বেশ কিছুক্ষণ পর আদওয়ার নিস্তেজ হয়ে যাওয়া শরীরটা নড়ে উঠলো।চোখ খুলে জোরে জোরে শ্বাস নিলো কয়েকবার।আরহাম তাকে তুলে গালে আলতো হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কি হয়েছে আদওয়া?আমাকে বলুন প্লিজ।আমার টেনশন হচ্ছে খুব।’
কাঁপা কাঁপা স্বরে সে বলল, ‘আ্ আমার এমন বমিটিং হয়।স্ সা থে ব্লাড আসে।এরপর বুকে খুব ব্যাথা করে।’
আরহামের অস্থিরতা কমছেই না।হৃদয়ে ঘূর্ণিঝড় বইছে।তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললেন, ‘কেন এমন হয়?’
‘জ্ জানি না।’
‘ডক্টরে গিয়েছিলেন আগে?’
‘গিয়েছিলাম।’
‘কি বলেছিলেন?’
‘কিছু বলেননি।শুধু একটা ক্যপসুল দিতেন।আমি সেটা খেলে অনেকদিন সুস্থ থাকতাম।গত কয়েক দিন হঠাৎ করে আবার শুরু হয়েছে।’
‘কতদিন থেকে এই প্রবলেম?’
‘তিন বছরের মতো।’
আরহামে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্থিরতা লুকোনোর চেষ্টা করলেন।স্বাভাবিক হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা।চিন্তা করবেন না।দূর্বল লাগছে নিশ্চয়ই।আমি খাবার নিয়ে আসি?’
‘ইচ্ছে করছে না।’
‘অল্প খেলে হবে।আপনাকে তো সুস্থ হতে হবে শ্যামাপাখি।’
‘আচ্ছা।’
আরহাম তাকে কাঁথা দিয়ে শুইয়ে ওয়াশরুমের টেপ ছেড়ে পানি ছেড়ে ক্লিন করে নিচে নামলেন।পা যেনো চলছেই না,মাথাটা ভার হয়ে আছে।কেন এমন হচ্ছে!এতটা দূর্বল তো কখনো হইনি আমি।
78★
(১১৮)
বিকেলে আদওয়াকে নিয়ে ডক্টর থেকে ফিরছিলেন আরহাম।অনেকক্ষণ ধরে আরহামকে অন্যমনষ্ক হয়ে ড্রাইভ করতে দেখছিলো আদওয়া।হাসফাঁস করতে করতে প্রশ্ন করেই ফেললো, ‘কিছু নিয়ে টেনশন করছেন?’
আরহাম মিররে চোখ রেখে বললেন, ‘উহু।’
‘আপনার চোখ লাল কেন?’
‘ঘুম কম হয়েছে তাই।’
‘ওহ সরি।আমার জন্য…
‘ইটস ওকে।’
‘শুনুন না!’
‘উমম..
‘বাসার দিকে যান।মা বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’
আরহাম আদওয়ার দিকে দৃষ্টি তুলে বললেন, ‘আপাতত না।শুধু শুধু উনাদের ঝামেলা করার প্রয়োজন নেই।কয়দিন পর একসাথে থেকে আসবেন।’
‘আপনি কি করবেন?’
‘আপনার অপেক্ষা করবো।’
‘আমার সাথে যাবেন না?’
‘যাবো।’
‘থাকবেন না?’
আরহাম হালকা হেসে প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলেন।গ্লাস দিয়ে রাস্তার পাশে শমপাপড়ি দেখে ব্রেক ব্রেক বলে জোরে চিৎকার করতেই আরহাম দ্রুত ব্রেক কষেন।অস্থির হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কোনো সমস্যা? ‘
আরহাম উত্তর পেলেন না।
কিছুক্ষণ পর আদওয়ার স্থির চোখজোড়া শমপাপড়ির পরিচিত সেই দোকান থেকে সরে এলো।আমতা আমতা করে বলল, ‘ক্ কিছু না।ভেবেছিলাম হাওয়াই মিঠাই হয়তো।’
‘তাঁর জন্য এত এবনরমাল বিহ্যাভ করতে হয়?আমি সত্যি ভয় পেয়ে গেছি।’
‘সরি।চলুন।’
গাড়ি চলতে শুরু করলো।আদওয়ার কানে কেবল বাজলো, ‘শমপাপড়ি!শমপাপড়ি!এই নামটা!এই ডাকটা!
