মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় | পর্ব – ৪ | শ্বেত পাথরের মূর্তি

34 Min Read
মধ্যরাত্রে সূর্যোদয়

কেউ চলে গেলে কি কারুর জীবন থেমে যায়? পুবালি ছেড়ে চলে যাবার পরে কি অরুন্ধুতির জীবন থমকে গিয়েছিল, না অরুনা আবার ফিরে পেয়েছিল তার জীবন। আমিও মন কে প্রবোধ দেই যে আমার দূর্ভাগ্যের জন্য আজ আমাদের এই দশা। ভাগ্য আমাদের একসাথে এনেছিল এক সময়ে, কিন্তু সেই ভাগ্যের পরিহাসে আমরা দুইজন আজ পৃথক পৃথক পথে চলে গেছিলাম। এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে। দিন যায়, আমি আমার মন শক্ত করতে চেষ্টা করি। কিন্তু বারে বারে পাপী মন মানে না, বারে বারে তার কথা মনে পরে যায়। দিনে দিনে আমি শুকিয়ে গেছিলাম। ছোটমা বাবু দুজনেই আমার শরীর খারাপ দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন।
এক রবিবার সকালবেলায় বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কি হয়েছে তোমার? ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করছ না তুমি। ওজন কমে গেছে, দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছও? এই ভাবে কত দিন চলবে, পরী?” ছোটমা গলায় চিন্তার সুর। সেদিন বিকেলে ছোটমা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, কিন্তু সেই অসুধে আমার শরীর ঠিক হয় না। আমার ওষুধ যে অন্য কারুর কাছে, সেটা আমি বলে বুঝাতে পারিনা।

শীতের ছুটির পরে কলেজ শুরু হয়ে যায়। আমি নিজেকে পড়াশুনায় আর কলজের কাজে ব্যাস্ত রাখতে চেষ্টা করি। আমার সেই চঞ্চল, উচ্ছল হাসি মুখ হারিয়ে যায়। ছোটমায়ের মন যেন কেঁদে ওঠে আমার ম্লান চেহারা দেখে।
একদিন ছোটমা আমাকে বলেন, “পরী তোকে এইরকম ভাবে ভেঙ্গে পড়লে ত হবে না। তুই বড় হয়েছিস, তোকে তোর অতীত ভুলে নতুন জীবনে পা রাখতে হবে। তোর সামনে এক বিশাল সুন্দর জীবন পরে আছে।”
আমি ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলি, “তুমি কি করে আমাকে বল সেই সব দিনের কথা ভুলে যেতে?”
ছোটমা আমার হাত ধরে বলেন, “আমি ওর মা, পরী। আমি যদি থাকতে পারি তাহলে তুই কেন পারবি না।”
আমি ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে কাষ্ঠ হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি নিজেকে পড়াশুনায় ডুবিয়ে দেব, ছোটমা। আমি প্রানপন চেষ্টা করব নিজেকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ছোটমা, তোমার ছেলে তুমি হারিয়েছ, তার বেলায় তুমি কি করবে?”
ছোটমা, “ও হয়ত একদিন বুঝতে পারবে, যে আমি যা করেছি ওর ভালর জন্য করেছি।”
আমি ধরা গলায় বলি, “ছোটমা, আমি একটু একা থাকতে চাই।”
ছোটমা ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরে আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম ছোটমায়ের প্রান তাঁর ছেলের জন্য প্রতিরাতে কাঁদে, কিন্তু সেই কান্নার আওয়াজ কোনদিন বুক থেকে মুখে আনেননি ছোটমা, শুধু মাত্র সমাজ আর আত্মীয় সজ্জনের কাছে মুখ দেখানর ভয়ে। ছোটমা কি জানে যে তার একমাত্র পুত্র দেশ ছেড়ে চলে গেছে? হয়ত জানে না।
ছোটমা আর বাবু বুঝতে পারেন যে আমি নিজেকে বদলে ফেলেছি আর নিজেকে পড়াশুনায় ডুবিয়ে দিয়েছি। আমার স্বাধিনতার বেড়ি একটু বেড়ে যায় তারপর থেকে।
শীতকাল চলে যায়। চিতকুলের ভ্রমণের পর প্রায় এক বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের ঘটনা। একদিন আমরা সব বন্ধু বান্ধবী মিলে মেডিকেলের দিকে হেটে যাচ্ছিলাম।
দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা সেই চিঠি টা তুমি নিয়ে নিলে কেন?”
আমি, “সুপ্রতিমদা, যার জন্য সেই চিঠি লিখেছিলাম সে আর দিল্লীতে থাকেনা, সে ব্যাঙ্গালর থাকে।”
দেবব্রত, “একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি কি? সেদিন সেই চিঠি পৌঁছানর ব্যাপারে তোমাকে খুব মরিয়া লাগছিল?”
আমি বুকের বেদনা লুকিয়ে হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “না আমাকে কোন প্রশ্ন করতে পারিস না তুই। আমার বান্ধবীর কাছে লেখা সেই চিঠি আর এই সব মেয়েলি ব্যাপার।”
কি বুঝল দেবব্রত জানিনা। কিন্তু তিস্তা আর দেলিসা আমাদের দেখে ফিকফিক করে হেসে ফেলে।
তিস্তা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “কি গো, কিছু যেন গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে?”
দেবব্রত ওর মাথার ওপরে চাঁটি মেরে বলে, “নিজের মতন সবাইকে ভাবিস কেন বলত?”
