ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ২

10 Min Read

প্রচণ্ড সুশীল প্রকৃতির মেয়ে নামী। আর পাঁচটা মেয়ে রূপ, সৌন্দর্যের দিক দিয়ে তাকে পেছনে ফেলতে পারলেও গুণের দিকে পারবে না। এই মেয়েটি দারুণ মেধাবিনী। শুধু পুঁথিগত বিদ্যাতেই সে সীমাবদ্ধ নেই। বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও সাহিত্যের প্রতি রয়েছে নিবিড় ঝোঁক। পড়াশোনার ফাঁকে ঠিক সমরেশ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, শরৎচন্দ্র ইত্যাদি বহু লেখকের বই পড়ে নেয়। এসএসসির পর থেকে বাবার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে করে নিয়েছে নিজের একচ্ছত্র অধিকার। এ পর্যন্ত শ’খানেক বই পড়া হয়েছে তার৷ সে চায় তার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হোক। তার বাবা ব্যবসায়ী আর মা ছিলেন গৃহিনী। দু’বছর হলো মা মারা গেছে। মায়ের স্বপ্ন ছিল, সে একদিন অনেক বড়ো ডাক্তার হবে৷ সেই স্বপ্নকে বুকে লালন করেই গতবছর এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস অর্জন করেছে। কিন্তু আফসোস, মা এ খবর জানতে পারল না। আজ পৃথিবীতে নিলু বেঁচে নেই। কিন্তু নিলুর স্বপ্ন বেঁচে আছে। একমাত্র মেয়ে নামীর মাধ্যমেই সে স্বপ্ন গুলো পূর্ণতা পাবে৷ মায়ের স্বপ্ন পূরণে একাগ্রচিত্তে লড়ে যাচ্ছে মেয়ে নামী। গত বছর পারিবারিক সমস্যায় মেডিকেলে পরীক্ষা দিতে পারেনি৷ তাই এ বছরের জন্য পাকাপোক্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু বিজনেসের প্রয়োজনে বাবা আখতারুজ্জামানকে দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে। সৎ মা আলিয়া খাতুন আর তাকে সহ নিয়ে যাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাবা। নামী জানে এছাড়াও তাদের বিশেষ একটি পরিকল্পনা রয়েছে। বাবা আর সৎ মা মিলে বেবি প্লানিং করছে। আমেরিকায় গিয়ে বেবি কনসিভ করবে আলিয়া। ফলশ্রুতিতে ঐ দেশের নাগরিকত্বও মিলে যাবে। নামী জানে বাবার বহুদিনের স্বপ্ন এটা। মা বেঁচে থাকলে হয়তো মেনে নেয়া সহজ হতো। যেখানে মন থেকে সৎ মাকেই মেনে নিতে পারেনি। সেখানে সৎ ভাইবোনকে কীভাবে মেনে নেবে? নতুন অতিথির আগমন ঘটার পর বাবা যদি তাকে আর ভালো না বাসে? সৎ মা এখন যে ভালো মানুষি দেখায় তখন যদি সবটা বদলে যায়। এত আশঙ্কা মনে নিয়ে আমেরিকায় যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
