ঘড়ির কাটা সকাল সাতটা পনেরো ছুঁয়েছে৷ এরই মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া এসে পৌঁছাল সৌধরা। সৌধ ড্রাইভ করার ফাঁকে ফ্রন্ট মিররে দেখে নিল, বান্ধবী প্রাচী ঘুমাচ্ছে। পাশে বসে বই পড়ছে চৌকশ স্টুডেন্ট আইয়াজ। সৌধর মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। আইয়াজের উদ্দেশ্যে বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ এই শালা মনে হয় টয়লেটে বসে বসেও পড়ে! ‘
একরাশ বিরক্তি এসে ভর করল ওর চোখে মুখে৷ পাশের সিটে বসে থাকা বন্ধু আজিজ হেডফোন কানে গুঁজে গান শুনছে। তার দিকে তাকিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলল,
‘ আজিজ, প্রাচীকে ডাক দে। ফুলবাড়ীয়ায় ঢুকেছি আমরা। ‘
গাড়ির স্পিড কমে এসেছে। আজিজ সৌধর কথা অল্প শুনে হেডফোন গলায় নামাল। জিজ্ঞেস করল,
‘ কী বললি? ‘
‘ ফুলবাড়ীয়া ঢুকেছি। নিধির বাড়ি কোথায় আমি জানি না। জানলেও তো লাভ নেই৷ সে তো আর তার বাড়িতে আমাদের পা মারাতে দেবে না। তার বাড়ি স্বর্গ কিনা? আর আমরা তো নরকের কীট! ‘
সৌধের কণ্ঠে যেন ক্ষোভ উপচে পড়ল। আজিজ বোকা ভাবে হেসে দিয়ে বলল,
‘ অযথা রাগছিস। ওর পরিবার অন্যরকম। জানিসই তো। তোর, আমার পরিবারে যেটা স্বাভাবিক ওর পরিবারে সেটা প্রচণ্ড অস্বাভাবিক। আমার দেখা সকল মধ্যবিত্ত পরিবারই এমনরে। ‘
‘ ধূরর বাদ দে। নিধিই বেশি ভয় পায়। যাকগে এখন প্রাচীকে ডাক। ‘
আজিজ আইয়াজকে বলল,
‘ কীরে ডাক্তার নানা, এবার তো বইটা বন্ধ কর। আমরা পৌঁছে গেছি। ‘
নাকের ডগায় আসা মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা উপরে তুলল আইয়াজ। এরপর গোল গোল চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ পৌঁছে গেছি! ‘
বিস্ময় প্রকাশের সঙ্গে পাশে বেঘোরে ঘুমানো প্রাচীকে ডাকতে শুরু করল সে৷ ধনবাড়ি ছাড়ার পর থেকেই ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। আইয়াজের মৃদু স্বরের ডাকে আড়মোড়া ভেঙে ওঠে বসল প্রাচী৷ হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘ এত দ্রুত এসে গেছি! ‘
আজিজ বলল,
‘ দ্রুত কই তুই ঘুমুচ্ছিলি বলে সময়টা কম মনে হচ্ছে।’
সহসা প্রাচী বলে ওঠল,
‘ কাছাকাছিই এসে গেছি। আরেকটু সামনেই নিধির বাড়ি। ‘
সৌধ আচমকা ব্রেক কষলো। প্রাচী তার এলেমেলো চুলগুলো হাত খোপা করে নিয়ে পুনরায় বলল,
‘ এখানে থামলি কেন? এখানে না, আরেকটু সামনে গিয়ে থামা। সামনেই দেখবি ছোটো একটা বাজার, কয়েকটা চা স্টলও আছে। ওখানেই বসবি তোরা। ‘
সৌধ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে। আইয়াজ বই বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকাল। আজিজ বলল,
‘ তুই একা চিনবি? ‘
‘ কেন চিনব না কেন? এর আগে দুবার এসেছি না? ‘
সৌধ গাড়ি স্টার্ট করে প্রাচীকে বলল,
‘ রেডি হয়েছে কিনা শোন। ‘
