প্রেমাতাল | পর্ব – ৫৬

20 Min Read

মুগ্ধর মা ফোন রাখার কিছুক্ষণ পরই মুগ্ধ ফোন করলো।
-“তিতির, আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। একটু সময় দিতে পারবে?”
কি করবে তিতির? মাত্রই ওর মা ফোন করে বলল যাতে দেখা না করে আর এক্ষুনি ও দেখা করতে চাইছে! আল্লাহ কেন এমন পরিস্থিতিতে ফেলে? তিতির বলল,
-“কবে?”
-“আজ। সন্ধ্যার পর।”
মনে মনে অনেক যুদ্ধ করেও তিতির না করতে পারলো না। বলল,
-“আচ্ছা, কোথায়?”
-“তোমাকে আসতে হবে না, আমি ধানমন্ডি আসবো কিন্তু অফিসের পর। পারবে তো?”
-“হ্যা পারবো।”
-“রওনা দিয়ে ফোন দিব, এখন রাখছি।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধর মাকে কথা দিয়েছে আবার মুগ্ধকেও না করতে পারলো না, কাজটা কি ঠিক হলো? ও তো আর বাধা দিচ্ছে না বিয়েতে তাহলে দেখা করতে দোষ কি! এই ভেবে নিজেকে শান্তনা দিল তিতির। ইকরাকে কেন মুগ্ধ বিয়ে করছে? আর এত তাড়াহুড়োই বা কিসের? তিতিরকে নিয়ে যাওয়ার আরেকটা ট্রিক কি এটা? ছিঃ ছিঃ তা কেন হবে? মুগ্ধর ব্যপারে অন্তত এসব চিন্তা করা যায়না। মনে মনে এরকম অজস্র চিন্তা করতে করতে সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো তিতির।
রেস্টুরেন্টে দুজন দুজনার মুখোমুখি বসে কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। মুগ্ধর মুখটা অনেক শুকনো লাগছে। তিতির কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলে যদি মুগ্ধ এমন কিছু বলে যা ও মানতে পারবে না! ওয়েটার এল অর্ডার নিতে। মুগ্ধ অর্ডার দিয়েও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। অবশেষে মুগ্ধই প্রথম কথা বলল,
-“তিতির, তোমার কিছু বলার নেই?”
-“তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
মুগ্ধ ম্লান হেসে বলল,
-“এটা বলার ছিল তোমার?
তিতির এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
-“কিছু কি হয়েছে?”
-“কিছু বলতে তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছো?”
-“না মানে, এরকম হুট করে তুমি বিয়ে করছো, তাও আবার ইকরাকে। তাই ভাবছি কোন অঘটন কি ঘটলো নাকি!”
-“নাহ, কোন অঘটন ঘটেনি।”
-“ও।”
একটু অভিমান হলো তিতিরের। কিছু তো নিশ্চই ঘটেছে যা মুগ্ধ বলতে চাচ্ছে না। আজ তিতির এতই দূরের হয়ে গেল যে সবটা খুলে বলাও যায়না। ঠিকই আছে, তিতিরের তো এটাই প্রাপ্য ছিল। কি করতে পেরেছে ও মুগ্ধর জন্য? কিছুই না। আর কিছুই বলল না। চুপ করেই রইলো। মুগ্ধও চুপ। এই প্রথম বোধহয় ঘন্টার পর ঘন্টা দুজন একসাথে বসে আছে কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। খাবার এল। মুগ্ধ বলল,
-“খাও।”
