যখন অর্কের ঘুম ভাঙে তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটার গন্ডি পেরিয়ে বারোটার ঘর ছুঁইছুঁই।বাড়িতে বিয়ের আমেজ বলে কথা।হট্টগোল হবে এটাই তো স্বাভাবিক।মেহেনূরদের বাসার হৈচৈও অর্কদের বাসা থেকে শুনা যাচ্ছে।আত্মীয় স্বজনরা সবাই আসতে শুরু করেছে।এত হৈহল্লার মধ্যেও অর্ক সজাগ হয় নি!অর্কের ঘুম ভাঙে রাওনাফের চিৎকারে।পনেরো মিনিট যাবৎ রাওনাক অর্ককে খুব ভালো করে ডাকছিল।কিন্তু অর্কের যেন তাতে কোনো হেলদোলই নেই।শেষমেশ উপায় না পেয়ে অর্কের কানে কাছে গিয়ে দিলো এক গগনবিদারী চিৎকার।ব্যাস,কাজ হয়ে গেলো।ধরফরিয়ে উঠে বসে অর্ক।বুকে থুথু দিয়ে রাওনাফের দিকে কড়মড় করে তাকিয়ে বাজখাঁই গলায় বললো,
– এই শালা!এমন হনুমানের মতো চেচাচ্ছিস কেন?
– সাবধান অর্ক!কথায় কথায় এমন শালা ডাকবি না।আমি তোর কোন জন্মের শালা লাগি হুম?
রাওনাফ কথাটা বলে চোখ রাঙিয়ে অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে।অর্ক ফোকলা হেসে রাওনাফকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আরে ভাই,এটা তো কথার কথা।তুই আমার শালা হতে যাবি কোন দুঃখে?তুই তো আমার জানেমান!
অর্ক চোখ টিপ দিয়ে শেষের কথাটা বললো।রাওনাফ মুখ গোমড়া করে অর্কের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে থমথমে মুখে বললো,
– হুম সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি!কাল দিন বাদে পরশু আমার বিয়ে।বিয়ের শপিং থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ এখনো পড়ে আছে।এই একদিনে কিভাবে সবটা ম্যানেজ করবো যেই চিন্তায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। অথচ তুই এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস।আবার বলে নাকি আমি ওর জানেমন!ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিস কয়টা বাজে?
অর্ক রাওনাফের উপর থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঠিক বারোটা এক মিনিট বাজে।রাতে ঘুম না হওয়ার কারণে সকালের দিকে চোখটা লেগে এসেছিল।তাই বলে এত দেরি হয়ে যাবে এটা অর্কও ভাবতে পারে বি।চটজলদি বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে অর্ক।শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এসে সোজা ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে সবাই বসে ইভেন্টের লোকজনদের সাথে আলাপ আলোচনা করছে।একপাশে বসে আছে ওর নানু।দৌড়ে গিয়ে নানুকে জড়িয়ে ধরলো অর্ক।উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– বিবিজান তুমি কখন এসেছো?(অর্ক ওর নানুকে বিবিজান বলেই ডাকে)
আমেনা বেগম অর্কের কান ধরে আদুরে গলায় বললো,
– বিবিজানের কোনো খুঁজ খবর রাখিস তুই হুম?সেই সকাল বেলা এসেছি।তোর মা বললো,তুই অনেক রাত করে ঘুমিয়েছিস তাই আর তোকে সজাগ করি নি।
অর্ক চারপাশে চোখ বুলিয়ে আমেনা বেগমের কানে ফিসফিস করে বললো,
– এখন তো তোমার সাহেবের কাছে চলে এসেছো।এবার সাহেবের এত আদর সোহাগ সামলাতে পারবে তো?
– ওরে দুষ্টু!দাড়া তুই!
