অপেক্ষা – মাহা আরাত | পর্ব – ৪৭

16 Min Read

আরহাম রেডি হচ্ছিলেন।ঘড়ি পড়তে পড়তে ব্যস্তভঙ্গিতে আদওয়ার কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে চলে যেতে আবার ফিরে এলেন।তাকে উৎসুক দেখাচ্ছে।আরহাম সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু বলবেন?’

‘উমমম….. উহু,কিছু না।’

‘সিওর?’

‘হুম।’

আরহাম বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলেন, নিচে মাইমুনার সাথে সাক্ষাৎ শেষে বেরোনোর সময় দেখলেন আদওয়া দরজায় সেটে দাঁড়িয়ে আছি।উসখুস করছে কিছু একটা বলতে।আরহাম ঠোঁট চেপে হেসে পুনরায় গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু কি বলবেন?কিছু লাগবে?নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই তো।’

‘উহু কিছু না।’

‘নির্দ্বিধায় বলুন।’

আদওয়া রুমে ডুকে পর্দার আড়াল থেকে বলে,’আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছিলো।আর চকলেট আর আচার।’

‘আনহাইজেনিক।’

গা জ্বালানো শব্দটা বলে আরহাম চলে গেলেন।আদওয়া বের হয়ে দেখে আরহাম চলেই গিয়েছেন।মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে বলে, ‘বোকা!কেন যে মুখফুটে বললাম।লোকটা মুখের ওপর একপ্রকার না করে দিলেন।তাতে কি!আব্বুকে বলবো আমি।আমার জন্য এসব নিয়ে আসতে।যেমনটা কালকে ফুচকা আনিয়ে খেয়েছিলাম!

দুপুরবেলা আরহাম যখন কল দিলেন আদওয়া উনার নাম্বারে চেয়ে ভেংচি কেটে মনে মনে বলল, ‘ধরবো না।ধরবোই না আজ।চালাক লোক।’

রাগ করে উনার নেইম ইডিট করে ‘আনহাইজেনিক’ সেইভ করলো।গাল ফুলিয়ে বিছানার এক কোণায় বসে মনে মনে আরহামের ওপর তীব্র রাগ ঝারছে।অথচ একের পর এক কল আসছেই উনার।না পারতে কল ধরে সালাম দিলো।

উনি উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন?’

‘ভালো।’

‘নামাজ পড়েছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘খেয়েছেন?’

‘না।’

‘কেন?’

‘ইচ্ছে হয়নি।’

‘গাল ফুলিয়ে কথা বলছেন কেন?রেগে আছেন না কি?’

‘নাহ।’

‘মন খারাপ?’

‘নাহ।’

‘আমার কথা মনে পড়ছিলো?’

‘নাহ।’

‘আচ্ছা।’

…..

‘খেয়ে নিন।’

‘মন চাইলে খাবো নাহলে খাবো না।’

‘খাবারের সাথে রাগ করতে নেই।’

‘জানি আমি।’

‘আচ্ছা।রাখি?’

‘ওকে।আসসালামু আলাইকুম।আল্লাহ হাফিজ।’

*****
আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা।বৃষ্টির কারনেই এমন।আসরের নামাজ পড়ে আম্মুর রুমে গিয়ে পানি গরম করে দিয়ে রুমে এসে কাঁথা কম্বল মুড়িয়ে পুনরায় শুয়ে পড়তে নিলেই হঠাৎ চোখ যায় টেবিলে।বেঙ্গলের প্যাকেট দেখে উঠে এগিয়ে গিয়ে খুলতে নিলে দেখে এক ডজন আইসক্রিম।খুশিতে চকমক করে উঠে তার।আচারের চারটে বৈয়াম সহ চকোলেট।খুশিতে সাতপাছ না ভেবেই আইসক্রিমের বক্স খুলে ঝটপট খাওয়া শুরু করলো।খানিক পর ব্লেজার গায়ে জড়াতে জড়াতে রুমে আসলেন আরহাম।ওর বিরতিহীন খাওয়া দেখে বললেন, ‘আইসক্রিম খান।ঠান্ডা লাগুক।তারপর খুক খুক করবেন। বুকে ব্যাথা হবে, কফ হবে।তখন বলবেন না,কষ্ট হচ্ছে।’