তিতির না বলল না, আবার খেতেও পারলো না। ঘাটাঘাটি করতে লাগলো। মুগ্ধ খেয়াল করলো ব্যাপারটা কিন্তু কিছু বলল না। মুগ্ধ খেতে শুরু করলো। তিতিরও খেয়াল করলো যে মুগ্ধ অস্বাভাবিক ভাবে খাচ্ছে, রাগ দেখাচ্ছে? কার উপর? মুগ্ধ আসলে কি চাইছে? এই প্রথম তিতির মুগ্ধকে বুঝতে পারলো না। দুজনের মধ্যে আর কোন কথা হলো না সেদিন, মুগ্ধ একবার তিতিরের হাতটাও ধরলো না। তারপর আরেকবার ফোনও দিল না।
ইকরা সত্যিই মুগ্ধকে ভালবাসতো তাই ও মুগ্ধকে পেতে চলেছে তাহলে কি তিতিরের ভালবাসায় কোন খাদ ছিল? নাকি তিতিরের ভালবাসার চেয়ে ইকরার ভালবাসার জোড় বেশি? এটা হতেই পারে, ইকরা তো কখনোই মুগ্ধর চেয়ে নিজের ফ্যামিলিকে বেশি ইম্পরট্যান্স দেয়নি। কি কি না করেছে মুগ্ধকে পাওয়ার জন্য, ফ্যামিলি বা নিজের মান সম্মানের কথাটাও তো একবার ভাবেনি মেয়েটা। অন্ধের মত পাগলামি করেছে মুগ্ধকে পাওয়ার জন্য। আর তিতির? ও তো নিজের ফ্যামিলিকেই সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্স দিয়েছে। নিজের ফ্যামিলির জন্য মুগ্ধকে কত কষ্ট দিয়েছে! ঠিকই আছে আল্লাহ ন্যায় বিচারক। কিন্তু ফ্যামিলিকে সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্স দেয়াটা কি ভুল? এই বাবা-মায়ের জন্যই তো ও আজ পৃথিবীতে এসেছে, এতবড় হয়েছে। সব তো এই বাবা-মায়ের জন্যই। মুগ্ধকে কষ্ট দিয়ে তিতিরও তো কম কষ্ট পায়নি। এসব এলোমেলো চিন্তা মাথায় নিয়েই রোজ অফিসে যেতে হচ্ছে তিতিরের। অফিসে কাজের এত চাপ, ছুটি চেয়েও পেলনা। আবার কাজ করতেও পারছিল না ঠিকভাবে, কিন্তু করতে হচ্ছিল। খুব প্রেশার ফিল করলো তিতির।
এভাবেই দেখতে দেখতে চলে গেল ৪ দিন। মুগ্ধ এ কদিনে একবারও ফোন করেনি। তিতির আর থাকতে না পেরে বৃহস্পতিবারের বিকালে ফোন করলো মুগ্ধকে। মুগ্ধ ফোন ধরলো না। খুব কষ্ট পেল তিতির, মুগ্ধ ফোনটা ধরলোই না! অবশ্য বিয়ের আগের দিন ব্যস্ত থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। রাত ৮ টার দিকে কলব্যাক করলো মুগ্ধ।
-“তিতির, ফোন দিয়েছিলে? সরি আমি অফিসে ব্যাস্ত ছিলাম। আর ফোনটাও সাইলেন্ট করা ছিল। মাত্রই দেখলাম। তুমি আমার অফিসের নাম্বারে ফোন দিতে।”
-“না না প্রব্লেম নেই, আমি এমনিই কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলাম।”
-“ওহ! বলো।”
-“কাল তোমার বিয়ে আর আজও তুমি অফিস করছো?”
-“হ্যা, তো? বিয়ে দেখে কি হাত পা গুটিয়ে বাসায় বসে থাকবো নাকি? কাজ না করলে খাব কি?”
-“ও, তাহলে কি বিয়ের পরদিনও অফিস করবে নাকি?”
-“নাহ, বিয়ের পরদিন তো শনিবার। সেদিন আমার এমনি অফ ডে। রবিবার থেকে অফিসে যাব।”
-“ওহ, হানিমুনে কবে যাবে? আর কাশ্মীরই কি যাবে?”
-“কিসের হানিমুন? ইকরাকে যে বিয়ে করছি এটা ওর চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য আবার হানিমুন!”
-“এভাবে বলছো কেন? তুমি তো বলেছিলে আজও কাশ্মীর যাওনি, হানিমুনেই প্রথমবার যাবে বলে।”
-“গাধার হাড্ডি।”
-“কে?”
-“তুমি।”
-“কেন?”
