#লাজুকপাতা
#পর্ব-৭
পলাশবাড়ীতে আমার স্কুল কলেজ কেটেছে মেয়েদের সঙ্গে। গার্লস স্কুল, গার্লস কলেজ। শিকদার বাড়ির মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে পড়াশোনা করবে! ছি: ছি: মেয়েদের বিয়ের বাজারে যদি দর কমে যায়!
ক্লাস এইট থেকেই আমার বোরখা পরা লাগতো। সেদিক দিয়ে নাবিদ আমাকে বেশ ছাড় দিয়েছে। কলেজের জন্য জিনিসপত্র কিনতে যেদিন নিউমার্কেট গেলাম সেদিন নাবিদ আমাকে বলল,
“এই জরী, তুমি কী বোরখা পরতে?”
আমি জবাব দিতে খানিকক্ষণ সময় নিলাম। নাবিদের সঙ্গে একবার ই আমার বাড়ি যাওয়া হয়েছে। সেইবার মা আড়ালে ডেকে বলেছিলেন,
“কিরে বোরখা ছাড়া আসলি! আদব লেহাজ বিয়ের পর সব গেছে। ”
আমি আমতা আমতা করে বলেছিলাম,
“নাবিদ বারন করলো৷ ”
মা একটু মিইয়ে গেলেন। বললেন,
“তাইলে থাক৷ শহুরে ছেলেপেলে, আমাদের মতন তো আর না।”
নাবিদ যখন আমাকে বোরখার কথা জিজ্ঞেস করলো তখন আমি স্মিত হেসে বললাম,
“তুমি চাইলে নিশ্চয়ই পরব।”
নাবিদ কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখ দুটো ভীষণ রকম উজ্জ্বল ঠেকছিল। খুব খুশি হলে বাচ্চাদের চোখ যেমন হয় তেমন।
অনেক জিনিসপত্র কেনা হলো। বাড়তি কিছু কসমেটিক্স কেনা হলো ইডেনের সামনে বসা দোকানগুলো থেকে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি ঘোরা হলো। টিএসসি তে চা খাওয়ার সময় নাবিদ বলল,
“ভালো করে পড়াশোনা করলে এখানে রোজ চা খেতে পারতে।
আমি হাসলাম। নাবিদ পড়েছে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে। রাজশাহী শহর টা ওর খুব পছন্দের। চাকরি বাকরির চেষ্টা করেছিল সেখানে, কিন্তু হয় নি। এখানের চাকরিটাও ভীষণ ভালো। বেতনও ভালো, বিয়ের আগে মা চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, পঞ্চাশ হাজার বেতন রে! পঞ্চাশ হাজার।
আমাদের অনেক ঘোরাঘুরি হলো সেদিন। নাবিদ আমাকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গেল। শহুরে জীবন, স্টাইল সবকিছুতে অনভ্যস্ত আমাকে নাবিদ একটু একটু করে সব শিখাচ্ছে। রাস্তা পাড় হবার সময় আমার হাত শক্ত করে ধরে থাকে। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। গাড়ি কাছাকাছি চলে এলে পায়ের নিচে বরফ হয়ে যায় যেন। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। নাবিদ টেনে আমাকে নিয়ে যায়। কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“এই বোকা মেয়ে, আমি শক্ত করে হাত ধরে আছি তবুও ভয় কিসের! ”
আমি হাসি। সত্যিই তো! যার ভরসায় আমি পলাশবাড়ী ছেড়ে এখানে এলাম সে তো আমার হাত শক্ত করেই ধরে আছে।
রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও অপ্রস্তুত হয়ে যাই। চিকেন কাটলেট জিনিস টা এর আগে জীবনেও খাই নি। এক টুকরো নরম তুলতুলে পাউরুটি আর গরম ধোঁয়া ওঠা চিকেন কাটলেট এর সঙ্গে শসা পেয়াজ সামনে নিয়ে অপ্রস্তুত মুখে বসে থাকি৷ নাবিদ কাটাচামচ আর ছুড়ি দিয়ে কিভাবে কাটতে হয় সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখি। প্রথমবারে হাত কাঁপলেও সফল হই। নাবিদ আমাকে দেখে হাসে, কিছু না বললেও ওর হাসি দেখে আমি বুঝে যাই ও মনে মনে বলে,
“তুমি একদিন সব পারবে। ”
***
ভাত, ডাল, মাছ, মাংসের পদ, সবজি, ভাজি ছাড়াও পিঠেপুলি বানাতে আমি পারি। শহরে এসে নতুন করে আরও কিছু শিখছি। যেগুলো শহরের মানুষ খায়। আমার টাপুর টুপুরের জন্য পাস্তা, চাউমিন বানানো শিখলাম। প্রতিদিন ই কিছু না কিছু শিখছি।
কলেজে যাবার দুদিন আগে আম্মা আমাকে ডেকে বললেন,
“জরী তুমি তো এখন থেকে কলেজে যাবা। তাইলে রান্নার কি ব্যবস্থা হবে।”
আমার খুব মন খারাপ হলো। রান্নার দায়িত্ব তো আমি নিজে ভালোবেসে নিয়েছিলাম।
আমার যে মন খারাপ হয়েছে সেটা বুঝতে দিলাম না। আম্মাকে বললাম,
“আমার তো সকালে ক্লাস থাকবে। দুপুর নাগাদ তো চলেই আসব আম্মা। সকাল টা একটু ম্যানেজ করতে হবে। ”
আম্মা খানিকটা রুক্ষ গলায় বলল,
“মানে আমিই তো ম্যানেজ করব তাই তো? ”