মাথা দুলিয়ে হাই তুলতে তুলতে নিধিকে কল করল প্রাচী৷ বেশ রাত করে ঘুমিয়েছিল সে। কে জানত রাত সাড়ে তিনটায় সৌধ ফোন করে সুহাসের বিয়ের দাওয়াত দেবে! সুহাসটার সঙ্গে কীভাবে কী ঘটে গেল। এই নিয়ে বিস্ময়, আতঙ্ক জেগেছে সকলের মনে৷ সেই বিস্ময়, আতঙ্ক মেটাতেই এভাবে ছুটছে ওরা৷ আজিজ হোস্টেলেই ছিল। আইয়াজের বাড়ি ঢাকার মোহাম্মদ পুরে। সেখান থেকেই ছুটে এসেছে সে৷ সৌধ, সুহাস টাঙ্গাইল শহরে স্থানীয়। জন্মদিনে বড়ো ভাইয়ের গিফট করা প্রিয় গাড়িটা নিয়ে ভোর রাতেই বেরিয়ে পরেছে সৌধ। প্রথমে বাসস্ট্যান্ড থেকে আইয়াজ, আজিজকে তুলেছে। এরপর ধনবাড়ি গিয়ে তুলেছে প্রাচীকে। তার বাবা, মায়ের অনুমতি ফোন কলেই নিয়েছে সৌধ। প্রাচীর বাবা প্রবাসী। পরমব্রত পালকে কল করেছিল সে। সৌধকে বেশ ভালো করেই চেনেন পরমব্রত পাল। দু’টো উপজেলার বর্তমান এমপি সুজা চৌধুরীকে কে না চেনে? সুজা চৌধুরীর ছোটো ছেলে সৌধ। এ খবর কে না জানে? এছাড়া সৌধর বন্ধু মহল সম্পর্কেও সকলে অবগত। সুহাস, সৌধের দাপটেই প্রাচী, নিধি সহ তাদের বাকি সব বন্ধুরা শহরে এবং কলেজ ক্যাম্পাসে নিশ্চিতভাবে চলাফেরা করতে পারে। সবদিক বিবেচনায় পরমব্রত পাল অমত করেননি। মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বন্ধুদের সঙ্গে। আলাদা ধর্মানুসারী প্রাচী খুবই মিশুক প্রকৃতির একটি মেয়ে। দু’বছরের বন্ধুত্বে কোনোদিন এক মুহুর্তের জন্যও কারো মনে হয়নি সে আলাদা ধর্মের। বরং অন্যদের তুলনায় তাকেই সবচেয়ে আপন মনে হয়েছে। যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি মুহুর্তেই সহজ হয়ে যায় এই মেয়েটার জন্য। বন্ধুদের মাঝে ভয়াবহ ঝামেলা লেগে গেলে এই মেয়েটা ঠাণ্ডা মাথায় ঝামেলা মেটায়। সকলের পাশে রয় বিনা সংকোচে। ইদের সময় প্রতিটি বন্ধু, বান্ধবীকে উপহার দেয় সে। এছাড়া প্রতি ইদে প্রিয় বন্ধু সুহাস, সৌধদের বাড়িতে বেড়াতেও আসে। ওদের সকলের সুখ, দুঃখের বান্ধবী প্রাচী। যার জীবনে কোনো সমস্যা নেই আছে শুধুই সমাধান। এই যেমন, গত এক বছর যাবৎ সৌধ গোপনে গোপনে নিধির প্রতি তীব্র প্রণয়ে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এই প্রণয় একতরফা। তার সে গোপন অনুভূতি সুহাসের পর জানে শুধুই প্রাচী।
ছুটি পড়ে যাওয়ায় নিধিকে গুটি কয়েকদিন দেখতে পায়নি সৌধ। ফলশ্রুতিতে তার বুকের ভেতর অস্থিরতারা থইথই করছে৷ সেই অস্থিরতা কমাতেই আজ এভাবে ছুটে আসা। সুহাসের বিয়ের খবর শুনে নিধি নিশ্চয়ই চুপ থাকবে না৷ ছুটি কাটানোর কথা ভুলে গিয়ে অবশ্যই তাদের সঙ্গে সুহাসের বউ দেখতে আগ্রহী হয়ে পড়বে। আর সেই আগ্রহের সুযোগটাই সৌধ নিয়ে নিল। সে একা নিধিকে আনতে গেলে নিধি আসত না৷ তার পরিবার বেশ কঠিন কিনা। তাই বুদ্ধি করে ঘনিষ্ঠদের মধ্যে আইয়াজ, আজিজকে ধরে এনেছে। এতেও মেয়েটা জটিলতা বাড়াল। বলল,
