তোমাকে | মুন্নি আক্তার প্রিয়া | পর্ব – ০৪

পরী ভ্রু দুটি কুঁচকিয়ে বলে,

“কী হয়েছে? এভাবে সামনে এসে দাঁড়ালেন কেন?”
তুর্য পরীকে অবাক করে দিয়ে বলে,
“এটা কোনো গান ছিল? আমার তো মনে হলো এতক্ষণ বসে বসে পাখিদের কিচিরমিচির শুনছিলাম।“
পরী তুর্যর দিকে এক আঙুল তুলে বলে,
“হেয় ইউ..”
“তুর্য। আমার নাম তুর্য।“
মিটিমিটি হেসে কথাটা বলল তুর্য। 
পরী দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“রাবিশ!”
এরপর তুর্যকে পাশ কাঁটিয়ে চলে যায় অন্যদিকে। মেহেনুবা দৌঁড়ে এসে পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“হায় আল্লাহ্! কী সুন্দর গাইলিরে তুই।“
পরীর একটু আগে বলা তুর্যর কথা মনে পড়ে গেল। তাই বলল,
“সত্যিই সুন্দর গেয়েছি?”
“আলবৎ সুন্দর গেয়েছিস।“
“সত্যি বলিস কিন্তু।“
“আজব। আমি তোকে মিথ্যা বলতে যাব কেন?”
“হু। চল গিয়ে বসি।“
“চল।“
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সবাই বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন প্রান্ত সেলিমকে বলে,
“সেলিম ওর বাবার কাছে কোনো বিচার দেবে না।“
“কেন ভাই?”
“আমি বলেছি তাই।“
সেলিম মাথা চুলকে বলে,
“আচ্ছা।“
প্রান্ত চোখের চশমা ঠিক করতে করতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে,
“মেয়েটা কি আমার মুখ দেখেছিল সেদিন?”
“না ভাই। আপনি তো হেলমেট পড়া ছিলেন।“
“ওকে, তুমি গিয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়ো।“
“মানে? ক্যান?”
“মেয়েটার প্রতিবাদী রূপটা একটু দেখা দরকার। গান গাওয়ার সময় তো মনে হলো ওর মতো শান্তশিষ্ট দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টা নেই।“
“কী করতে চাইতেছেন?”
“আগে যাও তো তুমি।“
সেলিম প্রান্তর কথামত লুকিয়ে পড়ল। প্রান্ত পিন্টুকে ডেকে বলে,
“তোমায় তো পরী দেখেনি তাই না?”
“না ভাই।“
“গুড। মেয়েটা আসছে। মারো আমায়।“
পিন্টু অবাক হয়ে বলে,
“কী?”
“শোনোনি কী বলেছি? মারো আমায়।“
“হায় হায় ভাই! কন কী? আমি আপনারে মারুম?”
“উফ! সময় নষ্ট করো না তো। মারো।“
পিন্টু মাথা নিচু করে বলে,
“আমি পারুম না ভাই।“
প্রান্ত চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে,
“আমায় মারবে নাকি তোমাকে মেরে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেবো?”
“দরকার হলে আপনি আমারেই মারেন।“
প্রান্তর খুব রাগ হচ্ছে। তবুও পিন্টুকে কিছু না বলে সেলিমকে ডাকে। সেলিম কাছে আসার পর বলে,
“পরী এইদিকেই আসছে। ও তোমাদের কাছাকাছি আসতেই তুমি পিন্টুকে মারা শুরু করবে। আর হ্যাঁ, এখন একদম চুপ। কোনো প্রশ্ন করবে না। আমি আড়ালে যাচ্ছি।“
প্রান্ত গিয়ে আড়ালে দাঁড়ায়। পরী আর মেহেনুবা কথা বলতে বলতে আসছে। সেলিমের থেকে হাত দুয়েক দূরে থাকতেই সেলিম ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় দেয় পিন্টুকে। পিন্টু এক থাপ্পড়েই নিচে পড়ে যায়। পরী সেখানেই থমকে যায়। চোখমুখ কুঁচকে রাগ নিয়ে সেলিমের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেনুবা সেটা বুঝতে পেরে পরীর হাত শক্ত করে ধরে বলে,
“তুই কাউকে কিচ্ছু বলবি না। চল এখান থেকে।“
“আমার হাত ছাড় মেহু। ঐ বজ্জাত ছেলে কলেজের সামনে এসে মারামারি করছে।“
“করুক। তাতে তোর কী? আমি তোকে কোনো ঝামেলায় জড়াতে দেবো না।“
মেহেনুবা প্রায় টানতে টানতেই পরীকে নিয়ে যায়। একটা রিক্সা ডেকে জোর করে পরীকে উঠিয়ে নিজেও উঠে বসে। রিক্সা চোখের আড়াল হতেই প্রান্ত সেলিম আর পিন্টুর দিকে এগিয়ে আসে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“সাথে থাকা মেয়েটা কে?”