আমেনা বেগম অর্ককে ধরার জন্য উদ্যত হতেই অর্ক দৌঁড়ে চলে আসে।রাওনাফকে কোথাও দেখতে না পেয়ে রোশনির কাছে জিজ্ঞাস করে জানতে ও ওদের বাড়ি গেছে।শপিংয়ে যাওয়ার জন্য অর্ক রোশনিকে রেডি হতে বলে ও চলে গেলো রাওনাফকে আনতে।অর্ক মেহেনূরদের বাসার গিয়ে ডোরবেল এ চাপ দিতে যাবে তখন দেখলো দরজাটা খোলাই আছে।কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে।অর্ক দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে যাবে ওমনি কেউ চিৎকার দিয়ে উঠে।অর্ক ভরকে গিয়ে উপরে তাকাতেই দেখে কেউ একজন হুড়মুড়িয়ে উপর থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে।অর্ক চটজলদি তাকে ধরে ফেলে।মুখের সামনে কতগুলো আর্টিফিশিয়াল ফুল ধরে রেখেছে।যার কারণে অর্ক ওর মুখ দেখতে পাচ্ছে না।তবে এই মুহুর্তে যে ওর কোলে চেপে আছে, সে যে একজন মেয়ে অর্ক সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।মেহেনূর ভয় পেয়ে গিয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।পরমুহূর্তেই মেহেনূরের মনে হলো ও যেনো হাওয়ায় ভাসছে।মুখের সামনে থেকে ফুলগুলো সড়িয়ে পিটপিটিয়ে চোখ খুলে উপরের দিকে তাকায়।দেখে অর্ক ওর দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে।মেহেনূর চোখ খুলতেই চমকে উঠে অর্ক।নীলাদ্রি এক জোড়া আঁখি ওর দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে।অর্ক এক ধ্যানে মেহেনূরের ওই চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে।কাল রাতেও মেহেনূরের চশমা বিহীন চোখ ব্যালকনিতে দেখেছিল অর্ক।কিন্তু তখন তো এই নীল চোখ দেখে নি ও।মেহেনূরের চোখগুলো অর্কের খুব চেনা চেনা লাগছে।কোথাও দেখেছে ও এই চোখজোড়া।কিন্তু মনে করতে পারছে না।অর্কের মস্তিষ্কের নিউরন গুলো যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।আর এই দিকে অর্ককে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহেনূরের হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।শ্বাস আটকে শক্ত হয়ে আছে মেহনূর।অর্কের কোলে থাকায় মেহেনূরের খুব অস্বস্তি হচ্ছে।আর বেশ লজ্জাও লাগছে।এইভাবে অর্কের কোলে পড়ে যাবে ভাবতে পারে নি ও।তারউপর অর্ক ওইভাবে তাকিয়ে আছে।যেটা মেহেনূরের লজ্জা আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।মেহেনূরের শুকনো একটা ঢোক গিলে মাথা নিচু করে নিয়ে মিনমিনে স্বরে বললো,
– আমাকে নামান।
অর্কের যেন কোনো হুশই নেই।নির্বিকারভাবে এখনো তাকিয়েই রয়েছে মেহেনূরের দিকে।মেহেনূর ফের বললো,
– নামান আমাকে।
এইবার ঘোর কাটে অর্কের।মেহেনূরকে চটজলদি কোল থেকে নামিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
– ঠিক আছো তুমি?কোথাও লাগে নি তো তোমার?
– জ্বি আমি ঠিক আছি।সরি,আসলে আমি বুঝতে পারি নি আমি এইভাবে পড়ে যাবো।
– ইটস ওকে,কিন্তু তুমি উপরে কি করছিলে…..
কথাটা বলতে বলতে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় অর্ক।অর্ক আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে।চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে এ তো এলাহি কান্ড!অলরেডি মেহেনূরদের বাড়ির ভিতরের সব ডেকোরেশন কমপ্লিট।খুব চমৎকার ভাবে ডেকোরেশন করা হয়েছে।বাড়ির রঙের সাথে ফ্লাওয়ার কম্বিনেশনও দারুণ মানিয়েছে।অর্ক ঘুরে ঘুরে এইসব কিছু দেখছে আর ভাবছে এত তাড়াতাড়ি কিভাবে সবটা পসিবল হলো?সবে কাল রাতের বেলায়ই ডেইট ফিক্সড করা হলো আর আজ দুপুর সাড়ে বারোটায় সব কমপ্লিট!এইটুকু সময়ের মধ্যে কিভাবে পসিবল এটা?অর্ক হা করে তাকিয়ে আছে।অর্ককে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাওনাফ গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– কি রে, এইভাবে কি দেখছিস?