গতবছর বাবার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল নামী। সময়ের ব্যবধানে মনকে শক্ত করে নিয়ে, কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে এখন। কিন্তু এ বছর মেডিকেল পরীক্ষায় না বসে ভিন দেশে চলে যেতে হবে! এটা মেনে নিতে পারল না সে। কিছুতেই রাজি হলো না আমেরিকায় যেতে। সদ্য যৌবনে পা দেয়া মেয়েকে দেশে একা ছেড়ে যেতে রাজি নন আখতারুজ্জামান। নিজের পরিবারকে ভরসা করতে পারছে না সে। তাই নিজের চরম বিপদের দিনে প্রিয় বন্ধু সোহানের শরণাপন্ন হয়েছে। আখতারুজ্জামানের মেইল পেয়েই ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছে সোহান খন্দকার। সকল দিক বিবেচনা করে, অতীতে ঘটে যাওয়া সেই হৃদয়বিদারক পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে নামীকে ছেলের বউ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একালে না হয় মাথা উঁচু করে নিলুর সামনে দাঁড়াতে পারেনি। পরকালে যেন দাঁড়াতে পারে। সেই আশায় নিলুর চোখের মণিকে সযত্নে নিজের ঘরে নিয়ে যাবার পণ করেছে। করেছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছায়ার মতো পাশে থাকার অঙ্গীকার। পুত্রবধূ নয় নামী তার আরেক মেয়ে হয়েই থাকবে। হ্যাঁ মেয়ে। নামী নিলুর অংশ। যে মেয়েটার বাবা হওয়ার কথা ছিল সেই মেয়েটার শশুর হতে হবে তাকে। এই যদি হয় নিয়তি হোক। এ দফায় নিয়তিকে সুপ্রসন্ন মনে মেনে নেবে।
নামী বা সুহাস কেউই জানে না তাদের বাবা, মায়ের অতীত কী ছিল? তারা শুধু জানে ওরা খুব ভালো বন্ধু। নামীর বাবা, মা আর সোহান ছিল কলেজ ফ্রেন্ড। অতীতে তারা ছিল বন্ধু। বর্তমানে হতে যাচ্ছে বেয়াই, বেয়ান। এইটুকু কেবল জানা ওদের৷ অথচ কত কথা অজানা!
সুহাস প্রচণ্ড দুরন্ত স্বভাবের। ঠিক নামীর বিপরীত চরিত্র এই ছেলে। মিল শুধু এক দিকেই এই দু চরিত্রই দারুণ মেধাবী। মা ডাক্তার, বাবা দু’টো বেসরকারি চিকিৎসালয়ের মালিক। ফলশ্রুতিতে বেশ দম্ভ নিয়েই চলাফেরা করে। কলেজ প্রাঙ্গন থেকে শুরু করে পরিচিত শহর, বাড়ি। সকল স্থানেই সে এবং তার পুরো গ্যাং রাজ করে বেড়ায়। তাদের গ্যাং এর নাম, “বিগ বস”
বিগ বসের হেড সদস্য তিন বন্ধু। সুহাস খন্দকার, সৌধ চৌধুরী আর আইয়াজ হোসেন। তিনজনই বনেদি পরিবারের সন্তান। সুহাস, সৌধ স্কুল বন্ধু হলেও আইয়াজের সঙ্গে পরিচয় মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে। তবুও অপরিচিত কেউ বুঝতে পারবে না আইয়াজের সঙ্গে তাদের পরিচয় মাত্র দু’বছরের।
ছুটি কাটাতে এসে কীভাবে ফেঁসে গেছে সেই বিবৃতি লিখে ম্যাসেন্জার গ্রুপে সেন্ট করল সুহাস৷ সৌধ, আইয়াজ দু’জনই সিন করল। তৎক্ষনাৎ সৌধ রিপ্লাই করল,
‘ এ্যা মাম্মা বলিস কী! তোর বিয়ে! ? ‘
রিপ্লাইয়ের সাথে গোটা দশেক চোখ টিপ ইমুজি দিল সৌধ৷ আইয়াজেরও উৎসুক বার্তা এলো,
‘ বলিস কী দোস্ত। এই বয়সে বিয়ে! আংকেল যা মানুষ যদি করতেই হয়? মেয়ে দেখতে কেমন রে? কীসে পড়ে? ‘
সুহাস ভয়েসে উত্তর দিল। সৌধ গোটা দশেক দাঁত ক্যালানো ইমুজি দিয়ে বলল,