-“আমি বলতে বাধ্য নই, এই গালিটাই দিতে মন চাইলো তাই দিলাম। তুমিও পাল্টা গালি দিতে পারো কিন্তু কেন তোমাকে গালিটা দিলাম সেটা জিজ্ঞেস করতে পারো না।”
-“আচ্ছা বেশ কিন্তু হানিমুনে কেন যাবে না?”
-“টাকা কি মাগনা আসে?”
-“কিপটামি করছো কেন? কাশ্মীর যেতে কয় টাকাই লাগবে?”
-“তুমি আমাকে কিপটা বলতে পারলে? জীবনেও তোমার সাথে কিপটামি করেছি আমি?”
-“না তা করোনি।”
-“হ্যা, যে যেরকম তার সাথে সেরকম করতে হয়। ইকরা তো গলায় পারা দিয়ে বলবে টাকাপয়সা দিবি কিনা বল! ও তো এই টাইপ মেয়েই। বিউটি পার্লার আর শপিং ছাড়া কিছু বুঝে? বিয়ের পর থেকে ওর বেহিসাবি খরচগুলো তো আমার টাকাতেই করবে তাই ওকে নিয়ে হানিমুনে গিয়ে আমি টাকা নষ্ট করবো না।”
-“নষ্ট কেন হবে? ঘোরাই তো হবে।”
মুগ্ধ হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল,
-“এই তুমি ফোন রাখো তো, অসহ্য।”
তিতির কিছু বলল না, ফোনও রাখলো না। চোখ বেয়ে গাল গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা জল পড়লো বুকের উপর। মুগ্ধ কান্নাটা টের পেল না। আবার ঝারি দিয়ে বলল,
-“আজব তো, কি বললাম কানে যায়নি? ফোন রাখো না কেন? ফোন রাখোহ।”
তিতির চুপচাপ ফোনটা নামিয়ে লাইনটা কেটে দিল।
তারপর ৯ টা বাজলো, ১০ টা বাজলো, ১১ টা বাজলো। তারপর একসময় ১২ টাও বেজে গেল.. একটা মেসেজ এল মুগ্ধর। লিখেছে, “Sorry.. ajke shondhar rough behave er jonno.” তিতির রিপ্লাই দিল না। রিপ্লাই দিয়ে কিইবা হবে! ঘড়ির কাটায় আজ শুক্রবার। আজ ইকরা-মুগ্ধর বিয়ে। আজ থেকে ইকরা মুগ্ধর বউ! আজ থেকে ওরা এক ঘরে থাকবে, এক বিছানায় শোবে। আজ থেকে ইকরার শরীরেও ঘুরে বেড়াবে মুগ্ধর দুষ্টু হাত। আজ থেকে মুগ্ধর ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে ইকরাও শিহরিত হবে। আজ থেকে ইকরাও জানবে কখন মুগ্ধর চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যায়, কখন বেড়ে যায় ওর নিঃশ্বাসের ওঠানামা। আজ থেকে ইকরাও জানবে মুগ্ধর বুকের ধুকধুকানির শব্দ কেমন হয়! আজকের পর এরকম আরো অনেক কিছুই ইকরা জানবে যা একমাত্র তিতির জানতো। এসব ভাবতে ভাবতে তিতির কাঁদছিল। কষ্টে বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কিচ্ছু সহ্য হচ্ছিল না ওর। বিছানার উপর হাটু ভাজ করে বসে কাঁদছিল, ঘরের মধ্যে হেটে হেটেও কাঁদছিল, ফ্লোরে বসেও কাঁদছিল। কাঁদতে কাঁদতে নিজের গায়ে নিজেই নখ বসিয়ে টেনে টেনে খামচি দিচ্ছিল, হাত কামড়াচ্ছিল, চুল ছিঁড়ছিল। গায়ের ওড়না দাত দিয়ে ছিঁড়ে কুচিকুচি করছিল। কোনভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছিল না তিতির। সবকিছু এভাবে শেষ হয়ে যাবে? কিচ্ছু করতে পারবে না ও? যাদের ভালবাসার মানুষের বিয়ে হয়ে যায় তাদের প্রেমটা বুঝি এভাবেই শেষ হয়ে যায়। মানুষের মুখ থেকে শোনা, দেখা ফিল করা আর নিজের জীবনে ফেস করার মাধ্যে এতটাই ফারাক আগে জানতো না তিতির।
সারারাত এভাবে পাগলের মত কান্নাকাটি করলো তিতির। এক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারেনি। সকালে নাস্তা খেতে যায়নি দেখে মা এল ডাকতে। দরজার বাইরে থেকেই ডাকলো,
-“তিতির, এই তিতির.. আর কতক্ষণ ঘুমাবি? এবার উঠে খেয়ে নে মা। খেয়ে নাহয় আবার ঘুমাস।”
তিতির উত্তর দিল না। মা গিয়ে চাবি নিয়ে এল, চাবি দিয়ে লক খুলে ঘরে ঢুকতেই মা দেখলো তিতির ফ্লোরে কাত হয়ে শুয়ে কাঁদছে। চুলগুলো এলোমেলো, বিদ্ধস্ত চেহারা। ওড়নাটা কুটিকুটি করে ছেঁড়া। মা ওর পাশে বসে বলল,
-“কি রে কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? হায়হায় চোখ দুটো একদম ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে। হাতে কিসের আঁচর লেগেছে? কি হয়েছে মা?”