‘ দেখ সৌধ, আমার বাবা খুব শক্ত ধাঁচের মানুষ। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের মেলামেশা একদম পছন্দ করেন না৷ তবুও আমার ছেলে বন্ধু আছে জানেন। কিন্তু সেই বন্ধু বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসা সে সহজভাবে দেখবেন না৷ জানিস তো, আমি কত যুদ্ধ করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি। এখনো বার বার পরিবার থেকে বাঁধা পাই৷ বিয়ে নিয়েও অশান্তি চলে৷ এর ওপর তুই বা তোরা যদি বাড়ি আসিস। যতই সুহাসের বিয়ের দাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসিস না কেন৷ এটা নিয়ে দশকথা হবে। আমার চাচারাও খুব কঠিন মানুষ। বাবাকে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলে আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দেবে। এমনও হতে পারে একটা পাত্র ধরে বিয়েও দিয়ে দেবে। ‘
নিধির এত এত সমস্যা নিয়ে বিরক্তিতে গা গুলাচ্ছিল সৌধর৷ কিন্তু যখন শেষ কথাটা বলল, বুকের মধ্যস্থে আঘাত পেল খুব। আর কিছু বলতে পারল না সে৷ তারপর অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, একটু কষ্ট হলে হোক প্রাচীকে নিয়ে যাবে তারা। নিধির বাড়িতেও শুধু প্রাচী যাবে। ওর পরিবারকে ম্যানেজ করে বাড়ি থেকে বের করে আনবে। এরপর বাকিটা খুব সহজেই সামলে নেয়া যাবে।
তিন বন্ধুর পঁচিশ মিনিট অপেক্ষার অবসান ঘটল। প্রাচী আর নিধিকে দেখেই আইয়াজ গিয়ে গাড়িতে বসল৷ আজিজ তখন থেকে সৌধকে খোঁচাচ্ছিল,
‘ দোস্ত একটা খাই? দোস্ত একটা ব্যস একটাই। ‘
সৌধ জানে আড়ালে আজিজ সিগারেট খায়। শুধু তাদের সামনেই সাধু সাজার চেষ্টা করে অনুমতি চায়। সৌধ এসব একদম পছন্দ করে না। করার কোথাও নয়। আগামী প্রজন্মদের নাগরিকদের সুস্থতা তো তাদেরই নিশ্চিত করতে হবে৷ ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষরা অসুস্থ হয়ে তাদের সাহায্য নিতে আসবে। দেখা গেল তাদের দ্বারাই অসুস্থ ব্যক্তিদের জ্ঞান প্রদান করা হবে। ‘ ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) এমফাইসিমা ও ক্রনিক ব্রংকাইটিস সহ, ক্যান্সার বিশেষত ফুসফুসের ক্যান্সার, প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সার, ল্যারিংস ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার এর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়। ‘ এরকম এক গাদা জ্ঞান দিয়ে রোগির জন্য ধূমপান হারাম করে দেয়া হবে। সেখানে তারাই যদি এসব করে রোগিরা তাদের জ্ঞান গ্রহণ করবে? যদিও রোগিরা জানবে না তারা সিগারেট খায় কিনা। তবুও বিবেক বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে৷ যা থেকে নিজেরা নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারবে না তা থেকে অন্যকে নিয়ন্ত্রণ থাকার পরামর্শ দেয়া তো অন্যায় হবে। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল সৌধ। প্রাচী আর নিধিকে আসতে দেখে চোখ কটমট করে আজিজের দিকে তাকাল। বলল,
