ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ২৩

15 Min Read

ইদের ছুটি কাটাতে সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে গেছে। গতরাত দেড়টার দিকে সুহাস এসেছে নামীর কাছে। এই নিয়ে প্রচণ্ড রাগারাগি করেছে নামী। দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে প্রায় দু’ঘন্টা। সিমরানের থেকে খবর পেয়েছে সুহাস বাড়ি এসেছে বিকেলের দিকে। এরপর দু’ঘন্টা সময় বোন এবং মাকে দিয়েছে। উদয়িনীর সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে, মতের অমিলও অনেক। চাপা অভিমান আকাশছোঁয়া। তবু মায়ের প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই। সুহাস এখন পুরোপুরি নামীতে মত্ত৷ বুঝতে পারে উদয়িনী। কিন্তু আগের মতো ঘাটে না আর৷ তার মনে তীব্র ভয় আছে৷ ছেলেমেয়ে এখন বড়ো হয়েছে। বুঝ, শক্তি প্রখর হচ্ছে। প্ররোচিত করার চেষ্টা পূর্বে বহুবার করলেও এখন আর করে না৷ পাছে নিজের কুকর্ম প্রকাশ পেয়ে যায় এই ভয়ে। শতহোক পৃথিবীর কোনো মা নিজের প্রতি গর্ভজাত সন্তানের ঘৃণা দেখতে চায় না৷ চায় না উদয়িনীও। তাই বলে নামীকেও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি৷ কখনো পারবে কিনা তাও জানে না। নামী সম্পর্কিত কোনো কথাই সুহাসের কাছে জানতে চায় না সে। আর না সুহাস বউ সম্পর্কে মাকে কিছু জানায়৷ মাঝেমাঝে অবশ্য সিমরানকে টিটকিরি দিয়ে অনেক প্রশ্নই করে। সিমরানও কম নয়। তার মা যদি বুনো ওল হয় সে যেন বাঘা তেঁতুল। ঠিক এমনই করে জবাব দিয়ে দেয়। বাড়িতে সময় দিয়ে ক্লিনিকে গিয়ে বাবার সাথেও দেখা করে আসে সুহাস। এরপর বেরোয় বন্ধুদের সঙ্গে বাইক নিয়ে। সেখান থেকেই নামীর কাছে ফিরতে রাত বাজে দেড়টা। সুহাস আসবে বলে কয়েক পদের রান্না করেছিল নামী। সেগুলো আর কারোরি খাওয়া হয় না। ঝগড়া করতে করতে এক পর্যায়ে রেগে বাসা ছাড়তে উদ্যত হয় সুহাস। নামী তখন আর কিছুই বলতে পারে না। এই ছেলেটা তার অনুভূতিই বুঝে না৷ তীব্র অভিমান বুকে চেপে বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে চুপচাপ। রাগি বউয়ের আকস্মিক নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ায় সুহাসও দমে যায়। বাসা ছাড়তে পারে না আর। রুমে গিয়ে বউয়ের মান ভাঙাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে৷ শেষ রাত কাটে বউয়ের মান ভাঙিয়ে, আদর দিয়ে, ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখে।
রাতটা নিদ্রাহীন কাটিয়ে সকালবেলা সুহাস গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। নামী আর ঘুমায়নি। শাওয়ার নিয়ে এসে ভেজা চুল আঁচড়ে চুপচাপ বসে আছে সুহাসের পাশে৷ তাকিয়ে দেখছে উবু হয়ে ঘুমানো বরটাকে।
গত কয়েক বছরে সবকিছুর পরিবর্তনের সঙ্গে সুহাসের শারীরিক পরিবর্তনও চোখে লাগার মতো। দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের ফলে সে যে পেশিবহুল শরীরটা তৈরি করেছে। এর পিছনে একমাত্র অবদান নামীরই। সেদিনের সেই অপমান কতখানি মনে গেঁথেছিল তা আজ ওর শরীরের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। শুধু কি তাই? অসভ্য ছেলেটা ঘনিষ্ঠ মুহুর্তেও টিপ্পনী কাটতে ছাড়ে না। নিজের পেশিবহুল উন্মুক্ত বক্ষঃতলে পিষতে পিষতে ফিসফিস করে শুধায়,
‘ তোমার সেই ফকফকা চেঙ্গিস খান এখন লোমশে আবৃত বলিষ্ঠ বুকের নিচে তোমাকে পিষতে পারে। এ মুহুর্তে তোমার অনুভূতি ঠিক কী জান? শর্টকাটে শেয়ার করো প্লিজ? ‘
নামী তখন তীব্র লজ্জায়, ঈষৎ রাগে ছটফটিয়ে ওঠে। নখ ডাবিয়ে দেয় সুহাসের পুরো পিঠজুড়ে। সুহাস চ্যাঁচিয়ে ওঠে৷ শক্ত করে চেপে ধরে আদুরে কামড় বসায় বউয়ের গ্রীবাদেশে। নিজেদের সেই একান্ত মুহুর্তের কথা স্মরণ করে লজ্জায় আরক্ত হয় নামী। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে সুহাসের পিঠে। বেচারার পিঠজুড়ে অসংখ্য নখের আঁচড়। মায়া হয় খুব৷ পরোক্ষণেই ভেঙচি কেটে বিড়বিড়ায়,
‘ বেশ হয়েছে। যেমন কর্ম তেমন ফল। ‘
.
