আমার দিনগুলো কাটে ছন্দহীন। ছেলেমেয়েদের সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষা শেষ হলো রোজার আগেই। বিকেলে খানিকটা সময় পাওয়া গেল। ওরা কিছুদিন ছুটি নিলো। কলেজে যাওয়া হয়। সুবর্না একগাদা খাতা দিয়ে দেয়। লিখতে লিখতে হাপিয়ে যাই। মাঝেমধ্যে মনে হয় নিজেকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলছি। আমারও একটু বিশ্রাম প্রয়োজন।
নিজের সুবিধার জন্যই বাড়িতে কাজের লোক পাল্টালাম। আগের খালা এসে কোনোরকম ঘর ঝাড়ু দিয়ে, মুছে রান্নাঘরের ক’টা বাসন মেজেই দৌড়াতো। প্রত্যেক মাসে আট দশ দিন বাড়ি গিয়ে থাকতো। আম্মার বহু দিনের পরিচিত লোক। কথাবার্তায়ও তেজ বেশী। আমি আম্মাকে না জানিয়েই কাজের লোক রাখলাম। সে ঘরদোর পরিস্কারের পাশাপাশি, বাসন মাজা, তরকারি কাটা, কাপড় ধোঁয়া, রুটি করা সব কাজ ই করে দিয়ে যায়। দুই বেলার বদলে আমি এখন একবেলায় সব রান্না করি।
আম্মা চোখ কপালে তুলে বলেন,
“এত্তগুলা টাকা খরচ করতে কইলজায় লাগে না তোমার? আমাদের কি সেই অবস্থা আছে যে এমন কাজের লোক রাখব। তোমার শ্বশুরের দোকানের অবস্থা ভালো না। জামিল তো কিছু দেয় না। বাড়িভাড়া আর নাবিদের টাকায় ই তো সংসার চলে। ”
আমি শান্ত গলায় বললাম,
“নাবিদের টাকা না আম্মা, এইটা আমার টাকা। আমার টিউশনির টাকা। ”
আম্মা গলার স্বর আরও রুক্ষ করেন। বলেন,
“টাকায় আমার তোমার বলে কিছু নাই। এই টাকা সংসারের টাকা। আর কী এমন কাজ, হাতে হাতে করলেই তো হয়ে যাবে। ”
“আমার তো দুইটা হাত মা। দুই হাতে পারি না, মুক্তা কলেজে যায়, পড়াশোনা করে ও’কে তো আপনি কিছু করতে দেন না। আর আপনি তো প্রায় ই অসুস্থ থাকেন। কোমড় ব্যথা, পা ব্যথা এসব লেগেই থাকে। তাহলে কাজ করার জন্য বাকী হাতগুলো কোথায়?”
আম্মা থতমত খেয়ে যায়। আমি যে এতগুলো কথা অকপটে বলব সেটা উনি ভাবে পারেন নি। উনি সারাদিন খিটমিট করতে থাকেন, বিনা কারণেই টাপুর টুপুর কে বকাঝকা করলেন। বাবার সঙ্গেও যাচ্ছেতাই আচরণ। আমি রাগের কারণ বুঝি, কিন্তু মাথা ঘামাই না।
আম্মা নাবিদ কে এই ব্যাপার বললেন। কিভাবে কী বলেছেন আমি জানিনা, তবে নাবিদ আমাকে এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করলো না। শুধু বলল,
“আম্মার সব ব্যাপার অতো গুরুত্ব দিও না, কিছু কথা এক কানে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিও। ”
আমি অবাক হলাম না। হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
“এরকম বলছ কেন?”
“এমনি। কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা হলে আমাকে বলবে। ”
আমি হাসি। নাবিদ কে আমি কখনোই কোনো ঝামেলার কথা বলি না।
আম্মা নতুন খালার দোষ খুঁজে বেড়ান। তার কাজ পছন্দ হয় না। হেলেদুলে কাজ করে টাকা নিয়ে যান। এইভাবে খালি খালি টাকা নষ্ট হচ্ছে। এরচেয়ে সংসারের একটা জিনিস কিনলেও ভালো।
আমি পাত্তা দেই না। আমার মতো চলি। আম্মা এর ওর কাছে আমার বদনাম করে। দুটো পয়সা রোজগার করে দেমাগে বাঁচি না, হাভাতের ঘরের মেয়ে। পয়সা জীবনে চোখে দেখিনি।
এগুলো আমার পিছনে বললেও সামনাসামনি মাঝেমধ্যে খুব ভালো ব্যবহার করে। আমি মন খারাপ করেও আবার নিজেকে সান্ত্বনা দেই, ভালো মন্দ মিলিয়েই তো মানুষ হয়। কী হবে শুধু শুধু মন খারাপ করে। মানুষ কী তার পুরো জীবনে সবার কাছে ভালো হয়ে উঠতে পারে! আমিও নাহয় কারো কারো কাছে খারাপ ই রইলাম।
***
রোজার কয়েক দিন আগে ঝড়ের মতো এসে মনি আর পাশা মিয়া হাজির হয়। সঙ্গে রোজার বাজার। অনেক বাজার। আম্মা সবকিছু ভুলে যান। তিনি মেয়েকে নিয়ে আহ্লাদ করেন। খাবারের প্যাকেট গুলো দেখে খুশি আর ধরে না। একটা দিন কাটতেই হাজির হয় শিল্পী আক্তার লাভলী আর তার মেয়ে। শিল্পী আক্তার এক গাল হেসে বললেন,
“খালাম্মা আপনের নাতনি খালি কয়, নানুবাড়ি যাব তাই নিয়া আসছি। ”
তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“যাও তোমার নানুর কাছে বসো। নানুরে ছড়া শুনাও। ”
মেয়েও ছড়া শুনাতে শুরু করে। আম্মা বিরক্ত হলেও চুপ করে থাকে। ব্যাগভর্তি বাজার দেখে নরম হয়ে যায়।
নাবিদ আর জামিল ভাই প্রচন্ড রেগে যায়। বাবা দুজনকে সামলানোর চেষ্টা করেন। আম্মা বলেন,
“প্যাটের মাইয়া ফালাইয়া তো দিতে পারি না। আসছে, কয়টা দিন থাকুক। এরপর নাহয় বইলা দিলাম যে আর আসবি না। ”
নাবিদ খুব রেগে যায়। এতো রাগ ওর এর আগে কখনো দেখিনি।
মনি সবার জন্য জামা, কাপড় আনে। আমার জন্য আনা শাড়িটা আম্মার পছন্দ হয়। সে মুখ বেজার করে বলে,
“আমার জন্য মাইড্যা রঙ না আইন্যা ওই রঙ আনতি। ”
শিল্পী জবাব দেয়, খালাম্মা ওই রঙ আপনারে মানাবে না। ওইটা ভাবীরে মানাবে, ভাবী আবার ফকফকা সুন্দর। হিহিহি।
***
ঘরের কাজ সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাই। মনির সতীন, স্বামী সবারই মুখের রুচি খুব ভালো। মেয়েটা সারাদিন ঘুরঘুর করে আর খেতে থাকে। মুড়ি, বিস্কুট, চানাচুর, কলা সব খেয়ে শেষ করে তারপর চাল খায়। শিল্পী আক্তার মেয়ের সাফাই গায়। বলেন,
“মাসের পনেরো দিন মাইনষের খিদা বেশী থাকে। ”
আমি কিছু বলি না। শিল্পী আক্তার আমার সঙ্গে ভাব জমাতে আসে কিন্তু আমি চুপ থাকি। মনি একদিন বলল,
“ভাবী আপনে আপার সাথে কথা বলেন না ক্যান? আর আপনার মোবাইলে নিশি গান দেখতে চাইছে আপনি নাকি দেন নাই?”
“হ্যাঁ। ”
“ক্যান? ”
আমি মনির দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,
“আমার ইচ্ছা। ”
মনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
“আপনি সুন্দর দেইখা আপনার অনেক দেমাগ তাই না?”
আমি জবাব দিলাম,
“হ্যাঁ। ”
মনি আবারও বিস্মিত হয়। একটু থেমে বলে,
” এতো দেমাগ ভালো না। ”
আমি ঠোঁট টিপে হেসে বলি,
“ভালো, মন্দ তুমি কেমনে বুঝলা! তুমি তো আর আমি মতো সুন্দর না। ”
মনি থতমত খেয়ে যায়। সারা বিকেল কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে যায়৷ পাশা মিয়াও তার ছোট বউয়ের দু:খে কাতর। শিল্পী আক্তার অবশ্য তেমন গুরুত্ব দেয় না। সে নিচতলার ভাবী আর নাজমা ভাবীর ওখানে ঘুরতে যায়।
***
দুদিন পর জামিল ভাই পাশা মিয়াকে বলে,
“এই মিয়া তোমার সার্কাস পার্টি নিয়া বিদায় হও। ”
পাশা মিয়া তখন রুটি ছিড়ে তার ছোট বউকে খাওয়াচ্ছেন। তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। মনি গলা চড়িয়ে বলল,
“বড় ভাই, এইগুলা কেমন কথা?”
জামিল ভাই মনিকে ঠাস ঠাস দুটো চড় মারলেন। পাশা মিয়া চোরের মতো এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলেন। শিল্পী আক্তার লাভলীও ভীত চোখে দাঁড়িয়ে আছে। মনি হু হু করে কাঁদতে লাগলো। জামিল ভাই গলা চড়িয়ে বললেন,
“এক ঘন্টার মধ্যে বিদায় হবি তোরা খবিশের দল। রাস্তাঘাটে বাইর হইতে পারি না তোদের নাটকের জ্বালায়। ”
বাক্স, প্যাটরা নিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাই বেরিয়ে যায়। শিল্পী আক্তার লাভলী আম্মাকে বলেন,
“আমার বাড়ি যাইয়েন খালাম্মা। আপনের মতো এতো বাড়ি না থাকলেও আমার বড় মন আছে। আল্লায় দিলে একদিন আপনের চেয়েও বড় বাড়ি আমার হইবে দেইখেন। ”
আম্মা জামিল ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে আসেন। নাবিদও তখন রেগে যায়। বলে,
“আম্মা তোমার একি আক্কেল! মান সম্মান কিছু রাখবা না? তুমি তোমার এই মেয়েরে মাথায় উঠিয়ে নাচতেছ! এরপর মুক্তার জন্য ভালো সম্বন্ধ আসবে!”
আম্মা চুপ করেন। পরের দুটো দিন তার রাগ আর মেজাজ চড়া থাকে। দুদিন পর মুক্তা জানায় যে ওর জমানো চারশ চৌত্রিশ টাকা পাচ্ছে না। জামাকাপড়, কসমেটিক্স সব ঠিক আছে কিন্তু টাকাটা নেই।
***
রোজার মধ্যে মনি ফোন করে আম্মাকে বলল,ঈদের পর আসবে সম্পত্তি বুঝে নিতে।
চলবে….