তিতির মায়ের হাত ধরে বলল,
-“মা, আজকে মুগ্ধর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মা। মিথ্যে ইগো, রাগ পুষে রেখে আমার জীবনটা নষ্ট করো না মা। ও ছাড়া আমি সুখী হবো না। কিছু একটা করো মা। এখনো তোমরা মেনে নিলে ও বিয়েটা করবে না।”
মা তিতিরের গালে একটা চড় বসালো। বলল,
-“তুই এত নির্লজ্জ কেন? তোকে আমি জন্ম দিয়েছি ভাবতেই আমার গা ঘিনঘিন করছে। মুগ্ধ যদি তোকে এতই ভালবাসতো তাহলে বিয়ে করছে কেন? আর যেখানে ও বিয়ে কিরছে সেখানে তুই এখনো ওর কথা বলিস কোন মুখে? সুহাসের সাথে এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গিয়েছে, কদিন পর বিয়ে আর তুই এখনো ওই ছেলের কথা বলছিস? এমন মেয়ে কেন জন্ম দিলাম? পাপ তো আমার। রাস্তার গুন্ডাদের মত তোর ভাইকে রাস্তায় ফেলে মেরেছিল সব ভুলে গেলি? কেমন বোন তুই? বাপটারে তো মারতে গেছিলি! কোনমতে বেচে ফিরেছে। আবার সেই ছেলের কথা? কেমন মেয়ে তুই? এত মানুষ দুনিয়াতে মরে তুই মরতে পারিস না? আল্লাহর ওয়াস্তে মর এবার। আমার একটু হাড় জুড়াক, আর পারছিনা।”
মা ঘর থেকে চলে গেল। তিতির একইভাবে পড়ে রইলো ফ্লোরে। সারাদিন কাঁদলো। কাল রাত থেকে কিচ্ছু খায়নি তিতির। সারাদিনেও কিছু খেল না। সন্ধ্যা নাগাদ ফোন এল মুগ্ধর। মুগ্ধর নাম্বারটা স্ক্রিনে দেখেই তিতিরের বুক কেপে উঠলো। হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিছু কি মিরাকল ঘটবে? মুগ্ধর বিয়েটা কি হবে না? এটা জানানোর জন্যই কি মুগ্ধ ফোন করেছে? চোখ মুছে ফোন ধরে তিতির বলল,
-“হ্যালো।”
মুগ্ধ তিতিরের গলা শুনেই বুঝতে পারলো যে, তিতির কাঁদছিল। এখন আর শান্তনা দিয়ে কি হবে? তাই সেদিকে না গিয়ে সরাসরি বলল,
-“তিতির, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি।”
তিতির হাসার চেষ্টা করে বলল,
-“ওয়াও কংগ্রাচুলেশনস!”
