সময় ঘনিয়েছে। শীতের আমেজ এসেই পড়েছে অবশেষে। যদিও হাড় কাঁপানো শীত এখনো আসেনি। সকালের মৃদুমিষ্টি সূর্যের প্রখর দিপ্ত রোদের মধ্যে ছাদে একটা চৌকিতে বসে আছে পরী। এই সময়টার রোদ শরীরে উষ্ণ স্পর্শ এনে দেয়। সময়গুলো যে অতি তাড়াতাড়ি কীভাবে চলে গেল কে জানে!
রেহেনা বেগম ছাদে এসে দেখেন পরী বই হাতে অন্য মনস্ক হয়ে বসে আছে। তিনি হাতের ভেজা কাপড়গুলো দড়িতে মেলে দিতে দিতে বলেন,
“এখনো বসে আছিস যে? কলেজে যাবি না?”
মায়ের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এসে পরী বলে,
“আজ ক্লাস নেই। প্রাইভেট আছে শুধু।”
“যাবি না?”
“ইচ্ছে করছে না। তবে যেতে হবে। সামনেই তো পরীক্ষা।”
“আচ্ছা যা তাহলে রেডি হয়ে নে।”
.
কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাত দুটো মুড়িয়ে মেহুর সাথে গল্পগুজব করতে করতে প্রাইভেটে যাচ্ছে। গল্পের এক পর্যায়ে মেহু বলে,
“একটা কথা বলবি?”
পরী সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে,
“কী?”
“তুর্য ভাইয়ার সাথে কথা হয় না? সেই যে রিনি আপুর গায়ে হলুদে দেখা হয়েছিল। এরপর আর হয়নি?”
“দেখা হয়েছিল দু’বার। শেষদিন বিদায় নিয়ে গেছিল।”
“বিদায় নিয়ে গেছিল মানে?”
“মানে ঢাকা থেকে অন্যত্র চলে গেছে।”
“আমায় বলিসনি তো!”
“এটা বলার কী আছে মেহু? যে যার ভালো থাকার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে।”
“তুই বারণ করিসনি?”
“না।”
“কেন?”
“কেন বারণ করব? কোন অধিকারে বারণ করব?”
মেহুর মুখটা শক্ত হয়ে যায়। বলে,
“অধিকার না থাকলে বারণ করা যায় না?”
“তার ইচ্ছেতে আমি হস্তক্ষেপ কেন করব? সে যেখানে যেভাবে হ্যাপি থাকবে সেভাবেই হ্যাপি থাকতে দেওয়া উচিত।”
“তোর খারাপ লাগেনি সেদিন?”
পরী স্মিত হেসে বলে,
“খারাপ এখনো লাগে। কষ্ট এখনো হয়। কিন্তু কী বলতো, যার জন্য আমার কষ্ট হয় তার কিন্তু আমার জন্য কষ্ট হয় না। তার কষ্ট হয় অন্যজনের জন্য।”
“ভাগ্যের এই নির্মম খেলাটা আমি আজও বুঝলাম না।”
“সবকিছু বুঝতে নেই। কিছু জিনিস অজানা থাকা ভালো। এতে অন্তত কিছুটা হলেও ফিরে পাওয়ার আশ্বাস রাখা যায়।”
“তোর কি মনে হয় তুর্য ভাইয়া ফিরে আসবে?”
পরী লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
“জানি না।”
.
.
ছাদে টাইগারকে নিয়ে বসে ছিল তিথি আর দিশান। তুর্য চলে যাওয়ার পর থেকেই দিশানের হাসি-খুশি মনটা সন্ধ্যার মতো অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। দিশান এই বাড়িতে সবচেয়ে বেশি ভালো তুর্যকেই বাসতো। দিশানকে মনমরা থাকতে দেখে তিথি বলে,
“তুই আগের মতো দুষ্টুমি করিস না কেন রে দিশান?”
“আমি তুর্য ভাইয়াকে খুব মিস করি আপু।”
“রোজই তো ফোনে কথা বলছিস। এরপরও মন খারাপ কেন?”
“রোজ তো আর দেখা হচ্ছে না।”
“শোন, পরেরবার ফোন দিলে কান্নাকাটি করে বলবি ফিরে আসতে। ভাইয়াকে ছাড়া আমারও ভালো লাগে না। বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।”
হঠাৎই দিশানের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আনন্দিত স্বরে বলে,
“পরী আপুকে দিয়ে বলাব ভাইয়াকে ফিরে আসতে।”
তিথি হতাশ হয়ে বলে,
“পরী কখনই বলবে না।”
দিশান মন খারাপ করে বলে,
“কেন?”
“পরী চায় ভাইয়া ভাইয়ার মতো করেই ভালো থাকুক। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো জোরজবরদস্তি করবে না।”
“আপুটা খুব শক্ত মানুষ!”
“হুম রে!”
প্রান্ত ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
“কী গল্প হচ্ছে দু’ভাই-বোনের মধ্যে?”
