খিচুড়ি হাতে দূই শেফ হাজির দেখে হাফসা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কুকার কে?’
‘আপু আগে আপনি টেস্ট করে বলুন কেমন হয়েছে?’
‘ন্ না মানে।রাখো পরে দেখবো।’
‘এখুনি দেখতে হবে।খেয়ে বলুন না প্লিজ।’
‘ইচ্ছে করছে না।’
‘অল্প…
খাওয়া তো দূর মুখে নেওয়ার আগেই হাফসা ছুট লাগায় ওয়াশরুমের দিকে।আরহাম ওয়াশরুমের দিকে এগোতে এগোতে আদওয়াকে বললেন, ‘এটা এখান থেকে নিয়ে যান।রুমে স্প্রে করে দিন স্মেলে প্রবলেম হচ্ছে উনার।’
ফ্রেশ হয়ে বেরাতে দেখলো, আদওয়া গুটিসুটি মেরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। নীরবে নিজের অপরাধ মাথা পেতে নিচ্ছে দেখে হাফসা এগিয়ে এসে বলল, ‘সরি কিউটি। আমার একটু এবনরমাল ফিল হচ্ছিলো, দেটস হুয়াই না করেছি।’
সে হেসে বলল, ‘ডাজন্ট মেটার। সুস্থ হলে, একদিন খাওয়াবো।’
‘ইন শা আল্লাহ।’
আরহামের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার হাতে ব্যান্ডেজ কেন?কি হয়েছে?’
‘নাথিং সিরিয়াস।কি খাবেন বলুন। দূর্বল হয়ে গিয়েছেন একেবারে।’
‘ভাত।’
আরহাম হেসে ফেললেন।সন্তুষ্টচিত্তে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।দিস ইজ ফার্স্ট টাইম,হুয়েন আই এ্যাম স্যাটিসফাইড অন ইউর রিপ্লাই।’
হাফসাকে খাইয়ে দিয়ে যখন রুমে আসলেন আদওয়া বলল, ‘আর কতদিন অপেক্ষা করলে ছোটু টাকে দেখতে পাবো?সময় যেনো শেষ হচ্ছেই না।’
আরহাম মুচকি হাসছেন ওর আক্ষেপে।বাবুর তিন নম্বর আম্মু হয়েও তার এতো তাড়া!তাহলে বাবা হয়ে আরহামের অনুভূতি টা কেমন হতে পারে!
‘তার এতটুক এতটুক হাত পা হবে।লাল লাল গাল থাকবে।এসেই পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাবে!ইসসস কি মায়া লাগবে!জানেন, সায়হানকে আমি কত আদর করতাম।বাট এতো তাড়াতাড়ি ও বড় হয়ে গেলো!’
‘তাই?’
‘হুমম।আচ্ছা বাবুর নাম কি রাখবেন?’
‘বাবাটা সুন্দর মতো পৃথিবীতে আসুক,তারপর…..
‘উমার রাখবেন যদি ছেলেবাবু হয়,আর মেয়ে বাবু হলে উমাইজা।সুন্দর না?’
আরহাম আদওয়ার চোখে চোখ রেখে হেসে বললেন, ‘হুমম আপনার মতো।’
******
ঘড়িতে তখন দশটা।বাইরে থেকে একটু আগেই ফিরলেন আরহাম।বাবার সাথে ট্রাভেলসে যেতে হয়েছে।রুমে ফিরে আসতেই ভেতরটা হঠাৎ কেমন করে মোচড় দিয়ে উঠলো।দূই মিনিট স্থির দাঁড়িয়ে থেকে আদওয়া, হাফসার ঘর থেকে আসলেন।একজন খাচ্ছে, আরেকজন নামাজে।তাহলে?আরেক ফুল তো দূরে!
