মনে হয়, আল্লাহ যা করেছেন, যে ভাগ্য আমাকে দিয়েছেন ভালোর জন্য দিয়েছেন।
চলবে…