প্রেমালিঙ্গণ | পর্ব – ১২

9 Min Read

মাঝেই দুটো দিন কে’টে গেছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তন্দ্রা রেডি হচ্ছে। ভার্সিটিতে আজ প্রথম বর্ষের স্টুডেন্টদের নবীন বরণ হচ্ছে। কালো রঙের লং গাউন পড়েছে তন্দ্রা। ইলোরা শাড়ি পড়তে বলেছিল। শাড়িতে খুব একটা কমফোর্টেবল ফিল আসে না তন্দ্রার। তাই সে ইলোরার কালো শাড়ির সাথে মিলিয়ে কালো গাউন পড়ল। হালকা সাজের সাথে ধূসর রঙের হিজাব করেছে। ইলোরা একটু পর পর কল দিচ্ছে৷ রেডি হয়ে নিজের ঘর থেকে বের হলো তন্দ্রা। সকালের নাস্তা আগেই করে নিয়েছিল সে। মিসেস তাহেরা আর মিসেস সাহেরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তন্দ্রা বাড়ি থেকে বের হলো। স্বাক্ষর অনেকক্ষণ আগেই নাস্তা করে হসপিটালে চলে গেছে হয়তো। তন্দ্রা স্বাক্ষরের সামনে খুব একটা যায় না। এমনকি প্রয়োজন পড়লেও কোনো কথা বলে না। মি. ইলিয়াস মাহমুদ জানিয়ে দিয়েছেন আজ সন্ধ্যায় জোভানের বাবা মা এসে তন্দ্রাকে আংটি পড়িয়ে যাবেন। বিয়ের জন্য উনারা দেরি করতে চাইছেন না। এই নিয়ে তন্দ্রা কোনো কথাই বলেনি। সবাই তার নীরবতাকে সম্মতির লক্ষ্মণ মনে করে নিয়েছে।

পায়ে হেঁটে কিছুটা সামনে রাস্তায় এসে দাঁড়াল তন্দ্রা। কোনো রিকশাই পাওয়া যাচ্ছে না। এক্টুকুতেই বিরক্ত হলো সে। ইদানীং ক্ষণে ক্ষণে একরাশ বিরক্তি জেঁকে বসে। মেজাজ হয়ে থাকে খিটখিটে। হঠাৎ করেই সাক্ষর তার বাইক এনে দাঁড় করাল তন্দ্রার সামনে। সে তাকে দেখে সামনের দিকে হাঁটা ধরল। স্বাক্ষরও কম যায় না। সেও তন্দ্রার পিছু পিছু বাইক ধীর গতিতে চালিয়ে গেল। এদিকে একটা রিকশারও দেখা মিলছে না।

“আজকের পর থেকে আমার উপর আর অভিমান করে থাকতে হবে না।”

স্বাক্ষরের বলা কথা শুনে তন্দ্রা চলার গতিবেগ থামিয়ে দিল। পা যেন সামনের দিকে যাবে না বলে বায়না ধরেছে। সত্যিই তো আজ যদি জোভানের বাবা মা এসে আংটি পড়িয়ে যান তাহলে সে আর কার উপর এভাবে রাগ করে থাকবে! তন্দ্রা ভেতরে যেন প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। স্বাক্ষর আবারও বলল‚

“আজকের পর থেকে সব অন্যরকম হয়ে যাবে তন্দ্রাবতী।”

“হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ‚ আজকের পর থেকে সব কিছু অন্যরকমই হয়ে যাবে।”

“চলো আমিই তোমাকে আজ ভার্সিটি পৌঁছে দিয়ে আসি।”

তন্দ্রা একবার ভাবল‚ আজই তো শেষ সুযোগ স্বাক্ষরের সাথে যাওয়ার। তাহলে সে কেন এই সুযোগটাকে হাত ছাড়া করছে! অবশ্যই সে যাবে তার সাথে। নিজের মনের প্রশান্তির জন্য হলেও যাবে।

“হেলমেট দাও।”

স্বাক্ষরের যেন তন্দ্রার উত্তর জানা ছিল। সে তার হাতে রাখা হেলমেট এখনো তন্দ্রার দিকেই এগিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে তাকিয়ে স্বাক্ষরের সাথে কথা বলছিল‚ যার দরূন তার হাতে থাকা হেলমেট তন্দ্রা দেখেনি। স্বাক্ষরের হাত থেকে তাড়াতাড়ি করে তন্দ্রা হেলমেট নিয়ে পড়ে। এরপর বাইকে উঠে বসে। আজও সে স্বাক্ষরের থেকে কিছুটা দূরত্ব মেইনটেইন করছে।