আদওয়া এসব কথা কানে না তুলেই বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ।’

আরহাম ওর চোখে স্থির দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘বাপরে!এত রাগ!ফোনের ওপাশ থেকে গরম ধোঁয়া আসছিলো মনে হয়।জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলাম।’

‘তো আপনি বলবেন না যে আনবেন আসার সময়।তাহলে তো শুধু শুধু রাগ করতাম না।’

75★

(১১৫)
‘তো আপনি বলবেন না যে আনবেন আসার সময়।তাহলে তো শুধু শুধু রাগ করতাম না।’

‘আনতাম না কিন্তু বাসায় আসলে তো আমার সাথে তো কথা বলতেন না,গাল ফুলিয়ে থাকতেন।’

আদওয়া এক কৌঠা শেষ করে বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘আমার রাগের দাম আছে বুঝা যায়।’

‘ঠান্ডার সিজনে মানুষ কীভাবে আইসক্রিম খায়’ বলতে বলতে আরহাম উঠে এসে ওর হাত থেকে আইসক্রিমের বক্স নিয়ে ফ্রীজে রেখে লক করে চাবি নিয়ে মায়ের রুমের দিকে চলে গেলেন।

আদওয়া হা করে তাকিয়ে রইলো!কোথায় সে ভেবেছিল,এবার স্ট্রবেরী ফ্লেভার টা টেস্ট করে ভ্যানিলা খাবে,লোকটা তালা মেরে দিলেন?

মনে মনে রাগ ঝেড়ে আচারের বৈয়াম হাতে নিয়ে কমল গায়ে জড়িয়ে খেতে লাগলো।নামাজে যাওয়ার সময় নিশ্চয় শার্ট চেন্জ করে জুব্বা পড়বেন।তখনই নিয়ে আসব চাবিটা।

*****
মধ্যরাত।শ্বাসকষ্ট তীব্র বেড়েছে।ব্রিদেনে কষ্ট হচ্ছে।ঠান্ডায় কমল মুড়িয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সে।গলাতে খুসখুস করছে শুধু।বিকেলে আইসক্রিম খাওয়ার কষ্টটা এখন ঝেঁকে বসেছে।উনার কথা শুনলে এই রাতের বেলা এত কষ্ট পেতে হতো না।কাশি থামছেই না।অথচ ড্রয়ার হাতিয়ে ইনহেলারের খালি প্যাকেটটা অবধি পেলো না সে।জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ায় বুকে ব্যাথা ধরে গিয়েছে।মনে হচ্ছেই,এই শেষ নি:শ্বাস!এরপর আর শ্বাস নেওয়া যাবে না।কাশতে কাশতে মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে এলো আদওয়ার।পুনরায় আগের ভয়টা বেড়ে গেলো আদওয়ার।টিস্যু দিয়ে মুছে আবারে বেডে এসে শুতেই কেমনজানি অস্থির লাগলো ওর।কাশি আটকানোর জন্য মুখ দিয়ে হাত ঢেকে রেখেছে।তাতেও স্বস্তি নেই ওর।ওয়াশরুম থেকে পুনরায় কুলি করে এসে বিছানায় গা লাগাতেই হঠাৎ কটমট শব্দ হলো।ঘরে হালকা আলোর বাতিতে দেখলো,আরহাম দ্রুত এসে ঢুকে কেবিনেটের ড্রয়ার খুঁজছেন।সবগুলো চেক করে খুঁজে পেতেই আদওয়াকে ধরে আধশোয়া করে বাহুতে শোয়ালেন আরহাম।ওর মুখের ভেতর বারকয়েক গ্যাস দিয়ে আস্তে আস্তে উনার উরুতে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।আস্তে আস্তে শান্ত হলো আদওয়া।যেনো পুনরায় প্রাণ ফিরে পেলো।আরহাম অনুভব করলেন,ওর সারা শরীর কাঁপছে।কফ এতো মারাত্মক ভাবে কুপোকাত করে তাকে!