******
সন্ধ্যার পর নামাজ থেকে ফিরেই হাফসার রুমে গেলেন।আম্মু কিছু দরকারি কথাবার্তা সারছিলেন।আরহাম দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন।আম্মু বেরোতেই সোফায় গিয়ে পাশ ঘেষে বসে পড়লেন।হাফসা একপলক চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।আরহাম মুখ বাড়িয়ে তাকাতে মাথানিচু করে নিলো।
আরহাম বুঝলেন, উমায়ের রেগে আছেন।কি করে ভাঙ্গাবেন রাগ!
‘হোমাপাখি?’
…….
‘আমার দিকে তাকান না!’
হাফসা চট করে তাকালো।আরহামের দৃষ্টি স্থির হলো, তাঁর গুলুমুলু মসৃণ ত্বকে,ফুলানো গালে,নাকের চকচক করা তিলটায়,লাল ঠোঁটে।ইদানীং আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছেন উমায়ের।’
‘মাশা আল্লাহ।আমার পছন্দ আছে।’
‘তার মানে বিয়ের আগে আমাকে দেখেছিলেন?’
আরহাম ঠোঁট কামড়ে হাসলেন।যাই হোক,কথা ফুটেছে।
‘দেখেছি।’
‘সত্যি? ‘
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে বিয়ের দিন নিকাব খুলে এত ঢং করলেন কেন?’
‘আমি ঢং করেছি?’
‘হ্যাঁ।ওই যে বলেছেন, ইউ লুক লাইক অ্যা বাটারফ্লাই, লুক লাইক এ্যা ফ্লাওয়ার এগুলো কেন বলছিলেন?’
‘রাগ করলে এত মায়া লাগে আপনাকে।’
‘আপনি খুব চতুর লোক।’
‘কালকে আমার শ্বশুর বাড়ি যাবো।’
‘আমি মানা করেছি?যান না।’
‘আপনারও দাওয়াত আছে।’
‘আমি যাবো না।’
‘বাবা আমাকে গেইট থেকে তাড়িয়ে দিবেন উনার মেয়ে না নিয়ে গেলে।’
হাফসা উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘আমাদের বাড়ি যাবেন?’
‘জ্বি।’
‘কতদিন থাকবো?’
‘দুইদিন।’
‘মাএ?এত কম?’
‘কয়েক মাস পর যাবেন উমায়ের।এ সিচুয়েশনে আমি ভরসা পাই না।’
‘আচ্ছা আপনি থাকলে…
‘থাকবো।’
উমায়ের মিষ্টি হাসলো!সেই হাসিতে প্রশান্ত হলো একজোড়া পিপাসার্ত চোখ!
