অগোচরে তুমি | পর্ব – ৩

11 Min Read

– এই তোরা আবার এসেছিস?
দরজা খুলে খুন্তি উঁচিয়ে নিয়ে কথাটা বললেন আয়েশা বেগম।কিন্তু সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।খুন্তি উঁচিয়ে রাখা হাতটা চটজলদি নামিয়ে নেন।বিস্মিত হয়ে বললেন,
– মেহেনূর তুমি!
আয়েশা বেগমের রণচণ্ডীর রূপ দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায় মেহেনূর।চোখের চশমাটা ঠিক করে নাক ঘষে এক গাল হেসে বললো,
– জ্বি আন্টি!
– এসো এসো ভেতরে এসো।
মেহেনূরের হাত ধরে কথাটা বললেন আয়েশা বেগম।মেহেনূরের তো আত্মায় পানি নেই।গোল গোল চোখ করে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।কি জানি ঘরে নিয়ে খুন্তি দিয়ে ওকে না আবার পিটিয়ে দেয়!মেহেনূর একটা শুকনো ঢোক গিলে আয়েশা বেগমের হাতটা ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
– আমি এখন যাই আন্টি!পরে আসবো কেমন।
আয়েশা বেগম চোখের রাঙিয়ে বললেন,
– এই মেয়ে চুপ!এখন এসেছো এখন যাবে।পড়ে কেন হুম?
মেহেনূরের চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম।আয়েশা বেগমের হাতের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে।মেহেনূরের ওমন করে তাকিয়ে থাকা দেখে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আয়েশা বেগম নিজের হাতের দিকে তাকান।এতক্ষণে খেয়াল হয় তিনি কি করছেন।হাতে থাকা খুন্তিটা আবার চটজলদি নামিয়ে নিয়ে মুখে হাসি টেনে বললেন,
– আসলে অর্কের জন্য কন্টিনেন্টাল রান্না করছিলাম।দুপুরের খাবার খেয়ে এখন একটু ঘুমাচ্ছে।কিন্তু এনজিওর ছেলে গুলো এসে বার বার ওকে ডিস্টার্ব করছে।বলেছি যে, ছেলেটা অসুস্থ এখন তোদের সাথে খেলবে না তাও কথা শুনছে না!কলিং বেল বাজিয়েই যাচ্ছে।তাই আমি ভাবলাম এখনো হয়তো ওরাই দুষ্টুমি করছে।
মেহেনূর বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ধীর কন্ঠে বলল,
– আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম!
মেহেনূরের কথায় আয়েশা বেগম আশ্বাস দিয়ে বলেন,
– ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।তোমার যতবার ইচ্ছা ততবারই আসবে আমি বলে দিচ্ছি।আসো এখন ভিতরে আসো।
আয়েশা বেগমের কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে ভেতরে গিয়ে বসে মেহেনূর।ওর হাতে থাকা বক্সটা আয়েশা বেগমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
– মা বললো অর্ক ভাইয়া নাকি এক্সিডেন্ট করেছে?এটা উনার জন্য।মা একটু নানুদের বাসায় গেছে তাই আমাকেই আসতে হলো!
আয়েশা বেগম বক্সটা হাতে নিয়ে খুলে দেখেন ওটাতে অর্কের ফেভারিট সাবুদানা দিয়ে আতব চালের পায়েস।আয়েশা বেগম বক্স থেকে পায়েসটা একটা বাটিতে ঢালতে ঢালতে কৃতজ্ঞচিত্তে বললেন,
– ভাবীও না পারেন বটে!অর্ক অসুস্থ হলেই উনি ঠিক বুঝে যান ওর কি মন চায় না চায়।একটু আগেই পায়েসের কথা বলছিল।কিন্তু ঘরে সাবুদানা ছিল না বলে রান্না করতে পারি নি।তোমা….
– মা ও মা!
আয়েশা বেগম অর্কের চিল্লানিতে থেমে যান।মুখের কথাটা শেষ করতে পারলো না।অর্কের গলা পেয়ে মেহেনূর উঠে গিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
– আন্টি,আমি এখন উঠি।
– না!মাত্রই তো এলে!তুমি বসো একটু আমি আসছি।
ওইদিকে অর্ক ননস্টপ ডেকেই চলেছে।আয়েশা বেগম মেহেনূরকে বসতে বলে ছেলের রুমে চলে গেলেন।
– কি হয়েছে?