দিশান প্রান্তকে দেখে দৌঁড়ে জড়িয়ে ধরে।
“কেমন আছো ভাইয়া?”
প্রান্ত দিশানের চুলে হাত বু্লিয়ে বলে,
“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
“ভালো।”
প্রান্ত পকেট থেকে টাকা বের করে দিশানের হাতে দিয়ে বলে,
“যাও চকোলেট কিনে খাও।”
দিশান হাতে টাকা পাওয়া মাত্রই দৌঁড়ে দোকানে চলে যায়। প্রান্ত এসে তিথির পাশে বসে। তিথি হাসার চেষ্টা করে বলে,
“এতদিন পর?”
প্রান্ত দু’হাত পেছনের ফ্লোরে ভর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ব্যস্ত ছিলাম।”
তিথি ছোট করে বলে,
“ওহ।”
প্রান্ত ঘাড় ঘুড়িয়ে তিথির দিকে তাকায়। তিথি আলতো করে টাইগারের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। প্রান্ত বলে,
“তুমি অনেক পাল্টে গেছ।”
তিথি না তাকিয়েই বলে,
“যেমন?”
“কোনটা রেখে কোনটা বলব বলো? তবে আগের চেয়ে অনেক ম্যাচিউর হয়েছ।”
“বুঝতে শিখে গেছি।”
“কী?”
“জোর করে ভালোবাসা হয় না।”
“এই বুঝ দ্বারাই ম্যাচিউর হয়েছ।”
“তা তো বটেই। তবে পরীর একটা কথা আমার সবসময়ই মনে হয়।”
“কোন কথা?”
“পরী বলেছিল, ‘যাকে ভালোবাসো তাকে পাখির মতো মুক্ত আকাশে উড়তে দাও। যদি সে পাখি তোমার মায়ায় জড়িয়ে থাকে তাহলে দিনশেষে সে তোমার কাছেই ফিরে আসবে।’ কেন জানি ওর কথাটায় আমি অনুপ্রেরণা পাই।”
প্রান্ত কিছু বলে না। তিথি নিজেই বলে,
“তুমি পরীকে এখনো ভালোবাসো তাই না?”
“সহজ কথায় বলি, আমিও তোমার মতো বুঝে গেছি জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না। তাছাড়া আমি তো জানতাম না পরী তুর্যকে ভালোবাসে। তুর্য যে কেন পরীর ভালোবাসা বুঝল না!”
খুব আফসোসের স্বরেই কথাটা বলল প্রান্ত। তা শুনে তিথি তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে,
“তার তো যথাযথ কারণ আছে। ভাইয়ার তখন গার্লফ্রেন্ড ছিল। তাই না বোঝাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি! তুমি তো এত কাছ থেকেও কখনো আমার ভালোবাসা বুঝতে পারোনি।”
তিথির শেষের কথাটায় প্রান্তর বুকে চিনচিনিয়ে ওঠল। আসলেই তো! এতকাছ থেকেও প্রান্ত কখনো তিথির ভালোবাসাটা বুঝতে পারেনি। নাকি বুঝতে চায়নি!
প্রান্তকে নিরুত্তর দেখে তিথি বলে,
“লাইফে মুভ অন করা এতটাও সহজ না। ভাইয়া সময় নিচ্ছে নিক। হতেও পারে ভাইয়া কখনো পরীকে ভালোবেসে ফেলল। বা অন্য কাউকে।”
“হুম।”
“আচ্ছা যদি ওদের সম্পর্কটা হয়ে যায় তাহলে তুমি কষ্ট পাবে না?”
