লাজুকপাতা | পর্ব – ১৯

9 Min Read

টুম্পা ভাবী আর জামিল ভাইয়ের ডিভোর্স হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত । ভাবী মেয়েদের নিতে চায় না। সে জানায় মেয়েরা আপাতত বাবার কাছে থাকুক। সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে তারপর মেয়েদের দায়িত্ব নিবে। জামিল ভাই ভাবীর উকিল কে জানান মেয়েদের দায়িত্ব নেয়া তো দূরে থাক, তাদের যেন চোখের দেখাও না দেখতে পারে সেই ব্যবস্থা উনি করবেন।
ভাবীকে আমার ভীষণ স্বার্থপর লাগে। নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার অর্থ হলো তার নতুন সংসার গুছিয়ে নেয়া। জামিল ভাইয়ের মুখে শুনেছি যে ভাবীর বাবা অনেক দিন আগেই নিজের পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে। শুধু অপেক্ষায় ছিলো অফিশিয়াল ছাড়াছাড়ির। এমনকি তার কঠিন শর্ত ছিলো ভাবী যেন কিছুতেই টাপুর টুপুর কে নিয়ে বাপের বাড়িতে না আসে।
জামিল ভাই কয়েকটা দিন খুব ছটফট করলেন। রাতে শব্দ করে কান্নাকাটি করেন, সবকিছু জ্বালিয়ে দেবার হুমকি দেন। আর টাপুর টুপুর কী বুঝতে পারে কে জানে! ওরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। প্রানখোলা সেই হাসি টা আর নেই। আমার দেয়া চকলেটগুলো তেমন ই থাকে টেবিলের উপর বইখাতার পাশে। খাওয়া নিয়েও বায়না করে না। বাবা তার নাতনিদের মন বুঝতে পারেন। সে ঘুরতে নিয়ে যায়। এভাবে কিছুদিন যাবার পর ওরা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
নাবিদের অফিসের ভীষণ চাপ। সপ্তাহ খানেকের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হয়। আমাকে বাসায় রাখতে ভরসা পায় না, পরী আপার কাছে গিয়ে ক’টা দিন থাকতে বলে। আমি রাজী হতে পারি না ছেলেমেয়ে গুলোর জন্য। ওদের সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তবুও হাতে দুদিন সময় নিয়ে আপার ওখানে যাই। আপা ভীষণ খুশি হন। আমাদের মধ্যে যে সাময়িক দূরত্ব তৈরী হয়েছে সেটা মিটে গেছে অনেক দিন হলো। আমার কথা জমানোর বক্সে কথা না জমাতে পারলে ভীষণ খারাপ লাগে।
পরী আপার ওখানে ঘুরে আসি টাপুর টুপুর কে নিয়ে। ওদেরও মন ভালো হয়। আপা আমার জন্য আপ্যয়ন, আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখেন না। এখানে আসলে যে আদর যত্ন পাওয়া যায়, পলাশবাড়ীতে গেলেও সেটা মিলে না। আপা আমাকে কথায় কথায় বলেন,
“তোর নিরুর সঙ্গে কথাবার্তা হয় জরী?”
“মাঝেমধ্যে হয় আপা। আমি ফোন করি, নিরু আপা অবশ্য আমাকে মিসড কল দেয়। ”
“ওর সঙ্গে একটু খাতির কম করিস তো। ”
“কেন আপা?”