দেলিসা, “হুম খুব বেশি ভাব মনে হচ্ছে, এখন থেকেই এত আগলে রাখা।”
দেবব্রত, “শোন, আমি তির্থাঙ্কর নই আর মিতা, তিস্তা নয়। সুতরাং তোরা মুখে কুলুপ এটে থাকলে ভালো হবে।”
আমি বুঝতে পারলাম যে কথার প্রসঙ্গ আমাকে নিয়ে আর সেই প্রসঙ্গ ধিরে ধিরে বিরূপ ধারন করছে। আমি সবাইকে বলি, “আমরা সবাই বন্ধু বান্ধবী, সেই সম্পর্ক যেন আমাদের মধ্যে থাকে আর সেটাই বিবেচ্য। আর যেন এই নিয়ে কোন কথা না হয় আমাদের মধ্যে।”
দেবব্রত সবাইকে বলে, “ভালো ত, এই তোরা সিনেমা দেখতে যাবি?”
রজত, পুশপাঞ্জলি, সঙ্খ সবাই এক মত। আমার সেদিন সিনেমা দেখতে যাওয়ার মন ছিল না। আমি চুপ করে ছিলাম। দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি হল?”
আমি বলি, “না আজকে নয়, অন্য কোনদিন যেতে পারি।”
দেবব্রত, “রবিবার?”
আমি জানালাম যে ছোটমাকে না জানিয়ে আমি কথা দিতে পারছিনা। দেবব্রত, “ঠিক আছে, রবিবার, গ্লোব।”
রজত পুশপাঞ্জলি একসাথে চেঁচিয়ে ওঠে, “এক জনের জন্য কেন সিনেমা দেখা বন্ধ করা হবে?”
তিস্তা আমার মনের কথা বুঝে ফেলে ওদের বলে, “না না, আজ নয়, রবিবার হলে, তির্থাঙ্কর আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে যেতে পারবে।”
দেলিসা ওদের বলে, “ভালো ভালো, তাহলে দানিস কে আমি ডেকে নেব।”
শনিবার রাতে আমি ছোটমাকে রবিবারের সিনেমা দেখার কথা জিজ্ঞেস করি। ছোটমাকে আমাকে সিনেমা দেখতে অনুমতি দিলেন সাথে সাথে সাবধান বানী দিলেন, যেন সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসি। মায়ের মন, সর্বদা যেন চিন্তিত কিন্তু তাও যেন আমি সোনার খাচায় বন্দিনী এক রাজকন্যে। সেই প্রথম বার বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাওয়া। বুকের মাঝে স্বাধীনতার মলয় কিন্তু সেই বাতাসে যেন পরাধীনতার কটু গন্ধ ভেসে আসে মাঝে মাঝে।
রবিবার সকালে তিস্তা আমাকে ফোন করে জানায় যে ও আমাকে নিতে আসবে। আমি ওর কথা শুনে একটু থমকে যাই কেননা ওর সাথে নিশ্চয় তির্থাঙ্কর থাকবে। প্রথম দিনে তির্থাঙ্কর যেরকম ভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল তাতে আমার মনে ওর প্রতি একটু ঘৃণা ভাব জাগে। মন শক্ত করে নিলাম আমি, দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। আমি বাসস্টান্ডে ওদের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বেশ কিছু পরে মারুতি চেপে তির্থাঙ্কর আর তিস্তা এসে পৌঁছায়।
আমাকে দেখে তিস্তা আনন্দে দৌড়ে এসে বলে, “তোমাকে সব কিছুতেই মানিয়ে যায়।”
আমি সেদিন একটা খুব সাধারন গোলাপি রঙের চুরিদার পড়েছিলাম। তিস্তা একটা চাপা গাড় নীল রঙের টপ আর হাল্কা নীল রঙের জিন্স পড়েছিল। তিরথাঙ্করের দিকে তাকিয়ে একটু মাথা নারিয়েছিলাম ভদ্রতার খাতিরে। আমাকে দেখে তির্থাঙ্কর ইশারা করে পেছনের সিটে বসতে বলে। আমি আর তিস্তা পেছনের সিটে বসে পরি।
তিস্তা তির্থাঙ্করের মাথায় চাঁটি মেরে বলে, “একদম পেছনের দিকে দেখবে না, বুঝলে, সোজা গাড়ি চালাও।”
তির্থাঙ্কর, “পেছনের সিটে যদি এত সুন্দরী দুই মহিলা বসে থাকে তাহলে কি করে মন দিয়ে গাড়ি চালাই বল?”
আমি জানতাম যে ওর কথার ছোবল আমার দিকে, তাও আমি চুপ করে থাকি। আমি চুপ করে বসে থাকি আর তিস্তা গল্প শুরু করে, একবার বকতে শুরু করলে তিস্তা যেন আর থামতে চায় না।
আমাকে চুপচাপ দেখে তিস্তা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি হয়েছে বলতো? তুমি এত চুপচাপ কেন?”