-“হুম.. মা, স্নিগ্ধ রেডি হয়ে অপেক্ষা করছে। পিউয়ের তো এই বিয়েতে মত নেই তাই ও আসবে না। আমি রুম থেকে বের হলেই আমরা ইকরাদের বাসায় যাব।”
-“ও। গাড়ি সাজিয়েছো?”
-“নাহ, ধুর।”
-“মা কি বাসর ঘর সাজিয়েছে?”
-“নাহ।”
-“প্রথমে নিশ্চই মা বলেছিল তারপর তুমি ঝাড়ি দিয়ে থামিয়েছো?”
-“হ্যা।”
-“হুম, জানতাম।”
-“মায়ের বিয়ের বেনারসিটা ইকরা চেয়েছিল। মাও দিয়ে দিচ্ছিল। আমি দিতে দিইনি। আমার কাছে রেখে দিয়েছি, ওটা তোমার বিয়েতে গিফট করবো। ওটার ওপর শুধু তোমারই হক আছে। পড়বে তো?”
তিতির হেসে বলল,
-“হ্যা, অবশ্যই পড়বো।”
একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তিতিরের গাল বেয়ে। মুগ্ধ বলল,
-“এই জানো আমি আজকে সাদা পাঞ্জাবি পড়েছি। মা গতকাল কিনে এনেছে। আমাকে তো পুরা হিরো হিরো লাগছে।”
কথা শেষ করেই মুগ্ধ হাসলো। তিতিরও হেসে বলল,
-“ওয়াও। ছবি তুলে রেখো। পরে ফেসবুকে ইনবক্স করে দিও, দেখবো।”
-“ফেসবুক যে ইউজ করিনা তাতো জানোই, আইডি ডিএক্টিভ।”
-“আইডি তো আছে, এক্টিভ করে ছবি পাঠিয়ে আবার ডিএক্টিভ করে দিও, অথবা হোয়াটস এ্যাপে।”
-“এখন আর এসব কিছুই ইউজ করিনা। ভাল লাগেনা। আমার ছবি তুলতেও ভাল লাগেনা জানোইতো। স্নিগ্ধ যদি তোলে তো ওকে বলবোনে তোমাকে পাঠাতে।”
-“আচ্ছা।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলো। তারপর হঠাৎ মুগ্ধ বলল,
-“তিতির, যেদিন আমার বিয়ে ফিক্সড হয়েছে সেদিনই আমি তোমাকে জানিয়েছিলাম। ৪ দিন সময় হাতে ছিল।”
এটুকু বলার পর হঠৎ করেই মুগ্ধ কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-“আমার মনের কোথাও একটা ছোট্ট আশা ছিল যে তুমি এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘ফ্যামিলি, সোসাইটি, দুনিয়া ভেসে যাক, তুমি ইকরাকে বিয়ে করোনা। আজ, এক্ষুনি আমি তোমাকে বিয়ে করবো।”
মুগ্ধ চিৎকার করে কাঁদছিল। তিতির সহ্য করতে পারছিল না। মুগ্ধ কখনো এভাবে কাঁদেনি, কক্ষোনো না। যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতে স্ট্রং থাকাটা মুগ্ধর সবচেয়ে বড় গুন। কখনো কিছুতে ভেঙে পড়েনি। সবকিছু হাসিমুখে সামলেছে। আর আজ ও নিজেই কিনা ওকে কাঁদালো। তিতিরও এতক্ষণের লুকিয়ে রাখা কান্নাটা আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না। দুজনেই একসাথে কাঁদতে লাগলো। তিতির ফোনের ভেতর দিয়েই শুনতে পেল মা মুগ্ধর দরজায় নক করে ডাকছে ওকে। মুগ্ধ সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করলো না। কাঁদতে কাঁদতেই আবার বলল,