.
সাতসকালে ঘুম থেকে ওঠেই তৈরি হয়ে নিল সিমরান। হ্যান্ড পার্স নিয়ে বের হবার পূর্বে মায়ের ঘরে উঁকি দিল। দেখল, মা কফি খাচ্ছে। তাকে দেখেই বলল,
‘ সাতসকালে কোথায় যাচ্ছ? ‘
সিমরান মৃদু হেসে কপটহীন স্বরে বলল,
‘ নামীপুর বাসায়। ব্রোও আছে ওখানে। ‘
সুহাস নামীর কাছে বুঝতে পেরেছিল উদয়িনী। এ নিয়ে আর কিছু বলার নেই তার। কিন্তু সকাল হতেই মেয়েও সেখানে ছুটছে? মুখটা কঠিন হয়ে এলো। কিছু বলতে উদ্যত হলে সিমরান প্রচণ্ড তাড়া নিয়ে বলল,
‘ আমি বেরুচ্ছি আম্মু, ফিরতে দেরি হবে টেনশন করো না। ‘
চলে গেল সিমরান৷ বিমূঢ় হয়ে বসে রইল উদয়িনী৷ ইদের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছে। পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন কাটাবে বলে। অথচ তার পরিবার নেই। গত কয়েক বছর ধরেই ছেলেমেয়েদের সাথে তার দূরত্ব। নিজের অহংবোধে ডুবে গিয়ে এই দূরত্বকে এতকাল সে গুরুত্ব দেয়নি৷ এখন বয়স বাড়ছে। চাকরির মেয়াদও ফুরিয়ে এসেছে। স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব নতুন নয় পুরোনো। ছেলেমেয়েদের সাথে যে মনের সংযোগ ছিল তা ছিন্ন হতে হতে এবার সে নিজেকে সম্পূর্ণ একা অনুভব করতে শুরু করল। কেঁপে ওঠল বুক। মৃদু কম্পন অনুভব করল হাত, পায়েও৷ কফির মগ পাশের টেনিলে রেখে ফোন হাতে নিয়ে কল করল ছেলেকে। ঘুম ভেঙে গেল সুহাসের। ফোন রিসিভ করতেই শুনতে পেল মায়ের কাঁপা স্বর,
‘ বাবা ওঠেছিস? ‘
ঘুম কাতুরে কণ্ঠে সুহাস জবাব দিল,
‘ না, এনি প্রবলেম? তোমার কণ্ঠ এমন লাগছে কেন?’