‘ এ্যা মাম্মা আমরা কি আসব? বাসর সাজাতে হবে তো। ‘
আইয়াজ হাহা রিয়াক্ট দিল। সুহাস রাগি ইমুজি দিয়ে বলল,
‘ মজা নেস তোরা? বা’লছা’ল বাদ দিয়ে পরামর্শ দে।’
আইয়াজ বলল,
‘ বিয়েতে পুরোপুরি অমত তোর? ‘
সৌধ বলল,
‘ মেয়ে দেখতে কেমন? ভালো হলে হাতছাড়া কেন করবি? ‘
সুহাস সৌধের ম্যাসেজের রিপ্লাইয়ে বলল,
‘ মেয়ের ফিজিক্যাল স্ট্রাকচার এগ্রিঅ্যাবল কিন্তু… ‘
‘ কিন্তু কী? এমন সুযোগ আমি পেলে তো লুফে নিতাম। তুই কেন নিবি না? অরিনের জন্য! দোস্ত, তুই কি অরিনের প্রতি সিরিয়াস? ‘
‘ উমহ সেটা বড়ো ব্যাপার নয়। ‘
‘ তাহলে কী? আকিব স্যার কী বলেছে মনে নেই? আমাদের যে বয়স চলছে, এ বয়সে বিয়ে করার মধ্যে আলাদা একটা জোশ আছে। কী যে মজা… টাটকা টাটকা ফিলিংস। ‘
সুহাস নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার দুরন্ত মস্তিষ্কে সৌধের কথায় অভিলাষ জন্মাল। সৌধ কোনো উত্তর না পেয়ে পুনরায় বলল,
‘ শোন, তুই যদি বিয়েটা করতে না চাস আংকেলকে বল আমি করব বিয়ে। আব্বা, আম্মা রাজি না থাকলেও করব। ঠিকানা দে আসতেছি! ‘
বিস্মিত হলো সুহাস৷ মেয়ে না দেখেই সৌধ এতটা আগ্রহী? ভ্রু কুঁচকে গেল তার৷ ইগোতেও লাগল খুব। নামীকে তার জন্য বাছাই করা হয়েছে। সে যদি বিয়ে নাও করে সৌধ কেন করতে চাইবে? বুকের ভেতর বিশ্রী একটা অনুভূতি হলো৷ বলল,
‘ গায়ের কালার ডাল মেয়েকে তুই বিয়ে করবি?’
সৌধ হাহাহা ইমুজি দিয়ে বলল,
‘ দোস্ত এইটা কোনো ব্যাপারই না। নাইট ক্রিম কিন্না দিব। দরকার পড়লে বিদেশি প্রডাক্ট আইনা দিব। ‘
ওদের কথোপকথন দেখে আচমকা আইয়াজ ভেঙচি ইমুজি দিয়ে বলল,
‘ বিদেশি প্রডাক্ট আইনা দিলেই বিদেশি চিজ পাবা নাকি? ‘
সৌধ বলল,
‘ ওরে মেনি বিড়াল! কইছে টা কী! শা’লা মেনকা। ‘
এ পর্যন্ত ম্যাসেজ দেখেই সুহাস আর কিছু বলল না। সৌধ সুহাসের থেকে কোনো বার্তা না পেয়ে বলল,
‘ দোস্ত আমরা এখানেই থেমে যাই। বাই এনি চান্স ঐ মেয়েটা তোর বউ হয়ে গেলে এসবের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে হ্যাঁ, তুই যদি বিয়েটা করতে না চাস। আংকেল আর মেয়েটির জন্য আমি রেডি৷ ‘
আইয়াজ বলল,
‘ সুহাস, একটা ছবি দে তো মেয়েটির। সাদা, কালো বিবেচনা না করে ভাবি হিসেবে চলে কিনা দেখি। ‘
সৌধ বলল,
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ছবি দে। ‘
