সকাল হতে না হতেই বাড়িতে আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ফ্যামিলিগত ভাবেই স্বাক্ষর তন্দ্রার রিসেপশন আয়োজন করা হচ্ছে৷ ইলিয়াস মাহমুদ আর ইউসুফ মাহমুদ এর অফিস থেকে কিছু সংখ্যক মানুষ ইনভাইট করার হয়েছে। প্রতিবেশিদেরও আসতে বলা হলো। ইলোরার বাবা মা আর ছোট ভাই এসেছে। মুহিতের পরিবার থেকেও তার বাবা মা এসেছেন। মুহিত তার বাবা মায়ের একটা মাত্রই ছেলে। স্বাক্ষরের বেস্টফ্রেন্ড আকাশও এসেছে। রিসেপশনটা বাড়িতেই করা হবে। দুপুরের দিকে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়েছে। স্বাক্ষর আজ বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠল। স্বাক্ষর বেশ কয়েকবার তন্দ্রার সাথে দেখা করতে চেয়েছে কিন্তু কাজিনমহলের কেউই তন্দ্রার সাথে তার দেখা করতে দিতে চাইছে না। তাদের একটাই কথা, তন্দ্রাকে সাজানোর পর দেখতে পারবে। এদিকে স্বাক্ষর তন্দ্রাকে দেখার জন্য মনে মনে বেশ ছটফট করছে।
তন্দ্রার লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করে আনা ল্যাভেন্ডার কালার পাঞ্জাবি পড়েছে স্বাক্ষর। জুম্মার নামাজের সময় হয়ে এসেছে। বাড়ির সব পুরুষরা মসজিদে চলে গিয়েছে নামাজ আদায় করার জন্য। মেহমানদের আপ্যায়নের সব কাজ প্রায় হয়ে এসেছে। ঘন্টা খানেক পর সবাই আসতে শুরু করল। পার্লার এর একটা মেয়ে এসেছে তন্দ্রাকে সাজানোর জন্য। ফর্সা গায়ে ল্যাভেন্ডার কালার লেহেঙ্গাটা দারুণ মানিয়েছে তন্দ্রাকে। হাল্কা পার্টি সাজ। লম্বা চুলগুলো কার্লি করা। মাথায় স্টোনের ক্রাউন আর হাল্কা কিছু অর্নামেন্টস। তন্দ্রাকে সাজানো শেষ হলেই পার্লার এর মেয়েটা চলে গেল। তন্দ্রার ঘরে এখন শুধু ইলোরা‚ হেনা‚ হাসনা আর শিরিন আছে। তন্দ্রাকে যখন সাজাচ্ছিল সেই সুযোগে ওরাও তৈরি হয়ে নিয়েছে। ইলোরা এসে তন্দ্রার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে বলল‚
“একদম পরীর মতো লাগছে রে তোকে। নোসপিনটা দারুণ মানিয়েছে৷”
“ভাইয়া তো কাল রাত থেকে তোর সাথে দেখার করার জন্য ছটফট করছে।”
শিরিনের কথায় তন্দ্রা লজ্জা পেল। আজ তার বেশ লজ্জা লজ্জা পাচ্ছে। তাকে আরও লজ্জা দেওয়ার জন্য হাসনা বলল‚
”কী দিয়ে জাদু করলি রে ভাইকে?”
”তোর নাক ফুটো করার বিষয়টা ভাইয়া বাদে বাড়ির সবাই জানে। তার কাছ থেকে লুকোচুরি কেন? আড়ালে তো ঠিকই তাকে দেখছিস।”
হেনা প্রশ্নটা করেই ভ্রু কুচকালো। ইলোরা তার দিকে তাকিয়ে বলল‚
”আরে বুঝ না, ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিবে সারপ্রাইজ।”
“বেশি বেশি বলছিস তোরা। এমন কিছুই না।”
“এমনটাই৷ নয়তো কেন বললি স্বাক্ষর ভাইয়া যেন বউ সাজের আগে তোকে না দেখে? শপিং এ মাস্ক পড়ে গিয়েছিলি কেন?”
