মায়ের ভালোবাসা কপালে লেখা নেই শায়েরের তাইতো অকালে মাকে হারাতে হয়েছে। মাকে কখনো বলতে পারেনি যে,মা আজ তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো। আর তুমি আমাকে গল্প বলবে। সেই গল্প শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়বো। এটা ওটা বায়না করা হয়নি মায়ের কাছে। আঁচলে মুখ মোছা হয়নি। একটু খানি মাতৃত্বের গন্ধ ও নাকে ঢেউ খেলেনি। কারণ তাকে জন্ম দিয়েই সে পরলোকগমন করেছেন। তাইতো শায়েরের জীবনটা অতি বিষাদময় কেটেছে। শৈশব কেটেছে আরো অবহেলায়। এতগুলো বছর পর কেউ তাকে খাইয়ে দিচ্ছে ভাবতেই ভালো লাগছে ওর। মালা পরম যত্নে খাবার তুলে দিচ্ছেন শায়েরের মুখে। আর শায়ের বাচ্চাদের মতো খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে বাইরে এসে চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু সযত্নে মুছে নিলো সে।
মালা যে শায়ের কে খাইয়ে দিয়েছে তা পরীর কানে যেতে সময় লাগলো না। পরীর চামচা কুসুম গিয়ে বলে,’জানেন পরী আপা বড় মায় শায়ের ভাইরে খাওয়াইয়া দিছে আইজ। ভাইয়ের হাত নাকি পুইড়া গেছে। আমি নিজের চক্ষে দেইখা আইলাম।’
-‘কি বলিস??আচ্ছা আম্মাকে কিছু বলছে সে??’
-‘কি কইবো??’
-‘হাত পুড়েছে কিভাবে??’
-‘কইলো তো হারিকেনে পুড়ছে।’
পরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভয় পেয়ে গিয়েছে সে। যদি শায়ের ওর নাম বলতো তাহলে মালা ওর হাতটাও পুড়িয়ে দিতো। কিন্ত মালা শায়ের কে খাইয়ে দিয়েছে শুনে মুখ বাকিয়ে সে বলে,’সামান্য একটা কাজের ছেলেকে আম্মা খাইয়ে দিলো!!’
-‘কি করবে কন আপা। একে তো হাত পুইড়া গেছে। তার উপর জ্বর উঠছে। নিজের বাড়িও যাইতে পারব না। মা নাই তো। কে সেবা করবো?ভাইডা অনেক ভালা আপা।’
মনক্ষুণ্য হলো পরীর কথাটা শুনে তবে অতটা খারাপ লাগলো না। কারণ মা হারা শায়েরের কষ্ট টা সে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারলো না। মা হারা সন্তানের কষ্ট সেই বোঝে যে মা হারিয়েছে। মায়ের আঁচলের নিচে থেকে অতি আদরে বড় হয়েছে পরী। তাই সে শায়েরের কষ্ট বুঝবে কি??
কবির নওশাদকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। কেননা নওশাদের পা কেবল মচকায়নি। বাজে ভাবে ভেঙে গেছে। তাই কবির নূরনগরে না এসে নওশাদের বাড়ি চলে গেছে। ডাক্তার পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে ওষুধ ও দিয়েছে। একজনকে দিয়ে আফতাব কে খবর পাঠিয়েছে কবির।
খবরটা জানার পর সবচেয়ে বেশি খুশি হলো পরী। যাক আপদ বিদায় হয়েছে। এখন সে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়বে। মোনাজাতে পরী আল্লাহ কে বলেছিল,’আল্লাহ ওই নওশাদকে তুমি আমার কপাল থেকে উঠাইয়া নাও তাহলে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়বো।’
