১.উত্তরের ঘন জঙ্গল এর পাশের আলিশান বাড়িটার লিভিং রুমে সোফায় বসে আছেন শামসুল কাদের, পাশেই বসে আছে, তার ছোট মেয়ে রুমাইশা কাদের।
এই বাড়িটা শামসুলের চাচাতো বোন রুনিয়া রহমানের শ্বশুর বাড়ি। যদিও শামসুল এখানে আসতে চাননি। কিন্তু ইশতিয়াক আহমেদ, রুনিয়ার স্বামী, এক প্রকার জোর জবরদস্তি করেই তাকে এখানে এনেছেন৷
আজ ১৬ বছর পর বোনের বাড়িতে পা রাখলেন শামসুল কাদের । এক সময় এই বোনের বাড়িতে তিনি সারাক্ষণ পড়ে থাকতেন বোনের কাছে।
রুনিয়ার নিজের কোনো ভাই নেই, আছে একটা বোন, তাই এই চাচাতো ভাইকেই নিজের ভাইয়ের মতো দেখেছেন সারা জীবন, এখনো দেখেন।
রুনিয়ারও ভাই না থাকায় প্রথম সন্তান হওয়ার সময় শামসুল রুনিয়ার প্রেগন্যান্সির শেষের ৪ টা মাস রুনিয়ার কাছেই থেকেছেন, ওর সুবিধা অসুবিধা দেখেছেন।রুনিয়ার বোন তানিয়া দেশে থাকেন না। স্বামী সন্তান নিয়ে তিনি দেশের বাইরে থাকেন৷
নিজের কোনো ভাইবোন না থাকায় রুনিয়া আর তানিয়াই ছিলেন শামসুলের চোখের মণি। রুনিয়া ছোট হওয়ায় ওর প্রতি একটু বেশিই টান ছিলো শামসুলের, যা নিয়ে তানিয়ার অভিযোগের শেষ ছিলো না৷
রুনিয়া যখন সন্তানসম্ভবা, ইশতিয়াক আহমেদের তখন নতুন চাকরি। রুনিয়ার শাশুড়ীর শরীর খারাপ। শ্বশুর থেকেও ছিলেন না। বাসায় একজন হেল্পিং হ্যান্ড ছিলো, কিন্তু একজন পুরুষ মানুষ না থাকলে বাড়িটা কেমন জানি অন্যরকম হয়ে যায়।
রুনিয়া কে ডাক্তারের কাছে আনা নেওয়া, সুবিধা অসুবিধা দেখা সব কিছু করতেন শামসুল কাদের। যার জন্য রুনিয়া আজ ও শামসুলের প্রতি কৃতজ্ঞ৷ কিন্তু তার সেই আদরের ভাই এক দুর্ঘটনার কারনে আর তার বাসায় আসে না। আর সে দুর্ঘটনার কারণ রুনিয়ারই বড় ছেলে সাফওয়ান আহমেদ।
রুমাইশা বাবার পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে। লজ্জা লাগছে তার খুব। আজ কত বছর পর ফুপ্পির বাড়িতে এসেছে সে। ছোটবেলায় তো সারাক্ষণ এখানেই পড়ে থাকতো রুমাইশা, ফুপ্পি ছিলো তার জান।
ফুপ্পির বাড়িতে হোক বা তার নিজের বাড়িতে, সারাক্ষণ ফুপ্পির সাথেই লেগে থাকতো রুমাইশা। আর ফুপ্পিও রুমাইশা কে চোখে হারাতো৷ নিজের মেয়ে না থাকায় রুমাইশার প্রতি ছিলো তার অগাধ ভালোবাসা৷
শেষ বার সেই কোন ছোটবেলায় এসেছিলো ফুপ্পির বাড়িতে বাবা মা আর আর রাফসান ভাইয়ার সাথে।
সেইবার সাফওয়ান আর শাফিন এর সাথে দুষ্টুমি করার সময় কিভাবে জানি সাফওয়ান তাকে কামড় দিয়ে ফেলে। প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে রুমাইশা৷ তার মনে আছে বাবা প্রচুর কাদছিলো, আর ফুপ্পিও৷
মায়ের কোলের ভেতর শুয়ে মাঝে মাঝে পিট পিট করে তাকালে সে দেখতে পেতো তার পরিজনদের দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখ৷ সেবার সুস্থ হওয়ার পর থেকেই ফুপ্পির বাড়িতে যাওয়া একেবারের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো তার।
কেউ আর ফুপ্পির বাড়ির নাম ও নেয় না৷ বাবা ও যেতে চায় না। অথচ ওর খুব মন খারাপ হতো ফুপ্পির জন্য৷ ফুপ্পিও তারপর খুব একটা আসতো না তাদের বাসায়, হয়তো বছরে একবার, বা তাও না৷
আজ কতদিন পর ও ফুপ্পির বাড়িতে এসেছে৷ সাফওয়ান আর শাফিনের সাথেও এরপর আর দেখা হয়নি৷ শাফিনের সাথে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হলেও সাফওয়ান এর সাথে এরপর আর কোনো কথা হয়নি।