অর্ক রাওনাফের দিকে ফিরে বললো,
– এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ডেকোরেশন করে ফেললি?কিভাবে সম্ভব এটা?
অর্কের পুরোকথা শুনার আগেই রাওনাফ মেহেনূরের দিকে তাকায়।মেহেনূর আবার মই বেঁয়ে উপরে উঠে হাতে থাকা অবশিষ্ট ফুলগুলো দরজার উপরের ফ্রেমে ভালো করে লাগিয়ে দিয়েছে।মেহেনূর যখনই মই থেকে নামতে যাবে ঠিক তখনই মইটা হালকা কেঁপে উঠলো।বোন যদি এই মই থেকে পড়ে তাহলে নির্ঘাত হাড়গোড় ভেঙ্গে একাকার হয়ে যাবে।যে ভাইয়ের বিয়ের জন্য এত আয়োজন করছে শেষে সেই ভাইয়ের বিয়ে খেতে হবে হসপিটালের বেডে শুয়ে থেকে।কথাটা ভাবতেই গা শিউরে উঠে রাওনাফের।দৌড়ে গিয়ে মই’টা ধরলো রাওনাফ।এইদিকে অর্ক ওর কথার প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব না পেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে রাওনাফ নেই।ও দরজার কাছে মই ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর মেহেনূর মই বেঁয়ে নামছে।যে মেয়েকে একটু আগেই হাড়গোড় ভেঙ্গে যাওয়ার মতো এক্সিডেন্ট থেকে ও বাঁচালো সেই মেয়েই কিনা মিনিট দুয়েক পড়েই আবার নাচতে নাচতে গিয়ে মইয়ে উঠে পড়লো।অর্কের কেন যেন খুব রাগ হচ্ছে মেহেনূরের উপর।এই মেয়েটা এত ইরেসপন্সিবল কি করে?অর্ক রাগে গজগজ করতে করতে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে মেহেনূরকে কড়াগলায় বললো,
– এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম বড় না।একটু আগেই তো এখান থেকে পড়ে হাড়গোড় সব গুড়া করে ফেলতে।নেহাতই আমি ধরেছিলাম বলে।নয়তো এতক্ষণে হসপিটালের অপারেশন থিয়েটারে থাকতে হতো।এখন আবার উঠেছো এখানে।
অর্কের কথা শুনে রাওনাফ অবাক হয়ে মেহেনূরের দিকে তাকায়।মেহেনূর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফ ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বোনকে বুকের সাথে শক্ত জড়িয়ে ধরলো।মেহেনূরের মাথায় চুমু দিয়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– তোর কোথাও লাগে নি তো বোন।কতবার করে তোকে মানা করছি।তাও শুনছিস না আমার কথা।এখন যদি তোর কিছু হয়ে যেতো?
ভাইয়ের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মিষ্টি একটা হাসি ফিরিয়ে দেয় মেহেনূর।ধীর কন্ঠে বললো,
– কিন্তু কিছু হয় নি তো ভাইয়া!আমি একদম ঠিক আছি দেখ।
মেহেনূর ফের বললো,
– তখন মই থেকে ফুলগুলো লাগাতে পারছিলাম না বলে একটা পা দরজার উপরে রেখেছিলাম।উনি দরজা খোলার জন্য ধাক্কা দিলেন আর দরজাটা একটু নড়ে উঠতেই পা টা স্লিপ করে গিয়েছিল বলে আমি পড়ে গিয়েছিলাম।
রাওনাফ অর্কের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বললো,
– এখন যদি আমার বোনটা পড়ে ব্যাথা পেতো?
অর্ক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।যত দোষ এই নন্দ ঘোষ!একই তো এই মেয়ে ইডিয়েটের মতো দরজা খুলে রেখে তারউপর আবার পা তুলে বসে ছিল।আবার পড়ে যাওয়ার হাত থেকে ওই তো ওকে বাঁচালো!আর এখন, এই মেয়ে ভাইয়ের কাছে ইনিয়েবিনিয়ে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে দোষটা ওর ঘাড়েই দিচ্ছে?এ তো দেখছে ভারী বজ্জাত, শয়তান মেয়ে।অর্ক মেহেনূরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বললো,
– আমার কি দোষ?আমি কি জানতাম তোর বোন দরজা খোলা রেখে ওটার উপর বাদরের মতো ঝুলে দাঁড়িয়ে আছে।
– তাই বলে তুই দেখবি….