মাইমুনা কল ধরবেন না জেনেও একের পর এক কল দিলেন তাকে।ওপাশের ব্যক্তি একটুও গুরুত্ব দিলেন না।খুব একটু ইচ্ছে হলো,মাইমুনার সাথে কথা বলতে।
হঠাৎ মনে পড়লো, অনেক আগে উনার দাদূর ছোট্ট বাটন ফোনের নাম্বার টা সেইভ করে রেখেছিলেন।সেটা খুঁজে কল লাগাতেই একজোড়া কাঁপা কাঁপা স্বর ভেসে এলো।আরহাম পরিচয় দিলে,তিনি বোধহয় চিনলেন।কুশলাদি বিনিময় শেষে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাইমুনা পাশে আছেন?’
‘একটু আগেই গেলো আমার ওষুধ দিয়ে।’
‘উনি আর আসবে রুমে?’
‘না,আসবে না।ওষুধ তো দিয়ে গেলো।’
‘উনি কেমন আছেন দাদূ?ভালো আছেন তো?’
‘ভালো আছে।’
‘দাদূমণি একটু সুযোগ হবে উনার সাথে কথা বলার?প্লিজ উনি যদি আশেপাশে থাকে,একটু ডাকবেন?’
‘আমি ডেকে আনছি।’
ফোন লাইনে রেখে তিনি মনে হয় বেরিয়ে গেলেন।একটু পরেই ওপাশ থেকে বেশ অসন্তোষ স্বরে ভেসে আসলো, ‘দাদূর ফোনে কল দেয়া বাকি ছিলো আপনার?আমার কিছু বলার নেই।চিঠিতে তো পড়েছেন।’
‘এটা আপনার মত নিয়েই পাঠানো হয়েছে মাইমুনা?’
‘হ্যাঁ।যা জিজ্ঞেস করার, কোর্টে করবেন।’
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কুট কুট করে কেটে গেলো ফোনটা।আরহামের ভেতরের চেপে রাখা যন্ত্রণা টা আরো তেজি হয়ে উঠলো।উনার অপরাধ ‘আদওয়া।’তারা অনুমতি না দিলে তো তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিতেন না।বা এমনও তো নয়,একজনকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে অন্যজনকে আঘাত দিচ্ছেন।সর্বোচ্চ সমতা করার পরও তিনি ব্যর্থ।প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা আপনিও বুঝবেন হানি, যখন আমি থাকবো না!
*****
ডিনার রেডি করেছে আদওয়া।খাবার জন্য ডাকলেই আরহাম বললেন, ‘খিদে নেই।’
বুকের ভেতর অশান্তি চলছে খুব।কিন্তু অশান্তির ওষুধ তো আরো তোপিয়ে তুলছে!হাফসাকে ঘুম পাড়িয়ে চোখেমুখে ভালোবাসা এঁকে অন্ধকারে পাশে বসে রইলেন চুপচাপ।হাফসা এতক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে।আরহাম অনেকক্ষণ বসলেন,অনেকক্ষণ!মাইমুনার বিহ্যাবিওর উনাকে চমকেছে।এত তাড়াতাড়ি বদলে যাওয়া যায়!তিন বছরেরও বেশী সময়ের ভালোবাসাটুকু এত স্বস্তা!
ঘন্টাখানিক পর রুমে ফিরে দেখলেন আদওয়া বালিশ কোলে সোফায় ঘুমে ঢুলছে।আরহাম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এখনো জেগে? ঘুমাননি?’
‘উহু।’
‘কেন?’
‘আপনার অপেক্ষা করছিলাম।’
‘এতক্ষণ?’