আর এরপর সাফওয়ান নিজের পড়াশোনার জন্য সিঙ্গাপুরে চলে যাওয়ার পর ওর সাথে কোনো যোগাযোগই হয়নি আর রুমাইশা বা ওর পরিবারের৷ কোনো এক অজানা কারণে বাসার কেউই সাফওয়ান কে পছন্দ করে না, বিশেষ করে রুমাইশার মা, আয়েশা খানম। কারণ টা এখনো ওর অজানা।
রুমাইশা কে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ইশতিয়াক আহমেদ রুমাইশা কে স্বাভাবিক করার জন্য বললেন,
— রুমি মা! তুই মাথা নিচু করে বসে আছিস কেন? এতদিন পর ফুপ্পির বাড়িতে এসেছিস, কোথায় মজা করবি, সবার সাথে কথা বলবি, তা না করে এখানেই বসে আছিস তখন থেকে। তোর ফুপ্পি রান্না ঘরে আছে, ওইখানে যা। ফুপ্পির সাথে গিয়ে গল্প কর।”
রুমাইশা অনুমতির জন্য শামসুল কাদেরের দিকে তাকাল। কিন্তু শামসুল রুমাইশার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর অথচ শান্ত কণ্ঠে বললেন,
—থাক, এখন যেতে হবে না।”
তারপর ইশতিয়াক আহমেদ কে বললেন,
—দুলাভাই, আমরা এখনই উঠবো, আপা কে বলেন কোনো আয়োজন না করতে, বসতে গেলে তখন সন্ধ্যা হয়ে যাবে৷”
শামসুলের কথায় ইশতিয়াক আহমেদ আহত দৃষ্টি তে তাকালেন। যে শামসুল তার অতি আদুরে বোনের জন্য সারাক্ষণ এ বাড়িতেই পড়ে থাকতো সে এখন সেই বাড়িতে ১০ মিনিট ও বসতে চাইছে না৷
শামসুল তার শ্যালক কম, বন্ধু বেশি৷ রুনিয়ার সাথে তার বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে যখন তিনি যেতেন তখন শামসুলের সাথেই সারাক্ষন ঘুরে বেড়াতেন তিনি৷ বয়সে শামসুল তার থেকে কিছুটা ছোট হলেও বন্ধুর মতো ছিলো তার।
তার বড় ছেলে সাফওয়ান গর্ভে থাকাকালীন রুনিয়ার জন্য রাতদিন এক করে ফেলেতো শামসুল কাদের। বিপদে আপদে সবসময় বন্ধুর মতো পাশে থেকে সে বিপদ মোকাবিলায় ইশতিয়াকের সাথে ছায়ার মতো ছিলো শামসুল। আর ইশতিয়াক ও শামসুল এর জন্য এমন টাই করতো।
কিন্তু এক দুর্ঘটনাই সব শেষ করে দিলো। হাসি খুশি দুটো পরিবার কেমন জানি নিস্তেজ হয়ে গেলো চরম সত্য টা জানার পর৷
ইশতিয়াক কিছুক্ষন থম মেরে বসে থেকে বললেন,
—ঠিক আছে তোরা বস, আমি তোর আপাকে পাঠাচ্ছি।
ইশতিয়াক উঠে বাইরে যেতেই এক মিনিটের মাথায় রুনিয়া এসে উপস্থিত হলেন লিভিং রুমে। এসে শামসুল কে ধমকের সুরে বললেন,
—কি রে শামসুল! এতদিন পর আসলি, এসেই যাবো যাবো করছিস কেন? মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিস দুদণ্ড বসতে দে অন্তত। নাস্তা প্রায় রেডি হয়ে গেছে আমার, নাস্তা করে তার পর যাবি।
এরপর রুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—রুমি মা, তুই আমার সাথে আয়, এখানে বসে থাকতে হবে না।”
রুমাইশা, একবার শামসুল এর দিকে তাকালো, শামসুল মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। বোনের ওপর তিনি আর কথা বলতে পারলেন না৷
লিভিং রুম থেকে বের হয়ে রুমাইশা শাফিন কে দেখতে পেলো, সদর দরজা দিয়ে কেবল ভেতরে ঢুকছে। শাফিন তখন কলেজ থেকে ফিরেছে মাত্র।
রুমাইশা কে দেখে শাফিন ছুট্টে এসে রুমাইশার দুই হাত আকড়ে ধরলো নিজের দুহাতে। চোখ মুখ ওর আনন্দে ঝিলিক দিচ্ছে। মুখে হাসি ধরছে না৷ উৎফুল্লতার সাথে ও বলে উঠলো,
—আপু! তুমি আমাদের বাসায় এসেছো! কতদিন পর!”
