পরিজান | পর্ব – ১০

11 Min Read

নাঈম নিজের ঘরে শুয়ে আছে। মাথার মধ্যে হালকা
ব্যথা অনুভব করছে। যার জন্য মাথাটা বেশ ভারি মনে হচ্ছে নাঈমের। জ্বর ও এসেছে গায়ে। আজকে ওদের কেউই বের হয়নি। সবাই এখন নাঈমের পাশেই বসে আছে। মিষ্টি ভিশন ক্ষেপেছে পরীর উপর। ওর ধারণা পরীই একাজ করেছে। কিন্ত কিছু বলতে পারছেনা। ওর খুব ভয় করছে। এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না। তখনই ঘরে প্রবেশ করল শায়ের। নাঈমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,’এখন কেমন আছেন?’
নাঈম চোখ তুলে তাকিয়ে আলতো হাসলো,’জ্বী ভালো।’
চেয়ার টেনে বসে শায়ের বলল,’ভাগ্য ভাল যে আমি ঠিক সময়ে পৌঁছেছিলাম। রাতে জ্বরটা বেড়েছিল। ভাবলাম বের হব না। আল্লাহ ই নিয়ে গেছে আমাকে।’

‘আপনার কি মনে হয়?মানে কাজটা কে করতে পারে?’
‘আমার মনে হয় বিপক্ষ দল একাজ করেছে। আর নয়তো আপনার উপর কারো ক্ষোভ ছিল। আপনার সাথে কি কারো মনোমালিন্য হয়েছিল?’
নাঈম মাথা নেড়ে না বলল।
‘তাহলে বুঝতে পারছি না। বন্যার কারনে লোকজন ও লাগাতে পারছি না।’

পালক বলে উঠল,’জমিদার এবং ওনার ভাই এখন কোথায়?দেখছি না তো?’

‘ওনারা শহরে গিয়েছেন। দুদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। আমি এখন আসি।’

শায়ের উঠে চলে গেল। মিষ্টি বলল,’আমি নিশ্চিত কাজটা পরী করেছে।’
পালক শায়েরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,’ছেলেটা অদ্ভুত,মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে কখনোই কথা বলে না।’

‘ওই অদ্ভুত এর মধ্যে ভুত আছে। এটা জমিদার বাড়ি নাকি ভুতের বাড়ি বুঝিনা। শোন নাঈম আমি আর কোন কথা শুনব না। এবার আমরা ফিরে যাচ্ছি।’

নাঈম কে শাসিয়ে কথাটা বলে মিষ্টি। প্রতুত্যরে নাঈম বলল,’আমাকে পরীর সাথে কথা বলতে হবে। কাজটা কি সে সত্যিই করেছে?’

‘পরী আপার লগে দেহা করার কথা ভুইলা যান সাহেব। আপার পরাণ থাকতে বেডা মাইনষের সামনে আইব না।’
হাতে ফলের থালা নিয়ে ঘরের ভেতর এলো কুসুম। তারপর আবারও বলতে লাগল, ‘পরী আপা আমারে পাঠাইছে আপনাগো সব কইতে। জানেন তো আমাগো বড় মা আপারে কসম দিছে হেয় যেন কোন পুরুষরে মুখ না দেহায়। কিন্ত ক্যান কসম দিছে তা আপাও জানে না। আপনাগো কেউ অন্দরে গেছিল আপা জানে কিন্ত হেয় আপনাগো ক্ষতি চায় না।এই গেরামের মানুষ একে অন্যের শত্রু। তাই আপা চায় আপনাগো ক্ষতি না হোক। আর আপনাগো সাবধান থাকতে কইছে। রাইতের বেলা বাইর হবেন না। সবসময় শায়ের ভাইয়ের সাথে থাকবেন। ‘

কথা শেষ করে কুসুম চলে গেল। কুসুমের কথার মানে পুরোপুরি কেউ না বুঝলেও পালক বুঝেছে। ও বলল,’তার মানে মালা বেগম এর কসমের জন্য পরী কারো সামনে আসে না। এমনকি নিজের চাচার সামনেও না। কারণ কি?পরীর রুপ?নাকি এর মধ্যে অন্য কারণ আছে?’