******
পরদিন মাঝপথে সঙ্গী হলো বৃষ্টি।যাএা তখনোও বেশ বাকি।জায়গাটাও নির্জন।আরহামের কাঁধে পড়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলো হাফসা।বৃষ্টির ঝমঝমানিতে চঞ্চল চোখজোড়া তরাক করে খুলে ফেললো।পিট পিট করে চোখ মেলে আরহামের থেকে সরে এসে জানালার পাশ ঘেঁষে বসলো।উনি তখন ড্রাইভারের সাথে কথা বলছিলেন, গাড়ি কোথায় পার্ক করা যায়।
গ্লাস খুলে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুতে গেলেই আরহাম খপ করে হাত ভেতরে নিয়ে গ্লাস লাগিয়ে দিলেন।হাফসা গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো।কিন্তু আরহাম ব্যস্ত ড্রাইভারের সাথে কথোপকথনে।
হাফসা আবারও চুপিচুপি হাত বাড়ালো গ্লাস হালকা নামিয়ে।আরহাম আবারও এগিয়ে এসে হাত এনে গ্লাস লক করে দিলেন।আরহামের কড়াদৃষ্টির নিচে হাফসার চুপসে যাওয়া মুখখানা চাপা পড়ে রইলো।
*****
বৃষ্টি যখন থামলো পরিবেশ তখনো ঘোলাটে।বেরিয়েছিলেন,যোহরের নামাজ পড়ে।আসরের আগেই পৌঁছার কথা ছিলো। কিন্তু এখন সময় আসরের।
রাস্তাটা প্রায় জঙ্গলের মাঝ দিয়ে।চারিপাশের ভয়াবহ নির্জন পরিবেশে চোখ বুলাতেই হাফসা আঁতকে উঠলো।আরহামের পাশ ঘেঁষে এসে বসতেই আরহাম হাত বাড়িয়ে তাকে আগলে নিলেন।আব্বুর সাথে ফোনকল শেষে তিনি বললেন, ‘ওদিকে আর না এগোই?বাসার দিকে ফিরি?বাসায় সবাই টেনশন করছেন উমায়ের।’
হাফসা অসহায়দৃষ্টিতে তাকালো।
ড্রাইভার বললেন, ‘বাসার দিকে ফিরার মতো অয়েল নেই।’
‘কোনোভাবেই যাওয়া যাবে না বাড়িতে?ঘন্টাদেড়েকের রাস্তা তো মাএ।’
‘কিন্তু উমায়ের এখন শুধু পাহাড়ি এলাকা…
হাফসার অসহায়দৃষ্টিতে চোখ রেখে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি রান করুন।মাগরিবের আগেই যেনো পৌঁছা যায়।’
*****
কিন্তু ফিরা হলো না।আরেকটু এগোলেই আবারও ঝুম বৃষ্টি পড়ে।এমন বাজে সিচুয়েশনে দূর থেকে প্রদীপের একটু আলো যেনো বিস্তর ভরসা।
কথামতো এগিয়ে যাওয়া হলো সেদিক।এদিকে দূপক্ষের টেনশনের শেষ নেই।এসে দেখলেন,বৃদ্ধ এক দম্পতির বসবাস।সাহায্য চাইলে,প্রথমে না মানলেও পরে আশ্রয় দিলেন।কিন্তু আরহাম ভেতরে ভেতরে অশান্তিতে ভুগলেন।অপরিচিত কাউকে বিশ্বাস করে রাত কাটানো কি ঠিক হবে!
তাদের শেষমেশ আশ্রয় হলো এই কুঠিরেই।টিনের চাল গুলো খঁসে পড়ার উপক্রম।কোনোমতে বৃষ্টির জলকে বাঁধা দিচ্ছে।নির্জন জায়গায় এ বাড়িটা আরো কয়েকবার চোখে পড়লেও এখানে মানুষের বসবাস সেটা কল্পনাতীত ছিলো।
রাত বাড়ছে।থাকার জন্য আশ্রয় দিলেন বটে,কিন্তু পেটের খিদে জোড় বেড়েছে।আরহাম চুপচাপ থাকলেও হাফসার ছটফটানি সহ্য হলো না।
ফ্লাশ জ্বালিয়ে একটু দূরের টিনে ঢাকা ছাউনির দিকে এগিয়ে গেলেন।বৃদ্ধা তখন সব সেরে মাএ বেরোচ্ছিলেন।আরহাম কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেন।তবুও বললেন, ‘কিছু খাবার হবে?’
বৃদ্ধা জানতে চাইলেন, সবাই কি অভুক্ত?’
‘দূজনের খাবার কোনোমতে হলে হবে।শুধু রাতটুকুর জন্য।ভোরের আলো ফুটলেই বেরিয়ে পড়বো।’
‘তোমরা তো তিনজন।গাড়ির ভেতরে একজন না?’
