তিতির কখন যেন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। মুগ্ধ ওকে বুকের উপর থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর উঠে দাঁড়াতেই বুঝতে পারলো শরীরটা ভার হয়ে আছে। বুকের ভেতর ব্যাথা করে উঠলো। বুকে হাত দিতেই দেখতে পেল বুকের লোমগুলো ভিজে গেছে তিতিরের চোখের জলে। বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে উঠলো। ও জানেনা একটা মেয়েকে আদর করে তারপর চূড়ান্ত আদরের সময় ছেড়ে দিলে কেমন লাগে কিন্তু নিজেকে দিয়ে এটা বুঝতে পারছে একটা ছেলের কেমন লাগে! তিতির যেমন হাজার ফোঁটা চোখের জল ফেলেছে ওর বুকের উপর তেমনি ওর নিজেরও হাজার ফোঁটা চোখের জল বুকের ভেতর জন্ম নিয়ে বুকের ভেতরই ঝরে গেছে। তিতিরের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল মুগ্ধ।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের আবছা অন্ধকারে থাকা পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুগ্ধ বুঝতে পারছিল ওর চোখ জ্বলছে। কাঁদলে নাকি হালকা লাগে? বুকের ভেতর এত কান্না অথচ কাঁদতে পারছে না কেন ও? কান্নার কি কোন মন্ত্র আছে? যেটা পড়ে মেয়েরা এত কাঁদে? নিশ্চই আছে যেটা ও জানেনা আর জানেনা বলেই কাঁদতে পারেনা। সারা শরীরের রক্ত যেন ফুটছে। আবার যেতে ইচ্ছে করছে তিতিরের কাছে, কিন্তু না ও যাবে না। তিতির কষ্ট পেয়েছে, আবার কষ্ট দেয়ার মানে হয়না। আর ওরও উচিৎ কন্ট্রোলে থাকা। কিন্তু সারাটা রাত কিভাবে কাটাবে ও? বারান্দার মধ্যে পায়চারী করলো কিছুক্ষণ। নিজের শরীরটাকে ব্লেড দিয়ে কেটে কুচিকুচি করতে পারলে বোধহয় এ অস্থিরতা কমতো। আরো কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে ফিরে গেল মুগ্ধ। ওর টি-শার্ট, তিতিরের শাড়ি সব ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ওগুলো তুলে রাখলো। তারপর খেয়াল হলো ও এখনো সেই আধাভেজা হাফপ্যান্ট টা পড়ে আছে। চেঞ্জ করে নিল। তারপর শুয়ে পড়লো। তিতির ওর দিকে ফিরে ঘুমাচ্ছে। এলোমেলো চুলগুলো চোখের উপর এসে পড়েছে। চুলগুলো চোখের উপর থেকে সরিয়ে দিল মুগ্ধ। তিতির ওর ছোঁয়া পেয়ে ঘুমের ঘোরেই ওকে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধর একটু শান্তি লাগলো। তিতিরকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। একফোঁটা না ঘুমিয়ে কাটলো মুগ্ধর রাতটা। সারাটা রাত ধরে যত আজগুবি চিন্তা করছিল। তার মধ্যে একবার তান্নাকে খুন করার প্ল্যানও করে ফেলেছিল।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ওরা ঢাকা রওনা দিল। দুপুরের মধ্যে ঢাকা পৌঁছে গেল। তিতির ওদের বাসার গলির মোড়েই নেমে গেল। নামার আগে মুগ্ধ বলল,
-“থ্যাংকস ফর লাস্ট টু ডেস।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ আবার বলল,
-“সেদিন অফিসের জন্য যখন বাসা থেকে বের হয়েছিলাম, তখন ভাবিওনি এরকম কিছু হতে পারে। দুদিন, দুরাত যেন স্বপ্ন দেখলাম।”
-“থ্যাংক ইউ টু গত দুটো দিন আমাকে দেয়ার জন্য। আমার কাছেও স্বপ্নই ছিল।”
তিতির গাড়ি থেকে নেমে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলল,
-“কাল তোমার একটা কথার রিপ্লাই দিতে পারিনি। আজ দেই?”
-“সিওর। কোন কথাটা?”