শান্ত হতে বললেন, ‘এখন স্বস্তি লাগছে আদওয়া?’

মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে চোখ বুজে নিলো সে।আরহাম যত্নে এলোকেশী চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিতে দিতে বললেন,’আপনাকে নিষেধ করেছিলাম,আইসক্রিম না খেতে।এখন কত কষ্ট হচ্ছে!আমারই ভুল হয়েছে আপনার অবাধ্য আবদার পূরণ করা।’

আদওয়া হঠাৎ ভাঙ্গাস্বরে বলে উঠলো, ‘আমি যদি আপনার আগে মারা যাই…অতপর লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘আপনি কি কাঁদবেন আমার জন্য?’

‘নেভার সেইড দিস টাইপ ওফ ওয়ার্ড।আই কান্ট টেইক।’

*****
আজকে শুক্রবার।গোসল সেরে ড্রয়িংরুমে আসতেই মাইমুনা বায়না ধরে বলল, ‘ওইদিনের শাস্তি তো বাকি আপনার।ওইদিনের বদলে আজকে আমরা যা চাইবো,যা আবদার করবো মানতে হবে।’

আরহাম ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করে বললেন, ‘কোনদিনের?’

‘ওই যে কুইজে হেরে গিয়েছিলেন।তখন এমন শর্ত ছিলো না?’

‘ওহ।আচ্ছা বলুন কি চান?’

হাফসা হুলস্থুল করে বলে, ‘আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে।এই একটাই শর্ত।’

‘নো।এটা ছাড়া যেকোনো কিছু।’

আদওয়া ফোড়ন কেটে বলল, ‘না আমাদের এটাই কন্ডিশন।এটাই ফাইনাল।’

‘উহু,এমন কোনো আবদার আমি পূরন করতে পারবো না।বাইরে যাওয়া আমার পছন্দ নয়।আই প্রমিস,এর বাইরে যেকোনো আবদার আমি রাখবো আপনাদের।’

তিনজনে গাল ফুলিয়ে আর তাকালো না পর্যন্ত।আরহাম মিনিট পাঁচেক তাদের সামনে বসে নামাজের জন্য তৈরী হতে গেলেন।এতক্ষণে একটাবারও কেউ তাকালোই না।

আরহাম নামাজে গেলে তিনজনে যুক্তি করে,লোকটার সাথে কথাই বলবে না আর।ইগনোর করবে যতক্ষণ পর্যন্ত শর্ত না মানেন।দেখি কতক্ষণ সহ্য করতে পারেন।

বিকেলবেলা~
আসর নামাজ থেকে ফিরে ভাবলেন,মাইমুনাকে নিয়ে বাগানে বেরোবেন।সে উদ্দেশ্যে মাইমুনার রুমে গিয়ে দেখলেন বেলকনিতে সে দৃঢ় মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে।আরহাম গিয়ে পাশে বসলেন,তাও উনার কোনো হেলদোল নেই।আরহাম ডাকলেন,সে মনোযোগ ভেঙে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু বলবেন? কোনো দরকার?’

‘এমনিই আসছি।’

সে নিরুত্তর থেকে পুনরায় বইয়ে মনোযোগ দিলো।আরহাম অবাক হলেন।অন্যসময় হলে সে আরহামকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তো,সব ফেলে উনার সাথে গল্পে সায় দিতো,এখন তাকাচ্ছেন পর্যন্ত না।’

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, ‘আপনি কি বিজি হানি?’

‘হুমম।’

‘একটু সময় কথা বলা যায় না?’

‘খুব সিরিয়াস মোমেন্টে আছি শাহ।’

‘আই মিস ইউ।’

‘হুমম।’

মাইমুনা পাত্তাই দিচ্ছেন না আরহামকে।বেশ রাগ হলো উনার।উঠে বেরিয়ে গেলেন।পথিমধ্যে দেখা হলো আদওয়ার সাথে।সে বিড়াল হাতে নিয়ে ছাদের দিকে উঠছিলো।আরহামও উঠলেন।ভাবলেন, তাঁর সাথে বিকেলের পরিবেশটা উপভোগ করা যাবে।কিন্তু আসার পর থেকে সে তাঁর মিউ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।কোলে নিয়ে চুমু খাচ্ছে,পশম এলোমেলো করছে।রেলিং এ তাকে তুলে হাটাচ্ছে,ফুল এনে কানে গুজে দিচ্ছে।

আরহাম দূর থেকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকে ফলো করছেন।অন্তত আদওয়া এমন না।সে সারাটাদিন আরহামের সাথে একটু ক্ষণের অপেক্ষা করে,অথচ এখন পাত্তাই দিচ্ছে না।আরহাম তাকে পাশে এসে বসতে বললেন অথচ সে অজুহাত দিলো খামাখা।সে তাঁর অভিব্যক্তি দিয়ে আঙ্গুল তুলে বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে অপেক্ষারত মানুষটার প্রয়োজন অনুভব করছে না বরং তাকে লাপাত্তা দেয়া বিড়ালকেই সময় দিতে ব্যস্ত।

মাগরিবের নামাজ পড়ে আম্মুর রুমে গেলেন।অন্তত আম্মু তো সঙ্গ দিবেন।মায়ের কোলে মাথা রাখতেই প্রশান্তি অনুভব করলেন। কিন্তু সেই শান্তি বেশীক্ষণ টিকলো না।মাইমুনা আর আদওয়া এসে তাকে নিয়ে গেলেন গল্প করবে বলে।

আরহাম চুপচাপ বসে রইলেন।সবাই কেমন বদলে যাচ্ছে!সকাল পর্যন্ত তো ঠিকই ছিলো সব।বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন আম্মু ফিরলেন না।মাইমুনার রুমের পাশ দিয়ে যেতে দেখলেন, তারা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।আরহাম নিজের রুমে ফিরলেন।উমায়ের কাপড় গুছিয়ে রাখছে কাবার্ডে।তিনি তাকে হাত ধরে বসিয়ে বললেন, ‘একটু পাশে বসুন।আপনাকে কে বলেছে এসব করতে?’

‘এমনিই।’

‘কিছু অর্ডার দেই খাবারের?’

‘ইচ্ছে করছে না।’

‘টেন্সড কিছু নিয়ে?শরীর ভালো?’

‘হুমম।’

আরহাম তাকে বেলকনিতে নিয়ে গেলেন।কোলে বসিয়ে বললেন, ‘সোনামণি যেদিন পৃথিবীতে আসবে,ওইদিন আপনাদের দূজনকে গিফট দিব।গেস করুন কি দিব?’

‘জানি না।’

‘গেস করুন।’

‘ঘুম পাচ্ছে।’

‘সারা বিকেল ঘুমিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ কিন্তু এখন…

‘বাকিদের মতো আপনিও আমাকে ইগনোর করবেন এখন?আচ্ছা যান।’

হাফসা ফিরে আসলো।সত্যিই ওর খারাপ লাগছে উনাকে হার্ট করতে।কিন্তু কিছুমুহুর্ত তো তো অপেক্ষা করতেই হবে।

******
ডিনারেও যখন তারা রীতিমতো ইগনোর করছিলো তখনও আরহাম বুঝলেন না কি এমন ভুল করেছেন যে জোট বেঁধে তারা এমন করছে।বিষয়টাকে নিতান্ত স্বাভাবিকই মনে করে ঘুমাতে গেলে দেখলেন উমায়েরকে দূপাশ থেকে জড়িয়ে দূজনে শুয়ে আছে।

আরহাম আশ্চর্য হলেন খুব!তিনজনে তিনজনের সঙ্গ ছাড়ছেই না।এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমি কোথায় ঘুমাবো?’

মাইমুনা উত্তর দিলো, ‘আমার রুমে নয়তো আদওয়ার রুমে নয়তো আম্মুর কাছে নয়তো উপরের রুমে।’

‘আজকে কি একসাথে ঘুমাবেন আপনারা?’

‘শুধু আজকে না,এখন থেকে আমার একসাথেই থাকবো।’

‘মানে????’

‘যা শুনেছেন।এখন যান যান ঘুমান গিয়ে।’

‘যাবো না।’

‘তাহলে সোফায় ঘুমান।’

‘না।’

‘তাহলে দাঁড়িয়ে থাকুন।’

‘তো কেন আপনারা আমার ওপর রাগ?এত ইগনোর কেন করছেন সবাই?কি করেছি আমি?’

‘আমাদের কোনো আবদার আপনি রাখেন না।তাই আপনার কোনো কথাও আমরা শুনবো না।’

‘কোন আবদার রাখলাম না?’

‘ঘুরতে নিয়ে যান নি।’

‘ওহহহ তাই?এজন্য এত ইগনোর আমাকে।’

‘হুমমম।’

‘আচ্ছা ভালো।’বলে আরহাম দরজা লাগিয়ে বেরিয়ে গেলেন।তিনজনে হতাশ হলো!আরহাম এতো একরোখা!

*****
পরের দিন নাস্তার টেবিলে তিনজনকে চুপচাপ দেখে আরহাম মনে মনে হাসলেন।নাস্তা শেষ হতে বললেন, ‘রেডি হয়ে নিন।বেরোবো।’

‘কোথায়?’

‘বেড়াতে।’

তিনজনে সমস্বরে বলে উঠে, ‘সত্যি?’

‘জ্বি।’

আম্মু এসে বাঁধা দিয়ে বললেন, ‘হাফসা কোথাও যাবে না।সো,আর কেউও যাবে না।’

তিনজনের অসহায় দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে আরহাম বললেন, ‘আমি টেক কেয়ার করবো আম্মু।অল্প সময় মাএ।’

*****
দীর্ঘ সময় ন্যাচারাল বিউটি পরিদর্শন করে তারা ফিরে এলো একটা পার্কে।গাড়ি পার্ক সিঁড়ি বেয়ে তিনজনকে নিয়ে ঢুকে পড়লেন।বিডি এডোয়ার্ড গার্ডেন্স।একপাশে ছোট ক্রিক বা নালা ঝরঝর শব্দে বয়ে যাচ্ছে।ক্রিককে ঘিরে হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে এদিক- ওদিক ঘোরাঘুরি করছে।নালা এপার-ওপার করবার জন্য সুন্দর কাঠের অর্ধচন্দ্রাকৃতি ব্রিজ রয়েছে।চমৎকার পরিবেশ।পার্কটা এত সুন্দর যে বহু নবদম্পতি বিয়ে সেরে এখানে চলে আসে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করতে। এত সকালে অবশ্য লোকের তেমন আনাগোনা নেই।কয়েকটা পাখি এক প্রাচীন গাছের ডালে বসে একটানা ডেকে যাচ্ছে।

একটু পর পর বেঞ্চ পেতে রাখা আছে। তারই একটাতে তাদেরকে বসতে ইঙ্গিত করলেন আরহাম নিজেও পাশে বসলেন।বেশ কিছুক্ষণ চারিপাশের সৌন্দর্য অবলোকন করতে তারা বায়না ধরলো ট্রেন চড়বে।

দুজনকে আগের সিটে বসিয়ে দিয়ে তিনি আর উমায়ের পিছের সিটে আরাম করে বসে পড়লেন। সামনে দুজনে কলকল করে কথা বলে যাচ্ছে। এক- একবার করে হাসিতে ভেঙে পড়ছে। দেখে ভালো লাগে। এই যে সবকিছুতে সরলভাবে আনন্দ প্রকাশ করা, নিঃসংকোচে উপভোগ করা, এ যেন আরহামের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়। সারাদিন কাটে ব্যস্ততার সাথে, ইন্সটিটিউশন সামলে,বিজনেস সামলে।ওয়ার্কারদের শত কমপ্লেন শুনে, তাদের সমস্যার সমাধান করে। কাজ শেষে ফিরে আসেন বাড়িতে,আবারো সেই একই নিয়ম।মনের মধ্যে অনেকখানি ক্লান্তি জমা হয়ে গেছে, হঠাৎ করে যেন অনুভব করলেন তিনিও।মাঝে মাঝে হয়তো এমন একটা ভ্যাকেশন নেওয়া দরকার।

ট্রেন চলতে শুরু করল। প্রথমে ধীরে ধীরে চললেও আস্তে আস্তে স্পিড পিকাপ করে তীব্রগতি নিল। নকল পাহাড়ের রাস্তা ধরে এঁকেবেঁকে চলতে লাগল-এই ওপরে উঠছে, এই নীচে নামছে। মাঝে মাঝে অন্ধকার টানেলের মধ্যেও ঢুকে পড়ছে। আশপাশের যাত্রীদের চিৎকারে কান পাতা যাচ্ছে না। বেশ খানিকটা সময় ধরে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে চলে অবশেষে ট্রেনটা এসে থেমে পড়ল।বউয়ের আবদারে এখন তাকে বাচ্চাদের ট্রেনেও চলতে হচ্ছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেমে তাদের নামতে সাহায্য করলেন।

ভেতরে গিয়ে খাবার অর্ডার করে অল্প খেয়েই আদওয়া আবার বাচ্চাদের স্পটের দিকে এগিয়ে গেলো।হাফসাকে এসেও হাত ধরে নিয়ে গেলো।

আরহাম আর মাইমুনা অন্যপাশে বসে আছেন।মাইমুনাকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন আরহাম।তখুনি চোখ যায় কর্ণারে।দূজনে বাচ্চাদের রাইডে চড়ছেন।প্রচন্ড হাসি চলে আসলো আরহামের।মাইমুনাকে দেখাতেই সেও হেসে বলে, ‘আপনার বাচ্চা দূই বউ।’

কিছুক্ষন ধরে এক যুবকের দৃষ্টি তাদের দূজনের দিকে স্থির।আদওয়া ইশারায় হাফসাকে সেই দৃশ্য দেখাতেই দূজনে চটপট উঠে এসে আরহামের দূপাশে বসে পড়ে।
ততক্ষণে অপরিচিত আগন্তুক তাদের অনুসরণ করে আসতে দেখে,আরহাম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন।যেনো চোখ দিয়ে শাসাচ্ছেন,বুঝিয়ে দিচ্ছেন এদের দিকে চোখ দিলে চোখ উপড়ে ফেলবেন।একদৃষ্টিতে দূজনকে অনেকক্ষণ ধরেই ফলো করছিলেন আরহাম,আর আদওয়াকে তিনিই ইশারা দিয়েছিলেন।লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে ফিরে গেলো।বুঝতে বাকি রইলো না,এরা তিনজন এই ব্যক্তির বুকিং প্রোপার্টি।