“এই দূরত্বটা শুধুমাত্র একটা বাহানা। আসল দূরত্ব তো তোমার আমার মনের। একদিন সব দূরত্ব ঘুচে যাবে। সেদিন আমরা বড্ড কাছে চলে আসব।”

তন্দ্রা স্বাক্ষরের কথা আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারল না। সে তার কিছুটা কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে। স্বাক্ষর খুব সাবধান হয়ে বাইক চালানোয় মনোনিবেশ করল। এরই মাঝে আয়নার সন্তপর্ণে বার দুয়েক তন্দ্রাকে দেখে নেয় স্বাক্ষর। কালো রংটায় তার তন্দ্রাবতীকে আরও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। স্বাক্ষর গুনগুন করে একটা গানের লাইন ধরে।

❝তোকে খুব ভালোবাসি‚ ছুটে তাই কাছে আসি
দুজনের রব দুজন‚ এভাবেই বারোমাসই❞

লাইনটা বড্ড প্রিয় তন্দ্রার। সেদিন গাড়িতে বসে “ইমরান” এর গাওয়া এই গানটি শুনেছিল। গানের লাইন গুলো যেন তারই মনের কথা। দারুণ ভাবে উপভোগ করেছিল সেদিন এই গানটাকে। সমস্ত ভাবনাকে দূরে রেখে স্বাক্ষর তন্দ্রাকে নিয়ে ভার্সিটির সামনে চলে আসে। তন্দ্রা বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল। স্বাক্ষরের দিকে না তাকিয়েই বলল‚

”আসছি।”

তন্দ্রা চলে আসতে নিলে স্বাক্ষর তার হাত ধরে ফেলল। বাঁধা পেয়ে থেমে গেল তন্দ্রা। স্বাক্ষর বাইকের চাবিটা প্যান্টের পকেটে রেখে দিয়ে তন্দ্রার সামনে এসে দাঁড়ায়।

“আজকের দিনটা তোমার সাথেই সময় কা’টাব তন্দ্রাবতী।”

“কিন্তু!”

”কোন কিন্তু না। চল ভেতরে।”

নবীন বরণের সকল কার্যক্রম অডিটোরিয়ামে আয়োজন করা হবে। সকল শিক্ষার্থী সেখানেই গিয়ে বসছে। ভেতরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। সিনিয়র রা মিলে নতুনদের বরণ করে নিচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে দুটি করে রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে স্বাগতম জানাচ্ছে। স্বাক্ষর তন্দ্রার হাত ধরে একটা কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যেই ভীড় হয়ে আসছে। দুজনে অডিটোরিয়ামের ভেতরে চলে যায়। স্বাক্ষর সামনের একটা চেয়ার টেনে তন্দ্রাকে বসায়। অল্প কিছু সময়ের মাঝেই সকল আয়োজন শুরু হয়ে যাবে।

অন্য দিকে বাড়িতে মিসেস তাহেরা অধীর আগ্রহে রান্না করছেন। বিভিন্ন পদের সুস্বাদু খাবার রান্না করায় ব্যস্ত উনি। মিসেস সাহেরা কিছুতেই কিছু করে আটকাতে পারছেন না এই আয়োজন। একমাত্র তিনি জানেন স্বাক্ষর কী পরিমান তন্দ্রাকে তার জীবনে চায়। মায়ের কোলে মাথা রেখে তার একটাই বায়না “তন্দ্রাবতীকে সে বউ হিসেবে চায়” এতে মিসেস সাহেরার কোনো সময়ই আপত্তি ছিল না। কাল রাতে তিনি এই কথাটা ইলিয়াস মাহমুদকে জানিয়েছেন। তিনি বিষয়েটাকে খুব একটা আমলে নেননি। উনার একটাই কথা‚ উনি কিছুতেই নিজের কথা খেলাপ করবেন না। আর যেখানে তন্দ্রা কোনো আপত্তি করছে না। হয়তো বা তন্দ্রাও এই বিয়েতে মত আছে। মিসেস তাহেরা রান্নার দিকটা দেখছেন। মিসেস সাহেরা মাহমুদ বাকি সকল কাজ করে নিজের ঘরে গেলেন। বেশি কিছুক্ষণ থম মে’রে বিছানায় বসে রইলেন।

এইতো কিছুদিন আগের ঘটনা। মায়ের কোলে মাথা রেখে স্বাক্ষর এই সেই কত ধরনের আবদার করছিল। তার মধ্যে একটা আবদার ছিল তন্দ্রাকে নিয়ে। মিসেস সাহেরা খুশি মনে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সকল আবদার খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। তখনই ঘরে আগমন ঘটল তন্দ্রার।

“বড়ো মা!”