আপা এড়িয়ে যান। বলেন, এমনি রে। বাচাল স্বভাবের তো। সারাদিন ফোন নিয়েই থাকে। এই নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর সঙ্গেও নাকি ঝগড়াঝাটি লেগে থাকে।
আমার আপার কথা বিশ্বাস হয় না। নিরু আপার মুখ পাতলা টাইপ। বোকাসোকা ধরনের মানুষ। নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য আপা আমাকে দূরে থাকতে বলেছে।
আপার ওখান থেকে বাসায় ফিরতে হয়। টাপুর টুপুর এর স্কুল এখন অফ। ওদের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। ওদের আরও থাকার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু আমার জন্য থাকতে পারে নি।
***
বাড়িতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। এক রাতে জুয়েল ভাই বাড়িতে আসে। নাবিদ তখন বাসায় নেই, জামিল ভাই আর বাবার পারমিশন নিয়ে মুক্তাকে নিয়ে যায়। জুয়েল ভাইয়ের মা অসুস্থ, তিনি ছেলের বউকে কাছে চাচ্ছেন। আম্মার সম্ভবত আপত্তি ছিলো, কিন্তু তিনি জামাইয়ের সামনে কিছু বলতে পারেন না। জুয়েল ভাই মুক্তাকে নিয়ে যাবার দুদিন পর জানান যে ও এখন থেকে শ্বশুর বাড়ি থাকবে। অনুষ্ঠান করার সময় তার নেই। আম্মার ভীষণ মন খারাপ হয়। তিনি দশজনের কাছে গল্প করেছিলেন মেয়ের শ্বশুর বাড়ির নামে। এখন তার মান ক্ষুন্ন হবে।
বাড়িতে মা আমাকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার এক কথা নাবিদ কে বলে সংসার আলাদা করতে। আমি চুপচাপ শুনি। মা একসময় বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। পরী আপাকে নিয়ে তার চিন্তা নেই। ডাল, ভাত খাক আর কম খাক তবুও সেটা নিজের সংসার। খবরদারি করার মতো কেউ মাথার উপর নেই। আমাকে নিয়ে তার রাজ্যের চিন্তা। আমার জীবন টাও শেষমেস মায়ের মতোই হয় কিনা!
সংসার নিয়ে ভাবনা আমারও আসে। সেই ভাবনা নিজেই থামিয়ে দেই। আম্মা ছাড়া এই বাড়ির অন্য মানুষগুলো আমাকে ভালোবাসে, সম্মান করে। আমি আলাদা হয়ে গেলে টাপুর টুপুর এর কী হবে! মেয়ে দুটো মানুষ হবে অনাদরে, অযত্নে। মায়ের অভাব আমি জীবনেও পূরন করতে পারব না জানি, তবুও বুঝতে শেখা অবধি আমার ওদের পাশে থাকা উচিত। একটা বয়স পর্যন্ত সবার জীবনেই স্নেহ, মায়া, আদর যত্ন প্রয়োজন।
বিয়ের একটা বছর এতো জলদি কিভাবে চলে গেল নিজেও টের পেলাম না। এই তো সেদিন পলাশবাড়ী থেকে নতুন বউ সেজে ঢাকায় এলাম। গাড়ির জার্নিতে সব সাজগোজের বারোটা বাজিয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় মটকা মেরে ঘুমিয়ে রইলাম। সব যেন সেদিনের ঘটনা। অথচ চোখের পলকেই সময়টা চলে গেল।
চৌদ্দ দিনের জায়গায় নাবিদ কে থাকতে হলো উনত্রিশ দিন। আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। বাড়িতে কোনো সমস্যা হয় নি, তবুও সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। খেতে বসে দেখি গলা দিয়ে কিছু নামে না। প্রথম বেলায় ভাবলাম অরুচি সম্ভবত। কলেজ থেকে ফিরে খিদেয় চোখে দেখি না। দুই টুকরা মাংস আর ডাল দিয়ে মাখানো ভাত টাও দুই লোকমার বেশী খেতে পারলাম না। ঘুমাতে গিয়ে দেখি পাশের জায়গাটা খা খা করছে। পাশের জায়গাটা যতটা না, খা খা করছে তারচেয়ে বিশ গুণ বেশী খা খা করছে আমার হৃদয়। আম্মাও আমার অস্বাভাবিকতা টের পেলেন। তিনি আমার দিকে আড়চোখে তাকান। কথাবার্তা এমনিতেও প্রয়োজন ছাড়া বলেন না। মামী একদিন আমাকে দেখতে এলেন। এসে বললেন,
“তোমার গাল দুটো এমন চিপসে গেছে ক্যান? কোনো সমস্যা? ”
আমি হেসে বলি, না তো মামী।
মামীও আম্মার মতো অন্য কিছু সন্দেহ করে। ভাবে আমি বুঝি প্রেগন্যান্ট। কিন্তু সেসব কিছুই না। আমার সমস্যা তো আমি জানি।
কলেজে যেতেও ভালো লাগে না। তবুও একদিন যেতে হয়। সামনে প্রি টেস্ট পরীক্ষা আছে। সাজেশন, নোট এগুলো কালেক্ট করতে হবে।
একদিন কলেজে যাবার পর সুবর্না হাসতে হাসতে বলল,
“এই জরী একটা মজার ব্যাপার শোন। আমরা এতদিন খেয়াল করি নি। আমাদের ফার্স্ট বয়ের নাম কিন্তু শুভ্র। চশ মাও আছে কিন্তু। ”
আমি প্রথমে বুঝতে পারি না, পরে বুঝেও কিছু বলি না চুপ করে থাকি।
পরের দিন ক্যান্টিনে যাবার সময় শুনি আরেকটা ছেলে বলল,
“এই মামা সাইড কর। শুভ্র’র জরী আসছে। ”
আমার খুব রাগ লাগলো। আমি সুবর্নাকে গিয়ে ধরলাম। বললাম,
“কাহিনী কী সুবর্না?”