উদয়িনী ঠোঁট কামড়ে নিজের কষ্ট চেপে নিল। বলল,
‘ সিনু না খেয়েই বেরিয়ে গেল। বলল তোদের ওখানে যাবে। একসঙ্গে খেয়ে নিস। ‘
সুহাস চোখ ডলতে ডলতে ওঠে বসল। শত অভিমান থাকলেও মায়ের এই কণ্ঠ সুহাসের হৃদয়ে গিয়ে লাগল। সে নরম গলায় বলল,
‘ চিন্তা করো না। নামী খাইয়ে দিবে ওকে। নামীর হাতে খেতে পছন্দ করে সিনু। ‘
উদয়িনী চমকে গেল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘ ওহ! ‘
‘ তোমার শরীর ঠিক আছে মা? ‘
বাঁকা হেসে উদয়িনী বলল,
‘ হ্যাঁ ঠিক আছে। তোর বাবার নাম্বারটা হোয়াটসঅ্যাপে দিতে পারবি? ‘
পৃথিবীতে এরচেয়ে বিস্ময়কর কিছু হতে পারে কী? এক নারী তার সন্তানকে ফোন করে বলছে তার স্বামীর ফোন নাম্বার দিতে? বাবা নাম্বার পরিবর্তন করেছে আড়াই বছর আগে। সেই নাম্বার যে মা জানে না। সুহাস মাত্রই জানতে পারল৷ মায়ের শতদোষ থাকলেও বাবার প্রতি রাগ হলো এবার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ দিচ্ছি। তুমি কী করছ মা? ‘
‘ কফি খাচ্ছিলাম। তোর নানু আসবে দুপুরে। তার ঘরটা গুছাব। বাবার নাম্বারটা মনে করে দিয়ে দিস। রাখছি। ‘
ফোন কেটে গেল। সুহাস কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে বাবার নাম্বার সেন্ট করল মাকে। আজ মায়ের কণ্ঠ ভীষণ অন্যরকম লাগল। ঐ কণ্ঠে ক্রোধ ছিল না ছিল প্রচণ্ড অসহায়ত্ব। যা অনুভব করে সুহাস বাবাকে একটা টেক্সট করল,
‘ মা ভালো নেই বাবা। মা তোমায় ফোন করলে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলো প্লিজ। ‘
রাতে রান্না করা খাবার গুলো গরম করে রুমে এলো নামী। ননদ এলেই খাবে তারা। আপাতত ভেজা চুলগুলো শুকানো যাক। হেয়ার ড্রায়ারে লাইন দিয়ে বরের হাতে ধরিয়ে দিল সে। সুহাসের ঘোর কাটল শ্যাম্পুর কড়া ঘ্রাণে৷ চুল কী শুকাবে? বউকে জাপ্টে ধরে কোলে বসিয়ে চুলে নাক গুঁজে বসে রইল কিয়ৎক্ষণ। এরপর চুল শুকাতে শুকাতে গল্প করল বন্ধুদের নিয়ে। আইয়াজ আর ফারাহর সম্পর্ক কেমন চলছে? মাঝেমধ্যেই ফারাহকে জ্বিনে ধরে। তখন বেচারা আইয়াজের দশা হয় ঠিক দেবদাসের মতো৷ ছেলেটা বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে। কিন্তু ফারাহই ভিড়াচ্ছে শুধু। মাঝে মাঝে ফারাহকে বেশ সন্দেহ হয়, রহস্যময় লাগে। সুহাসের মুখে এ কথা শুনে নামীও চিন্তিত হয়ে পড়ে। সুহাসের কথা বা ভাবনা ভুল নয়। তার নিজেরও ইদানীং ফারাহকে বেশ রহস্যময় মনে হয়৷ আইয়াজ ফারাহর গল্প শেষে সৌধ আর নিধিতে চলে গেল ওরা। সৌধ নিধির প্রতি ভীষণ পজেসিভ৷ এতগুলো বছর ধরে বিনা স্বার্থে ভালোবেসে যাচ্ছে মেয়েটাকে। অথচ তার তরফ থেকে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। খুব কঠিন হৃদয়ের নারী নিধি। এতকিছু করেও টলানো যাচ্ছে না। সৌধ, নিধির কথা শুনে অন্যমনস্ক হয়ে গেল নামী। সৌধ যেমন নিজের সবটুকু দিয়ে নিধিকে ভালোবাসে। ঠিক তেমনি সিমরান ভালোবাসে সৌধকে। এরা দু’জনই একতরফা ভাবে ভালো বেসে যাচ্ছে। নামী জানে সৌধ কোনোদিন সিমরানকে ভালোবাসবে না। তার ভালোবাসা সব একমাত্র নিধির জন্যই। সৌধ খুব একগুঁয়ে স্বভাবের। তার বিশ্বাস নিধিকে সে নিজের করেই ছাড়বে। তাছাড়া একটি ছেলের থেকে এমন ভয়ানক ভালোবাসা পেলে কোন মেয়েই বা মুখ ঘুরিয়ে থাকবে? থাকলেও কতদিন পারবে? সবটা বুঝে নামী৷ তাই সিমরানকে ইনিয়েবিনিয়ে অনেক সময়ই বোঝায়, সৌধ তাকে ভালোবাসে না৷ কিন্তু মেয়েটা নেতিবাচক কথাগুলোও ইতিবাচক নিয়ে নেয়৷ তার দৃঢ় বিশ্বাস সৌধকে সে নিজের করে পাবেই পাবে। এর কারণ বহু যুবকের প্রেম প্রত্যাখ্যান করে এক সৌধতে মগ্ন সে। তার এই প্রগাঢ় বিশ্বাস, ভালোবাসা কখনোই বৃথা যেতে পারে না। সিমরানের সেসব কথা শুনে চুপসে যায় নামী৷ কিছুই বলতে পারে না৷ আর না কখনো সুহাসের সাথে শেয়ার করে এসব। যে যাই বিশ্বাস করুক৷ সে একমাত্র ভাগ্যে বিশ্বাস করে। খুব ভালো করেই জানে মানুষ যাই পরিকল্পনা করুক না কেন সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী এক এবং অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা।
চুল শুকানো শেষে রাবার ব্যন্ড দিয়ে চুল বেঁধে সুহাসের দিকে ঘুরে বসল নামী। জিজ্ঞেস করল,
‘ সৌধ ভাই নিধি আপুর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাচ্ছে না কেন? ‘
‘ পাঠাবে স্মৃতি আপুর বিয়ের পরই। ‘
‘ তাদের বাড়ির সবাই জানে নিধি আপুর ব্যাপারে?’