আমি মৃদু হেসে বলি, “আমার স্বভাব এইরকম তাই।”
মাথা নাড়ায় তিস্তা, “না না, একদম নয়। সেই পুরানো মিতা যেন নেই, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই মিতা।”
আমি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “আরে বাবা, জগত পরিবর্তনশীল। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝলি না রে।” সবাই আমরা হেসে ফেলি।
গ্লোবে পৌঁছে দেখি দানিস আর দেলিসা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। দানিস কে সেই প্রথম বার দেখলাম। অনেক লম্বা চওড়া ছেলে, প্রায় ছ ফুটের মতন লম্বা, ফর্সা আর দারুন দেখতে। হালকা নীল রঙের জিন্স আর গোলাপি চেক শার্টএ দারুন মানিয়ে ছিল ওকে।
দেলিসা আমকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি আর বদলাবে না। সেই সাদা মাটা কাপড় কিন্তু কত আভিজাত্য আছে তোমার মধ্যে।”
দানিস কে দেখে আমি হাত জোর করে অভিবাদন জানাই। দানিস সেই দেখে হেসে ফেলে। দানিস যেন অন্য মাটির মানুষ, ওর চোখের চাহনি যেন সব ছেলেদের থেকে অনেক আলাদা। আমাকে দেখে হেসে বলে, “প্রনাম করতে নেই আপা।”
আমি বুঝতে পারিনা ও কি বলে আমাকে ডাকল। দেলিসা আমাকে জানিয়ে দিল যে দিদিকে আপা বলে ডাকে। দানিস আমার কাছে এসে বলে, “আপা, আমার বড় আপা দুবাই থাকে। অনেকদিন তাঁর সাথে দেখা হয়নি। তোমাকে দেখতে ঠিক আমার বড় আপার মতন, তাই তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।”
ওর কথা শুনে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। দেলিসা আমার ঝাপসা চোখ দেখে বলে, “আরে চল, সিনেমা দেখি।”
আমি দেলিসা কে বলি, “হ্যাঁ রে, তোর দানিস ত ভারী হ্যান্ডসাম ছেলে। তোদের দুজনকে যেন ভগবান একসাথে বানিয়েছে।”
ওদের দেখে আমার নিজের ভালোবাসার কথা মনে পরে যায়। মনে পরে যায় আমাদের “সিন্ডলারস লিস্ট” সিনেমা দেখতে যাওয়ার ঘটনা। কিছু পরেই পুশপাঞ্জলি আর সঙ্খ এসে পৌঁছে যায়। কিন্তু আমাদের দলের মাথা, দেবব্রতর দেখা নেই। আমি সিনেমার পোস্টার দেখলাম, গ্লোবে সেদিন স্টালনের “ক্লিফহ্যাঙ্গার” চলছিল।
তিস্তা সঙ্খর সাথে পুস্পাঞ্জলিকে দেখে উত্যক্ত করার জন্য বলে, “কিরে তুই আর পুশপাঞ্জলি একসাথে, কি ব্যাপার?”
সঙ্খ এমনিতে চুপচাপ থাকার ছেলে, তাই লাজুক হেসে বলে, “নারে, পুশপাঞ্জলি আমার বাড়ির পাসে থাকে তাই আমরা একসাথে এসেছি।”
আমি পুস্পাঞ্জলিকে রজতের কথা জিজ্ঞেস করাতে একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়, “আমি কি করে জানব ওর কথা।”
দেলিসা আমার কানে কানে এসে বলে, “কিছু জিজ্ঞেস করো না, তেতে আছে মেয়ে। কাল দুজনার মাঝে এক চোট হয়ে গেছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মানে, ওরা কি পস্পরের সাথে…” আমি ওদের ভেতরের খবর জানতাম না যে রজত আর পুশপাঞ্জলির মাঝে প্রেমের খেলা চলছে।
বেশ কিছু পরে লক্ষ করি যে দেবব্রত আর রজত সিগারেট ধরিয়ে আমাদের দিকে হেঁটে আসছে। আমাদের সাথে দানিস আর তিরথাঙ্করকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে, “আজ দেখি সব জামাইদের মেলা, আমরা তাহলে আর খরচ কেন করব, জামাই রা করুক।” ওর কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে, দানিস সবার টিকিট কাটে।
সিনেমা হলে ঢুকে সবাই সিনেমা দেখতে বসে পরে। আমার একদিকে তিস্তা আর তার পাসে তির্থাঙ্কর। আমার অন্য পাসে পুশপাঞ্জলি তাঁর পাশে দেবব্রত, পুশপাঞ্জলি রাগে রজতকে পাশে বসতে দেয়না। সিনেমা শুরু হওয়ার কিছু পরে আমার মনে হল যেন কেউ আমার পিঠে হাত রেখেছে, ঠিক ঘাড়ের খোঁপার নিচে, আঙুল দিয়ে আঁচর কেটে দিচ্ছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি তির্থাঙ্করের হাত, রাগে আমার মাথা জ্বলে ওঠে। চোখে জল চলে আসে, মনে হল যেন ওই আঙুল আমাকে ধর্ষণ করছে। কামুক প্রব্রিতির মানুষ, পাসে ওর প্রেমিকা বসে তাও আমার ওপরে ওর নজর। আমি সামনের দিকে ঝুঁকে যাই।
পুশপাঞ্জলি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে কেন আমি সামনে ঝুঁকে আমি ওকে কিছু বলি না। কিছু পরে পেছনে ফিরে দেখি সেখানে আর তির্থাঙ্করের হাত নেই, তাই আমি আবার সিটে হেলান দিয়ে বসি। কিছু পরে আবার সেই একি ঘটনা, তির্থাঙ্করের হাত আমার পিঠে এসে পরে। আমি রাগে অপমানে কেঁপে উঠি, কিন্তু আবার কিছু না বলে সামনে ঝুঁকে যাই। এবারে দেবব্রত আমাকে লক্ষ্য করে। দেবব্রত পেছনে দেখে যে আমার সিটের ওপরে তির্থাঙ্করের হাত। চুপচাপ পুশপাঞ্জলির পেছন দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার সিটের পেছনে হাত রাখে। আমি বুঝতে পারি যে একটা মারামারি লাগবে এবারে কেননা দেবব্রত খুব গরম মাথার ছেলে।
ঠিক সেই, কিছু পরে আবার তিরথাঙ্কর হাত দিতে চেষ্টা করে আমার পিঠে আর এবারে ওর হাত ধরে ফেলে দেবব্রত। সিনেমা হলের মাঝে দেবব্রত তিরথাঙ্করের দিকে গম্ভির গলায় বলে, “ওঠ সিট ছেড়ে, বাইরে আয় তোর সাথে কথা আছে।”