আমি খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। এই মহিলার প্রতি সমস্ত ভালোলাগা এক নিমিষেই মুছে গেল। বাড়িতে মা, চাচিমা আমাকে, অরুকে পড়ার টেবিলে দেখলে কোনোদিন কাজে ডাকতো না।
আমি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললাম,
“আপনাকে কিছু ম্যানেজ করতে হবে না। আমি আগে যেমন করেছি, এখনো তেমন করব।
আম্মার গলার স্বর সহজ হলো। বললেন,
“ঘরের সবাই তো তোমার রান্নায় মজে গেছে। আমার রান্না আবজাব লাগে। নাইলে রানতে বাড়তে কী এমন কষ্ট! ”
আমার মনে দুটো ঘর আছে। এক জায়গায় ভালো মানুষেরা থাকে, আরেক জায়গায় খারাপ মানুষেরা। আম্মাকে আমি ভালো মানুষের ঘরে রেখেছিলাম বলেই তার আচরণে কষ্ট পাচ্ছি। পরী আপাকে বললাম কষ্টের কথা। আপা বললেন, এসব গায়ে মাখবি না। ভোরবেলা উঠে রান্না করে কলেজে যাবি। মুখে মুখে উত্তর দিয়ে কাজ হয় না জরী। তুই কিন্তু টাপুর টুপুর এর মায়ের মতো হবি না। তুই তোর কাজ দিয়ে জবাব দিবি।
নাবিদ কে আমি কিছুই বললাম না। পরী আপা বারন করে দিলেন। নাবিদ কে কখনো সংসারের জটিলতা যেন না জানাই।
নাবিদ আমাকে একটা নতুন মোবাইল কিনে দিয়েছে। ফোন টা সুন্দর। রঙ টা গোলাপি। স্মার্ট ফোন। আমাদের বাড়িতে সবার ই বাটন ফোন।
আমার হাতে স্মার্ট ফোন দেখে কুটিলা, জটিলা দুজনেই মন খারাপ করলো। নাবিদ কে সেটাও বলতে হলো না। কিভাবে যেন বুঝে গেল৷ নাবিদ একদিন খাবার টেবিলে বসে বলল,
“যারা কলেজে যাবে আমি শুধু তাদের ই ফোন কিনে দেব। এখন জরীকে দিলাম। এরপর মুক্তা যদি কলেজে যায় তখন ও’কে দেব। ”
মুক্তার চেহারাটা পাল্টে গেল খুশিতে। ওদিকে মনি সে গরম চোখে তাকাচ্ছে। আম্মা বললেন,
“এ কেমন কথা, কলেজে না গেলেও বাইরে তো যায়।”
নাবিদ নির্লিপ্ত গলায় বলে,
“তোমার মনে চাইলে মাথায় উঠায়ে নাচো আম্মা। যারা কোনো কাজের না, তাদের জন্য আমি এক পয়সাও খরচ করব না। ”
মনি খাবার রেখে উঠে গেল। সারাদিন চলল হু হু করে কান্নাকাটি। আম্মার ধারণা আমি নাবিদ কে কানপড়া দিচ্ছি।
***
আমার কলেজে যাওয়াও নাবিদের সঙ্গে। গলির মোড়ে রিকশায় ওঠা। পরনে সালোয়ার কামিজ। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। নাবিদ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
“ভয় পাচ্ছ জরী?”
আমি হেসে বললাম,
“না। ”
নাবিদ হেসে আমার হাত ধরলো। বড় রাস্তায় এসে পাড় হবার সময়ে হাত ধরলো না। বলল,
“একা পাড় হও তো। প্রতিদিন তো আমি সঙ্গে থাকব না।”
আমি অপ্রস্তুত হাসি দিলাম। নাবিদ আমার সঙ্গেই আছে। আমি এক পা বাড়িয়ে পিছিয়ে আসি। আবার কয়েক পা এগিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। নাবিদ সব টা দেখে। আমি নার্ভাস হয়ে যাই৷ ওর হাত ধরি, ও আমাকে রাস্তা পাড় করায়। বলে,
“আসার সময় কী করবে? আমি তো নিতে আসতে পারব না। ”
আমি জবাব দিতে পারি না। ও আবারও বলে,
“এক সঙ্গে অনেক মানুষ যখন রাস্তা পাড় হবে তখন তুমিও ওদের সঙ্গে রাস্তা পাড় হবে। জীবনে অনেক রাস্তা পেরোতে হবে জরী, আমি সবসময় তোমার সঙ্গে নাও থাকতে পারি। ”
কলেজ গেট দিয়ে ঢোকার সময় আমি নাবিদের দিকে তাকালাম। ও হাত নেড়ে বিদায় জানালো। আমিও হাত নাড়লাম। আমার চোখভর্তি পানি, নাবিদ কে ঝাপসা দেখছি। আমি হয়তো নাবিদ কে কখনো বলতেও পারব না যে, ও আমাকে সেই স্বপ্নটা পূরন করতে সাহায্য করছে। যেটা দেখার দু:সাহস করেও আমি থেমে গেছি। পলাশবাড়ীর শিকদার বাড়ির আমিই প্রথম মেয়ে যে অনার্সে পড়ার জন্য কলেজে পা রাখছে।
কলেজ শেষ হবার পরও দেখলাম নাবিদ দাঁড়িয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“অফিসে গেলে না?”
“গিয়েছিলাম, মাথা থেকে টেনশন যাচ্ছিলোই না। মনে হচ্ছিল তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছ। গাড়িগুলো এসে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। কারণ তুমি তো তখন শক্ত মানবী হয়ে যাও। ”
নাবিদের হাত ধরে আমি মনে মনে বললাম,
“আমি জীবনের ক্ষুদ্র, দীর্ঘ সব পথই তোমার হাত ধরে পাড়ি দিতে চাই।”
চলবে….