আল্লাহ পরীর দোয়া কবুল করেছে। তাই পরীও নফল নামাজ পড়বে। খুশিমনে পরী নিজের ঘরে চলে গেল।
অক্টোবর মাস,,,,,
বন্যার সমাপ্তি ঘটেছে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে। পুরো তেত্রিশ দিন প্রলয়কারি বন্যা ছিলো। বাংলাদেশের ৬৮ শতাংশ ডুবে গিয়েছিল এ বন্যায়। সেই দুর্ভিক্ষ এখনও নূরনগরের বাসিন্দারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পুনরায় নিজেদের ঘরবাড়ি ঠিক করে কোনমতে জীবনযাপন করছে। তবে অভাব তাদের ফুরাচ্ছে না। তাই গ্রামের অধিকাংশ পুরুষই শহরে পাড়ি জমিয়েছে। সম্পান মাঝিও শহরে গেছে। পদ্মা তো তার সব জল নিয়ে গেছে। এখন আর মাঝিগিরি করলে তার পোষাবে না। বিন্দুকে নিজের ঘরোনি করতে হবে তো। কাজ না করলে মহেশ কি তার হাতে বিন্দুকে তুলে দেবে?? সম্পান ভেবেছে ফেরার সময় বিন্দুর জন্য লাল রঙের শাড়ি কিনে আনবে। এর আগে আনতে চেয়েছিল কিন্ত আচানক পালকের মৃত্যুতে তা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্ত এখন সে বিন্দুর জন্য নিজে পছন্দ করে শাড়ি নিয়ে যাবে।
সম্পানের ভাগ্য ও ভালো বলা বাহুল্য। গ্রামে আসতেই পথে বিন্দুর দেখা। সম্পান খুশি হয়ে বিন্দুর কাছে এগিয়ে গেল। শাড়ির ব্যাগটা বিন্দুর হাতে দিয়ে সুধালো,’দ্যাখ বিন্দু তোর লাইগা শাড়ি আনছি।’
শাড়িটা বের করে খুশিতে বিন্দুর চোখজোড়া চকচক করে উঠলো। চোখে খুশির ঝিলিক দেখে সম্পান ও খুশি হলো। শাড়ি থেকে চোখ সরিয়ে সম্পানের দিকে তাকিয়ে বিন্দু বলল,’শাড়িটা খুব সুন্দর হইছে গো।’
-‘ব্যাগের মধ্যে আরো একখান জিনিস আছে।’
বিন্দু ব্যাগ হাতে বড় একটা সিঁদুর কৌটা বের করলো। বিষ্মিত চোখে তাকালো সম্পানের দিকে। শ্যামা কন্যা বিন্দুর মুখে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই পুরুষ কে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এতো নিখুঁত ভাবে একমাত্র সম্পান ই পারে ভালোবাসতে।
-‘আমি অপেক্ষা করতাছি তোরে এই সিঁদূর পরানের।’
-‘খুব তাড়াতাড়ি সেইদিন আইবো??’
-‘হ রে বিন্দু। আমি আর বেশি দেরি করমু না বিন্দু। এইবার শহরে গেলে বিয়ার সবকিছু কিইনা আনমু।’
একটু লজ্জা পেলো বিন্দু। নিজের বিয়ের কথা শুনলে সব মেয়েরাই লজ্জা পায়। তেমনি বিন্দুও পেলো। মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা সবটুকু সে সম্পান কে দিতে চায়। আঁকতে চায় ছোট একটি সুখি পরিবারের ছবি। সেখানে একটি ছোট্ট গ্রাম আর ছোট্ট একটি পরিবার থাকবে। মনে মনে নিজের ইচ্ছেগুলো পোষন করে সম্পানের পিছু পিছু হাটা ধরে বিন্দু। কাঁচা রাস্তায় কিছুক্ষণ হাটার পর দুজন আলাদা পথ ধরে। রাস্তার পাশের ধান ক্ষেতের আইল বরাবর বিন্দু নেমে পড়ল। আর সম্পান রাস্তার পথ ধরলো। দুকদম এগিয়ে থেমে গেল বিন্দু। পেছন ফিরে গলা ছেড়ে ডাকলো সম্পান কে।
-‘বিন্দুর মাঝে কি এমন দেখলা যে তোমার বিন্দুরেই লাগবো??’