“চিনি না ভাই। ঐদিনও সাথে ছিল।“
“বান্ধবী মেবি।“
“হইতে পারে। আমি শিওর ভাই, ঐ মাইয়া জোর কইরা নিয়া না গেলে প্রতিবাদী আপায় আজ আমার কান গরম কইরা ফেলত।“
সেলিমের কথায় প্রান্ত ফিক করে হেসে ফেলে। সেলিম বলে,
“আপনে হাইসেন না ভাই। মাইয়া পুরা ঝাল মরিচ।“
“এজন্যই তো দেখতে চাচ্ছি ওর তেজ।“
“মনে হয় না পারবেন।“
“কেন?”
“দেখলেন না তার বান্ধবী কেমনে নিয়া গেল?”
“ওকে, ফাইন। তাহলে ওর বান্ধবীকেই তুলে আনো।“
সেলিমকে আর কিছু বলতে না দিয়ে আবার বলে,
“আর হ্যাঁ, এখন যাও। আমি তিথিকে বাসায় দিয়ে তারপর আসব।“
সেলিম মিটমিট করে হেসে বলে,
“ভাবিরে বাসায় লইয়া আসলেই তো পারেন।“
“কে ভাবি?”
“ক্যান তিথি!”
“ফাউল কথা বলো না তো। আমরা ভালো বন্ধু।“
“হ, তিথি আপার ভাইও আপনার বন্ধু আবার তিথি আপাও বন্ধু।“
“তাতে সমস্যা কোনো?”
“না। আমার কোনো সমস্যা নাই’কা।“
“তাহলে কথা আর না পেঁচিয়ে চলে যাও।“
“আইচ্ছা।“
বিকেলের আবহাওয়াটা বেশ দারুণ। ঝলমলে রোদের সাথে বিশুদ্ধ বাতাস। তাই আবহাওয়া ও সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য পরী ছাদে চলে আসে। ভালোভাবে এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফুলগাছ গুলোর দিকে যায়। বলা তো যায় না তুর্য নামক যমদূত কোথা থেকে উদয় হয়ে আবার ফুলচোর বানিয়ে দেয়! আশেপাশের ছাদগুলোও ফাঁকা। কোনো মানুষজন নেই। তাই গুটিগুটি পায়ে গোলাপের দিকে এগিয়ে যায়। তাজা একটা ফুল নাকের কাছে নিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। আহা! মনটাই যেন শান্ত হয়ে গেল। এরই মধ্যে দিশান ছাদে এসে বলে,
“এই!”
পরী দ্রুত সরে গিয়ে বলে,
“কে, কে!”
দিশান হোহো করে হেসে বলে,
“ভয় পেলে নাকি?”
পরী হাফ ছেড়ে বলে,
“তুমি! আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম।“
“তুমি কি ভেবেছিলে তুর্য ভাইয়া?”
“হু।“
“ভাইয়াকে তুমি এতো ভয় পাও কেন?”
“আমি মোটেও তোমার ভাইয়াকে ভয় পাই না। আসলে কী বলো তো? তোমার ভাইয়ার নিশ্চয়ই ঝগড়া লগ্নে জন্ম হয়েছিল। এজন্যই সুযোগ পেলেই কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে চলে আসে।“
দিশান মিটিমিটি হাসছে। পরী চোখ পাঁকিয়ে বলে,
“সবসময় আমার কথা শুনে হাসো কেন?”