এরপরে যাওয়া হলো সপিং।লেডিস সাইডে ডুকে তারা তাদের ইচ্ছেমতো কেনাকাটা শেষ করলো।ফেরার পথে ভ্যান থেকে জালমুড়ি,আর ঘি চমচম ও খেলো।আসার সময় হাওয়ার মিঠাই ও নিলো।আজকে আরহাম একটুও বাঁধা দিলেন না।পুরো দিনটুকু ছিলো তাদের সাজানো।আম্মু বারবার কল দিচ্ছেন,বাসায় যাওয়ার জন্য।হাফসাকে নিয়ে এতো টেনশন করছেন আম্মু।অথচ সে তিড়িং বিড়িং লাফিয়ে বেড়াচ্ছে,খাচ্ছে, ঘুরছে।খাবার দাবারের আবদার শেষে তাদেরকে গাড়িতে তুলে বাসার উদ্দেশ্যে চললেন।
বাসায় এসে উপস্থিত সদস্যদের দেখে চমকে গেলেন….

76★

(১১৬)
আদওয়ার মা বাবা আসছেন।রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করলেন আরহাম।আদওয়ার খুশিতে চোখমুখ চকচক করছে,আর আড়চোখে সেটাই লক্ষ্য করছিলেন।সন্ধ্যার নাস্তা শেষে ইশার নামাজের জন্য তিনি বেরিয়ে গেলেন।মাকে রুমে এনে উথাল পাতাল কথা বলেই চলেছে আদওয়া।আজকে কোথায় কোথায় ঘুরতে গিয়েছে কি কি খেয়েছে,কি শপিং করেছে!মিসেস সেমু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে।মেয়েকে এমন প্রানোচ্ছল,আনন্দিত দেখে বুঝতে বাকি নেই, মেয়ে ঢের সুখে আছে।সবশেষে ওর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলো আরহামকে নিয়ে।একরাশ কৃতজ্ঞতা এসে ভর করলো মনে।কলিজার টুকরা মেয়েটাকে তাঁরা কত যত্নে রেখেছে।

ওর কথার ঝুড়ি শেষ হতে বললেন, কুরবানির ঈদের পর সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যেতে।আরও কথাবার্তার মাঝে সায়হান এসে আদওয়ার কোলে উঠে বসে রইলো।

******
আজ আদওয়ার মা-বাবাকে দেখে যন্ত্রণায় একদম বুক ফেটে কান্না চলে আসছিলো।তারা কতো ভালোবাসে তাদের মেয়েকে।আমার মা-বাবা থাকলে নিশ্চয়ই আমাকেও দেখতে আসতেন।নেই বলেই উনি কখনো বাবার বাড়ি যেতে আগ্রহ দেখান না।মন খারাপের সাথে অভিমানও গাঢ় হলো হাফসার।জীবনের প্রতিটা ধাপে ধাপে বুঝে এসেছে মা বাবা কত দামি একটা উপহার।ভাবনার মাঝেই আরহাম রুমে আসলেন।লাইট অফ করে এসে শুয়ে নিলেও হাফসা তখনো ঠায় বসে আছে চুপচাপ।জিজ্ঞেস করলেন,

‘কি হলো?

‘তিনটা মাস হলো আমি বাবার বাড়ি যাইনি।’

আরহাম উত্তরে বললেন না কিছু।চুপ দেখে হাফসা বলল,কিছু তো বলুন।’

‘আপনাকে ছাড়া আমি থাকবো কি করে?’

‘আমি কি থাকার কথা বলছি?গিয়ে চলে আসতাম না হয়।বা আপনার কি একদিন ও ছুটি হয়না গিয়ে থাকার?’

‘আই এম সরী।’

হাফসা আহত সুরে বলল,’ আমার মা বাবা নেই বলে আমার যাওয়া হয় না।মা বাবা থাকলে নিশ্চয়ই অনেকবার যেতাম।কোন মেয়ে তিন-চারমাস বাবার বাড়ি না গিয়ে থাকে?মাসে অন্তত একটাবার ও যাওয়া যেতো!’

আরহাম চুপচাপ শুয়ে পড়লেন।এবারও কোনো উত্তর না পেয়ে হাফসা অধৈর্য হলো।বলল, ‘কিছু বললে চুপ থাকেন কেন শুধু? আমার ভালো লাগে না। ‘

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।