‘ এখনো না। জানাবে শিঘ্রই। ওর পরিবারে এসব নিয়ে প্রবলেম নেই। সব প্রবলেম নিধির পরিবারেই। সুজা আংকেলকে জানানোর পর এসব সলভ হয়ে যাবে৷ ‘
নামী মৃদু হাসল। মনে মনে বলল,
‘ এবার সিমরানকে সৌধ ভাই আর নিধি আপুর ব্যাপারে জানানো উচিত। ‘
পরোক্ষণেই ভাবল,
‘ উহুম, যখন বিষয়টা পারিবারিক ভাবে আগাবে তখনি জানাব৷ আমার কাজ শুধু পাশে থেকে মেয়েটাকে সামলানো। ‘
এরপর ভাবল, সৌধর প্রতি সিমরানের অনুভূতি বিষয়ে সুহাসকে জানাবে কিনা? প্রচণ্ড দ্বিধায় পড়ে গেল সে। বলবে বলবে করেও শেষ পর্যন্ত আর বলল না। না জানি সুহাস কী প্রতিক্রিয়া দেবে। এই ভয়েই কিছু বলতে পারল না৷ সে তো জানে বোনের ব্যাপারে ছেলেটা কতখানি পজেসিভ!
.
.
এমপি সুজা চৌধুরীর বাড়ি আত্মীয়, স্বজনে ভরপুর। পুরো বাড়িটা সাজানো হচ্ছে ঠিক রাজমহলের মতো। এ যেন ঠিক এক রাজকন্যেরই বিয়ের আয়োজন। সৌধদের বাড়ির নাম স্মৃতিসৌধ। এই বাড়িটা সুজা চৌধুরীর খুব শখের বাড়ি৷ আজ বাদে কাল যে মেয়েটির বিয়ে। সেই মেয়েটিও এ বাড়ির খুব শখের। বাড়ি জুড়ে একদিকে সুখের বন্যা বইলেও অন্যদিকে চাপা কষ্টের জোয়ার আসছে। তবু জীবন চালনা করতে হবে জীবনের নিয়মেই। সকালের নাস্তা শেষে চৌধুরী গিন্নি ছোটো ছেলেকে ডেকে পাঠালেন। সৌধর মা তানজিম চৌধুরী। মায়ের ঘরে এসে সৌধ দেখল, মা পান মুখে দিচ্ছেন৷ পাশে আপু আর ছোটো কাকার চার বছরের মেয়ে তাহানী। তাহানী নামটা রেখেছে তানজিম চৌধুরী। যাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। কিন্তু তাহানীকে অভিনন্দন জানিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে চৌধুরী বাড়িতে। তাহানী নামের অর্থ অভিনন্দন।
সৌধর একমাত্র কাকা সুলল চৌধুরী। স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি আর বিয়ে করেনি। বয়স গতমাসে একচল্লিশে পড়েছে। চার বছর ধরে পরিবারের সবাই খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে সুললকে বিয়ে করানোর জন্য৷ সে চেষ্টা বরাবরের মতোই বৃথা। তাহানীকে সৎ মা নামক শব্দটির সঙ্গে পরিচয় করাতে নারাজ সে। ঘোর আপত্তি। তার বুড়ো মা আর ভাবির দায়িত্বেই আছে ছোট্ট তাহানী। আর সে একাগ্রচিত্ত ঢাকা শহরে থাকা তাদের পারিবারিক বিজনেস সামলাচ্ছে৷ মায়ের ঘরে ঢুকে তাহানীকে কোলে তুলে নিল সৌধ। ছোটো ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরে রইল তাহানী। সৌধ ওর ছোট্ট গালে চুমু খেয়ে মাকে বলল,
‘ আম্মা ডাকছিলে? ‘
তানজিম চৌধুরী পান চিবুতে চিবুতে বললেন,
‘ হু আব্বা ডাকছিলাম। সোহান ভাইয়ের বাড়ি যাও তাড়াতাড়ি। সিনু মারে নিয়া আসো গা। ‘
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে সৌধ বলল,
‘ তোমাকে কতদিন বলেছি পান খাবে না। আর তুমি এটা অভ্যাসে পরিণত করছ? ‘