– রেনুফা আন্টি কিছু পাঠিয়েছে?
কপাল কুঁচকে আসে আয়েশা বেগমের।ছেলে নিশ্চয়ই ফোন করে বলেছে ওর জন্য পায়েস রান্না করে দিতে!কথাটা উনার মাথায় আসতেই মুহূর্তে রাগ উঠে গেলো।শাষানোর ভঙ্গিতে বললেন,
– এটা কোন ধরনের হেংলামো অর্ক?তুই রেনুফা ভাবীকে পায়েস রান্না করে দিতে বললি কেন?
চোখ চকচক করে উঠে অর্কের।শরীরের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে লাফ দিয়ে যেই উঠতে যাবে ওনমি হাতে ব্যাথা অনুভব হওয়ায় আবার শুয়ে পরে।কৌতূহলী স্বরে বললো,
– কি পায়েস?দাঁড়িয়ে আছো কেন?যাও গিয়ে পায়েসটা নিয়ে আসো!
– তার আগে বল তুই উনাকে কেন বললি?
অর্ক মায়ের কথায় নিচু স্বরে বলে,
– আমি তো পায়েসের কথা বলি নি!আন্টিকে শুধু একটা ম্যাসেজ দিয়ে বলেছিলাম,আমি এক্সিডেন্ট করেছি!
আয়েশা বেগম অর্কের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে।ছেলের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না।অর্ক বিছানার শুয়ে থেকে বুকের উপর হাত রেখে আঙুল নাড়াচ্ছে আর ছটফট করছে।আয়েশা বেগম বুঝতে পারছেন পায়েসের আনন্দে ছেলে এক্কেবারে গদগদ হয়ে গেছে।অর্কের দিকে আড় দৃষ্টি রেখে উচ্চস্বরে বলেন,
– মেহেনূর,টেবিলের উপর থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে অর্কের ঘরে আসো তো মা!
কপাল কুচকে আসে অর্কের।মেহেনূর নাম কয়েকবার বাজে ওর কানে।মুখ কালো করে বললো,
– ওই মেয়ে আমাদের বাসায় কি করে?এখন সোজা আমার ঘরে এসে পড়বে!তুমি ওকে চলে যে….
– আন্টি!
অর্ক আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু মেহেনূর চলে আসায় থেমে যায়।মেহেনূর পায়েসের বাটিটা বেড সাইড টেবিলে রেখে অর্কের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে শীতল কণ্ঠে বললো,
– সরি!আমি জানতাম না আমার এই বাসায় আসাতে আপনার অসুবিধা হয়!আসলে নানাভাই একটু অসুস্থ, তাই মা নানুদের বাসায় গেছে।মা বললো পায়েসটা দিয়ে যেতে।আমাদের বাসায় তো আর কাজের বুয়া নেই তাই আমাকেই আসতে হলো।
কথা গুলো শেষ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেহেনূর। পরমুহূর্তেই আয়েশা বেগমের দিকে এগিয়ে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বলে,
– আসি আন্টি,ভালো থাকবেন।
আয়েশা বেগম উৎকন্ঠিত স্বরে বলেন,
– আসলে অর্ক কথাটা ওইভাবে বলতে চা..…
হতাশ চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন আয়েশা বেগম।উনার কথা শেষ করার আগেই মেহেনূর চলে গেছে।চোখ ছলছল করে উঠে উনার।
– মা আমাকে একটু বসিয়ে দাও!