“হয়েছে বোন মাফ কর।”
মিসেস তাহেরা তন্দ্রার ঘরে এলেন ডাকার জন্য। মেয়েকে একপলক তাকিয়ে দেখে নিলেন। মেয়ের বিয়ে নিয়ে কত কিছু ভেবে রেখেছিলেন তিনি। আল্লাহর হয়তো এটাই ইচ্ছে ছিল। ধীর পায়ে মেয়ের কাছে এগিয়ে এলেম মিসেস তাহেরা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন‚
“মাশাআল্লাহ৷”
তন্দ্রা হাসি মুখে তার মা’কে দেখতে থাকে। মিসেস তাহেরা ওদের সকলকে তাড়া দিয়ে বললেন‚
“হলো তোদের? তন্দ্রাকে নিয়ে ড্রইং রুমে আয়।”
তাহেরা মাহমুদ এর কথা শিরিন মনে মনে কিছু একটা ভাবল। হেনাকে ইশারায় কিছু একটা বোঝায়।
“ফুপি তুমি যাও আমরা তন্দ্রাকে নিয়ে আসছি।”
মিসেস তাহেরা হেসে চলে যেতে নিলে হেনা উনাকে আটকে দিয়ে বলল‚
“ফুপি যাওয়ার সময় শুভ, সাইফ আর মুহিতকে পাঠিয়ে দিও৷”
“আচ্ছা।”
মিসেস তাহেরা যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর ওরা তিনজন তন্দ্রার ঘরে এলো। এরপর সবাই একসাথে ঘর থেকে বের হয়। শুভ‚ সাইফ আর মুহিত সামনে দাঁড়িয়ে। ওদের জন্য তন্দ্রাকে দেখাই যাচ্ছে না। মেহমানরা সবাই তন্দ্রাকে দেখার জন্য ড্রইং রুমেই অপেক্ষা করছে। স্বাক্ষর তো অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে৷ বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে আছে। হচ্ছে টা কী! কাল রাত থেকে সে তন্দ্রার দেখা পাচ্ছে না। আর এই ছেলে মেয়ে গুলো তো হাড়বজ্জাত। কতবার চেষ্টা করল তন্দ্রাকে একটিবার দেখার। বারবারই তার চেষ্টা বিফলে। স্বাক্ষরের বিরক্তি মাখা মুখটা দেখে এখানে উপস্থিত মিটিমিটি হাসছে। তার কাছে এসে তন্দ্রার সামনে থেকে ওরা সবগুলো সরে দাঁড়ায়। তন্দ্রাকে দেখা মাত্রই স্বাক্ষরের দৃষ্টি থমকে গেল। চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গিয়েছে সে। আজ তন্দ্রাকে তার কল্পনার তন্দ্রাবতীর মতোই লাগছে। এতোদিন যেমনটা সে কল্পনা করে এসেছে। তার হাতটা বুকে চলে গেল অটোমেটিক। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করছে তার তন্দ্রাবতীকে দেখে। স্বাক্ষর খেয়াল করল তন্দ্রা নাক ফুটো করিয়েছে এবং তার দেওয়া নোসপিনটাই সে পড়ে আছে। দেখতে খুব মায়াবী লাগছে। লাইটের আলোতে ক্ষণে ক্ষণে জ্বলজ্বল করে উঠছে।
স্বাক্ষর আর তন্দ্রাকে এক সাথে বসান হলো। মেহমানরা সবাই বেশ প্রশংসা করছে ওদের দুজনকে একসাথে দেখে। দুজনকে নাকি পাশাপাশি খুব সুন্দর মানিয়েছে। মেহমানদের খেতে দেওয়া হয়েছে। এদিকে শুভ‚ শিরিন‚ হেনা‚ হাসনা‚ সাইফ‚ মুহিত‚ ইলোরা একত্রে মিলে স্বাক্ষর তন্দ্রার সাথে গ্রুপ সেল্ফি তুলছে। এখন গোধুলি বিকেল। মেহমানরা সবাই এতক্ষণে চলে গেছে। মুহিত আর ইলোরার বাড়ির সবাইও চলে গিয়েছেন। ছাদে তন্দ্রার লাগানো কাঠগোলাপ গাছটায় আজ অনেক ফুল ফুটেছে। একসাথে এতোগুলা ফুল দেখে তন্দ্রা ভীষণ খুশি হয়ে যায়। শুভ তার ক্যামেরা দিয়ে স্বাক্ষর আর তন্দ্রাকে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে ছবি তোলে।