‘বেশি ভাবিস না পালক। ওদের সম্পর্কে জানার দরকার নেই। আজ নাঈমের উপর হামলা করেছে কাল আমাদের উপর ও করতে পারে!তার থেকে ভাল আমরা এখান থেকে চলে যাই।’
ভয় জড়ানো কন্ঠে বলল রুমি। নাঈম এবার রাগ করে বলে,’তোরা থামবি?এক চিন্তায় মরে যাচ্ছি আরেক চিন্তা ঢোকাচ্ছিস মাথায়। আমার মনে হচ্ছে কুসুম সব কথা বলেনি। এই বাড়ির সবাই আমাদের থেকে কিছু আড়াল করছে।’

‘অন্দরে যা হচ্ছে তা সবকিছু পরীর মা জানে। কিন্ত আমার মাথায় যেভাবনাটা ঢুকেছে সেটা হলো পরীর চাচা।’

পালকের কথায় শেখর বলল, ‘বিয়ে করেনি তাইতো?তার বউ হয়তো মারা গেছে। এজন্য আর বিয়ে করেনি। আর এসব ব্যাপার বাদ দে তো। আমরা দুদিনের অতিথি বলতে গেলে। কারো পারিবারিক বিষয়ে জেনে কি হবে?’

আসিফ বলল,’সেটাই ঠিক। বেশি গোয়েন্দাগিরি করলে শেষে আমাদের ই বিপদ।’

কেউ আর কোন কথা বলল না। নাঈম ভাবছে, শায়েরের কথা শুনে মনে হল ও কিছুই করেনি। কিন্ত কে করেছে?মাথা ফেটে যাচ্ছে নাঈমের। অন্যদিকে পালক ভাবছে মালার কথা। মালা হয়তো অনেক কিছুই জানে। কিন্ত কি জানে?

কুসুম ছুটে গেল পরীর কাছে। এতক্ষণ সব লুকিয়ে শুনেছে সে। পরীকে খবরটা দিতেই ছুটে গেল।
পরীর সামনে গিয়ে হাপাতে হাপাতে সব বলল। সব শুনে পরী মুচকি হাসল বলল,’শহরে বাবু পরীর লগে কথা কইতে চায়। এতো সপন দেহা ভাল না কুসুম। পরী তারে কিছুই করব না। পরীর বাপে জানলে অনেক কিছু করবো।’
‘একখান কথা জিগাই আপা?বড় মা আপনেরে কসম দিছে ক্যান?’
‘জানি নারে কুসুম। আম্মার মনে অনেক কষ্ট। সোনা আপার তো কোন খবর নাই। রুপা আপা থাকতেও নাই। আমারে নিয়া অনেক চিন্তা করে আম্মা। রুপ থাকা হইল অভিশাপ রে কুসুম। ‘

‘কন কি আপা?আপনে মেলা সুন্দর। যার লগে আপনার বিয়া হইবে হেয় অনেক ভাগ্যবান। ‘

‘নারে কুসুম। রুপ আছিল বইলা সবাই সোনা আপার দিকে খারাপ নজরে তাকাইতো। রুপা আপারে তো,’

একটু থামল পরী। ধরা গলায় বলল,’আমার দিকে কেউ খারাপ নজর না দেয় তাই আম্মা কসম দিছে আমি যেন কাউরে মুখ না দেহাই। পুরুষ মাইনষের নজর খুব খারাপ। মন চায় চোখ দুইটা উঠাইয়া ফালাই।’
কুসুম চুপ করে রইল। রাগে শরীর কাপছে পরীর। কুসুমের মনে হলো পরী বোধহয় কারো লালসার শিকার হয়েছিল। কিন্ত জিজ্ঞেস করল না। পরীকেই বলতে দিলো।
‘আজকের পুরুষ মানুষ সুন্দর কিছু দেইখা মুগ্ধ হয় না। লালসার চোখে দেখে। সুন্দর ছুঁতে পাগল হয় তারা। হিংস্র থাবা দিয়ে সব সৌন্দর্য শ্যাষ কইরা দেয়।আমার কাছে ওই পুরুষগো বাঁচার দরকার নাই। জানস কুসুম আমি একটা মানুষ রে খুন করতে চাই।যে তিন তিনটা জীবন নষ্ট করতে চাইছিল।’

চমকালো কুসুম, পরীর দিকে তাকিয়ে ভাবল এত সুন্দর ফুলকে কে নষ্ট করতে চেয়েছিল?সে বলল, ‘কেডা আপা?’
মুহূর্তেই পরীর ভাব গতি বদলে গেল বলল,’তা দিয়া তুই কি করবি?আম্মা আইবো কহন?’
একটু ভয় পেল কুসুম। এতক্ষণ তো ভাল করে কথা বলছিল এখন আবার হলো কি?কুসুম বলল,’কবিরাজ দেহান হইলেই আইব।’
‘তুই যা এহন।’
কুসুম কোনোমতে ছুটে পালালো। পরী জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এই মুহূর্তে রুপালির কথা ভিশন মনে পড়ছে পরীর। অনেক দিন দেখে না রুপালিকে।প্রিয়জন দূরে থাকলে বুঝি এমন কষ্ট হয়। পানি এলো পরীর চোখে। বোনদের খুব মনে পড়ে ওর। যাদের সাথে শৈশব কেটেছে আজ তারাই নেই।

রাতে মালার অবস্থার অবনতি হলো। কবিরাজ দেখিয়ে কোন লাভ হলো না। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে মালার। জেসমিন মালার পাশে বসে চোখের পানি ফেলছে।পরীকে খবর দিতে না চাইলেও সে খবর পেয়ে যায়। জুম্মান গিয়ে পরীকে খবর দিতেই পরী ছুটলো মায়ের ঘরের দিকে। পথিমধ্যে কিছু একটা ভেবে থেমে গেল পরী তারপর আবারও ছুটল পালকদের ঘরে। পরীর কথা শুনে ওরা সবাই ছুটে গেল মালার ঘরে। মালা তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। সবাইকে একসাথে আসতে দেখে জেসমিন আতকে ওঠে। পালক এগিয়ে এসে বলল,’কি হয়েছে ওনার?আমাকে দেখতে দিন?’
জেসমিন বলে উঠল, ‘তোমরা সবাই চইলা যাও।আপা এমনেই ঠিক হইয়া যাইব।’
পরী ক্ষেপে গেল জেসমিন এর উপর বলল,’বাধা দেন ক্যান?আমার আম্মা ভাল হইলে তো আপনার ক্ষতি তাই না?আমার আম্মার যদি কিছু হয় তাইলে ভাল হইব না। সইরা যান কইতাছি।’
জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে পরীর হাত ধরে বলল, ‘পরী তুমি চইলা যাও। আপার ভাল চাই দেইখা কইতাছি। ‘

গর্জে ওঠে পরী,’হাত ছাড়েন আমার। ওই বুড়ি আর আপনে আম্মারে খালি কবিরাজের কাছে নিয়া যান যাতে আম্মা ভাল না হয়। আমি এইবার সব বুঝছি। আপনেগো কারণে আমি আম্মার ঘরে আইতে পারি না। আম্মা আগে ভাল হোক তারপর ওই বুড়িরে আমি ওর স্বোয়ামির কাছে পাঠায় দিমু। ডাক্তার আপা আপনে আম্মারে দেখেন।’