‘ অনুমতি চাস ক্যান ব্যাটা। কন্ট্রোল না করতে পারলে দূরে গিয়ে চুষে আয় যাহ। মরে গেলেও অনুমতি পাবি না। ‘
কথাটা বলেই গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল সে। আজিজ নিরীহ লোকের মতো ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে গাড়িতে ওঠে বসল। মনে মনে ভাবল, কন্ট্রোল করতে পারবে না কেন? অবশ্যই পারবে। সে তো আর নেশাখোর নয়। শখের বশে মাঝেমধ্যে খায় এই আর কি৷ ভেবেই সৌধের গম্ভীর মুখটায় তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘ তোর মেজাজ একটু বেশিই খিঁচে আছে আজ। ‘
সৌধ নির্বিকার ভঙ্গিতে এক পলক তাকাল। আজিজ জানালা দিয়ে মাথা বের করে নিধি, প্রাচীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘ বইনেরা একটু স্পিডে হাঁটেন। ‘
নিধি চড়া গলায় বলল,
‘ ভাইয়েরা ধৈর্য বাড়িয়ে অভ্যাস করুন৷ সারাজীবন বউদের জন্য তো এভাবেই অপেক্ষা করতে হবে। শপিংয়ে বেরোলে, শশুর বাড়ি গেলে বা অন্য কোথায় বেড়াতে গেলে। ‘
আজিজ মৃদু হেসে মাথা ভেতরে ঢুকাল। ততক্ষণে নিধি, প্রাচী এসে পড়েছে। নিধি এসেই গাড়ির জানালা দিয়ে হাত ঢুকাল। আইয়াজের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
‘ কীরে ভাই, তোর সিলেবাস শেষ? ‘
আইয়াজ ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,
‘ নারে আরেকটু বাকি৷ তোর কী অবস্থা? ‘
‘ আমারো সেমরে দোস্ত। ‘
আজিজ ফিসফিস করে সৌধকে বলল,
‘ হয়ে গেল। এই দুইটা একসাথে হলেই হইছে। জ্বালাই ফালায় একদম। খালি পড়া পড়া আর পড়া৷ এদের জীবনে আর কিছু নাই। ‘
সৌধর গম্ভীর মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে গেল। তাদের বন্ধু মহলে সবচেয়ে পড়ুয়া স্টুডেন্ট আইয়াজ আর নিধি৷ দু’টোর সম্পর্কও বন্ধুর চেয়ে ভাইবোন বেশি। ওদের একে অপরের প্রতি আলাদা দরদ আছে। নিধি আইয়াজকে নিজের ভাইয়ের মতোই ভালোবাসে। আইয়াজও বোনের চেয়ে কম দেখে না নিধিকে। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল সৌধ। আপাতত তার মেজাজ ভালো নেই। সেটা নিধিকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য খেঁকিয়ে বলে ওঠল,
‘ এখানে আমরা পড়াশোনা নিয়ে ডিসকাস করতে আসছি? ‘
প্রাচী ত্বরিত গাড়ির ভেতরে ঢুকল। নিধি হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে এগিয়ে গেল সামনে। ড্রাইভিং সিটে বসা সৌধের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পাপড়ি ঝাপটাল কতক্ষণ। এরপর মাথা একটু নিচু করে বলল,
‘ কীইরে ভাইই, ষাঁড়ের মতো খেঁকাচ্ছিস কেন? ও মা মুখটা এত গম্ভীর কেন? কী রাগি লুক নিয়ে বসে আছিসরে সৌধ! ‘
সৌধ ভেবেছিল নিধির দিকে আপাতত তাকাবে না। আর না বলবে কথা৷ কিন্তু নিধির বলা টানা সুরে কীইরে ভাইই শুনে কানটাই গরম হয়ে গেল। শক্ত চোখে তাকাল শক্ত কিছু কথা বলতে। নিধি ওর ফর্সা মুখের অল্প দাঁড়ির শক্ত চোয়াল দেখে নিমিষে দমে গেল। ঈষৎ হেসে বলল,