ইলোরা আর মুহিত আজ রাতে তন্দ্রাদের বাড়িতে থেকে গেছে। দুপুর থেকে পড়ে থাকা ল্যাভেন্ডার কালার পাঞ্জাবিটা অনেক আগেই চেঞ্জ করে ফেলেছে স্বাক্ষর। বিকেলে ছবি তোলা শেষ হবার পরপরই তন্দ্রা তার ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। এতো সময় লেহেঙ্গা পড়ে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল তার। ফ্রেশ হয়ে লাল রঙের লং জামা পড়ে নেয়। গলায় চিকন চেইন আর দু’হাতে দুটো চিকন চুড়ি পড়ে আছে। নোসপিন পড়ার পর থেকে তন্দ্রাকে দেখতে বউ বউ লাগছে৷ একটু পর সে নিজেকে আয়নায় দেখছে। আনমনেই লজ্জা পাচ্ছে। স্বাক্ষরের ঘরটা ছোট্ট ছোট্ট ক্যান্ডেল লাইট দিয়ে সাজিয়েছে আকাশ‚ শুভ‚ সাইফ আর মুহিত মিলে। ক্যান্ডেল দিয়ে সাজানোর কথাটা স্বাক্ষরই আকাশকে বলেছিল। বেস্টফ্রেন্ডকে যা বলা যায় তা তো ছোটদের বলতে পারবে না। আকাশ পরে বাকিদের জানিয়ে দেয় ক্যান্ডেল দিয়ে সাজাতে।
রাত সাড়ে এগারোটার দিকে তন্দ্রাকে স্বাক্ষরের ঘরে নিয়ে আসা হয়। তন্দ্রাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে ওরা সবাই ঘরে বাইরে চলে যায়। এসি চলার মাঝেও তন্দ্রার হাত একটু আধটু ঘামছে। নাকের ডগায়ও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। ভেতরে ভেতরে খুবই নার্ভাস হচ্ছে সে। ঘরে বাইরে ইলোরা‚ হেনা‚ হাসনা আর শিরিন দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। দশ হাজার টাকা না দিলে আজ স্বাক্ষরকে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে দেবে না তারা। স্বাক্ষরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ‚ শুভ‚ সাইফ আর মুহিত। স্বাক্ষর কোনো রকমে ওদের পাওনা টাকা দিয়ে দিল। আর ওরাও টাকা পেয়ে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল।
তন্দ্রা বিছানায় বসে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। আজ আকাশটা চাঁদের আলোয় পরিপূর্ণ। চাঁদের আলো জানালা ভেদ করে ঘরের ভেতরেও আসছে। তার উপর পুরো ঘর জুড়ে ছোট্ট ছোট্ট ক্যান্ডেল লাইট জ্বালিয়ে রাখা। ক্যান্ডেলের টিপটিপ লাল আভায় পুরো ঘরটায় যেন অন্যরকম সৌন্দর্য বিরাজ করছে। নীরবতা ভেঙে হঠাৎ ঘরের দরজা আটকানোর শব্দ হলো। তন্দ্রা সেইদিকে তাকিয়ে দেখে স্বাক্ষর দাঁড়িয়ে। ধীর পায়ে সে তন্দ্রার দিকেই এগিয়ে আসছে। তন্দ্রা কিছুটা নড়েচড়ে বসল। একঝাঁক নার্ভাসনেস তার ঘিরে ধরেছে। স্বাক্ষর বিছানার পাশের টেবিলে একটা খাম রাখল।
”আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তোমার গলা কাঁপছে কেন তন্দ্রাবতী? তুমি কী ভয় পাচ্ছ আমাকে?”