তানজিম চৌধুরী হাসলেন। কাঁধে পড়ে থাকা আঁচলখানি মাথায় তুলে নিয়ে বললেন,
‘ এই একটুআধটু খাই। তুমি যাও সিনু মারে নিয়া আসো গা। সুহাস ব্যাটায় নাকি শশুর বাড়ি গেছে শুনলাম। মেয়ে মানুষ বৃষ্টি মাথায় কইরা একা একা না আসাই ভালো। ভাবিও নাকি আসছে৷ তার সাথে কথা বইলা তারপরে নিয়া আইসো। ‘
স্মৃতি আপু আড়চোখে ভাইকে দেখে নিল। গতরাতেই ভাইকে সে বলেছিল সিনুকে সাতসকালে নিয়ে আসতে। ভাইয়ের মেজাজ ভালো নেই। তাই রাজি হয়নি৷ সুহাসের পরিবারের সঙ্গে চৌধুরী পরিবারের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। সেই সুবাদে স্মৃতি আর সিমরানের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ আর মধুর। একদিন বাদেই মেহেদি অনুষ্ঠান। টুকটাক শপিং এখনো বাকি। সিমরানের পছন্দ জ্ঞান ভালো। প্রচণ্ড স্মার্ট আর মিশুক প্রকৃতির মেয়ে। স্মৃতির মতে বিয়ে বাড়ির আমেজ খুবই সাদামাটা। বিয়ে বিয়ে অনুভূতিটা ঠিক আসছে না। আসল কথা তার কাজিনদের সাথে বা অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে মতের অমিল, রুচির অমিল হচ্ছে। নিজের বাড়িতেও ভীষণ অস্বস্তিকর লাগছে। সৌধর বন্ধু, বান্ধবী সবাই আসবে ইদের পরদিন। তার বান্ধবীরাও ইদের পর আসবে। আগে কারো পক্ষে আসা সম্ভব হবে না৷
নামী আসবে আগামীকাল। সে সুহাসকে নিয়ে গেছে তার গ্রামের বাড়িতে। একদিন থেকে তারপর ফিরবে। এই বৃষ্টিমুখর পরিবেশে সিমরান একা একা আসুক চায় না স্মৃতি৷ তাছাড়া উদয়িনী আন্টিকে খুব ভয় পায় সে৷ তানজিম সবটা বুঝিয়ে ছেলেকে আদেশ করল সিমরানকে নিয়ে আসতে। মায়ের আদেশ অমান্য করার মতো ছেলে সৌধ নয়৷ পারিবারিক ভাবে তারা সকল ভাই, বোনই খুব কঠিন নিয়মে মানুষ হয়েছে। বেয়াদবের স্থান সুজা চৌধুরীর বাড়িতে নেই৷ তাই মায়ের আদেশ আদবের সঙ্গেই মান্য করল সৌধ৷ তাহানীকে স্মৃতি আপুর কোলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে৷ প্রথমে ভেবেছিল গাড়ি নিয়ে বের হবে৷ বৃষ্টি থেমেছে। আকাশটাও পরিষ্কার। সবটা দেখে নিয়ে বাইক নিয়েই বের হলো। স্মৃতি আপুও সিমরানকে টেক্সট করে বলে দিল,
‘ সিনু, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসিস৷ একদম বিয়ের পর বাড়ি ফিরবি৷ আব্বাকে দিয়ে আংকেলকে ফোন করিয়ে দিব নো প্রবলেম। আর আন্টিকে ভাই ম্যানেজ করে নেবে নো টেনশন। ‘
স্মৃতি আপুর ম্যাসেজ পেয়ে সিমরানকে আর পায় কে? ঝড়ের গতিতে সে তৈরি হয়ে নিল। সৌধ ভাই! তার স্বপ্নের পুরুষ আসছে তাকে নিতে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ভাবল, বিয়ের আগেই ঘটা করে শশুর ঘরে ক’জন যেতে পারে হু হু? আহা! আকাশে বাতাসে আজ শুধু খুশির ঢেউ।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।