মাথা নেড়ে পালক কাছে যেতে জেসমিন আবারও না করছে। উপস্থিত সবাই অবাক হচ্ছে। জেসমিন এরকম করছে কেন?পরী বারবার অপমান করছে তবুও জেসমিন মানছে না। শেষে পরী আর রুমি টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো জেসমিন কে। মিষ্টি ও চলে এসেছে।
ঘন্টা খানেক পালক ছিল মালার কাছে। মালাকে একটু সুস্থ করে পালক বাইরে আসতেই পরী বলল,’কি হইছে আম্মার?আম্মা ভাল হইব তো?’
পালক কিছু না বলে জেসমিন কে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেল বাকিদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলল।পরীর তর সইছে না। রুমি পরীকে শান্তনা দিলো কারণ মেয়েটা শব্দ করে না কাঁদলেও চোখ থেকে পানি ঝরছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর পালক এসে পরীকে বলল,’পরী তোমার মায়ের অবস্থা বেশি ভাল না। শহরে নিয়ে গেলে তোমার মা ভাল হয়ে যাবে। যা করার জলদি করতে হবে। কবিরাজ তোমার মা’কে ভাল করতে পারবে না।’
পরীর ভয় হলো মালাকে নিয়ে। মালার কিছু হলে পরী কাকে নিয়ে থাকবে?শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠল। চেষ্টা করেও নিজেকে শক্ত রাখতে পারছে না পরী। মায়ের প্রতি সব মেয়েরাই দূর্বল হয়। সব কষ্ট তারা হাসিমুখে মেনে নিলেও মায়ের কষ্ট মানতে পারে না। নারীর মন কোমল পদ্মের ন্যায় পরিস্ফুটিত। মায়ের জন্য মন চোখ দুটোই কাঁদছে পরীর। নিজেকে আজ দূর্বল মনে হচ্ছে। পালক পরীর কাধে হাত রেখে বলল,’চিন্তার কোন কারণ নেই পরী। ভাল ডাক্তার দেখালে তোমার মা ভাল হয়ে যাবে।’
পরী কৃতজ্ঞতার সহিত পালকের দিকে তাকালো।পালক সৌজন্য মূলক হাসি দিল। ঘরে গিয়ে পালক কারো সাথে কোন কথা বলল না।

সকালে কারো চিল্লানোর আওয়াজে ঘুম ভাঙে পালকের। বাইরে এসে দেখে মালা পরীকে মারছে।চুলের মুঠি ধরে মেরেই যাচ্ছে। জেসমিন মালার হাত ধরে টানছে। ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্ত পারছে না। পালক নিজেও দৌড়ে গেল। পরীকে ছাড়িয়ে বলল,’কি করছেন?এভাবে কেউ মারে নাকি?’

‘ওরে মাইরা ফালামু আমি। শরীর ভাল আছিল না দেইখা কাইল কিছুই কইতে পারি নাই। বড় মাইনষের মুখে মুখে তর্ক করা শিখছে ও। এমন মাইয়া লাগব না আমার।’

পরী বলল,’সব সময় আমার লগে এমন করেন ক্যান আম্মা। আমি আপনের ভাল চাই দেইখা,,,’
মালা পরীকে থামিয়ে বলল,’তোরে আমার ভাল দেখতে হইব না। তোর মুখ বন্ধ রাখলেই আমার ভাল। আল্লাহ এই কেমন মাইয়া আমার পেটে দিলা?’

মালা বিলাপ করতে করতে চলে গেল। পরী রাগে ফুসতে ফুসতে নিজের ঘরে চলে গেল। জেসমিনের সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য প্রায়ই পরী মার খেত আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। মায়ের এরকম আচরণ পরীর ভাল লাগে না।
আফতাব বিকেলে ফিরে এসেছে। কালকে আসার কথা ছিল কিন্ত আজকে হুট করেই চলে এসেছে। মালার অসুস্থতার খবর পালক নিজে আফতাবের কাছে বলল। এও বলল সে যেন মালাকে নিয়ে শহরে ভাল ডাক্তার দেখান। নিজের পরিচিত একজন ডাক্তারের ঠিকানা ও পালক দিয়ে দিলো আফতাব কে। আফতাব দেরি করল না। পরদিন সকালে চলে গেল মালাকে নিয়ে। পরীকেও জানানো হলো না।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।