‘আমার লাগবে না।উনারা দূজনের জন্য….’
তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘বউরে পাঠায়া দেও।ব্যবস্থা করতেছি।’
****
হাফসা হাতে হাত লাগিয়ে উনাকে সাহায্য করলো।উপরে গাঢ়ী পলিথিন।বৃষ্টির শব্দ শুনা যাচ্ছেই।আরহাম বারান্দার টুল থেকে ছাউনির দিকে তাকিয়ে রইলেন।যেনো,আড়াল হলেই প্রিয়তমাকে হারিয়ে ফেলবেন।
আজকে রাতের ভোজ হলো তিনটে ডিম ভাজির সাথে নাম না জানা এক শাকের,সাথে মরিচ।
নাদূস নুদুস করে মরিচটা নিজের পাতেই তুলে নিচ্ছিলো,আরহাম প্লেট থেকে মরিচ টা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন।একই প্লেটে সাধারণ এ আহারের মাঝে অমৃতের মতো স্বাদ খুঁজে পেলেন।ড্রাইভারও তৃপ্তি ভরে খেয়ে গাড়িতে ঘুমাতে গেলেন।
রাত বাড়তে লাগল। ঝিঁঝি পোকা ডাকতে থাকে। বাতাসে হালকা সুবাস ভেসে আছে কোনো নাম না-জানা ফুলের।
পুরনো ধাঁচের বাড়ি।টিনের জল টপটপ করে মাটি ছুঁইছে।টিনের ঘরে বৃষ্টির ঝুমঝুমানি শব্দ যে কতটা শ্রুতিমধূর প্রথমবারের মতো অনুভব করলেন আরহাম।এতক্ষণের সংশয় ভেঙে বৃদ্ধ দম্পতিকে দস্তুরমতো বিশ্বাস করা যায়।ঘরে শীত শীত আবহাওয়া।আব্বু আম্মু,বাবা তিনপক্ষকে ভরসা দিয়ে শান্ত করে আরহাম টিনের বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে দেখলেন, হাফসা গুটিসুটি মেরে নিভু নিভু প্রদীপের আলোয় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘ঠান্ডা লাগছে?’
‘হুমম।’
আরহাম প্রদীপটা এককোনায় রেখে এসে দরজাটা আটকে দিলেন।তাকে ঘুমাতে বলে, শত তালি দেওয়া নকশিকাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে তাকে বুকের সাথে চেপে রইলেন।
উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ রেখে বললেন, ‘যদিও এটা এক্সিডেন্টালি তবুও এত সুন্দর আবহাওয়ার সাথে আমার পরিচয় ছিলো না।’
‘আমার খুব ভালো লেগেছে।এতক্ষণ গরম লাগছিল, চুলার পাশে ছিলাম।’
‘তারা খুব বিনয়ী।’
‘ইসস কালকেও যদি এরকম সারাদিন বৃষ্টি হয়?’
‘জঙ্গলের মধ্যে একা জায়গাটা।ভয় লাগছে না?’
‘উহু।’
‘বানর দেখেও যা হয়েছিলো আপনার।বুঝা যায়।’
‘সেটা তো এমনিই।’
‘হুমম।’
‘শুনুন না।’
‘শুনছি তো।’
‘আপনার সাথে যদি এরকম একটা ঘরে থাকতে পারতাম।ওসব দালানে থেকে এই অনুভূতি পাওয়া যায় না।আমাকে এখানে রেখে যান।কিছুদিন পর পর আসবেন।’
‘ইসসস…শখ!’
‘সত্যি বলছি।’
‘এসে দেখবো আমার টুকটুকে বউ চুরি হয়ে গেছে।’
‘চুরি হবো কেন?’