‘ সরি সরি, তোর বোধহয় মেজাজ ঠিক নেই। বসছি আমি। পরে কথা বলব। ‘
সৌধর আর শক্ত কথা বলা হলো না। ফর্সা দেহের হার্ট আকৃতির মুখ, বাদামী বর্ণের এক জোড়া চোখ, মাঝারি আকৃতি বিশিষ্ট সুন্দর নাক আর হালকা গোলাপি রাঙা ফোলা ঠোঁটজোড়া দেখেই তার সমস্ত রাগ পানি হয়ে মাটির সাথে মিশে গেল। বুকজুড়ে বয়ে গেল প্রশান্তিদায়ক হাওয়া। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। নিধি ধীরস্থির ভাবে গাড়িতে ওঠতে উদ্যত হয়েছে। আচমকা তার গাড়িটির দিকে খেয়াল হলো। বিস্ময় ভরে পুনরায় চলে এলো সৌধর কাছাকাছি। বলল,
‘ কীইরে সৌধ, নতুন গাড়ি নাকি? ‘
মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়াতে মৃদু হাসল সৌধ। পলকহীন তাকিয়ে বলল,
‘ বড়ো ভাইয়ের গিফট। বলেছিলাম তোকে। ‘
হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে নিধি বলল,
‘ ওওও ঐটা। বাহ কি সুন্দর রে। টয়োটা প্রিমিও? ‘
গাড়ির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল নিধি। সৌধ বলল,
‘ হ্যাঁ। গাড়িতে ওঠ দেরি হয়ে যাচ্ছে। ‘
নিধির সবচেয়ে ভালো লাগছিল গাড়ির রঙটা৷ নেভি ব্লু কালার টয়োটা প্রিমিও গাড়ি! আহা সৌধর আর সৌধর পরিবারের কাছে গাড়ি যেন দুধভাতের মতোই। ভাবতে ভাবতে ওঠে বসল সে। বলল,
‘ ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি স্টার্ট করতে পারেন। ‘
নিধির এহেন কথায় সকলে হো হো করে হেসে ওঠল। ফ্রন্ট মিররে নিধির হাসিটুকুও সন্তর্পণে দেখে নিল সৌধ। এরপর আপন মনে ড্রাইভ করতে লাগল সে। গাড়িতে পুরোদমে হইচই লেগে গেছে। যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে বন্ধুরা৷ সুহাসকে অবশ্য মিস করছিল ওরা। তখন প্রাচী বলল,
‘ আরে আমরা তো ওর কাছেই যাচ্ছি। বাছাধন যে সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হয়ে গেল রে। ‘
নিধি এ কথায় সৌধর দিকে বাঁকা চোখে তাকাল। বলল,
‘ শুনলাম আমাদের ড্রাইভার সাহেব নাকি সুহাসের প্রক্সি দিতে চেয়েছিল! ‘
হকচকিয়ে গেল সৌধ। চোখ কটমট করে তাকাল আইয়াজের দিকে। আইয়াজ চোরা চোখে এক পলক সৌধকে দেখে নিয়ে বইয়ের পাতায় মন দিল। সৌধ দাপুটে স্বরে বলল,
‘ তোকে ঐ গ্রুপে রাখিনি। ওটা আমাদের ব্যক্তিগত গ্রুপ। ওখানের কথা কোন লজ্জায় শুনিস তুই? ‘
ক্ষেপে গেল নিধি৷ বলল,
‘ ঐ ঐ আমি মোটেই শুনতে যাইনি। আইয়াজ যেচেই বলেছে। ভাগ্যিস বলেছে নয়তো জানতেই পারতাম না। তোর বিয়ের প্রতি এত ঝোঁক। স্মৃতি আপুকে বলতে হবে বিষয়টা। ‘