দিশান কোনো উত্তর দেয় না। পরী দিশানের দৃষ্টি লক্ষ করে পেছনে তাকায়। তাকিয়েই জোরে চিৎকার দিয়ে দূরে ছিটকে যায়।
“ওহ আল্লাহ্ গো!”
তুর্য মেজাজ দেখিয়ে বলে,
“দিনদুপুরে ভূত দেখলে নাকি?”
পরী নিজেকে শান্ত করে বলে,
“না।“
“তাহলে চিৎকার করলে কেন?”
“আমার ইচ্ছে।“
তুর্য আর কথা না বাড়িয়ে কোলে থাকা কুকুরটাকে ছাদে নামিয়ে দেয়। কুকুরটা পরীর দিকে এগিয়ে যেতেই পরী দৌঁড়ে গিয়ে দিশানের পেছনে দাঁড়ায়। লাফিয়ে লাফিয়ে বলে,
“কুত্তাটাকে সরান। আল্লাহ্ গো!”
তুর্য ঝাড়ি দিয়ে বলে,
“কুত্তা কী? কুকুর বলো। শিক্ষিত হয়েও কুকুরকে কুত্তা, বিড়ালকে বিলাই এসব বলো কেন?”
“ইশ! আসছে আমার কী শিক্ষিত গো। শুনেন,আমি এত ফর্মালিটি মেইনটেইন করে কথা বলতে পারি না।“
“হ্যাঁ,সেটা তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়।“
“কী বললেন?”
“কানে শোনো না নাকি?”
কুকুরটা আবারও এগিয়ে আসলে পরী এবার তুর্যর পিছনে গিয়ে লুকিয়ে বলে,
“বারবার ও কেন আমার কাছে আসছে?”
“এখন বুঝলাম কেন তখন চিৎকার দিয়েছিলে! তুমি যে এত ভীতু জানতাম না তো।“
“ওয়ে, আমি ভীতু নই ওকে?”
“সেই তো! সাহসীর পরিচয়ই তো এটা।“
পরী কিছু বলার আগে তুর্য নিচে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,
“আয় টাইগার আমার কাছে আয়। যার তার কাছে যাস না।“
পরী হাত নাড়িয়ে বলে,
“ওয়েট, ওয়েট। কী নামে ডাকলেন?”
“টাইগার।“
“ও টাইগার?”
“না। ওর নাম টাইগার।“
পরী ফিক করে হেসে বলে,
“কী জামানা আসলো আল্লাহ্! কুত্তার নাম নাকি টাইগার। অবশ্য কুত্তার মালিকটা কেমন দেখতে হবে তো!”
“শোনো, তোমার আমায় যা বলার বলো। কিন্তু টাইগারকে বারবার কুত্তা বলবা না।“
“একশো বার বলব। কী করবেন আপনি?”
“আমি কিছুই করব না। যা করার টাইগারই করবে।“, বলে কুকুরটাকে ছেড়ে দেয় তুর্য। টাইগার জিহ্বা বার করে পরীর দিকে এগিয়ে যেতেই পরী রেলিং সাথে লেগে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে,
“ওরে আল্লাহ্! কুত্তা থুক্কু টাইগাররে ধরেন প্লিজ। আমার কাছে আসতে দিয়েন না।“
টাইগার গিয়ে পরীর ওড়নার এক কোণা দাঁত দিয়ে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। পরী গা ঝাড়া দিয়ে দাঁতমুখ খিঁচে বলে,
“ইয়াক ছিঃ! আমার ওড়না মুখে নিয়েছে।“
তুর্য বলে,
“টাইগারকে ঘেন্না করবা না একদম। ও অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।“
টাইগার পরীর ওড়না মুখে নিয়েই তুর্যর দিকে এগোতে থাকে। পেছন পেছন পরীও আসে আর বলে,
“আম্মা গো আম্মা! তোমার পরী বুঝি এই বিদেশি কুত্তা থুক্কু না কুকুর নামক টাইগারের পেটে চলেই যাবে গো!”
পরীর বিলাপ শুনে দিশান হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তুর্য এবার পুরোপুরি ফ্লোরে বসে পড়েছে হাসতে হাসতে।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।