লিপি ভাবীর সঙ্গে আমার একটা সহজ সম্পর্ক হয়ে গেল। ওনার কথাবার্তা এখন আর আমার তেমন খারাপ লাগে না। হাতে হাতে কাজগুলো এগিয়ে দেয় যেটা আমার ভালো লাগে। যেদিন আমার ক্লাশ থাকে, সেদিন আমার জন্য আলাদা বাটিতে খাবার বেড়ে রাখে। ওনার একটা বিষয় আমার ভালো লেগেছে। আম্মা আমার যত রকমের বদনাম তার সঙ্গে করেছে, সে সেগুলো আমাকে বলে নি। কিন্তু সেই কথাগুলো আমি জেনেছি কাজ করতে আসেন যে খালা তার থেকে। ওনার আরও একটা বিষয় আমার ভালো লেগেছে, সেটা হলো ওনার হাসি। শব্দ করে হাসেন কিন্তু দেখতে ভালো লাগে।
আম্মা আমার থেকে ওনাকে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাতে অবশ্য আমার তেমন অসুবিধা নেই। আমি আমার মতো থাকি। পরীক্ষা শেষ করে কলেজে ছুটি পেলাম বেশ কিছুদিন। টিউশন ব্যাচে ছেলেমেয়ের সংখ্যা আরও বাড়ছে। তিন টা ব্যাচ হয়েছে এখন। ভালোই লাগে এই ব্যস্ততাটুকু আমার। নাবিদ মাঝেমধ্যে বলে, এতো কাজ না করতে। একটু রেস্ট নিতে। কিন্তু আমার রেস্ট নিতে ইচ্ছে করে না। নতুন নতুন অনেক কিছু শিখতে ইচ্ছে করে, জানতে ইচ্ছে করে।
ফেসবুক নামক এক আশ্চর্য জিনিসের সঙ্গে শেষমেস আমিও জড়ালাম। স্কুল, কলেজের পুরোনো কিছু বন্ধুদের খুঁজে পেয়েছি সেখান থেকে। কিছু আজেবাজে ছেলেও আছে যারা সারাক্ষণ মেসেজ দিয়ে বেড়ায়। সেগুলো বাদ দিয়ে অন্য সব কিছুই ভালো লাগে।
বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। যাকে নিয়ে আমার কৌতুহলের শেষ নেই, তার চিঠি এলো। চিঠিটা দিয়েছেন বাবা। সন্ধ্যেবেলা চা দিতে যাবার সময় আমার হাতে দিয়ে বললেন, বড় বউমা তোমাকে দিছে। কাউরে জানাইয়ো না।
চিঠিটা হাতে নিতেই আমার মন টা দ্রবীভূত হয়ে গেল। দ্রুত ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম। আমার কেমন অস্থির লাগে! আমি চিঠির উপর টা দেখি। কমলা রঙের খামে কিছু লেখা নেই। এমন রঙের খাম সচরাচর দেখা যায় না।
আমি খাম খুললাম। সাদা কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠি।
আমার টাপুর টুপুর এর কাকিমনি,
তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম আমার মেয়েদের সঙ্গে। দুই হাতে দুজন কে নিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছ। আমি মুগ্ধ চোখে মেয়েদের দেখার বদলে তোমাকে দেখলাম। কত বয়স হবে মেয়েটার! উনিশ, বিশ। সেদিন বেশী কাছ থেকে দেখি নি। তারপর আরেকদিন দেখলাম কাছ থেকে। আমি শুধু চোখ দুটোই দেখলাম। আমাকে নিয়ে তোমার ভাবনা হয়তো খুব একটা ভালো না, হয়তো আমাকে ভীষণ স্বার্থপরও ভাবছ। আসলে তোমার ভাবনাই ঠিক। আমি ভালো নই, স্বার্থপরও। কিন্তু আমি ভালো হবার নাটক করেছি, চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি।
টাপুর টুপুর এর বাবার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে। রোগা কালোমতন একটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বেহায়া ছেলেটা একদিন কবিতা লিখেও পাঠালো। আমি মুগ্ধ হলাম না। বছর খানিক এভাবে যাবার পর আমার মনে হলো এই ছেলেটা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমার ওকেই দরকার। জীবনে আমার শুধু ওর ভালোবাসাই দরকার। আমি বাবার বাড়ির আরাম আয়েশ ছেড়ে এক কাপড়ে শ্বশুরবাড়ি এলাম। আমার বিয়ে হয়েছিল ছয়শ টাকায় কেনা নাকফুল আর সাড়ে চারশ তে কেনা শাড়িতে। অথচ বাবার কাছে আমি ছিলাম একমাত্র রাজকন্যা।
বিয়ের পরের জীবন টা অদ্ভুত রকমের। আমি আজও জানিনা যে সেই অদ্ভুত রকমের জীবন টা খারাপ নাকি ভালো। টাপুরের বাবার কাজের দিকে কোনো মন নেই। টিউশনি করাতে পারবে না, বাবার দোকানও তার ভালো লাগে না। সকালে খেয়ে ঘুমায় ওঠে সন্ধ্যেবেলা। রাত দুটো অবধি সে বাইরে আড্ডা দেয়। আমি কেমন আছি, মেয়ে দুটো কেমন আছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। এভাবে কী কারো জীবন কাটে! টাপুরের দাদি তার ছেলেকে কিছু বলেন না। তার যত বিরক্তি আমার উপর। আমি খুব বেশি অশান্তি করি। আমি মেয়েদের রেখে বাইরে কাজ করতে গিয়েও অনেক লাঞ্চনার শিকার হয়েছি। সেসব গল্প নাহয় না বলি। বিভীষিকাময় গল্পটা বলে নেই।
আমি দ্বিতীয়বার অন্ত:স্বত্তা হবার পর আমার গর্ভপাত করানো হয়। কাজ টা করে মেয়েদের বাবা আর দাদি মিলে। আমি বিষয় টা মানতে পারিনি। ওই বাড়ি আমি ছেড়ে দেই। যারা আমার গর্ভে থাকা বাচ্চাকে মেরেছে তারা যে কোনোদিন আমায় মেরে ফেলবে না তার গ্যারান্টি কী!
পরবর্তী যেসব স্টেপ আমি নিয়েছি সবসময় নিজের কথা ভেবেছি। আমি মেয়েদের নিয়ে আসিনি। দুনিয়ার মানুষ ভাবছে মেয়েদের আমি ভালোবাসি না। ভাবুক, তাতে সমস্যা নেই। আমিও তো কতকিছু ভেবে ঘর ছেড়েছিলাম, বিয়ে করেছিলাম। এখন আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি। আরেকবার সংসার শুরু করার সুযোগ এই মুহুর্তে চাচ্ছি না। এই মুহুর্তে শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবতে চাই, আরও স্বার্থপর হতে চাই।
টাপুর টুপুর কে দেখো এই কথাটা তোমাকে বলার দরকার নেই। নাবিদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তোমার কথা বলল, তুমি নাকি আমায় দেখতে চেয়েছিলে! সামনাসামনি দেখা হবে একদিন। আমার মেয়েদের কত প্রিয় তুমি! ভালো থেকো।
টাপুর, টুপুর এর মা
চিঠির সঙ্গে একটা ছবি। সেই ছবিতে হাস্যজ্জ্বল এক মেয়ে। সাদা জামা, ওড়নায় বসে আছে দিঘির পাড়ে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসছে। আমার মনে হলো আমাকে দেখেই হাসছে। মনে মনে বললাম, আমাদের একদিন দেখা হবে।
চলবে….