“না। তুর্য আর পরী দুজনই আমার পছন্দের মানুষ। আমি চাই দুজনই ভালো থাকুক। তাছাড়া আমার জানামতে এমন কোনো বিধান নেই যেখানে লেখা আছে, কাউকে ভালোবাসলে তাকে পেতেই হবে।”
“ভালো বলেছ। আচ্ছা এখন উঠি। পড়তে বসতে হবে। তুমি রুমে চলো।”
“না। আমিও চলে যাব এখন। কাজ আছে আমার একটা।”
“আচ্ছা।”
———————
অফিস থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়েই রান্না বসিয়েছে তুর্য। আজ অফিস তাড়াতাড়ি ছুটি হওয়ায় বাহির থেকে খাবার খেয়ে আসেনি। নিজেই রান্না করবে বলে বাজার করে নিয়ে এসেছে। ফ্রিজ থেকে কাতলা মাছ বের করে ভিজিয়ে রেখেছিল। সেগুলো বরফ ছোটার পর ভালোমতো ধুয়ে মশলা মিশিয়ে নিয়েছে। কড়াইতে তেল গরম করে মাছের পিসগুলো গরম তেলে ছেড়ে দিচ্ছে।
দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অতীতের কতশত কথা ভাবতে থাকে। ভালো থাকার অভিপ্রায়ে সকলের থেকে দূরে সরে এসেছে। ভালো কতটা আছে জানা নেই। তবে মানিয়ে নিতে শিখেছে পরিস্থিতির সাথে। অনেকদিন হলো বাড়িতে ফেরা হয় না। এবার অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একবার যেতেই হবে।
ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে মাছ ভাজা শেষ করে তরকারি বসিয়ে দেয়। অন্য চুলোয় বসিয়ে দেয় ভাত। হাত ধুয়ে রুমে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে অনলাইনে যায়। মেইন আইডি ডিএক্টিভ করা। ফেক আইডি দিয়েই যা একটু অনলাইনে যাওয়া হয়। যদিও অফিসের কাজের চাপে একদমই সময় হয়ে ওঠে না। তবুও এই ব্যস্ততাকেই ভালোবাসে তুর্য। ব্যস্ততা আছে বলেই হয়তো এখনো নিজেকে ঠিক রাখতে পেরেছে। রিনির আইডিটা সার্চ দিয়েই দেখতে পেল সিয়ামের সাথে হাসিমুখে বিয়ের ছবি। এছাড়াও দুজনের আরো অনেক ছবি রয়েছে। তুর্য তাচ্ছিল্য করে হেসে মনে মনে বলে,
“বেঈমানগুলো ভালোই থাকে।”
ডাটা অফ করতে গিয়ে আবারও অনলাইনে যায় তুর্য। পরীর আইডিটা সার্চ দিয়ে ওর টাইমলাইন ঘুরে। পরীর কোনো ছবি নেই ফেসবুকে। শুধু গুটি কয়েক ছোট ছোট পোষ্ট। কেন জানি ওর পোষ্টগুলো পড়লে মনে অজানা এক শক্তি আসে। মন হালকা লাগে। ইচ্ছে হয় একবার ফেক আইডি দিয়েই পরীকে নক দিতে। কী ভেবে যেন আর দেওয়া হয়ে ওঠে না।
রান্নাবান্না শেষ করে গরম পানি মিশিয়ে গোসলটা সেরে নেয়। তারপর গিটারটা নিয়ে বারান্দায় বসে। গান গাইতে ইচ্ছে করছে আজ খুব। ফোনের রেকর্ডিং অন করে তুর্য গান ধরে,
“Tere bin jeena hai aise
Dil dhadka na ho jaise
Yeh ishq hai kya duniya ko
Hum samjhaye kaise
Ab dilon ki rahon mein
Hum kuch aisa kar jayein
O khuda…
Bata de kya lakreenon mein likha
Hamne toh
Hamne toh bas ishq hai kiya
O khuda,
Bata de kya lakreenon mein likha
Hamne toh
Hamne toh bas ishq hai kiya…”
গান সেভ করে দোনোমনা করে অবশেষে পরীকে ম্যাসেঞ্জারে দিয়েই দেয়। কে জানে, পরী চেক করবেই কী’না!
————————-
গায়ে পাতলা একটা শাল জড়িয়ে ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে পরী। আকাশে চাঁদ আছে তবে ঘোলা। মৃদু মৃদু বাতাস এসে শরীর কাঁপিয়ে তুলছে। মায়ের সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে খুব। মনটা যে খুব বিষণ্ণ। কিন্তু তার জো নেই এখন। শীতে ঠান্ডা বাঁধিয়ে বসেছে তিনি। রাতে জোর করে খাবার খাইয়ে তারপর ওষুধ খাইয়ে শুয়ে দিয়েছে। বাবাকে মায়ের পাহারায় রেখে এসেছে। একবার ইচ্ছে হলো মেহেনুবাকে ফোন করে কথা বলতে। আবার মনে হলো এই সময় তো ও সাগরের সাথে কথা বলে। এখন আর ওকে বিরক্ত করে কাজ নেই। ছাদের এক পাশেই রয়েছে ফুলগাছের চারা। কয়েকটা ফুলও ফুঁটেছে। পরী এগিয়ে গিয়ে ফুলগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। আর আপনমনেই হেসে ওঠে। আজকাল ফুলকে খুব বেশিই আপন মনে হয়। ফুলের সূচনা ধরেই তুর্যর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ! প্রথম সাক্ষাতেই ঝগড়ার উৎপত্তি। ঝগড়ার কথাগুলো মনে পড়তেই পরী একা একা শব্দ করে হেসে ওঠে। জীবনে মানুষটা নেই কিন্তু আছে কিছু অধরা স্মৃতি। যা চাইলেও মুছে ফেলা সম্ভব না কখনো। কোথায় আছে মানুষটা? যেখানেই থাকুক না কেন আমরা তো এক আকাশের নিচেই আছি! এই অনুভূতিটা অদ্ভুত রকমের আনন্দ দেয়। ভিনদেশে হলেও মানুষ এটা ভেবে আনন্দ পায় দূরত্ব যতই হোক আমরা আছি একই আকাশের নিচে! তুর্যর থেকে আমার দূরত্ব ঠিক কতটা? আচ্ছা সে এখন কেমন আছে? তার কি মনে পড়ে কখনো আমার কথা?
Leave a comment