– ভাইয়া,তুই শুধু শুধু উনাকে বকছিস কেন?দোষটা তো আমারই ছিল।আমিই তো দরজাটায় পা রেখে কাজ করছিলাম।উনি কিভাবে জানবে আমি দরজায় পারা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।আর উনিই তো আমাকে বাঁচালেন।নয়তো সত্যি সত্যি আমি এখন হসপিটালেই থাকতাম।
মেহেনূর ওর কথাগুলো শেষ করেই ওখান থেকে চলে যায়।অর্ক কপাল কুচকে মেহেনূরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।এই মেয়েটা সব সময় ওর চিন্তা ভাবনা গুলোকে তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেয়।ওকে সব সময়ই ভুল প্রমাণ করে দেয় মেহেনূর।অর্ক মেহেনূরকে যেমনটা ভাবে মেহেনূরের কাছ থেকে অর্ক ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়াটাই পায়।অর্ক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– শুনলি তো এবার?
– সরি!
– ইটস ওকে।আচ্ছা বললি না তো বাড়ির ডেকোরেশনটা কারা করেছে?
– মেহেনূর!
– ও তো চলে গেছে।
– আরে গাধা আমি বললাম মেহেনূরই এইসব করেছে। কালকে রাতে তোরা সবাই চলে যাওয়ার পর এখানকার অনেকজন ইভেন্ট ম্যানেজারের সাথে কথা বলে মেহেনূর।ওদের সাথে কথা বলে যাদেরকে ওর পছন্দ হয়েছে তাদেরকে বলেছে বিয়ের সব ধরনের ডেকোরেশন করে দেওয়ার জন্য।মেহেনূর বলেছে যে বাড়ির ভিতরে আর বাহিরে যেখানে রিসেপশনের আয়োজন করা হবে ওইখানের ডিজাইন সব মেহেনূরই বলে দিবে।উনারা শুধু ওর কথামতো সাজিয়ে দিবে।
অর্ক অবাক হয়ে রাওনাফের কথাগুলো শুনলো।এই মেয়ে এইসব বিষয়েও পারদর্শী?কিভাবে?এতটুকু একটি মেয়ে এইসবের কিই বা বুঝে।অর্ক অবাক স্বরে বললো,
– তোর বোন কি বিদেশে এইসবই করে বেড়ায় নাকি?
অর্কের কথায় রাওনাফ হেসে দিয়ে বলে,
– হ্যাঁ!মেহেনূর হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করছে।তার সাথে ইভেন্টে এই বিষয়গুলোও ও ভালো বুঝে।
– তাই নাকি?
– হুম।আমার বোনের যে আরো কত গুণ আছে সেইসব তোদের ধারণাতেও আসবে না।
এই বোরিং মেয়ের এত গুণ?ভাই তো দেখা যাচ্ছে বোনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ!কি জানি হয়তো ভাই বলেই!অর্ক মনে মনে কথা গুলো আওড়িয়ে বললো,
– আচ্ছা এইসব কথা এখন বাদ দে।আমরা এখন শপিং করতে যাবো।ভাবীকে বলে এসেছি রেডি হওয়ার জন্য।তুইও গিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।
___________________
শপিং করার জন্য সেই দুপুর একটায় বাসা থেকে বের হয়েছিল অর্ক,রাওনাফ,মেহেনূর,রোশনি আর রোশান।এখন বাজে রাতের একটা পঁচিশ।পনেরো মিনিট আগেই সবাই বাসায় ফিরেছে।মোটামুটি সবার জন্য শপিং কমপ্লিট।রাত পেরোতেই রাওনাফ আর রোশনির গায়ে হলুদ।আজকে সারাদিনের মধ্যে দুই বাসার লোকজন তাঁদের গেস্টদের দাওয়াত দেওয়া থেকে শুরু করে বাড়ির সব ডেকোরেশন, লাইটিং, সাউন্ড সিস্টেম সেট করা সব কমপ্লিট করে ফেলেছে।সকালে অনেক কাজ আছে বলে সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে।রোশনি ফোনে রাওনাফের সাথে প্রেমালাপ করছে।যতোই হোক, ওদের বিয়ে বলে কথা।অন্য সবার মতো ঘুমিয়ে পড়াটা সাজে না।বিয়ের আগে রাত জেগে হবু বরের সঙ্গে প্রেম করাটাও অন্যরকম একটা ভালো লাগা, ভালোবাসার বিষয়।রোশানও শুয়ে শুয়ে কারো সাথে চ্যাটিং নিয়ে ব্যস্ত।ক্ষনে ক্ষনেই ম্যাসেঞ্জারের টং টাং শব্দ শুনা যাচ্ছে।