-“আমি জানি তিতির, তোমার ফ্যামিলি তোমার কাছে অনেক ইম্পরট্যান্ট। ছোটবেলা থেকেই তারা তোমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমার ব্যাপারটা বাদ দিলে তোমার ফ্যামিলির মত ফ্যামিলি খুব কম মেয়েরই আছে। কিন্তু তিতির আমি যদি সুযোগ পেতাম আমিও তোমাকে তাদের চেয়ে কম যত্নে রাখতাম না। তারা তোমাকে দুনিয়াতে নিয়ে এসেছে তাই আমি তোমাকে পেয়েছি, এজন্য আমি তাদের প্রতি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। হ্যা আমি পেয়েছি তোমাকে। বিয়ে করতে পারিনি ঠিকই কিন্তু তোমাকে আমি এতটাই পেয়েছি যতটা অনেকেই বিয়ে করেও পায়না। কিন্তু তোমার ফ্যামিলি তোমাকে অনেক কাঁদিয়েছে তিতির। যদি তারা তা না করে আমার হাতে তুলে দিত আমি তোমার চোখ দিয়ে একফোঁটা জল মাটিতে পড়তে দিতাম না। সারাজীবনে একটা সেকেন্ডের জন্যও না।”
তিতির কোন উত্তর দিতে পারলো না। মুগ্ধ উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করলো ন। আবার বলতে শুরু করলো,
-“অনেক অনেক বছর আগে তুমি যখন আমার জীবনে এসেছিলে তখন যে আমি কি পেয়েছিলাম তিতির আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তুমি একটা ছেলে হলে বুঝতে পারতে একটা অবুঝ বাচ্চা মেয়েকে ভালবাসা, জীবন, প্রব্লেম, সেক্স সব কিছু বোঝানোর ফিলিংস কেমন হয়। তুমি এমন একটা মেয়ে ছিলে যাকে যেমন ইচ্ছা তেমন করে গড়ে নেয়া যায়। আর আমার উপর অন্ধ বিশ্বাস দেখে তো আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম। কিভাবে সম্ভব আজকের যুগে একটা ছেলেকে এতটা বিশ্বাস করা?”
তিতির কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“প্লিজ তুমি কেঁদোনা, তোমার কান্নাটা আমি সহ্য করতে পারছিনা। আমি অভ্যস্ত নই।”
মুগ্ধ সেকথার কোন জবাব না দিয়ে নিজের মত করেই বলতে লাগলো,
-“তোমার হাসি, তোমার তাকানো, তোমার স্পর্শ, তোমার লজ্জা পাওয়া সব কিছুতে আমার নেশা হয়ে গেল। তোমার মতই আমার জীবনের সব শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলোও তোমার দান। তোমার জ্বরের ঘোরের সেই পাগলামি আমি জীবনেও ভুলতে পারবো না, সেদিন তুমি যে কি বলেছিলে আর কি করেছিলে তিতির আজও সব আমার চোখের সামনে ভাসছে। তুমি যে কি পাগলী একটা তা সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। আজও তোমার সেই রেকর্ডিং টা আমি শুনি। ভবিষ্যতেও শুনবো, যতদিন বেঁচে থাকবো শুনবো। তুমি যদি ওটা ডিলিট করে দিতে বলো তবুও আমি ডিলিট করবো না। আমি তো কখনোই ছবি তুলিনা, ছবি তোলার কথা মনেও থাকে না কিন্তু তোমার আমার যে দুএকটা আনসেন্সরড ছবি তুমি জোর করে তুলেছিলে তা আমি যত্ন করে রেখেছিলাম। দেখতে ভাল লাগতো। আজীবন দেখবো ওগুলো। তুমি বললেও ডিলিট করবো না।”
বাচ্চাদের মত করে কাঁদছিল মুগ্ধ। তিতির বার বার বারণ করছিল। কিন্তু আজ মুগ্ধ কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিল না। তিতিরেও কান্না থামছিলই না। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“সব তো শেষই হয়ে যাচ্ছে আজ একটা সত্যি কথা বলবে আমাকে?”
মুগ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“না পারবো না।”
-“প্লিজ।”
-“কি কথা?”
-“তুমি ইকরাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করছো না?”
-“বাধ্য যদি নাই হতাম তাহলে কি ইকরাকে বিয়ে করতাম? মেয়ের কি অভাব নাকি?”
-“কে বাধ্য করেছে? কি হয়েছে?”