‘ডাকাত আছে।’
হাফসার সব সাহস গুড়িয়ে গেলো।কাঁথা টা মুখ পর্যন্ত টেনে চোখ বুজে রইলো।আরহাম ওর ভয়ার্ত অবস্থা বুঝে হেসে বললেন, ‘ভয় পেতে হবে না।আমি থাকতে আপনাকে কেউ চোখের দেখা দেখতেও পারবে না হোমাপাখি।’
******
ভোরের যখন আলো ফুটলো দিনটা ঝকঝকে পরিষ্কার।মৃদুমন্দ বৈরী বাতাসের সাথে ধোঁয়া উঠা গরম চা অলস শরীরকে একদম চাঙ্গা করে দিলো।
আরহাম বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।কিন্তু হাফসার যাওয়ার কোনো হেলদোল নেই।দূর থেকে দেখলেন, ছাউনির ভিতর বৃদ্ধার সাথে কলকলিয়ে গল্প করেই যাচ্ছে।আরহাম এসে বললেন, ‘এখন আসুন।বেরোবো আমরা।’
সে জিদ ধরে বলল, ‘আমি এখন যাবো না।সবে সকাল হলো।’
‘বাবা টেনশন করছেন।সারারাত উনিও ঘুমাননি।কতবার ফোন দিয়েছেন।ফিরে গেলেই তো তাদের টেনশন..
‘বলুন না আমরা বেশ আছি এখানে।একটু রোদ উঠলে এমনিই তো চলে যাবো।থাকবো না কি?’
বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার আহ্লাদ পেয়ে হাফসার যুক্তি আরো জোড়ালো হলো।আরহাম বুঝলেন, এমন পরিবেশে তাকে আর আনা যাবে না।বাড়িঘর ভুলে সংসারটাই ভুলে যাচ্ছে সে।
ফেরার আগে ভাঁপ উঠা গরম ভাতের সাথে মজাদার এক ধরনের চাটনী দিয়ে আহার শেষে বিদায়ের প্রস্তুতি নিলেন।কম সময়েই তাদেরকে আপন লাগছে।আরহাম তাদের একটু সাহায্য করতে চাইলে তারা বেঁকে বসেন।দরিদ্র হলেও আত্মসম্মানবোধ টাটকা।ছেলে হিসেবে ঘর সারানোর বাহানা দিয়ে সাহায্য টুকু করে বললেন, ‘সময় হলেও আবারও কোনো একদিন আসবেন বেড়াতে।’
কম সময় হলেও তাদের সাক্ষাৎ ছিলো দারুণ।বিদায়টাও ছিলো মর্মান্তিক।গাড়িতে উঠেই বাড়ির পথে যাএা শুরু করলেন।পেছনের ফেলে আসা মায়াগুলো একটু হলেও পোড়াচ্ছে!
*****
দূপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যাচ্ছে।আরহাম তখনো ঘুমে।
হাফসা এসে ঠেলতেই ঘুম ছেড়ে উঠে বসলেন,
‘রাতে ঘুমোন নি তাই না?’
‘ঘুমালাম তো।’
‘মিথ্যে কথা।আমাকে পাহারা দিচ্ছিলেন নিশ্চয়ই।কি জানি চুরি হয়ে যাই?’
আরহাম এগিয়ে এসে হাফসার কোল জড়িয়ে শুয়ে বললেন, ‘রাতে কতটা ভয়ে ছিলাম আপনাকে বুঝাতে পারবো না।’
‘কেন কেন?’
‘কিছু না।’
‘কাকামণি খোঁজ করছিলেন আপনার।’
‘হুমম।যাচ্ছি।’
হাফসা বেরিয়ে গেলো।আরহাম তখনও ঠাঁয় তাকিয়ে রইলেন।কি সুন্দর অথচ কি ভয়ঙ্কর একটা রাত পার করেছেন তিনি আর একজনই জানেন!
79★
(১১৯)
ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই হাফসা নাস্তা নিয়ে হাজির হলো।আরহামকে বসতে বলে কাকামণি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনি কেমন আছেন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।বাসার সবাই ভালো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
‘নতুন মামণি ভালো আছে তো?’