সম্পান হেসে বলে,’বিন্দুরে দেখার পর তো আর কাউরে দেখি নাই। দুনিয়ার সবচাইতে সুন্দর মাইয়ারা যদি আমার সামনে আসে তাগো মাঝে আমি এই বিন্দুরেই খুজমু। আমার খালি বিন্দু হইলেই চলবো।’
বিন্দু এ লজ্জা কোথায় লুকাবে??লাল শাড়িটি দিয়ে মুখ ঢেকে সামনের দিকে দৌড় দিলো। তবে লজ্জাবতীর লজ্জা লুকাতে পারলো কই??ধান ক্ষেতের প্রতিটা শীষ দেখে নিলো। স্বাক্ষী রইলো আকাশ, হাওয়া আর গগনে উড়ে চলা একঝাক পাখি। কিন্ত শ্যামলতা বিন্দু ভাবলো তার লজ্জা সে আড়াল করে ফেলেছে। সম্পান দূর থেকেই বিন্দুর দৌড়ানো দেখছে। কিছুদূর গিয়ে ধপ করে মাটিতে পড়ে গলো বিন্দু। উঠে আবার দৌড় লাগালো। সেই দৌড় গিয়ে থামলো জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গনে।
বন্যা শেষে জমিদার বাড়ির চেহারা পাল্টে গেছে। আগের মতো নেই। দরজার বাইরে কড়া পাহারা। ছয়জন মিলে বাইরে পাহারা দিচ্ছে। বৈঠকে ও দুজন আছে। আগের কঠোর রূপ ধারন করেছে জমিদার বাড়ি। যেখানে প্রবেশ করতে হলে আফতাবের অনুমতির প্রয়োজন। জমিদার বাড়ির বিশাল প্রাঙ্গনে গাড়ি ভিড়েছে চার খানা। তিনখানা ভ্যানগাড়ি হলেও একখানা গরুর গাড়ি। গাড়িতে মালপত্র ওঠাচ্ছে দুজন। কেমন একটা সাজ সাজ রব। অবাক নয়নে সব দেখতে দেখতে বিন্দু পা বাড়ায় বৈঠকে ঢোকার বিশাল দরজায়। লতিফের অনুমতি পেয়ে বৈঠক পেরিয়ে অন্দরে পা রাখলো বিন্দু।
কুসুম ব্যতীত আরো তিনজন কাজের মেয়ে রাখা হয়েছে। তারা এই গ্রামেরই মেয়ে। চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না বিন্দুর। তবে তাদের সাথে কথা না বলে বিন্দু গেলো তার প্রিয় সখির কাছে।
পরীকে আজ নতুন নতুন লাগছে। নতুন পোশাকে তৈরি করছে নিজেকে পরী। দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যাবে সে। বিন্দু ঘরে ঢুকেই বলল,’পরী কই যাবি তুই??জেডি তোরে যাইতে দিবো??’
ঘাড় ঘুরিয়ে প্রাণখোলা হাসি হাসে পরী। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বিন্দুকে।
-‘পরী ছাড় আমারে। আমার কাপড় নোংরা তোর কাপড় নষ্ট হইবে তো!!’
পরী বিন্দুকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,’তোকে না বলেছি এসব কথা না বলতে? শরীরে ময়লা তো কি হয়েছে তোর মনটা তো পরিষ্কার।’
-‘নাহ,তুই কোথাও যাবি তাই কইলাম। তা যাবি কই??’
-‘রুপা আপার শ্বশুরবাড়ি। আপার ননদের বিয়ে। আমাদের যেতে বলেছে। তাই যাচ্ছি।’
-‘জেডি তোরে নিবো??’
-‘না নিয়ে যাবে কই!!আপার শ্বশুর যেভাবে বলে গেছে না গিয়ে উপায় নেই। তাই আমিও যাচ্ছি।’
-‘ওহ,পরী তোর কাছে একখান জিনিস রাখতে দিমু রাখবি??’
কথা শেষ করেই সিঁদূর কৌটোটা বাড়িয়ে দিল পরীর দিকে। বিন্দুর হাতে থাকা লাল শাড়ির দিকে এতক্ষণে চোখ পড়ল পরীর। সুন্দর শাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে,’কে দিলো এই শাড়ি??’