মেহেনূর সারাদিন বাড়িতে ছিল না।অবশ্য শপিংমল থেকে ভিডিও কল দিয়ে সবটা ওই বলে দিয়েছে সবাইকে।তারপরেও সব কাজ ঠিকঠাক মতো হয়েছে কিনা সেটা চেক করে এসে মাত্রই শুয়েছে।সারাদিন অনেক দখল গেছে ওর উপর দিয়ে।শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ওর।তারউপর কাল সারারাত ঘুমায় নি।ক্লান্ত শরীরটা হেলিয়ে দিলো বিছানায়।ঘুমানোর জন্য লম্বা একটা হাই তুলে চোখ বুজতেই দুপুরে অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে ঘটনাটা মেহেনূরের চোখে ঝলঝল করে উঠে।চমকে উঠলো মেহেনূর।ঘুমানোর জন্য ফের চোখ বন্ধ করতেই আবার একই ঘটনা ঘটেছে। যখনই ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করছে তখনই অর্কের সেই ঘোর লাগা চাহনি মেহেনূরের চোখে ভেসে উঠছে।ফলে বার বার আঁতকে উঠছে মেহেনূর।তার সাথে সাথে কেমন অদ্ভুত রকমের অস্বস্তিও হচ্ছে মেহেনূরের। ওর সাথে এর আগে এমনটা কখনো হয় নি।বুকের মধ্যে কেমন যেন চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে ওর।মনগহীনে অন্যরকম এক অনুভূতির অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে হৃদযন্ত্রটি।এই অনুভূতির সাথে মেহেনূর পূর্বপরিচিত নয়।
অন্যদিকে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিং ফ্যান টার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অর্ক।চোখে ভাসছে এক জোড়া নীলাদ্রি চোখ।মেহেনূরের ওই নীলাদ্রি চোখের ভয়ার্ত চাহনির কথা ভাবতেই অর্কের মন শিহরিত হচ্ছে বার বার।আজ শপিংমলেও মেহেনূরের অগোচরে লুকিয়ে সেই চোখ দেখেছে বহুবার!এটা কি অন্যায় নয়?নিজের মনকেই প্রশ্ন করে অর্ক।ওর মনে যে আরেকজনের বাস!আর এখন যে ও অন্যজনের ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে আছে!না না এটা অন্যায়।কিন্তু বেহায়া মন যে ঘুরেফিরে মেহেনূরের দিকেই ছুটে যাচ্ছে ক্রমশ।মেহেনূরের নেশা জড়ানো সেই চোখের চাহনি,ভয়ার্ত মুখটা বার বার ওর মনকে ব্যাকুল করে তুলছে।তবে কি ও কিরণের জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করছে?না!এটা হতে পারে না।আর কিছু ভাবতে পারছে অর্ক।মাথা চেপে ধরে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে।সংরক্ষণে রাখা সিগারেট আর লাইটার নিয়ে চলে যায় ব্যালকনিতে।আঙুলের ফাঁকে সিগারেট রেখে কিছুক্ষণ পর পর মুখে পুরে নিচ্ছে আর মনের সুখে ধোঁয়া উড়াচ্ছে।নেশায় ভোর হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই মনের দরজায় অন্যায় আবদার নিয়ে এসে, কেউ কড়া নাড়বে না!মালিকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে চাইবে না নিশ্চয়ই!
চলবে…