ছেলের কথায় হুশ ফিরে আয়েশা বেগমের।পরমুহূর্তেই মেজাজ গরম হয়ে যায়।নিজেকে সংযত রাখতে চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস ছাড়লেন বারকয়েক।উনি চান না অর্কের খাওয়াটা নষ্ট হোক!কারণ এখন যদি উনি কিছু বলেন তাহলে হয়তো পায়েসটাই অর্কের আর খাওয়া হবে না।ব্যাপারটা নিশ্চয়ই খুব বেশি ভালো হবে না।আয়েশা বেগম চান না মেহেনূরের আনা খাবারটা ফেলে দিয়ে অর্ক মেহেনূরকে আরো অপমানিত করুক!একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে অর্ককে উঠিয়ে বসিয়ে দেন।অর্ক তৃপ্তি সহকারে সম্পূর্ণ পায়েসের বাটিটাই খালি করে দিলো।অর্কের মুখ মুছিয়ে দিয়ে পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে আবার অর্কের সামনে এসে বসে আয়েশা বেগম।গম্ভীরমুখে বলেন,
– ওকে এইভাবে অপমানটা না করলেও পারতি অর্ক!মেয়েটা নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে।মুখের উপর এমন কথা শুনলে যে কারোই কষ্ট পাওয়াই কথা!সেধে এসে কেউ অপমানিত হতে চায় না!ও তো চলেই যেতে চেয়েছিল।আমিই বসতে বলেছিলাম!ওর মা ওকে না বললে ও মোটেও এ বাসায় আসতো না!আজকে কিন্তু মেহেনূর রেওয়াজ করতে ছাদে আসে নি!খেয়াল করেছিস কি?কালকে তোর বলা প্রত্যেকটা কথা ও শুনেছিল!
মায়ের দিকে বিস্ময়ে তাকায় অর্ক।আয়েশা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলেন,
– কালকেও মেহেনূর আমাদের বাসায় এসেছিল।আমি রাওনাফকে দেখতে চেয়েছিলাম।ছেলে কাজে ব্যস্ত থাকে সবসময় ফ্রী থাকে না।মেহেনূরকে বলেছিলাম ও যেন আমাকে একটু রাওনাফের সাথে কথা বলিয়ে দেয়।অনেকদিন দেখি না ছেলেটাকে।কাল সকালে মেহেনূর ড্রয়িং রুমেই ছিল!তুই রাগ নিয়ে বেড়িয়েছিলি বলে হয়তো খেয়াল করিস নি!আমি যখন রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম তখন ওকে দেখতে পাই।আমাকে বুঝতে দেয় নি যে ও তোর আমার সব কথা শুনতে পেয়েছে।কিন্তু আমি ওর চোখ মুখ দেখে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম।বাবা বাবাই হয়!কোনো ছেলে মেয়েই তার বাবার সর্ম্পকে কটুকথা বা অপমান মূলক কথা সহ্য করতে পারে না।কিন্তু মেহেনূর করেছিল!আর করেছিল বলেই হয়তো আজো এসেছিল তোকে ওরই মায়ের হাতের তৈরি পায়েস দিতে!বিনিময়ে কি পেলো? সেই তো অপমানিতই হয়ে গেল!
অর্ক মাথা নিচু করে বসে আছে।মায়ের এত কথার প্রত্যুত্তরে বলার মতো কোনো ভাষাই ও খুঁজে পাচ্ছে না!আয়েশা বেগম তাচ্ছিল্যে হেসে বলেন,
– একসময় আমার ছেলেকে নিয়ে আমার কত গর্ব হত!এখন তো আমার ভাবতেও অবাক লাগে আমার ছেলে কি না এই মন মানসিকতা মানুষ!যারা তোকে এত ভালোবাসে স্নেহ করে, প্রতিদান হিসেবে কি তাদের অপমান প্রাপ্য?
অর্কের মৌনতা বলে দিচ্ছে ওর অনুশোচনা হচ্ছে।আসলেই তো,মেহরাব সাহেব আর রেনুফা বেগম নিজেদের সন্তানদের সব সময় কাছে পান না।অর্ককে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে।অর্কের এখনো মনে আছে ওর বাবার ব্যবসায় অনেক বড় ধরনের লস হয়ে গিয়েছিল।পরিবারের সবার মন খারাপ ছিল।অর্কের মন দ্বিগুণ খারাপ ছিল কারণ ওইদিন ওর তেরোতম বার্থ ডে ছিল।সেদিন মেহরাব সাহেব আর রেনুফা বেগম ওনাদের বাসায় অর্ককে নিয়ে গিয়ে ওর বার্থ ডে টা সেলিব্রেট করেছিল।অনেক অনেক গিফটও দিয়েছিল ওকে।স্মৃতির খাতায় আজো ঝলমল করে উঠে সেই দিনটি।
– ওর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখিস তো একটু!বাবার অপমান নিজের অপমান কতটুকু সহ্য করতে পারিস?