বিন্দু সম্পানের দেওয়া শাড়ি আর সিঁদূর কৌটোর কথা খুলে বলল। পরী সযত্নে সিঁদূর কৌটোটা আলমারিতে তুলে রাখে। বেশি সময় নেই তার তাই সখিকে বিদায় দিলো।
কালো বোরখাটা গায়ে জড়িয়ে নেকাপ বেধে নিলো।
তারপর নিচ তলায় গেলো। মালা,জেসমিন,জুম্মান সবাই তৈরি। আবেরজান যেতে পারবে না। তার সে ক্ষমতা নেই। দুজন কাজের মেয়েকে রেখে গেলো আবেরজানের কাছে। কুসুম আর নতুন কাজের মেয়ে শেফালিকে সাথে নিলো।
গরুর গাড়ি আনা হয়েছে পরীর জন্য। কেননা গরুর গাড়ি চড়তে পরী খুব পছন্দ করে। তাই তো এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। মালা,জেসমিন ওঠে এক গাড়িতে।আফতাব আর আখির অন্য গাড়িতে। শায়ের সহ আরও দুজন উঠেছে অপর গাড়িতে। গরুর গাড়িতে পরীর সাথে জুম্মান,কুসুম আর শেফালি। পরীকে দেখে রাখার জন্যই ওদের সাথে দিয়েছে মালা।
কাঁচা মাটির রাস্তায় হেলেদুলে চলছে গরুর গাড়ি। পরীর ভিশন ভালো লাগছে। মাটির গন্ধ আসছে নাকে। সাথে গ্রামের দৃশ্য। নেকাবের নিচে হাস্যজ্বল চোখে সব দেখছে পরী। হঠাৎই রাস্তার পাশে নাম না জানা বেগুনি রঙের ফুলে চোখ আটকে গেল পরীর। ফুলের প্রতি প্রতিটি নারীর টান অনবদ্য। পরী ফুল ছোঁয়ার লোভে গাড়ি থামিয়ে কুসুম কে পাঠালো ফুল ছিড়ে আনতে।
গাড়ি থেকে নেমে কুসুম ছুটলো সেদিকে। কিন্ত ফুলে হাত দিতেই ঘটলো অঘটন। পাশে কদম গাছের নিচে বসে থাকা সুখান পাগলকে সে খেয়াল করেনি। কুসুম ফুলে হাত দেওয়ার আগেই সুখান পাগল তার হাত টেনে ধরে। চেঁচিয়ে বলে,’তুই আমার রানীর ফুল ছিড়বি?ওই ছেমরি! তোর চুল আমি সব ছিইড়া ফালামু।’
ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছে কুসুমের। পরীর আদেশে সে ভুলেই গিয়েছে যে এখানে সুখান থাকে। সুখান চুল টেনে ধরে কুসুমের। কুসুম এক চিৎকার দিলো,’পরী আপা আমারে বাঁচান।’
চমকে গাড়ির ভেতর থেকে উঁকি মারে পরী। শেফালি জুম্মান ততক্ষণে নেমে পড়েছে কিন্ত সুখানকে দেখে ওরা আগানোর সাহস পেলো না। কুসুম চিৎকার করে বলছে,’আমি তোর রানীর ফুল ছিড়মু না ছাড় আমারে।’
-‘তোরে ছাড়লে তুই আবার ফুল ছিড়বি!!’
– ‘আল্লাহ গো আমারে রক্ষা করো তাইলে আমি পাগলরে ভিক্ষা দিমু।’
লাঠি হাতে গাড়ি চালক এগিয়ে গিয়ে কুসুম কে ছাড়িয়ে আনলো। কাঁদতে কাঁদতে কুসুম গাড়িতে উঠতেই পরী বলল,’আমি বুঝিনি কুসুম যে ওখানে পাগলটা থাকে। তাহলে আমি তোকে যেতে বলতাম না।’
কুসুম রাগ করে হাটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল। একে তো ভয় পেয়েছে তার উপর চুলের ব্যথা। সেজন্য কাঁপছে কুসুম। পরীর মন খারাপ হল তা দেখে।
জুম্মান প্রশ্ন করে বসে,’আপা রানী কেডা? ওই পাগলটা রানী কইলো কারে??’
জবাব টা পরী দিতে পারলো না। সে জানে না তবে শেফালি বলল,’সুখান পাগলার বউ রানী। আগে ও ভালাই আছিলো কিন্ত বউ মরার পর পাগল হইয়া গেছে। গ্রামের সবাই এইয়াই কয়।’
পরী অবাক হয়ে বলে,’ভালোবাসা মানুষ কে পাগল করেও দেয়??’
-‘যে সত্যি ভালোবাসে সে তো পাগল হইবোই।’
পরী আর কথা বলল না। সারা রাস্তা সুখানের কথা চিন্তা করতে করতে গেলো।
পরীদের আগেই বাকিরা পৌঁছে গেছে রুপালির শ্বশুরবাড়ি। পরীরা পৌঁছাতেই কয়েকজন মেয়ে এসে ওদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। আশেপাশে না দেখে মাথা নিচু করে পরী চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর জুম্মান এসে খবর দিলো এখানে নওশাদ ও এসেছে। সে লাঠিতে ভর দিয়ে হাটাচলা করছে। তার পা এখনো ঠিক হয়নি। পরী ভাবলো তাহলে কি নওশাদের সাথে পরীর বিয়েটা ভাঙতে চলছে???