‘হুমম।’
‘আমি আসছিলাম না দেখে বুঝতে পারতেন আমি উমায়ের এর ঘরে ঘুমিয়ে গেছি।’
‘আপনি ঘুমানোর আগে তো কপালে চুমু দিয়ে যান।আজ দেন নি,তাই ভেবেছি আপনি জেগে এখনো।’
আরহাম কাছে এসে কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বললেন, ‘এত ভালোবাসা দেখিও না।ব্যাক দেওয়াতে আমি হেরে যাবো।’
‘আজকে আরো অনেক ইসলামিক ঘটনা বলবেন তারপর ঘুমাবো।’
‘চোখের পাতা পড়ে উঠতে চাইছে না,আর আপনি অনেকক্ষণ জেগে থাকবেন?পারবেন না।’
‘পারবো।’
‘আচ্ছা দেখি।’
লাইট অফ করে কাঁথা জড়িয়ে দিলেন গায়ে।তারপর তাকে নিজের বাহুতে আলতো করে শোয়াতে শোয়াতে এক কাফেলার কাহিনি বলতে শুরু করলেন।হজ্জের উদ্দেশ্যেই তাদের ভ্রমণ!উটগুলো মরুভূমি পেরোচ্ছে মক্কার উদ্দেশ্যে।কিন্তু কাফেলা গুলো মক্কায় পৌঁছাতে পারলো না,আদওয়া ঘুমে কাত!আরহাম আধো আলোয় ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।এই তার ঘুমের জোর দেখিয়েছে।কপালে অবিরত স্পর্শ আঁকতে আঁকতে একসময় বুঝলেন, চোখের উষ্ণ বৃষ্টি প্রিয়তমার গাল ছুঁইছে।আরহাম দ্রুত মুছে নিলেন!
একা হলেই অবাধ্য মনটা সব দূর্বলতার কথা মনে করিয়ে দাও।অসময়ের ধেঁয়ে আসা ঝড়গুলোর হিসাব মিলাতে মিলাতে কখন চোখ লেগে আসলো ঠিক নেই।কিন্তু শেষরাতে আদওয়ার অবস্থা দেখে শিরায় শিরায় কাঁপ উঠে গেলো আরহামের।আরহামের বুকে পড়েই ঘুমাচ্ছিলো।আচমকা কয়েকবার কেশে উঠে বসে পড়লো।আরহাম ভ্রু কুঁচকে সদ্য লেগে আসা ঘুমটা ছেড়ে যখন উঠে বসলেন, ফ্লাশের আলোয় আদওয়াকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।নাকমুখ দিয়ে ব্লিডিং শুরু হয়েছে।বুকের ব্যথা ঝেঁকে ধরেছে তাকে।ব্যস্ত হয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে দিয়ে যখন গালে হাত রাখলেন, তখন বুঝলেন গালে পানি।আদওয়া কি কাঁদছেন?শ্যামাপাখির এতো কষ্ট হচ্ছে?
83★
(১২৩)
‘কাঁদছেন কেন আদওয়া?’
কান্নার বাঁধ ভাঙার জন্য উনার আওয়াজই যেনো যথেষ্ট ছিলো।চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়লো আদওয়ার।
হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল ‘আমার এমন কেনো হয়?আমার কি কিছু হয়েছে?ডক্টরের ওষুধে সুস্থ হলাম না কেনো?’
আরহামের গলাটা ভার হয়ে আসলো।ইচ্ছে করলো, আদওয়ার আড়ালে কোথাও গিয়ে ভেতরে ঢেউ তোলা চোখের পানি গুলো ফেলে আসতে।
আদওয়ার মুখ দূহাতের আজলায় নিয়ে বললেন,
‘কিচ্ছু হয় নি আপনার।টেনশন করবেন না।আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন আদওয়া।আল্লাহকে বলুন,আপনাকে সুস্থ করে দিতে।আমি তো সবসময় আপনার জন্য দোয়া করি।’
‘সত্যি সুস্থ হবো তো?ব্লিডিং এর পর অনেক কষ্ট হয়।মনে হয়,এই বুঝি দম বেরিয়ে গেলো।’
‘কিছু হবে না।আমরা সিঙ্গাপুর যাবো না ভিসা চলে আসলে?ওখানে আপনার ভালো ট্রিটমেন্ট নিলে ইন শা আল্লাহ আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।’
আদওয়া মাথায় দূহাত চেপে চোখ বন্ধ করে নিলো।ভাঙ্গা ভাঙা গলায় বলল, ‘ব্রিদেনে খুব কষ্ট হচ্ছে।মাথাব্যথা করছে।কি করলে কমবে?’