“ভয় না একটু নার্ভাস।”
“চলো বেলকনিতে গিয়ে বসি।”
“হুম।”
তন্দ্রা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। স্বাক্ষর কাছে এসে তন্দ্রার কোমল হাতটা ধরল। দু’জনে বেলকনিতে এসে দোলনাটায় বসল। মৃদু বাতাসে বেলকনিতে লাগানো কাঠগোলাপ আর বেলী গাছটার থেকে ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। দোলনাটা হাল্কা দোল খাচ্ছে৷ তন্দ্রার বেশ ভালোই লাগছে এখানে বসে থাকতে। স্বাক্ষর তন্দ্রার মাথার উপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে নেয়। হাত খোপা করে রাখা চুলগুলো আলগোছে খুলে দিল। শ্যাম্পু করা চুল থেকে মিষ্টি সুবাস পাচ্ছে স্বাক্ষর৷ এক ঘোর লাগানো অনুভূতি। দুজনের মাঝে রয়েছে এক অবাক নিরবতা। তন্দ্রা কিছু বলঅতে গিয়েও নিজেকে বারংবার গুটিতে নিচ্ছে। কিছুতেই মনের কথাগুলো মুখে প্রকাশ করতে পারছে না। আচ্ছা ভালোবাসার কথাগুলো শুনতে এতটা লজ্জা লাগে কেন? আবার ভালোও লাগে! কেমন একটা লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতি! তন্দ্রাকে কাছে টেনে তার চুলে মুখ ডুবাল স্বাক্ষর। কিছুক্ষণ পর মুখ সরিয়ে তন্দ্রাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল৷ কাঁধে থুতনি রেখে কোমড় জড়িয়ে ধরল স্বাক্ষর। চারিপাশটা যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। তন্দ্রা একদম চুপ করে আছে। তার সর্বাঙ্গ মৃদু কাঁপছে। তন্দ্রা একটু সরে আসতে নিলে স্বাক্ষর আবারও তাকে আঁকড়ে ধরে।
“দূরে যেতে চাইলে খুব বেশি কাছে টেনে নিব তন্দ্রাবতী। তুমি সহ্য করতে পারবে তো?”
তন্দ্রা যেন মুহুর্তেই বাকহারা হয়ে যায়। মুখ দিয়ে তার কোনো কথাই বের হচ্ছে না। স্বাক্ষরের হাতটা সরিয়ে ঘরে চলে এলো। স্বাক্ষরের দিকে তাকাতে তার খুব লজ্জা লাগছে। এতোক্ষণ তার ভেতর শুধু নার্ভাসনেস কাজ করছিল‚ এখন তো লজ্জা নামক বস্তুটা তাকে কাবু করতে যাচ্ছে। স্বাক্ষর তার পেছন পেছন ঘরে আসে। তন্দ্রাকে লজ্জা পেতে দেখে সে আবারও জিজ্ঞেস করল‚
“আমার উত্তর কিন্তু আমি এখনো পাইনি তন্দ্রাবতী।”
“আমি জানি না।”
”কিন্তু আমি তো অনেক কিছুই জানি।”
তন্দ্রার খুব কাছে এগিয়ে গেল স্বাক্ষর। যতটা সন্নিকটে গেলে দুজন দুজনের হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পারবে। স্বাক্ষর তন্দ্রাকে অনুভব করতে পারছে খুব করে। তন্দ্রা চোখ বন্ধ করে নেয়। ভেতরে অনুভূতি এক উথাল-পাতাল ঝড় বইছে। স্বাক্ষর তন্দ্রাকে আরও কাছে টেনে নিল। তন্দ্রার ওষ্ঠদ্বয়ে উষ্ণ স্পর্শ ছুঁয়ে দেয়। সময়ের সাথে সাথে স্পর্শ গুলো গভীর থেকে গভীর হতে রইল করল। বেশ অনেকটা সময় দুটো ওষ্ঠদ্বয় এর গভীর আলিঙ্গন ঘটল। পবিত্র ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো আজ থেকে। উষ্ণ দুটি দেহ ভালোবাসার এক অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠল।