অফিডিয়ান | পর্ব – ৪৫

10 Min Read

৪৭. ছাই রঙা বোরখার ওপর মিশমিশে কালো রঙা হিজাব আর নেকাব পরে গাড়ির জানালা দিয়ে ভাবুক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে সাফওয়ানের পাশের সিটে বসে আছে রুমাইশা। সাফওয়ান ড্রাইভিং করছে।

রুমাইশার মন টা একদমই ভালো নেই। সাফওয়ান আজ সকালে সমস্ত পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছে ওকে৷ এমনকি দেশ ছাড়ার জন্য ওর পাসপোর্ট ও রেডি। অথচ কিছুই ওকে আগে ভাগে জানানো হয়নি। তার জন্য অবশ্য সাফওয়ানের ওপর বেশ রাগ দেখিয়েছে রুমাইশা। কিন্তু এখন রাগ দেখিয়েই বা কি হবে এখন! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আর এখন তো দেশে থাকার আর কোনো উপায় নেই।

কিন্তু ওরা কেন সাফওয়ান কে খুজছে সেটা সাফওয়ান ওকে এখনো বলেনি। রুমাইশা কয়েক বার জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু সাফওয়ান শক্ত গলায় বলে দিয়েছে যে ওর যখন যেটা উপযুক্ত মনে হবে তখন সেটা বলবে ও, তার আগে না। আর এসব নিয়ে রুমাইশার প্রচুর অভিমান হয়েছে সাফওয়ানের ওপর।

কেমন মানুষ যে বউ কে কিছুই বলতে চায় না! স্বামী স্ত্রী মানেই তো একে অপরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাথী, তাহলে সাফওয়ান তার স্বামী হয়েও তার সাথে এমন লুকোচুরি কেন করছে! সব কথা একবারে বলে দিলে কি হয়? অজানা কথা গুলো জানার জন্য মন টা সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে, এটা কি ভালো লাগে তার খুব?

সাফওয়ানের চোখ দুইটা রাস্তার দিকে, কিন্তু ওর সম্পুর্ন মনোযোগ রুমাইশার দিকে। রিমু যে তার ওপর খুব অভিমান করে আছে সেটা সে বুঝছে, কিন্তু কিছু করার নেই ওর৷ ওর জীবনের এই নোংরা দিক টা রিমু জানতে পারলে হয়তো ভেঙে পড়বে খুব! বা হয়তো থাকতে চাইবে না ওর সাথে আর।
তাই রিমু কে ওর প্রফেশন সম্পর্কে জানানোর জন্য আমাজনে যাওয়ার পরবর্তী সময় টাকেই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করলো ও, কারণ তখন আর রিমু ওকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা পাবে না। সব টা মেনে নিয়েই সাফওয়ানের সাথে থাকতে হবে ওকে তখন।

দড়াটানায় এসে গাড়ি টা এক সাইডে পার্ক করলো সাফওয়ান। কলেজে না গিয়ে এইখানে গাড়ি পার্ক করায় রুমাইশা একটু বিস্মিত হলো, কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না। ঘাপটি মেরে বসে রইলো নিজের জায়গায়।
সাফওয়ান ও রুমাইশার সাথে কোনো রকম কথা না বলে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে বাজারের ভেতর ঢুকে গেলো। রুমাইশার অভিমান আর ও দৃঢ় হলো সাফওয়ানের এহেন কর্মকান্ডে।

সে অভিমান করে বসে আছে, সাফওয়ানের তো উচিত ছিলো ওর অভিমান ভাঙানো! কিন্তু তা না! ব্যাটা উল্টো নিজেই রুমাইশার সাথে কথা বলছে না! চোরের ওপর বাটপারি করে পার পেয়ে যেতে চাইছে! কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরুক আগে। আজ তো ওকে রেখে আসবে বাপের বাড়ি, একবার গেলে এই জীবনে আর এমুখো হবে না রুমাইশা। তারপর বুঝবে শালা তাপুর বাচ্চা তাপু, বউ এর অভিমান না ভাঙানোর কত ঠেলা!

সে না হয় হলো, কিন্তু ও নিজে কি করে থাকবে, দেখা গেলো যার ওপর প্রতিশোধ নিতে এত কিছু করা, তার একটা চুল ও ছেড়া গেলো না, আর সে নিজে টাক হয়ে গেলো! নাহ, বাপের বাড়ি গিয়ে হারিয়ে যাওয়া যাবে না, সারাজীবন ওর ঘাড়ে বসে বসে ষড়যন্ত্র করে শালাকে বুঝিয়ে দিতে হবে কত ধানে কত চাল, তাহলেই আসল শান্তি পাওয়া যাবে!

—শালার ঘরের শালা! তোর বউ ভালো হবে না! ঠিকই আছে, আমি এমনিতেও ভালো না৷ সারাজীবন জ্বালিয়ে তোর জীবন তেজপাতা করে দেবো! এখনো তো আমি শয়তানি শুরু করিনি! যখন করবো তখন বুঝবি, কারে গাড়িতে ফেলে রেখে ঢ্যাং ঢ্যাং করতে করতে হারাই গেছোস!

বিড় বিড় করে নিজে নিজে এই সমস্ত বলতে লাগলো রুমাইশা।

খানিকক্ষন পর সাফওয়ান আবার গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে এলো। কিন্তু রুমাইশা তাকালো না সেদিকে, নিজের পাশের জানালা দিয়েই বাইরে তাকিয়ে রইলো।
সাফওয়ান একবার রুমাইশার দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য গলা খাকারি দিলো কিন্তু তাতে কাজ হলো না। রুমাইশা ওভাবেই ঘাড় ঘুরিয়ে পড়ে রইলো।

সাফওয়ান এবার উপায় না পেয়ে রুমাইশার দিকে ঝুকে এলো খানিকটা। জানালার গ্লাস তুলে দিলো দুপাশেরই। তারপর ডান হাত টা দিয়ে রুমাইশার মুখ টা নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু রুমাইশা ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিলো সাফওয়ানের হাত টা।
সাফওয়ান আর ও একবার চেষ্টা করলো রুমাইশার মুখ খানা এদিকে ফেরানোর৷ কিন্তু ব্যর্থ হলো এবার ও৷

কিন্তু রগচটা সাফওয়ানের আর ধৈর্যে কুলালো না৷ ক্ষিপ্র গতিতে রুমাইশার হাত দুইটা খপ করে ধরে এই মাত্র বাজার থেকে রুমাইশার জন্য নিয়ে আসা আইসক্রিম আর এক তোড়া গোলাপ ফুল ওর হাতের ভেতর ঠেসে দিয়ে শক্ত গলায় বলল,
— মোটেও তেজ দেখাবিনা, এসব কিন্তু আমার একদমই ভালো লাগে না! তোকে যে কিছুই বলবো না তা তো বলিনি, বলেছি সময় হলে সব কিছুই বলবো। তো এতে ঢং করে এত রাগ দেখানোর কি আছে?

বলে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো সাফওয়ান। আর সাফওয়ানের এমন ধমকে ঠোট উলটে কান্না এলো রুমাইশার। নেকাবের আড়ালেই ফুপিয়ে কেদে উঠলো ও৷ সাফওয়ান বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে বসে রইলো ওর পাশে। আর রুমাইশার কান্নার বেগ বেড়েই চলল।

কিছুক্ষণ পর কাদতে কাদতেই ও গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিলো। কিন্তু পেছন থেকে সাফওয়ান আটকালো ওকে, পেছন থেকে ওর হাত টা খপ করে ধরে ফেলে কড়া গলায় বলল,
— এক পা ও যেন গাড়ির বাইরে না পড়ে, পড়লে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে৷

কিন্তু রুমাইশা শুনলো না। সাফওয়ানের হাত থেকে নিজের হাত টা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলতে নিলো ও৷
ভয়ানক রাগ হলো সাফওয়ানের৷ ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে পেছন থেকে দুই হাত দিয়ে রুমাইশার কোমর টা ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের কোলের ওপর নিয়ে এলো ও, আর তারপর ই রুমাইশার নেকাব টা এক টানে খুলে ফেলে রুমাইশার গলা চেপে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোট ডুবিয়ে দিলো!
সাফওয়ানের দাঁতের চাপে ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো রুমাইশা। দুই হাত দিয়ে সাফওয়ান কে নিজের থেকে সরানোর চেষ্টা করলো ও৷ কিন্তু সাফওয়ানের শক্তির সাথে পেরে উঠলো না।

এক হাতে গলা ধরে অন্য হাতে শক্ত করে রুমাইশা কে নিজের সাথে চেপে ধরে আছে সাফওয়ান৷ রুমাইশা এইবার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাফওয়ানের বুকে কিল ঘুষি চালাতে লাগলো কিন্তু তাতে সাফওয়ানের সামান্যতম হেলদোল ও হলো না।

কিছুক্ষন পর রুমাইশার ঠোঁট ছেড়ে দিলো সাফওয়ান, কিন্তু নিজের থেকে দূরে যেতে দিলো না ওকে৷ রুমাইশার মুখের কাছে মুখ রেখে ওর চোয়াল দ্বয় হাত দিয়ে চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
— তোর সাহস কত বড়! আমার কথা অমান্য করে গাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছিস! এত স্পর্ধা কে দিয়েছে তোকে? চুপচাপ এখানে বসে থাকবি, এক পা ও এদিক ওদিক হলে জানে মেরে ফেলবো একদম।

বলে রুমাইশা কে নিজের কোলের ওপরে রেখেই আবার ড্রাইভিং শুরু করলো ও।

.