“ওই তো আমার মেয়েটা চলে এসেছে।”

খুব খুশি হয়ে কথাটা বলেছিলেন মিসেস সাহেরা। স্বাক্ষর উনার কথায় ফোড়ন কে’টে বলে উঠল।

“ওমনি! এখন তো আমাকে ভুলেই যাবা। জানি তো আমি সবই।”

স্বাক্ষরের কথায় তন্দ্রা আর মিসেস সাহেরা একে অপরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

“তুমি কী আমাকে হিংসা করছ?”

“তোর কী আমাকে দেখে হিংসুটে মনে হয়?”

“মনে হওয়ার কী আছে? তোমার কথাতেই বুঝা যাচ্ছে। তবে যাই বল বড়ো মা’র আদরের ভাগ কোনো ভাবেই ছাড়বে না এই তন্দ্রাবতী।”

“তোরা থামবি? কী শুরু করলি দুজনে?”

কথাগুলো মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠলেন মিসেস সাহেরা। তাহলে কী সত্যি সত্যিই তন্দ্রার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে? তাহলে তিনি স্বাক্ষরকে কী করে সামলাবেন?

স্টেজে মুহিত আর ইলোরা নাচের পারফর্ম করছে। দুজনে বেশ ভালোই নাচ করছে। তন্দ্রা নিজের ফোনে ওদের ভিডিও করছে। সবাই বেশ উপভোগ করছে। স্বাক্ষর তন্দ্রার পাশের চেয়ারটায় বসে আছে। বরাবরই তার এই হৈ-হুল্লোড় নিয়ে খুব একটা কৌতুহলী নয়। ভালো লাগে না তার এই সব। তবে তার তন্দ্রাবতীর সব কিছুই ভালো লাগে। গান হোক নাচ হোক সব কিছুই ভালো লাগে। সবাই স্টেজে নাচ দেখায় ব্যস্ত আর এদিকে স্বাক্ষর ব্যস্ত তার তন্দ্রাবতীতে। খুব হৈ-হুল্লোড়ও হচ্ছে। সবাই খুব করে উপভোগ করছে আজকের এই আয়োজনটাকে।

নবীন বরণের সকল আয়োজন শেষ হতেই স্টুডেন্টরা এক এক করে সবাই চলে যেতে থাকে। এদিকে তন্দ্রার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। স্বাক্ষর কেন তাকে নিজের মনের কথাটা বলে না! এই নিয়ে এক আকাশ সময় অভিযোগ পুষে রেখেছে সে। বাসায় ফেরার সময়ও হয়ে আসছে। তার বুক ধুকপুক করছে ক্রমাগত। কী আছে কপালে‚ আল্লাহ ভালো জানেন। স্বাক্ষর তন্দ্রার পাশে দাঁড়িয়েই ইলোরা আর মুহিতকে ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত করল। দুজনে স্বাক্ষরের ইশারা বুঝতে পেরে ভার্সিটি থেকে চলে গেল। স্বাক্ষর তন্দ্রাকে নিয়ে বাইক পার্কিং সাইডে এলো। কম বেশি অনেকেই ইতিমধ্যে চলে গেছে। কিছুক্ষণ একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল দুজনে। আজ স্বাক্ষরের কাছে তার তন্দ্রাবতীকে “বউ বউ লাগছে” সে বাইকের হেলমেটটা তন্দ্রার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে‚

“বিয়ে করবে আমাকে?”

স্বাক্ষর যে এমন কথা বলবে সেটা তন্দ্রার ভাবনাতীত ছিল। এমন একটা কথায় কী উত্তর দেওয়া যায়‚ ভেবে পেল না তন্দ্রা। তার এই ছন্নছাড়া প্রশ্নের উত্তর কী-ই বা হতে পারে‚ জানা নেই তার। বিয়ের কথা যখন বলেছে আরও আগে বলা উচিত ছিল‚ নয় কী? সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তন্দ্রার। অকপটে সেও উত্তর দিল।

“না।”

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।