সুবর্না হাসতে হাসতে বলে,
“আরে কাহিনী রোমান্টিক, তোর শুনতে ভাল্লাগবে না তাও বলি। রাজন নাকি তোর সাথে কথা বলছিল, সেটা দেখে শুভ্র রাজনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, জরীর সাথে এতো কিসের কথা। মানে শুভ্র’র মনে তোর জন্য সামথিং সামথিং….
রাগে আমি রীতিমতো কাঁপতে থাকি। সুবর্নাকে বলি,
“তুমি ওদের বলো নি যে আমি বিবাহিত। আমি তো তোমাকে বলেছিলাম। ”
“আরে না, বিবাহিত বললে ব্যাপার টা কী আর মজার থাকবে!”
আমি রেগে যাই। সেদিন পাপিয়া ম্যামের ক্লাশে হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলি,
“ম্যাম আমার একটা কথা আছে। ”
ম্যাম বলে, বলো জরী।
“কথাটা আসলে সবার উদ্দেশ্যে ম্যাম। ”
ম্যাম যেখানে লেকচার দেন সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। এতো সাহস আমার কবে কোত্থেকে হলো কে জানে! আমি বুক ভরে নি:শ্বাস নিয়ে বললাম,
“আমি আসলে ম্যারিড। হাজবেন্ড প্রচন্ডরকম সাপোর্টিভ, নাহলে আমার আর পড়াশোনা হতো না। কেউ প্লিজ আমার নামের সঙ্গে অন্য কারো নাম জড়াবে না। প্লিজ। ”
কথা বলা শেষ করে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে আমি নিজের সিটে বসি। ক্লাশ শেষে ম্যাম আমাকে ডাকেন। আমার ব্যাপারে খোঁজ নেন, বাড়ি, পড়াশোনা, হাজবেন্ড শ্বশুর সবকিছু। তারপর বলেন,
“তুমি খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে, তোমার জায়গায় অন্যকেউ হলে এই ব্যাপার টা এইভাবে হ্যান্ডেল না করে অন্যভাবে করতো। জরী একটা বিষয় সবসময় মাথায় রাখবে, জীবনে যত বড় ই হও সবাই কে সমান ভাবে সম্মান করবে। ”
সুবর্না আমাকে বলল,
“এই তুই এতো সেনসিটিভ কেন? সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এতো সিরিয়াস কেউ হয়! ”
আমি স্মিত হেসে বললাম, আমি আসলে নাবিদের জরী। অন্যকারো জরী শুনতে ভালো লাগলো না তাই…
সুবর্না হেসে ফেলে। বলে, তুই তো আস্ত পাগল রে। দেখে বোঝার উপায় নেই।
***
নাবিদ কে এতদিন পর দেখে বুঝলাম ও আমার মতো তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছিলো বুঝি। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ছাদের দিকে তাকালো। আমি তখন ছাদে গেছি বড়িগুলো দেখতে। অন্যান্য দিন এই সময় যাওয়া হয় না। তখন মধ্যদুপুর, নাবিদ আমাকে দেখে হাসলো। আমার মনে হলো আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। বেশী করে ঝাল দিয়ে চিংড়ি মাছের ভর্তা আর রসুন ভর্তা দিয়ে এক গামলা ভাত খেতে পারব। অরুচিও সেড়ে গেছে। সব রোগের ওষুধ কে পেয়ে গেছি যে!

চলবে…

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।