রুমাইশার নেকাব খোলা এখনো। চোখ থেকে পানি পড়ে ভেসে যাচ্ছে। বার বার হাত দিয়ে মুছে ফেলছে সে কান্না ও, তারপর সাথে সাথেই আবার চোখ ভর্তি হয়ে আসছে৷ নিঃশব্দে নিজের মনের কষ্ট গুলো বের করে দিচ্ছে ও৷ ঠোট টা সাফওয়ানের দাঁতের আঘাতে এক পাশ থেকে কেটে গেছে একটু, সেখান টা লাল হয়ে ফুলে গেছে।
সাফওয়ান দেখছে সব, কিন্তু কিছুই বলছে না। চুপচাপ ড্রাইভিং করে চলেছে৷

মিনিট দশেক পর কলেজে এসে পৌছালো ওরা। কলেজের মেইন গেইট দিয়ে ঢুকলো সাফওয়ানের কালো রঙা মার্সিডিজ বেঞ্জ টি৷ সবাই উৎসুক হয়ে দেখতে লাগলো সাফওয়ানের এ নজর কাড়া গাড়িটা। আর ওর ডিপার্টমেন্টের ছেলে মেয়ে গুলো জেনে গেলো আজ সাফওয়ান স্যার ক্লাস টেস্ট নিবেন সশরীরে।

পার্কিং লটে গিয়ে গাড়ি পার্ক করলো সাফওয়ান। রুমাইশা সাফওয়ানের কোলের ভেতর বসারত অবস্থায় চোখ দুইটা ভালো করে মুছে নেকাব দিয়ে আবার নিজের মুখ টা ঢেকে নিলো।

কলেজে ঢুকে প্রথমেই ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিং। রুমাইশা গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। আর বেরিয়েই দেখলো ওর ডিপার্টমেন্টের সিনিয়ররা আর ক্লাসমেট রা হা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডেপ্টের সামনে৷
ওদের অমন করে তাকানোয় অস্বস্তি তে পড়ে গেলো রুমাইশা। কাধের ব্যাগ টা ভালো ভাবে হাত দিয়ে ধরে নিলো। পা বাড়াতে পারছে না। আশেপাশের মানুষ গুলোর এমন বিস্ময়াভিভূত চাহনি দেখে ওর লজ্জা লাগলো খুব। মাথা নিচু করে হেটে ডেপ্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ও।

পেছন থেকে তখন সাফওয়ান বেরিয়ে এলো৷ জিন্সের প্যান্ট এর সাথে কালো রঙা পাঞ্জাবি পরনে ওর। পাঞ্জাবির হাতা টা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা৷ এখন ওর শরীরের সাপর আবরণ টা অনেক খানিই ইনভিজিবল হয়ে গেছে, আর বাকি যে টুকু আছে সেটুকু ওর শরীরের লোপের কারণে ঢাকা পড়ে গেছে৷
চোখে ব্লাক কালারের গগলস আর মুখে মাস্ক পরে আছে ও। চুল গুলো কুইফ স্টাইলে উপরের দিকে উঠানো৷

ঘুরে এসে ও দাড়ালো রুমাইশার পাশে। ইয়া লম্বা সাফওয়ানের পাশে রুমাইশাকে পুচকে দেখালো একদম। সাফওয়ান এসে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
— শেকড় গজিয়েছে নাকি? যাচ্ছিস না কেন? কোলে করে দিয়ে আসতে হবে নাকি তোকে এখন?

সাফওয়ানের কথায় রুমাইশা একবার কটমটে দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। আর তার পর মুখ ঝামটা মেরে গট গট পায়ে হেটে চলল নিজের ডিপার্টমেন্টের দিকে।
আর সাফওয়ান রুমাইশার যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিজের ডিপার্টমেন্টের অফিস রুমের দিকে এগোলো।

এদিকে রুমাইশা ডেপ্টে পৌছাতেই ওর ক্লাসমেটরা মৌমাছির মতো ছেকে ধরলো ওকে।

( রোজা রেখে এত কাজ কর্ম করে বেশি লিখতে পারিনি 🤧, ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন 🖤)

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।