আরহাম কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেন আদওয়ার প্রসঙ্গ উঠায়।মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালেন।বললেন,
‘স্ সরি আপনাকে না জানিয়ে…
আরহামের ইতস্ততায় বাবা হেসে ফেললেন।বললেন, ‘তুমি এত গিলটি ফিল করছো কেন?আমার মামণিটা যেখানে খুশি,সেখানে আমার অবজেকশন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
আরহাম স্বস্তির শ্বাস ফেলে একটু সহজ হলেন।বাবার সাথে কথা অব্যাহত চললো।আরহামের ইতস্ততভাব কেটে গেলো।মনে মনে আঁওড়ালেন, সবাই যদি এমন সহজ করে বুঝতো!
*****
বিকেলে তাকে নিয়ে বের হলেন বাইরে।পুকুর পাড়ে বসে তোহফার সাথে গল্প করছে হাফসা।আরহাম একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাকে চোখে চোখ রাখছেন।পূর্বের অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য কিছু কিছু সময় নিজেকেই দোষারোপ করেন আরহাম।একটু সতর্ক হলে,হয়তো বা তেমন হতো না।
হাফসার দিকেই দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে আদওয়াকে কল দিলেন।রিং হওয়ার সাথে সাথেই সে ধরে ফেললো।
চটপট সালাম দিয়েই বলল, ‘শ্বশুরবাড়ি গিয়ে একদম ভুলে গেলেন।’
‘সম্ভব না কি শ্যামাপাখিকে ভুলে থাকা?’
‘তাহলে কল দিলেন না?’
‘ভাবনাতে তো রেখেছি।কি করছেন?’
‘ছাদে বসে আছি একা একা।’
‘আ’ম অন ইউর সাইড, ইমাজিন।’
‘ইমাজিন করলেই কি সত্যি হয়ে যায় না কি?’
‘ইমাজিন আই কিস অন ইউর ফরহেড।’
আদওয়া আর উত্তর দিলো না।লজ্জায় লাল নীল হতে হতে ফোনটা কানে ধরে রইলো চুপচাপ।
‘আমি কি সত্যি কিস করেছি? সাইফিল করলেন কেন?’
‘ক ক্ কেন সাইফিল করবো!’
‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইউ শ্যামাপাখি।দেট মিনস..ইমাজিনেশন ইজ এ্যা বিগ পাওয়ার!’
‘আমাকে শ্যামাপাখি কেন ডাকেন?’
‘ভালোবেসে?’
‘আমি কি ব্ল্যাকবার্ড?’
‘না।’
‘শ্যামাপাখি ট্রান্সলেট করে দেখিয়েন তো।’
‘কি আসে?’
‘ব্ল্যাকবার্ড।’
‘লাভবার্ড আসা উচিত ছিলো।গুগল মে হ্যাভ মেইড অ্যা মিস্টেক।’
‘কবে আসবেন?’
‘খুব শীঘ্রই।মিস ইউ!’
*****
দূদিনের সফর শেষ করে গতকালই বাসায় ফিরলেন।আবহাওয়া বৃষ্টিময়।বর্ষার মুষলধারের বৃষ্টির মতো অনেকটা!
আরহাম বাসায় আসতেই আদওয়া দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে।আরহাম হাসিমুখে সালাম বিনিময় করতে করতে এসে সোফায় বসলেন মাইমুনার পাশেই।সালাম দিয়েও কোনো উত্তর মিললো না উনার থেকে।
কান্নার দমক আটকে রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে মাইমুনা আদওয়ার দিকে তাকালো যখন আদওয়া সযত্নে আরহামের চুল মুছে দিতে ব্যস্ত।মাইমুনা আচমকা সোফায় ভর দিয়ে উঠে রাগে আদওয়াকে ধাক্কা দিয়ে কান্নাসুরে বলতে লাগলেন, ‘এত আহ্লাদ কেন দেখাও?আমার মানুষকে আমি না দিলে তুমার হতেন না।তুমি শাহকে সরিয়েছো আমার থেকে।’
আচমকাই মাইমুনার চিৎকার করে বলা প্রতিটা কথা যেন বাড়ির দেয়ালে পুনরায় প্রতিধ্বনিত হয়ে শুনা যাচ্ছে।আদওয়া স্তব্ধ হয়ে গেল!আরহাম এতক্ষণে মাইমুনার চুপ থাকার কারণ বুঝলেন।মাইমুনা রেগে আদওয়াকে পুনরায় আক্রমণ করতে গেলে পড়ে যেতে নিলে আরহাম ধরে ফেললেন।মাইমুনাকে আটকাতে আদওয়াকে ইশারায় চলে যেতে বললেন।
মাইমুনা তখনও শান্ত হননি।বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে।আরহাম উনাকে ধরে সোফায় বসিয়ে শান্ত করতে করতে বললেন, ‘শান্ত হোও হানি।কেউ আমাকে নেয়নি।আমি আপনার।পায়ে ব্যথা পাবেন একটু শান্ত হোন প্লিজ।’
নিজেকে ছাড়াতে অনেক জোরাজোরি আর কান্নার দকলের পর মাইমুনা শান্ত হলেন।ছোট্ট বিড়ালছানার মতো শাহ এর বুকে পড়ে রইলেন।রুমে এসেছেন তারা।
আরহাম উনাকে জড়িয়ে ধরে আধশোয়া হয়ে আছেন বেডশীটে।বলেই যাচ্ছেন, ‘আমি ভাগ হইনি।আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি তো হানি।আমার ফার্স্ট মুন আপনি না!আমার প্রথম স্পর্শ, ফাস্ট কিস, ফাস্ট লাভ, ফাস্ট হাগ সবই তো আপনি।আমার হৃদয়ে তারা দূজনে মিলে যেটুক জায়গা আপনি একাই ততটুকু।আপনাকে ছাড়া আমি অপূর্ণ তো।আপনাকে ছাড়া তো কিছু ভাবতে পারি না, তবে কেন নিজে একা একা ভুল ভেবে অভিমান করলেন।একা কষ্ট পেলেন কেন?আমাকে বলতেন আমি সময় দিতাম আরও বেশী,আরও ভালোবাসতাম।আমি আপনার নিজের মানুষ না!আমাকে বলতে এত দ্বিধা কোথায়?’
প্রিয়তমের সুমধুর কথার বাণে সব অভিমান, রাগ গলে পড়ে গেলো মাইমুনার।জমা হওয়া বিস্তর অভিমানটুকু ভুলে আবারও হাস্যরসে মেতে উঠলেন উনার সাথে।
আদওয়া আর বের হলো না রুম থেকে।কিন্তু ডিনারের সময় যখন বেরুলো,তার চক্ষুগোলক দেখে আরহামের হৃদয় ব্যথিত হলো।কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে সে।
গাল ফুলিয়ে আরহামের হাত থেকে খাবারও খায়নি।
আরহামও আর ঘাটলেন না।ঘুমোনোর সময় মাইমুনা কে যত্ন করে ঘুম পাড়িয়ে রুমে ফিরলেন তিনি।ছোট্ট বিড়ালছানা তখন গালে হাত দিয়ে সোফার কোণায় ঘুমাচ্ছিলো।আরহাম কোলে নিয়ে বিছানায় নিয়ে আসতেই ঘুম ভেঙে গেলো আদওয়ার।তড়িৎ আরহামের থেকে একহাত দূরে সরে বসলো সে।আরহাম ধরতে গেলে লাগাতার কিল-ঘুষি দিলো।আরহাম সহ্য করলেন।মারতে মারতে শান্ত হলে আরহাম গালে হাত বুলিয়ে দিলেন।এলোচুল গুছিয়ে দিলেন।সরি বললেন খুব করে।কপালে,গালে,চোখে ভালোবাসার স্পর্শ দিলেন।আস্তে আস্তে আদওয়ার কষ্ট মিইয়ে গেলো।লোকটি যেনো ফ্লুইড হয়ে ওর হৃদয়ের ব্যথার দাগ শুষে নিলেন।