-“কাল বলছিলে না আমার ভার্জিনিটি নষ্ট করার রাইট তোমার নেই? কিন্তু তুমি কি এটা জানো আমার মনের ভার্জিনিটি তুমি অনেক আগেই নষ্ট করে দিয়েছো।”
মুগ্ধ হা করে চেয়ে রইলো। তিতির বলল,
-“আসি তাহলে। ভাল থেকো, নিজের যত্ন নিও।”
তিতির হাটা শুরু করতেই মুগ্ধ গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড়ে চলে গেল তিতিরের কাছে। বলল,
-“তুমি রাগ করেছো কালকের জন্য? আই এম রিয়েলি সরি।”
-“রাগ করিনি। এটা বলার ছিল কিন্তু কাল বলতে পারিনি তাই আজ বললাম। সত্যিই রাগ করিনি। রাগ করলে কথা বলতাম? যাই হোক, তুমি এখন যাও। তোমাকে এখানে আমার সাথে কেউ দেখলে কি হবে জানোই তো।”
-“ওকে। আর সবসময় তো ফোন দেইনা, মাঝে মাঝে দিলে ধরো প্লিজ।”
তিতির হেসে বলল,
-“আচ্ছা, যাও এখন.. টাটা।”
বাসায় ফিরে তিতির গতকাল রাতের ঘটনাগুলো নিয়েই ভাবছিল। ইশ কি সুন্দর করে আদর করে মুগ্ধ! আচ্ছা ওর যখন অন্য কোন মেয়ের সাথে বিয়ে হবে তখন কি তাকেও মুগ্ধ এভাবেই আদর করবে? না! মরেই যাবে ও তাহলে! মুগ্ধ শুধু ওর। সেই মুগ্ধ অন্য কোন মেয়েকে ওর মত করে আদর করবে, অন্য কোন মেয়ে ওর মুগ্ধকে স্পর্শ করবে এটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। আগুন জ্বালিয়ে দেবে, প্রয়োজনে খুন করবে। তবু ওর মুগ্ধকে ও অন্য কারো হতে দেবে না। আচ্ছা এমন কিছুই কি করা যায়না যাতে বাবা-মা রাজি হয়ে যায় মুগ্ধর সাথে বিয়ে দিতে? আর কিছুই কি করার নেই? তিতির কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসলো। উল্টোপাল্টা আঁকিবুকি করলে তিতিরের মাথায় ভাল ভাল আইডিয়া আসে। তাই করলো। কিন্তু কোন আইডিয়া এল না। সন্ধ্যাবেলা বাসার সবাই সিরিয়াল দেখতে বসেছে। এমন সময় তিতির চা বানাতে গিয়ে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল শুনতে পেল। সাথে সাথে ওর মাথায় একটা আইডিয়া এল। আইডিয়াটা নিয়ে সারারাত ভাবলো। ইয়েস, এর চেয়ে ভাল আইডিয়া হতেই পারেনা। বাবা-মা রাজী হতে বাধ্য।
খুশিতে ঘুমই আসছিল না তিতিরের। মুগ্ধকে ফোন করলো কিন্তু কিছু বলল না। একবারে সারপ্রাইজ দেবে।
মুগ্ধর মনটা বোধহয় খারাপ। সব কথাতে শুধু হু হা করছে। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“তোমার মনটা কি খারাপ?”
-“হ্যা তিতির, আমি কালকের জন্য লজ্জিত।”
-“কেন?”
-“অতটা উচিৎ হয়নি। আমার মাথা ঠিক ছিলনা।”
তিতির হেসে বলল,
-“কেন ভাং এ ধরেছিল তোমাকে?”
-“জানিনা, হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আমার কোন কিছুতে নেশা হয়না। কিন্তু ভাং টাতে আমি অভ্যস্থ নই।”
-“বাদ দাও না। কাল যা গেছে গেছে। ওটা নিয়ে আর ভেবোনা। সামনের দিনের কথা ভাবো।”
-“আমি তো কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না।”
এসব কথায় তিতিরের খারাপ লাগছিল। তাই ও প্রসঙ্গ পালটে বলল,
-“তোমাকে অনেক অনেক থ্যাংকস কাল রাতের জন্য। তুমি আমাকে দেখিয়ে দিয়েছো ভালবাসার বৃষ্টি কাকে বলে। তুমি আমাকে ফিল করিয়েছো সুখ কতটা সুখের হতে পারে!”
মুগ্ধর বুকের ভার হালকা হলো এটা ভেবে যে, যাক ঘুরে এসে তিতিরের মনটা তো ফ্রেশ হয়েছে। একটু হলেও ভাল আছে আগের চেয়ে। কিন্তু তখনও মুগ্ধ জানেনা কি চলছিল ওর মনের মধ্যে।
পরদিন দুপুর ১১/১২ টার দিকে তিতির হুট করে রান্নাঘরে গিয়ে বলল,
-“মা তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
-“এখন রান্না করছি, পরে বলিস।”
-“ইটস আর্জেন্ট।”
মা ওর দিকে ফিরে বলল,
-“কি বল?”
-“আমি প্রেগন্যান্ট।”
মায়ের হাত থেকে খুন্তিটা পরে কয়েকবার উল্টিপাল্টি খেয়ে একসময় থেমে গেল। তিতিরের একফোঁটা ভয় করলো না। বরং কথাটা বলতে পেরে বেশ হালকা লাগলো।
Leave a comment