তিস্তার অগোচরে ওর পিঠের পেছনে যে এত কান্ড ঘটে যায় সেটা তিস্তার খেয়াল নেই। আমার দিকে, দেবব্রতর দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে তিস্তা। তিস্তা জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”
তিরথাঙ্কর অকাঠ মিথ্যে কথা বলে তিস্তা কে, “আরে বাবা, কিছু হয়নি, আমি তোমার পিঠে হাত রাখতে গিয়েছিলাম আর হয়ত মিতার পিঠে হাত লেগে গেছে।”
আমি ওর মিথ্যে কথা শুনে রেগে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরি, “আমি আর সিনেমা দেখব না, আমি বাড়ি যাচ্ছি।”
দেবব্রত গর্জে ওঠে তিরথাঙ্করের দিকে, “এই শুয়রের বাচ্চা, বেড়িয়ে আয় তারপরে তোকে মজা দেখাচ্ছি।”
দানিস দেবব্রতর পাশেই বসে ছিল। দেলিসা আর দানিস আমাকে ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে আমি জানাই যে আমার শরীর খারাপ লাগছে তাই আমি বাড়ি যেতে চাই। দেবব্রত রেগে ফেটে পড়েছিল। তিরথাঙ্করের হাত ধরে সিট থেকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “সেই শুয়োরের বাচ্চা, তুই বের হবি হল থেকে না এখানে তোকে মেরে ফেলব।”
তিস্তা হাঁ করে আমাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
আমি তিস্তাকে বলি, “আমি বাড়ি যাচ্ছি রে, শরীর ভালো লাগছে না।”
আমি হল ছেড়ে বেড়িয়ে আসি। দেবব্রত আর রজত আমার পেছন পেছন হল থেকে বেড়িয়ে আসে। দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু আমি শুধু জানাই যে আমার শরীর ভালো লাগছে না। রাগে অপমানে আমার গাঁ হাত পা কাঁপছিল। চোখে জল এসে গেছিল, আমি ওদের নজর লুকিয়ে চোখের কোল মুছে ফেলি কিন্তু দেবব্রত সেটা লক্ষ্য করে ফেলে। কিছু পরে দেলিসা আর দানিস বেড়িয়ে আসে হল থেকে। দানিস আমাকে সেই এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। দেবব্রত দানিস কে তিরথাঙ্করের আচরনের কথা জানায়, সেই শুনে দানিস রেগে যায়। কিছু পরে তিস্তা পুস্পাঞ্জলিকে সাথে নিয়ে হল থেকে বেড়িয়ে আসে। তিস্তা কে দেখে আমি রাগে ফেটে পরি।
দেবব্রত তিস্তা কে দেখে জোর গলায় বলে ওঠে, “তুই কুত্তা, তোর কুকুরটাকে বেঁধে রাখ না হলে কোন দিন আমার হাতে মারা পড়বে।”
তিস্তা দেবব্রতর কথা শুনে রেগে গিয়ে বলে, “একদম মুখ সামলে কথা বলবি তুই।”
আমি থাকতে না পেরে তিস্তা কে বলি, “ওই জায়গায় তুই থাকলে তোর কেমন লাগত সেটা একবার ভেবে দেখিস।”
তিস্তা বলে, “না না, ও ইচ্ছে করে করেনি, হয়ত হটাত করে হাত লেগে গেছে।”
রাগে আমার ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল, আমি ঠোঁট মুছে ওর দিকে রেগে বলি, “তুই ভালো করে জানিস তুই কাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিস।”
তিস্তা আমার হাত ধরে অনুনয় করে, “প্লিস রাগ কোর না। যদি ও কিছু করে থাকে তাহলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমার কাছে, আমি ওর সাথে কথা বলে নেব এই ব্যাপারে, কিন্তু একটি বার ভেতরে চলো।”
আমার আর সিনেমা দেখার মন ছিল না, আমি ওকে জানাই, “না, আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। আমার ছোটমা আমাকে বলেছিলেন যে, এই জগতে প্রকৃত বন্ধু পাওয়া দুস্কর, তোদের সাথে মেশার আগে আমাকে ভেবে দেখা উচিত ছিল রে।”
আমরা দুজনে বুঝতে পারি যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরেছে। আমি ওর দিকে ব্যাথা ভরা চাহনি নিয়ে তাকাই।
দেলিসা আমাকে বলে, “ছাড় ওর কথা।”
তিস্তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, “তোর স্বভাবের জন্য একদিন তুই পস্তাবি। তোর স্বভাবের জন্য তোর আশেপাশের বন্ধু বান্ধব তোকে ছেড়ে চলে যাবে একদিন।”
দেলিসার কথা শুনে তিস্তা কেঁদে ফেলে।
দানিস আমার কাছে এসে বলে, “আপা, ওকে ছেড়ে দাও। চল আমার বাড়ি চল, আমার বড়দি, তিন বছর হল বাড়ি আসেনি আম্মি তোমাকে দেখে খুব খুশি হবে।”
দেলিসাও আমাকে অনুরধ করে ওর শ্বশুর বাড়ি যেতে।
শ্বেত পাথরের মূর্তি (#02)
আমি বললাম যে আমাকে বাবুর অনুমতি নিতে হবে। আমি ফোন করে বাবুকে জানিয়ে দিলাম যে আমার ফিরতে দেরি হবে। বাবু অনুমতি দিয়ে দিলেন কিন্তু প্রত্যকে স্নেহভরা পিতার মতন মেয়েকে সাবধান করে দিলেন যে আমি যেন সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসি। মাঝে মাঝে ছোটমা আর বাবুকে বুঝতে আমার বড় কষ্ট হত।
হল থেকে বেড়িয়ে এলাম আমরা। তিস্তা হলের সামনে চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
দেবব্রত দানিস কে ওর বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে, দানিস জানায় যে ওর বাড়ি খিদিরপুরে। দেলিসা দেবব্রত কে মজা করে বলে, “তুই আসছিস নাকি আমাদের সাথে? তোকে ত আমরা নেমন্তন্ন করিনি।”
দেবব্রত হেসে উত্তর দেয়, “না রে আমার আজকে আর ভালো লাগছে না, অন্য কোনদিন যাবো।”
আমি দেলিসা আর দানিস ট্যাক্সি চেপে খিদিরপুরের দিকে রওনা দিলাম। যাত্রাপথে আমি দানিসকে জিজ্ঞেস করি যে আমাকে বাড়ি ছেড়ে কে আসবে। দানিস উত্তর দেয় যে ওর দাদার গাড়ি নিয়ে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। বিকেল হয়ে এসেছিল। খিদিরপুরে গাড়ি ঢুকে পরে। একটা ছোটো গলির শেষে ওর বাড়ি। বাড়ির দরজা ছোটো, কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখি বাড়িটা বেশ বড় আর সুন্দর সাজান।
এক মধ্য বয়সি ভদ্রমহিলা এসে দেলিসাকে দেখে খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে। দানিসের মা, নিজের হবু বউমাকে দেখে খুশি। আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপরে দেলিসাকে জিজ্ঞেস করে আমার কথা।
দেলিসা জানায়, “ও শুচিস্মিতা আমার বান্ধবী, আমার সাথে কলেজে পরে।”
আমি ঝুঁকে পা ছুঁয়ে প্রনাম করি, দানিসের মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন, “তোমাকে দেখে আমার সায়মার কথা মনে পরে গেল, সায়মা, দানিসের দিদি, দুবাইয়ে থাকে। অনেক দিন মেয়েকে দেখিনি, শুধু ফোনে কথা হয়, মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে।”
দানিসের মা আমাকে হালিম খেতে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম বার আমি ওই রকম কোন মাংস খাই, মাংসের সাথে দাল দিয়ে তৈরি, একটু মিষ্টি একটু ঝাল, খুব ভালো খেতে। এর মাঝে বাবু ফোন করে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পরে মনে হল যেন দেরি হয়ে যাবে। আমি দানিস কে অনুরধ করি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। বাড়ি ফেরার আগে দানিসের মা আমাকে একটা রুপোর কয়েন দিয়েছিলেন, সেই কয়েনে আল্লহার নাম লেখা ছিল।
পুরো দিনের ঘটনার জন্য আমার মন খুব বিচলিত ছিল, আমার মনের দন্দ আমার মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাতে খাওয়ার সময়ে ছোটমা আমার মুখ দেখে বুঝতে পেরে যান যে আমার সাথে কিছু অঘটন ঘটে গেছে। ছোটমা বার বার জিজ্ঞেস করেন কিন্তু আমি চুপ করে থাকি। খাওয়ার পরে আমার ঘরে ঢুকে ছোটমা আমাকে বলেন, “তোর সাথে কে কি করেছে?”
আমি ছোটমায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যাই, মায়ের চোখ ফাকি দেওয়া যায় না। আমি কেঁদে ফেলি, ছোটমাকে সব ঘটনা জানিয়ে দেই। ছোটমা আমাকে সাবধান করে বলেন, “দেখ মা, তোকে বার বার বলেছিলাম যে এখানে বন্ধু পাওয়া অনেক মুশকিল, এর পর থেকে সাবধানে চলা ফেরা করিস।”
আমি ছোটমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম। ছোটমা আমাকে সান্তনা দিয়ে বলেন, “চিন্তা করিস না, এর পর থেকে মানুষের সাথে একটু বুঝে শুনে মেলামেশা করিস যেন।”
দিন যায়, আমার চারপাশের ছোটো ঢেউ আর যেন আমাকে ছুঁতে পারেনা। আমি এক অন্য শুচিস্মিতা হয়ে গেছিলাম। তিস্তার সাথে আমার ব্যাবধান বেড়ে চলে। সাথে সাথে দেলিসা, পুষ্পাঞ্জলি সবাই তিস্তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।
সামনে হোলি। ঠিক এক বছর আগে আমি কত স্বপ্ন দেখেছিলাম যে পরের হোলি তে ওর সাথে রঙ খেলবো, কিন্তু বিধি বাম। আমি চেয়েছিলাম আমাদের প্রথম হোলি খেলা স্মরণীয় হয়ে থাক, কিন্তু সেদিন আমার জীবনে আসে না। প্রত্যেক দিনের মতন সেদিন আমি সকাল বেলা স্নান সেরে পুজো দিয়ে ছিলাম। ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমার কোন বন্ধু বান্ধবী আসবে কি না। আমি জানাই যে আমার সেই রকম কোন বন্ধু বান্ধবী নেই যে কিনা আমার সাথে রঙ খেলবে। আমি বাবুর পায়ে ছোটমায়ের পায়ে রঙ মাখিয়ে দেই। ছোটমা আদর করে আমাকে আশীর্বাদ করেন। সারাদিন কাজের ছলে কেটে যায়, আমার জীবনের রঙ যেন সাদা আর কালো, আর যেন কোন রঙ আমার জীবনে ছিল না।
পরের দিন কলেজে গেলাম। সবার গায়ে রঙের দাগ। কলেজের বান্ধবীরা আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমার হোলি খেলিনি? আমি জানায় যে আমার রঙ্গে এলারজি আছে তাই আর হোলি খেলিনি। কলেজ শেষে আমি করিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম।
ঠিক সেই সময়ে দেবব্রত এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “সেই প্রথম দিন থেকে তোমাকে লক্ষ করছি, তুমি বাকিদের থেকে অনেক আলাদা। অনেক দিন ভেবেছি তোমাকে তাঁর কারন জিজ্ঞেস করি, কিন্তু প্রতি বার তুমি উত্তর এড়িয়ে চলে যাও।”
আমি ম্লান হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “কিছু নারে বাবা, রঙ্গে আমার এলারজি তাই আমি হোলি খেলিনা।”
দেবব্রত, “আমি হোলির রঙের কথা জিজ্ঞেস করিনি। সেদিন তুমি চিঠি নিয়ে নিলে তারপরে তুমি কেমন যেন হয়ে গেলে।”
আমি ওকে বলি, “আমি চেষ্টা করছি দেবব্রত, সেই শামুকের খোল ছেড়ে বেড়িয়ে আসার জন্য। কিছু দিন আগে আমার বড় বৌদি মারা গেছেন তাই এই বারে আমার হোলি খেলা হয়নি।”
দেবব্রত শয়তানি হেসে বলে, “আমি তোমাকে সেই শামুকের খোল থেকে যদি বের করে নিয়ে আসি?”
হটাত করে আমার মুখের ওপরে আবির মাখিয়ে দেয় দেবব্রত। আমি রেগে যাই ওর আচরনে। না, আমার গায়ে রঙ মাখানোর এক মাত্র অধিকার ওর, ও ছাড়া আমার জীবনে কেউ রঙ আনতে পারেনা।
আমি জোর গলায় ওকে বকে দিয়েছিলাম, “কি করছিস? আমাকে ছেড়ে দে।”
আমার গালে হাত বুলিয়ে দেয়, সারা গালে মাথায় লাল রঙ। চোখ ফেটে জল চলে আসে আমার। দেবব্রত মজা করে বলে, “মিতা, আজ হোলি, সবাই সবাইকে রঙ লাগায়।”
আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম, “প্লিস এই রকম আচরন আর কখন আমার সাথে করবি না।”
আমার কাঁপা গলার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পরে দেবব্রত।
আমার দুচখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার ভেতরে ওই চোখের পেছনে কিছু লুকিয়ে আছে, আমি একদিন সেই মিতার ভেতর থেকে শুচিস্মিতাকে ঠিক বের করে আনব।”
আমি মাথা দোলাই, আমার ভেতরের শুচিস্মিতাকে কেউ বের করে আনতে পারেনা। এই মিতা সেই মিতাই থেকে যাবে যতদিন না ও এসে হাথ ধরে পরীকে টেনে বের করে আনবে। আমি ওকে জিগেছ করেছিলাম, “আমি কি কিছু জিজ্ঞেস করেতে পারি?”
দেবব্রত, “আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি আছি মিতা।”
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা একটা কথা বল আমাকে, তুমি কলেজে থাকতে তিস্তাকে প্রোপস কেন করলে না?”
আমার প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে যায় দেবব্রত। আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে উলটে জিজ্ঞেস করে, “আমি তোমার মুখে এই প্রশ্ন আশা করিনি, আমি ভেবেছিলাম তুমি অন্য কিছু জিজ্ঞেস করবে।”
আমি মাথা নাড়াই, আমি জানতাম দেবব্রত আমার মুখ থেকে কি আশা করেছিল। আমি বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম যে দেবব্রত আমার প্রতি একটু ঝুঁকে পড়েছে। আমি ওকে আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এতই যদি ভালবাসতিস ওকে তাহলে প্রোপস করতে বাঁধা কোথায় ছিল?”
দেবব্রত মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “না সেই সব কথা, অতীত। তিস্তা কোনদিন আমার ভালোবাসা বুঝতে পারেনি। তিস্তা শুধু দেখেছে আমার বন্ধুত্ত।”
আমি জিজ্ঞেস করি, “তাঁর মানে এখন তোর মনের ভেতরে ওর প্রতি একটু ভালোবাসা বেঁচে আছে তাই ত।”
দেবব্রত, “ছাড়ো ওই সব কথা। সেইসব দিন ত আর আমি ফিরে পাবো না। আমি খোলা চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে চলি।”
আমার কাজল কালো দুচখের দিকে অকেন ক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে দেবব্রত। শেষ পর্যন্ত আমার কাছে ওর আচরনের জন্য ক্ষমা চেয়ে মুখ ধুয়ে নিতে বলে। আমি মুখ ধুয়ে নিয়েছিলাম, আমার দেহে ওর রঙ ছাড়া আর কারো রঙ দেবার অধিকার নেই।
বসন্ত শেষে গ্রীষ্ম কাল এসে দাঁড়ায় আমার দোরগোরায়। আমি একা একা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে রোজ হেঁটে যাই, সাথে কেউ নাই। তপ্ত বালুচর পায়ের তলায়, মাথার ওপরে একটু ছায়া নেই। ঠিক এক বছর আগে আমি কোলকাতার বাড়িতে এসেছিলাম, ওর বন্ধনের মাঝে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম। ছোটমায়ের সাথে সেই যে আসা, সেই দিন আমি ভাবিনি যে কয়েক মাস পরেই আমাদের জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, ভেঙ্গে পড়ে যাবে আমাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ।
কলেজ শেষ, আমি একা একা কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের গলি দিয়ে হাটি বাড়ি ফেরার জন্য। চারপাসে অসংখ্য বইয়ের দোকান। একা একা হাঁটতে হাঁটতে সেই কথা মনে পরে যায়, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে যে এখানে কত গুলো বইয়ের দোকান আছে। আমাকে উত্যক্ত করার জন্য উত্তর দিয়েছিল, “আট হাজার, ছয়শ বাইস খানা বইয়ের দোকান।”
আমি ওর কথা বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম এমন বোকা মেয়ে। সেই কথা ভেবে নিজের মনেই হেসে ফেলি আমি।
আনমনে রাস্তা পাড় করতে যাই ঠিক সেই সময়ে কী আমার হাত ধরে টেনে ধরে। আর ঠিক সামনে দিয়ে একটা বাস চলে যায়। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পরি।
দেবব্রত আমাকে জোর গলায় বকে দেয়, “হাঁটার সময়ে মন কোথায়, এখুনি বাসের নিচে পড়তে তুমি।”
আমার সামনে দিয়ে বাস চলে যাওয়ার পরে আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়, হয়ত এখুনি বাসের তলায় পরে মারা যেতাম কিন্তু আমার ভাগ্য যে অত ভালো নয়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে উত্তর দেই, “আমি অত ভাগ্য করে আসিনি রে।”
আমার বাজু ধরে টেনে ফুটপাথে উঠিয়ে আমাকে বলে, “আজ আমি তোমাকে ছারব না, তোমার সব কথা শুনতে চাই আমি।”
আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কি জানতে চাস তুই? তোর কাছে আমার বলার কিছুই নেই। কেন আমাকে একা ছেড়ে দিতে পারিস না।”
আমার বাজু ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলে, “আমি কি তোমার কেউ নই, এমন কি একটা ভালো বন্ধুও না?”
আমি ওকে বলেছিলাম, “দেখ দেবব্রত, তুই আমার ভালো বন্ধু, কিন্তু তাও আমি বলছি যে তোকে আমার বলার কিছু নেই।”
আমার দিকে ব্যাথিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। আমি আমার বুকের বেদনা লুকানোর জন্য ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনা। ফাঁকা বুকে বেজে ওঠে কান্নার সুর, সেই বেদনা বুকে ছাড়িয়ে চোখে চলে আসে, আমি নজর লুকিয়ে চোখের জল মুছে ফেলি। গভীর শ্বাস টেনে সেই ফাঁকা বুক ভরে নিতে আপ্রান চেষ্টা করি আমি। আমি দিনে দিনে বুঝতে পারি যে দেবব্রত আমার প্রতি আকৃষ্ট হয় যায়।
প্রতিপদে আমার ম্লান ঠোঁটে হাসি ফোটানোর আপ্রান চেষ্টা করে কিন্তু আমার ভাঙ্গা বুকে কারুর জন্য কোন জায়গা নেই। আমি নিজেকে সেই সব হাতছানির থেকে দুরে সরিয়ে রাখি, চারদিকে উঁচু দেওয়াল তুলে নিজেকে ভালোবাসার হাতছানি থেকে দুরে করে নিয়েছিলাম। বুকের মাঝে পুরানো ভালোবাসা ছাড়া কোন নতুন কাউকে আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবতে পারিনা আমি।
মে মাসের একদিন, গরমের ছুটির কয়েক দিন আগের ঘটনা। আমি এক রাতে, অনেক সাহস সঞ্চয় করে সুপ্রতিমদাকে ফোন করেছিলাম। বুকের মাঝে এক আশা বেঁধে, যদি ও সুপ্রতিমদাকে ফোন করে কিছু জানিয়ে থাকে, সেই ভেবে। রিতিকা আমার ফোনের উত্তর দিয়েছিল।
রিতিকা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি খবর? আমি খবর পেলাম যে তোমার নাকি বিয়ে?”
ওর কথা শুনে প্রায় চেঁচিয়ে উঠি আমি, “না, মিথ্যে কথা, বাবু তোমাদের দুরে রাখার জন্য সেই খবর ছড়িয়েছে।”
আমি বুকের মাঝে শক্তি সঞ্চয় করে দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ও কি ফোন করেছিল? কিছু খবর দিয়েছে?”
রিতিকা, “হ্যাঁ কিছু দিন আগেই ফোন করেছিল। এখন ও ইস্রায়েলে।”
আমার বুকের মাঝে যেন হাজার ঘোড়ার দৌরের শব্ধ ছনা যায়, আমার গলা ধরে আসে আমি জিজ্ঞেস করি, “আর কি বলেছে ও?”
আমি ঠোঁট চেপে ধরি, চোখে বুজে থাকি ওর খবর পাওয়ার আশায়।
রিতিকা জানায়, “ও জানিয়েছে যে তোমাকে কিছু করে হোক খবর পাঠাবে। একবার তোমার ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিল, কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতে পারেনি, এবারে ও অন্য কিছু করে তোমার সাথে সম্পর্ক করবে। পরের বার যদি আমাকে ফোন করে তাহলে আমি তোমার ফোন নাম্বার দিয়ে দেব আমি।”
রিতিকার কথা শুনে আমার চোখে জল চলে এসেছিল। আমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত জিতে গেল, আমার ওপরে বিশ্বাস হারায়নি তাহলে, বাবুর কথা তাহলে ও বিশ্বাস করেনি।
রিতিকা আমাকে বলে, “পরী কাঁদে না। তোমার বাবুর কথা ও এক বিন্দু বিশ্বাস করেনি। কিন্তু যাওয়ার সময়ে খুব ভারাক্রান্ত মনে দেশ ছেড়ে গেছে। পরী একবার ওর দিক ভেবে দেখ, তোমার বাবু এত বড় দুঃসংবাদ জানালে ও আর কি করতে পারে বলো? ইস্রায়েল থেকে একবার মাত্র ফোন করেছিল অভি, জানিনা আবার কবে ফোন করবে।”
আমি ফোনে চুমু খেয়ে ওকে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ রিতিকা।”
ওর কথা আরও জানতে ইচ্ছে করছিল তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা একটা কথা বলতে পার আমাকে, ও এখন কি করে?”
রিতিকা, “ও এখন একটা আইটি কম্পানিতে চাকরি করছে। সেই কম্পানি থেকে ওকে কাজের সুত্রে বাইরে পাঠিয়েছে। খুব খাটতে পারে তোমার অভিমন্যু, অনেক বড় হবে দিনে দিনে।”
রিতিকার কাছে ওর সংবাদ পেয়ে ফাঁকা বুকের মাঝে যেন শীতল হাওয়া বয়ে যায়। মন যেন পেখম তোলা ময়ুরের মতন নেচে ওঠে। আমি চোখ খুলে দেখি যে ও আমার সামনে দু হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আমি দৌড়ে ওর কোলে গিয়ে মাথা রেখে শুয়ে পরি।
আমি সুন্দর স্বর্গোদ্যানে একা একা ঘাসের বাগানের মাঝে ঘুরে বেড়াই। আমার চারপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। আকাশে বাতাসে গোলাপের গন্ধ, পায়ের তলার ঘাস শিশিরে ভেজা। গাছের ডালে ছোটো ছোটো পাখীর অতি মুধুর সঙ্গিত মৃদু মলয় কে মুখরিত করে তোলে। সেই বাগানের মাঝে একটা সাদা ঘোড়া আমার দিকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসে। আমার পরনে দুধ সাদা মখমলের পোশাক, মাথায় ফুলের মুকুট, হাথে ফুলের চুড়ি। আমার মাথার লম্বা ঘন কালো চুল বাতাসে ওড়ে।
আমার পিঠের পেছনে ঝিল্লি সুতোর বোনা বিশাল রঙ্গিন পাখা। আমি উড়তে চেষ্টা করি, প্রানপন শক্তি দিয়ে পাখা মেলে ধরি। কিন্তু কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে মাটির সাথে টেনে ধরে থাকে। আমি পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি যে আমার পায়ে ঘাসের দড়ির বেড়ি বাঁধা। সেই দুধ সাদা ঘোড়া আমার দিকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসে। আমি সেই সাদা ঘোড়ার কাছে কাতর মিনতি করে বলি আমাকে ঘাসের বেড়ি থেকে মুক্ত করতে। আমি চেঁচিয়ে উঠে বলি, “সাদা ঘোড়া, আমাকে ছাড়িয়ে দাও, আমি তোমার সাথে উড়ে যেতে চাই।”
চিৎকারে নিজের ঘুম ভেঙ্গে যায়, বুকের মাঝে উত্তাল ঢেউ বয়ে চলে। আমি যে একটা স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম এতক্ষণ। আমি আবার চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের শেষ দেখতে চেষ্টা করি, কিন্তু সেই স্বপ্ন হারিয়ে যায় খোলা চোখের আড়ালে।
ছোটমা আমার চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে আমার দরজা ধক্কা দেয়, “সোনা মা কি হয়েছে?”
আমি হাঁপাচ্ছিলাম, আমি উড়তে পারছিলাম না কিছুতেই। ছোটমায়ের গলার আওয়াজ শুনে যেন বুকে শান্তি ফিরে আসে। আমি দরজা খুলে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে বলি, “কিছু না ছোটমা আমি একটা স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
ছোটমা আঁচল দিয়ে আমার মুখ, কপাল মুছিয়ে দেন। ঘুম জড়ানো চোখের মাঝেও ছোটমায়ের স্নেহ ভালোবাসা যেন কমে না। আমাকে বলেন, “তোকে কত বার বলেছি দরজা খুলে শুতে।”
সকালের আলো জানালার কাছে এসে যায়।
আমি আবার বিছানায় শুয়ে সকালের সেই স্বপ্নের কথা ভাবতে চেষ্টা করি। স্বপ্নের মানে বুঝতে পেরে আমার সারা গায়ে ভয়ে কাটা দিয়ে ওঠে। আমি শ্বেত পাথরের মূর্তির মতন ঠায় বসে থাকি বিছানার ওপরে, পায়ের কাছে সকালের রোদ খেলা করে। আমি পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, মনে হয় যেন ঘাসের দড়ির বেড়ি আমার পায়ে বাঁধা। পরী উড়ে যেতে চায় প্রাণপণে কিন্তু সেই বেড়ির বাঁধনের ফলে সুন্দরী পরী উড়তে পারেনা। স্বপ্নের শেষ দেখতে পারিনি আমি, জানিনা সেই সাদা ঘোড়া তাঁর ভালোবাসার পরীকে বাঁধন মুক্ত করতে পেরেছিল কিনা। আমি কোনদিন হয়ত জানতে পারবোনা, যে সেই স্বরগদ্যানের পরী শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছিল কি না।
বুকের মাঝের ছোটো হৃদয়, গড়িয়ে যায় ঘাসের মাঠের ওপরে, গড়িয়ে চলে নদীর তীরে, গড়িয়ে চলে পাহাড়ের প্রান্তে, ঢালাও প্রান্তে, কখন উঁচু গাছের উপরে উঠে পরে, কখন নদীর অতল তোলে তলিয়ে যায়। গড়িয়ে চলে আমার ছোটো ব্যাথিত হৃদয়, থেমে থাকলে যে হৃদয়ে ভাঙ্গন ধরে যাবে সেই ভয়ে।
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।