আরহাম বেডশীট থেকে নরম বালিশ এনে তাকে আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে বললেন, ‘চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ট্রাই করুন।উঠে ডক্টরে যাবো।আমি মাথা মাসাজ করে দিচ্ছি।’
আদওয়া লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলল, ‘ফ্ ফজরের সময় তো কাছাকাছি।’
‘আপনি ঘুমান।আমি পরে ডেকে দিবো।’
******
নাস্তার জন্য ডাক আসলে আরহামকে দেখে আম্মু চমকে গেলেন।জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?চোখ লাল কেন আরহাম?’
‘ঘুম হয় নি।আব্বু কোথায়?’
‘বাইরে হাঁটতে গিয়েছেন মনে হয়।নাস্তা করবে বসো।’
আরহাম কোনোরুপ উত্তর না দিয়েই বাইরের দিকে হাঁটা ধরলেন।
গেট পেরিয়ে তিনি রোডের দিকে বেরোবেন তখন আরহাম সামনে এসে পথ আটকান।কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গেটের ভেতরে ব্রেন্চে নিয়ে বসিয়ে বলেন, ‘আব্বু আদওয়ার সিকনেস প্রচন্ড বেড়েছে।খুব কষ্ট হচ্ছিলো,আমি সহ্য করতে পারছি না।’
আব্বু চিন্তায় পড়ে গেলেন।বললেন, ‘এখন কি করবে?’
‘ভিসা আসতে কতদিন লাগবে?’
‘মেডিকেল ভিসা তো বেশি সময় নেয় না।শীঘ্রই তারা জানাবে।’
‘আদওয়া সুস্থ হবেন তো আব্বু?আমার এতো ভয় করছে।’
ছেলের দূর্বল কন্ঠ শুনে ভেতরে এক শকড বয়ে গেলো।আরহামকে কখনো এমন ভেঙে পড়তে দেখেন নি।তার বাহুতে হাত রেখে আশ্বাসভরা কন্ঠে বললেন, ‘ইন শা আল্লাহ।তুমি এত ভেঙে পড়ো না।’
*******
হাফসার সাথে মিট করতে গিয়ে সে ধরে ফেললো আবারো কিছু লুকোচ্ছেন আরহাম।বাবার ফিরে আসাটাও কাকতালীয় ছিলো না!খুব জোর অনুরোধ করতেই আর লুকোতে পারলেন না।আদওয়ার অল্প একটু অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে বললেন, সিঙ্গাপুর যাবেন।
সব শোনার পরও হাফসা জিজ্ঞাসাদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।আরহাম অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।কিছু বললেই টেনশন করতে শুরু করবেন তিনি।হাফসার সময় এগোচ্ছে।উনারও সুস্থ থাকা প্রয়োজন।
আরহামের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি লুকোচ্ছেন?’
‘কি লুকাবো?’
‘আপনাকে এমন ছন্নছাড়া লাগে নি এর আগে।কিছু তো হয়েছে।’
‘কিছু না।আদওয়া একটু অসুস্থ…
‘আর আপু বিচ্ছেদ চান এজন্য?’
‘হুমম।’
‘আপুকে এতো ভালোবাসেন আপনি।আপনাকেও তিনি খুব ভালোবাসবেন।কিছুদিন সময় দিন।একা থাকলে উনি আপনার অনুপস্থিতি বুঝবেন।ফিরে আসবেন আবারও।’
‘আমি যদি কখনো আপনার থেকে দূরে থাকি,নিজের যত্ন নিতে কার্পন্য করবেন না উমায়ের।’
‘করবো না।কিন্তু আপনি ভালো থাকুন।’
******
সময়টা সন্ধ্যের।কাঁচের গ্লাস পেরিয়ে আসা আলোতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আরহাম।পাশের বেডেই আদওয়া।বিকেলে অসুস্থতা প্রচন্ড বাড়ায় হসপিটালে নিয়ে আসতেই এডমিট দিয়ে দিলো।মাথাব্যাথায় মাথার ভেতরটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে আরহামের।বিকেলের সিন গুলো মনে পড়তেই আবারো মন ভেঙে গেলো উনার।খাবার নিয়েই রুমে ডুকছিলেন আরহাম।আচমকা রুমের দিকে কিছুর আওয়াজ শুনতে তড়িৎ গতিতে গিয়ে দেখেন,সোফার কাছে ম্যাটের ওপর সেন্সলেস হয়ে পড়ে রয়েছে আদওয়া।হন্ন হয়ে তাকে নিয়ে হসপিটালে আসছিলেন।মনে হলেই বুকের ভেতরে হার্টবিট তিনগুণ বেড়ে গেলো আরহামের।
শব্দ তুলে ফোনে কল আসলো।তুলার আগেই দরজায় আওয়াজ হয়।আব্বুর আগে আগে ধড়ফড়িয়ে ঢুকেন আদওয়ার মা-বাবা।
আদওয়াকে এক পলক দেখে আয়বীর সাহেব ছুটে এসে আরহামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কখন এমন হলো?কি অসুস্থ আমার মেয়ে?তুমি আগে জানাও নি কেন?’
আরহাম নিষ্পলক চেয়ে রইলেন উনার দিকে।আদওয়ার অসুস্থতা জানলে, উনারা নিশ্চয়ই ঠিক থাকতে পারবেন না।তাদের আশ্বস্ত করতে বললেন, ‘শান্ত হোন।দোয়া করুন,যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন।’
‘কতদিন থেকে অসুস্থ ও?ফোনে তো ঠিকঠাকই কথা বলছিলো।’
মিসেস সেমুর কান্নাজড়ানো গলায় আরহাম উত্তর দিলেন, ‘বিকেলে বেড়েছে।সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলেন তাই….
তিনি এবার কান্না করেই ফেললেন।আক্ষেপের সুরে আওড়াতে থাকলেন, ‘কি থেকে কি হয়ে গেলো আমার মেয়েটার…’
আদওয়ার ঘুম ভাঙ্গবে এই ভয়ে আরহাম তাদের নিয়ে বের হয়ে এলেন রুম থেকে।তাদেরকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে বুঝলেন, উনার কান্না চলে আসছে।
ডক্টরের ডাকে কেবিনে ফিরতে দেখলেন, ফুলটুসির মুখটা এতটুক হয়ে গেছে না খেয়ে।সেই যে রাতে ডিনার করেছিলো, আর এখন স্যালাইন চলছে।
এভাবেই অতিবাহিত হলো দূটো নির্ঘুম রাত।বিকেলে ইমেইল আসলো,ভিসা কনফার্ম।সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলযাভেদ মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটাল চোজ করা হ’য়েছে।আদওয়ার ডক্টরের থেকেও ফিটনেস প্রমাণপএ রেডি করা হয়েছে গতকাল।আগামী তিনদিন পর বাদ ফজর ফ্লাইট।সে মোতাবেকই যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
******
আদওয়া ঘুমুচ্ছে।পাশেই আরহাম বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।আব্বু ইশারায় ডেকে নিলেন আদওয়ার পাশ থেকে।আড়ালে আসতেই হাপিত্যেশ নিয়ে বললেন, ‘ফ্লাইট ক্যানসেল আরহাম।’
‘কেনো?’
‘তুমার নামের মামলার জন্য।একটু আগেই রিজেক্ট করলো।’
‘আমার নামে মামলা????’
‘মাইমুনার পক্ষ থেকে তুমার বিরুদ্ধে কেসটার জন্য।’
আরহাম নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।মাইমুনার জন্য আদওয়ার ট্রিটমেন্ট আটকাচ্ছে আজ!আর তিনি বিচ্ছেদ চাইছেন!
অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘এটা তো মেডিকেল ভিসা।সমস্যা তো হওয়ার…
‘হয়েছে।’
‘এখন কি করা আব্বু?’
‘যত তাড়াতাড়ি তুমি সিদ্ধান্ত নিবে,তত তাড়াতাড়ি কেস ক্লোজ হবে।তত তাড়াতাড়ি তুমি সিঙ্গাপুর যেতে পারবে।এখন সিদ্ধান্ত তুমার হাতে।তুমি মাইমুনাকে ডিভোর্স দিতে চাইলে….
‘কখনো চাই না।আমি কেন ডির্ভোস চাইবো?আমি উনাকে ভালোবাসি।’
‘তার লাইফে তুমাকে হয়তো আর প্রয়োজন মনে করছে না।’
‘এসব তোপে পড়া সিদ্ধান্ত।উনার ফ্যামিলি উনার ওপর প্রেসার ক্রিয়েট করছে আব্বু।আপাতত আমি আদওয়ার কি করবো বলুন।’
‘কোনো ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এখানের ট্রিটমেন্ট নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’
******
কালকে কোর্ট থেকে কেসের ডেট দেওয়া হয়েছে।কালকেই কেনো দেওয়া হলো এ নিয়ে আহনাফ তাজওয়ারের রাগের শেষ নেই!এদিকে আরহাম নির্বাক,বাকরুদ্ধ!একজন জীবন নিয়ে যুদ্ধ করছে,আরেকজন জীবন থেকে সরে যেতে চাইছে!মাইমুনা কি করে পারছেন এসব!আরহামের নাম্বারটা অব্দি ব্লক লিস্টে তার!
অবাধ্য মন বুঝলো না।এশার নামাজ শেষে মাইমুনার বাসা তে এসেছিলেন আরহাম তাকে একটু বুঝাতে।কিন্তু প্রায় আধঘন্টা থেকে ড্রয়িং রুমেই বসিয়ে সবাই অবহেলা দেখাচ্ছে।খুব আঘাত পেলেন আরহাম।উঠে চলে আসার প্রস্তুতিই নিচ্ছিলেন এমন সময় আসলো মাইমুনা।
আরহামকে নিয়ে রুমে আসতেই বাইরের ঘরে বাকিদের কানাঘুষা শুরু হয়ে গেলো।
‘এসব কি হানি?আপনি আমাকে্ আমাকে ডির্ভোস দিতে চান?’
মাইমুনার নিরুত্তরে আরহাম আবার বললেন, ‘আমি সত্যি ভালো নেই।এই দূ:সময়ে অন্তত এমনটা করবেন না।আমি আপনাকে ভালোবাসি।আমার যদি অপরাধ থাকে,বলুন শাস্তি দিন তবুও বিচ্ছেদ চাইবেন না।আই কান্ট লিভ উইদাউট ইউ।’
আরহামের এমন করুন আবেদন ঠেলে মাইমুনা রুঢ়স্বরে বলে উঠলেন, ‘আমি বিচ্ছেদ ই চাই শাহ।এ বিষয়ে আর কথা বাড়াবেন না প্লিজ।’
‘আপনি আমাকে ছাড়া সত্যি ভালো থাকবেন?প্লিজ সময় নিন একটু ভাবুন মাইমুনা।আমাদের এত বছরের সম্পর্ক এত ঠুনকো হয়ে গেলো আপনার কাছে?’
‘{হজরত মুআররিফ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে হালাল বিষয়ের মধ্যে তালাকের চেয়ে অধিকতর ঘৃণিত আর কিছু নেই’ (আবু দাউদ : ২১৭৭)। আল্লামা তীবি (রহ.) বলেন, তালাক ইসলামে বৈধ হলেও তা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়, কেননা শয়তানের কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো। সুতরাং শয়তানের প্রিয় কাজ আল্লাহর কাছে কখনো পছন্দনীয় হতে পারে না।}
আপনি ইচ্ছে করে এমন ঘৃণিত একটা সিদ্ধান্ত নিবেন?’
আরহামের এত কথার পিঠে সে কেবল বলল, ‘আমি ডির্ভোসই চাই।’
‘কারনটা?’
‘আমি আপনার সাথে ভ্ ভালো নেই।’
আরহামের বুকের মধ্যে কেউ যেনো বেয়নেট দিয়ে আঁচড় কেটে দিলো।বিনাবাক্যে ফিরে এলেন তিনি।তিন বছরে যতটুকু ভালোবাসা সে দিয়েছিলো, এই একটা মাএ বাক্য সেই ভালোবাসার পরিমাণ ডিঙ্গিয়ে গেলো!
নির্ঘুম যন্ত্রণাদায়ক রাতটা পেরিয়ে যখন ভোর হলো,আদওয়াকে ঘুমে রেখে বাসায় ফিরে এলেন আরহাম।হাফসা সবে তিলাওয়াত শেষে জায়নামাজ তুলে রাখছিলো।আরহাম এসে হাফসাকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে ফেললেন।মাইমুনার সাথে মিট হওয়া থেকে আজকের কোর্টে হাজিরা দেওয়ার বিষয়টা বললেন।হাফসা নির্বাক হয়ে রইলো অনেকক্ষণ।আরহামকে এভাবে কাঁদতে দেখে ওর চোখও বাঁধা মানলো না।নীরব আলিঙ্গনে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কোনো শব্দ বেরোলো না!
*****
প্রত্যাশিত সময়~
কোর্টে একটার পর একটা অভিযোগ আসতেই থাকলো আরহামের বিরুদ্ধে।অথচ তিনি শুধু বললেন, ‘আমি আমার স্ত্রীকে পার্সোনালি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।তারপর উনি যা বলেন, আমি মেনে নিবো।’
****
সুযোগ দেয়া হলো।
আরহাম চোখভরে তাঁর দৃষ্টি পড়ে নিলেন।অতপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি সত্যি কখনো আপনার হাজবেন্ড কে ভালোবেসেছিলেন মাইমুনা?না সব অনুভূতি মিথ্যে ছিলো?’
আরহাম দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন, ‘আমার সাথে আপনি সুখী ছিলেন না?এত অসুখী রেখেছিলাম আপনাকে?’
‘আমাদের বিচ্ছেদে আপনি যদি সুখী থাকেন, আপনাকে কখনো কেউ কষ্ট দিবে না।আমার চেয়েও যত্নে রাখবে এমন কারোর হলে,আপনি যেতে পারেন।অনেক জোর করেছি,এখন আর আটকাবো না।এটা সম্পর্ক!কোনো ছেলেখেলা নয়।’
মাইমুনা শুধু উত্তর দিলো, ‘আমি আমার মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারবো না।’
এরপরের পুরো সময়টুকু আরহাম একটা কথাও বললেন না।মনটা কেমন খচখচ করছে আদওয়ার জন্য।প্রতিটা সেকেন্ডও যেনো দম বন্ধকর অনুভূতি ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলছে!আরহাম সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে আসলেন এই বিচ্ছেদের মহল থেকে।অথচ তাঁর নীরবতাকে সম্মতি মেনে ওদিকে ডিভোর্সের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে!
*****
হাসপাতালে ফিরে দেখলেন অক্সিজেনের মাস্কের ভেতরেও শ্বাস ফেলতে আদওয়া ছটফট করছে।ডাক্তারের নিষেধ ডিঙ্গিয়েও তাকে ঘেরাও করে রয়েছে আপনজনেরা।আব্বু ছোটাছুটি করছেন কিছু পেপারস্ নিয়ে।আরহাম স্ট্যাচুর মতো নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।উনার সামনেই স্ট্র্যাচারে করে তাকে বিশাল এক যন্ত্রপাতির কক্ষ নেওয়া হলো।আরহামের প্রথমে চোখ আটকালো, উপরে বড় করে লিখা ‘আই সি ইউ ‘ নামক ভয়ঙ্কর শব্দটাতে।তারপর আটকে থাকা আদওয়ার দৃষ্টিতে।তাঁর অশান্ত চোখজোড়া পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আরহামকে কিছু বলে গেলো!বুঝিয়ে গেলো!অথচ আরহাম তখনো স্তব্ধ, নির্বাক!