কথাটা শেষ করে দ্রুত পা ফেলে অর্কের ঘর থেকে চলে যায় আয়েশা বেগম।অর্ক আহত দৃষ্টিতে মায়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছে।এখন বড্ড বেশি অনুশোচনা হচ্ছে ওর।নিজের অজান্তেই অনেক বড় অন্যায় করে ফেলে নি তো ও?নিজের মাকেও কষ্ট দিয়েছে ও!মেহেনূর কি ওর বাবাকে কালকের কথাগুলো বলে দিয়েছে?হয়তো বা!তা না হলে আজকে উনি ছাদে আসেন নি কেন?মেহেনূরকে রেওয়াজ করতে বলেন নি কেন?ওকে কি এখন ভুল বুঝবেন?কথা গুলো ভাবতেই শিউরে উঠে অর্ক।হঠাৎ করেই বড্ড বেশি গরম লাগতে শুরু করেছে।হাতরিয়ে এসির রিমোটটা নিয়ে পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়েছে।তবু গরম কমছে না।দম বন্ধ হয়ে আসছে!ছটফট করছে অর্ক।এই মুহূর্তে এই ঘর থেকে বেরুতে না পারলে ও হয়তো মরেই যাবে!মাকে ডাক দেওয়ার সাহস হলো না ওর।নিজেই অনেক কষ্ট করে বিছানা থেকে নেমে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ব্যালকনিতে চলে যায়।প্রকৃতি বাতাসে একটু স্বস্তি খুঁজার আশায়!
__________________
কেটে যায় এক সপ্তাহ।অর্ক এখন আগের মতো সম্পূর্ণ সুস্থ।এই এক সপ্তাহে বদলে গেছে অনেক কিছু।আয়েশা বেগম আর ছেলের সাথে আগের মতো কথা বলেন না।অর্কের কথার প্রত্যুত্তরে শুধু হ্যাঁ না বলে মাথা নাড়ান।মায়ে চোখে বড্ড বেশি ছোট হয়ে গেছে ও!চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পায় না এখন। মেহেনূরও এখন আর ছাদে রেওয়াজ করতে আসে না।মেহরাব সাহেবকেও ইদানীং বেশি বের হতে দেখা যায় না!উনি কি অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছেন?সেদিনের পর থেকে মেহেনূরের ছায়াটাও অর্কের সামনে তো দূর আশে পাশেও দেখা যায় না।নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে অর্কের।আজ ওর জন্য এতগুলো মানুষ আঘাত পেয়েছে খুব গভীর ভাবে!কথাগুলো মনে আসতেই আঁতকে উঠে অর্ক।অজানা ভয় ক্রমশ ওকে গ্রাস করে ফেলছে!এর থেকে মুক্তি পাওয়ার কি কোনো উপায় নেই?তনিমার ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে অর্ক।এনজিওর পাশের পুকুর ঘাটে বসে ছিল অর্ক।তনিমার ডাকে পাশে তাকিয়ে দেখে তনিমা সহ দিহাদ,কলি, অয়ন দাঁড়িয়ে আছে।অর্ক ওদের দিকে তাকাতেই তনিমা কৌতূহলী কন্ঠে বলে,
– অর্ক,আজকে কিরণ চৌধুরীর স্টেজ শো আছে।আমরা সবাই যাচ্ছি তুইও যাবি নাকি আমাদের সাথে?
শেষে কথাটা ভ্রু নাচিয়ে বললো তনিমা।অন্যসময় হলে তনিমার কান মুলে দিতো অর্ক।কিন্তু আজকে তেমন কিছু করলো না।শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শীতল কণ্ঠে বললো,
– ওই একজনই তো আমার সব সমস্যার সমাধান!

চলবে…

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।