কথোপকথনের এ পর্যায়ে সুহাস চমকে ওঠল। নামীর ছবি তার কাছে নেই! কী অবস্থা। সন্ধ্যার পর যাকে বিয়ে করতে হবে। তার একটা ছবিও নিজের কাছে নেই! ভেবেই ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো৷ এটা কী জীবন? না না এটা কী কোনো বিয়ের পর্যায়ে চলে? বিচলিত ভঙ্গিতে আশপাশে তাকাল সুহাস। নামীদের বারান্দায় বসে ফোন টিপছিল সে। দুপুরের খাবার আয়োজন চলছে বোধহয়। পোলাওয়ের ঘ্রাণ ভেসে আসছে৷ নামী কোথায় রান্নাঘরে? নাকি অন্য কোথাও? সে কাউকে দিয়ে নামীকে ডেকে আনবে? ডাকলেই কি মেয়েটা আসবে? আসবে না কেন? তখন ওভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর সোহান খন্দকার কতভাবে তাকে শাসিয়েছে হিসেব আছে? এই শাসানোর বিনিময়ে হলেও নামীর এখন তার কাছে আসা উচিৎ। উচিৎ মানে আসতেই হবে। আচমকা ওঠে দাঁড়াল সে। আশপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল নামীকে। ঠিক সে মুহুর্তেই মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে বালতি হাতে উঠানে নেমে এলো নামী। উঠানে টাঙানো রশির সামনে এসে বালতি মাটিতে রাখল। এরপর নিচু হয়ে চিপটানো ভেজা কাপড়গুলো ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে রশিতে মেলে দিতে লাগল৷ সুহাসের মাথায় তখনি দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসল। ভাবল,
‘ যেচে গিয়ে ছবি চাওয়ার মানেই হয় না। এতে নাগিনীর ভাব বেড়ে যাবে। আর আমার ভেল্যু কমে যাবে। ভাববে আমি ওর প্রতি ইন্টারেস্টেড। এরচেয়ে বরং আড়াল থেকে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নেই। সেও জানল না আমারো দর বেড়ে থাকল। ‘
ভাবামাত্রই ক্রুর হেসে কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। প্রতিটি ছবিই ছিল অপ্রস্তুত। তার মধ্যে কয়েকটা ছবি দেখে সুহাসের মাথাই খারাপ হয়ে গেল। নামী যখন চিপ্টানো কাপড় ঝাঁকি দিতে দুহাতে কাপড় ধরে উপর দিক তুলেছিল সে মুহুর্তের তিনটা ছবি তোলা হয়ে গেছে। যে তিনটা ছবিতে ওর বুকের ওপর থেকে ওড়না সরে গিয়েছিল। ম্যাসেন্জারে সমানতালে সৌধ আর আইয়াজের ম্যাসেজ আসছে। আর সুহাস ফোনের স্ক্রিনে নামীর দেহ মধ্যস্থে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সৌধ ইনবক্সে ম্যাসেজ দিল,
‘ কীরে কই গেলি। পিক দিলি না? ‘
সুহাসের ধ্যান ভাঙল। মস্তিষ্ক এলোমেলো লাগছে তার। নামীকে তার চৌম্বক মনে হচ্ছে আর নিজেকে মনে হচ্ছে ধাতব বস্তু৷ অন্য মনস্ক হয়ে ম্যাসেন্জার গ্রুপে ঢুকল সে৷ সৌধ, আইয়াজ কী ম্যাসেজ দিয়েছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল ,
‘ চুম্বকের ধর্মই তো ধাতুকে আকর্ষণ করা তাই না? ‘
সৌধ আর আইয়াজ এ বার্তা দেখে ভেবাচেকা খেয়ে গেল৷ বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের ছাত্র। একজন মেডিকেল স্টুডেন্টের মুখে অতীব সাধারণ এই প্রশ্ন পেয়ে দু’জনেরই চোখ উল্টে গেল। ইমুজি পাঠিয়ে সেই উল্টো চোখানুভূতি সুহাসকে দেখিয়েও দিল তারা।

টাইপোগ্রাফি- সিদরাতুল মুনতাহা সিমি

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।