-“বাদ দাও, এসব বলে লাভ নেই আর। তাছাড়া মানুষ চাইলেই সব কথা সবাইকে বলতে পারেনা, বাধা থাকে অনেক।”
তিতির আর কিছু বলল না। মুগ্ধ তখনো কাঁদছিল। আবার বলল,
-“জানো আজ বাবাকে খুব মিস করছি। মা কিছু হলেই বলে তোর বাবা বেঁচে থাকলে এরকম হতো না, ওরকম হতো না। তোর বাবা বেঁচে থাকলে আজ আমাকে বুঝতো। তখন আমারও বলতে ইচ্ছে করে, ইয়েস বাবা থাকলে আমাকেও বুঝতো। আমার জীবনের সব প্রব্লেম বাবা ম্যাজিকের মত সলভ করে দিত। কিন্তু বলতে পারিনা। মা যে কষ্ট পাবে।”
-“আমাদের কপালটাই বোধহয় এমন। বাবা মাকে কষ্ট দেবনা বলেই কত ত্যাগ করলাম তবু তারা কষ্টই পেল।”
-“কপালের কথা আর বলোনা। শালার আমার কপালের মত খারাপ কপাল দুনিয়ার আরো কারোর নেই। পৃথিবীতে শুধু একটা মেয়েকেই আমি স্ল্যাং ওয়ার্ডে গালি দিয়েছি, সে ইকরা। যে মেয়েকে সারাজীবন আমি কথায় কথায় ইনসাল্ট করেছি, প্রস্টিটিউটের সাথে যার তুলনা করেছি সবসময়, কপালের ফেরে তাকেই বিয়ে করতে হচ্ছে আজ। সেই হবে আমার ঘরের বউ, তাকে নিয়েই সংসার করতে হবে বাকী জীবন। এর চেয়ে মৃত্যু বেশি সম্মানের।”
-“ইকরার উপর তোমার অনেক রাগ তাই এসব বলছো। রাগ একদিন শেষ হবে, আমরা যাই বলিনা কেন ইকরা মেয়ে হিসেবে তো ভালই, তোমার সাথে যা করেছে তা তো তোমাকে পাওয়ার জন্যই করেছে। আর ইকরা দেখতেও অনেক সুন্দর।”
মুগ্ধ অট্টহাসি দিয়ে বলল,
-“সুন্দর তো সানি লিওনও।”
তিতির কি বলবে! কান্নাটাও থামাতে পারছে না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
-“সরি, আমার কাছ থেকে তুমি কষ্ট ছাড়া আর কিছু পেলে না। আমি আসলে তোমার জীবনে একটা বড় অভিশাপ হয়ে এসেছিলাম।”
মুগ্ধ চোখ মুছে নিজেকে কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করলো। তারপর বলল,
-“না তিতির, তুমি আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলে। আমার জীবনে ভাল যা কিছু হয়েছে তা তুমি আসার পরই হয়েছে। তুমি যত ভালবাসা আর মধুর স্মৃতি আমাকে দিয়েছো তা দিয়ে অনায়াসে একটা জীবন পাড় করে দেয়া যায়। ডোন্ট ওরি আমি ভাল থাকবো, আই প্রমিস। আর তুমিও ভাল থেকো।”
-“হ্যা, আমি তো ভালই আছি।”
-“রাখছি তাহলে.. মা, অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে।”
-“হুম, যাও। যেতে তো হবেই।”
-“এই শোনো..”
-“শুনছি বলো।”
-“আজ থেকে আমি একটা জিনিস খুব ইম্পরট্যান্টলি চাইবো আল্লাহর কাছে। তোমার ভাইয়ের মত ভাই তিনি যেন ঘরে ঘরে দেন। আর সেই ভাইদের বোনদের ভালবেসে দুনিয়ার সব প্রেমিকদের পরিণতি যেন আমার মতই হয়। আমি একা কেন কষ্টে থাকবো? দুনিয়ার সব শালা একই কষ্টে থাকুক। আর ওই নিষ্পাপ মেয়েগুলো তোমার মতই ধুকে ধুকে মরুক।”
কথাটা বলতে বলতে মুগ্ধ আবার কেঁদে ফেলল। তিতিরও কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“আল্লাহ তোমার মনের আশা পূরণ করুক।”
-“আমীন।”
-“আমীন।”

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।