পাশ থেকে রুনিয়া বলে উঠলেন,
— হ্যা, ম্যাডাম রা এসেছেন, এখনি আবার চলেও যাবেন।
কথা টা শোনা মাত্রই শাফিন এর চেহারা ঠিক যেভাবে দপ করে জ্বলে উঠেছিলো, ঠিক সেভাবেই নিভে গেলো!
বেজার মুখে বলল,
—কেন আপু? আজ চলে যেয়ো না, থেকে যাও প্লিজ! কাল যেও না হয়! তুমি জানো, বাসায় কারো সাথে যে দুটো কথা বলবো তা কারো কোনো সময় নেই আমার জন্য। বাবা সারাদিন থাকেন অফিসে, আম্মাজান সারাক্ষন থাকেন রান্নাঘরে, আর সাফওয়ান ভাইয়ার কথা তো বাদ ই দিলাম। সে বাড়িতে থাকা আর না থাকা সমান। আমি এই বাড়িতে যে কি বিপদে আছি, তুমি জানো না আপু।”
শাফিনের কথা শুনে রুনিয়া মুচকি হেসে রান্না ঘরের দিকে এগোলেন, আর রুমাইশা কে বললেন,
—তুই এদিকে আয় আমার সাথে, ও কথা শুরু করলে আর শেষ হবে না৷”
তারপর শাফিনের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
—আর শাফিন, তুই গিয়ে ফ্রেস হয়ে নিচে আয়, নাস্তা রেডি করছি আমি।”
শাফিন বাধ্য ছেলের মতো কোনো বাক্য ব্যায় না করে রুমাইশার দিকে তাকিয়ে সৌজন্য মুলক হাসি হেসে নিজের রুমে চলে গেলো৷ রুমাইশা গেলো ফুপ্পির পেছন পেছন৷
রান্না ঘরে গিয়েই ফুপ্পিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো রুমাইশা, তারপর খুব আদুরে কণ্ঠে বলল,
—তোমাকে খুব মিস করি ফুপ্পি, জানো! তুমি এখন আর আমাদের বাসায় যাও না আগের মতো! কত মজা হতো তুমি গেলে। আজ আমায় পাটিসাপটা বানিয়ে খাওয়াও, তোমার হাতের পাটি সাপটা অনেক মজা!”
রুনিয়া রুমাইশার এমন কাণ্ডকারখানায় হেসে দিলেন, বলে উঠলেন,
—দেখো, মেয়ের কাণ্ড দেখো, এত বড় হয়েছে তাও তার বাচ্চামি গেলো না৷ ছাড় এখন, দিবো বানিয়ে। তোর বাপ তো বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে! মনে হচ্ছে আমার ছেলে এসে আবার তোকে কামড়ে আধমরা করে ফেলবে! আমার ছেলে কি এখন ও ছোট আছে।”
রুমাইশার এবার সাফওয়ান এর কথা মনে পড়লো, রুনিয়া কে জিজ্ঞেস করলো,
—আসলেই তো, সাফওয়ান ভাইয়া কে তো কোথাও দেখলাম না, ভাইয়া কোথায়?”
প্রতিউত্তরে রুনিয়া চুপ করে রইলো। রুনিয়া কে চুপ থাকতে দেখে রুমাইশা আবার ও জিজ্ঞেস করলো,
— আচ্ছা ফুপ্পি! সাফওয়ান ভাইয়া আমাকে কামড়ে দিয়েছিলো তো কি হয়েছিলো ? আমি এত অসুস্থ ছিলাম কেন? আমার মনে নেই স্পষ্ট। মা বা বাবাকে জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতে চায় না, রাফসান ভাইয়াও না৷ আমাকে তো ছোটবেলায় রাফসান ভাইয়া ও কত কামড়ে দিয়েছে, কই তখন তো আমার কিছু হয়নি, কেউ কিছু বলেও নি ভাইয়া কে, তাহলে সাফওয়ান ভাইয়া কামড়ে দিলে সবাই এরকম করলো কেন?”
রুনিয়ার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠলো, কি যেন বলতে গিয়েও গলা আটকে গেলো তার। কণ্ঠ কেমন যেন ভারী হয়ে আসছে৷ নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নিয়ে রুনিয়া পাশে থাকা নাস্তার ট্রে টা দেখিয়ে বলল,
—এইটা নিয়ে লিভিং রুমে যা, আমি আসছি।”
রুমাইশা, বুঝলো তার কথায় ফুপ্পির মন খারাপ হয়েছে, কিন্তু কেন হয়েছে তা বুঝলো না রুমাইশা। অগত্যা ট্রে টা হাতে নিয়ে লিভিং রুমের দিকে এগোলো। কিন্তু লিভিং রুমে ঢোকার আগ মুহুর্তে ও এমন কিছু কথা ওর কানে এলো যা ও ভাবতেই পারেনি……..