স্মৃতি সৌধের বড়ো বোন। যার সঙ্গে নিধির সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ। প্রায়ই ম্যাসেন্জারে কথা হয় দু’জনের। এ পর্যন্ত দু’বার দেখা হয়েছে। সৌধই নিয়ে এসেছিল ক্যাম্পাসে। বন্ধুরা শুনেছিল বাংলাদেশের স্মৃতিসৌধ স্মরণে রেখেই সুজা আংকেল দ্বিতীয় সন্তানের নাম স্মৃতি আর ছোটো সন্তানের নাম সৌধ রেখেছেন৷ যাইহোক, স্মৃতি আপুর কাছে নালিশ জানাবে নিধি৷ শুনতেই প্রাচী ঠোঁট টিপে হাসল। এদিকে সৌধের গরম গরম চোখ দেখে নিধি বলল,
‘ আরে ড্রাইভার সাহেব ড্রাইভিংয়ে মন দিন। পেছনের সুন্দরীদের দিকে নজর পরে দিয়েন। ‘
সৌধ ফ্রন্ট মিররে তাকিয়ে নিধিকে উত্তর দিল,
‘ গাড়ির মালিককে মালিক বলতে শেখ। ড্রাইভার কীরে? বেয়াদব মেয়ে। ‘
নিধি ভেঙচিয়ে বলল,
‘ তোর দশ বিশটা গাড়ি হয়ে গেলেও তুই আমার কাছে মালিক হতে পারবি না। ড্রাইভারই থেকে যাবি।’
বাঁকা হাসল সৌধ। বিড়বিড় করে বলল,
‘ ব্যক্তিগত ড্রাইভার বানালে অসুবিধা নেই। ‘
পেছন থেকে চ্যাঁচিয়ে ওঠল নিধি,
‘ এ ভাইই, গালি দিলি নাকি? ‘
সৌধর মেজাজ আবারো খারাপ হলো। এই মেয়ে ওঠতে বসতে ভাই ভাই চিল্লায় কেন? আল্লাহ মালুম!
.
.
আলিয়া খাতুন নামীকে শাড়ি পরতে বললেন৷ অন্য কেউ বললে নামী শাড়ি পরত৷ সৎ মাকে সে একদমই পছন্দ করে না। তাকে দেখলেই মনে হয় এই মহিলাটি তার মায়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে। তাই শাড়ি পরতে বলায় জেদ করেই পড়ল না। সেলোয়ার-কামিজ পরেই ঘুরাফেরা করতে লাগল৷ একটু পরেই চাচি এসে খবর দিল, সুহাসের কিছু বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত করা হয়েছে। তারা এখন রাস্তায়। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে।
সুহাস ঘুম থেকে ওঠল সকাল দশটায়। দাদি এসে নামীকে বলল তার জন্য কফি বানাতে। আর নিজে গিয়েই দিয়ে আসতে৷ এ কথা শুনে নামীর শ্যামলাটে মুখটা আরক্ত হয়ে ওঠল৷ শ্বাস-প্রশ্বাস পরিণত হলো ঘন থেকেও ঘনত্বে৷ মনে পড়ে গেল গতরাতের সেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থাটুকুর কথা। ছেলেটা কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছিল। উহুম অস্বাভাবিক নয়। প্রতিটি স্বামীরই বোধহয় প্রথমবার স্ত্রীকে কাছে পেলে এমন অবস্থা হয়৷ ভাগ্যিস আচমকা সুহাসের ফোনটা বেজে ওঠেছিল। যতই তিন কবুল পড়ে বিয়ে হোক৷ এত অল্প সময়ে অমন কাছাকাছি আসাটা তার জন্য স্বস্তি দায়ক নয়। সুহাস ছেলে মানুষ। শহুরে ছেলে৷ অনেক বেশি স্মার্ট। সে হয়তো অল্পতে অনেকটাই মিশে যেতে পারে৷ কিন্তু তার তো সময় লাগবে৷ হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল নামী৷ কফি বানাতে বানাতে বার বার মনে পড়ল রাতের দুর্ধর্ষ মুহুর্তটুকুই।
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে সুহাস৷ সৌধরা কোন পর্যন্ত জানতে ফোন করেছিল মাত্রই। ওদের খবর নিয়ে এবার হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল। অরিনের অহরহ ম্যাসেজ এসেছে। মেজাজ খিঁচে গেল মুহুর্তেই।
গতরাতে নামী এসেছিল তার কাছে৷ দু’জন মিলে একান্তে কাটিয়েছে কিছু সময়৷ গল্প করেছে পড়াশোনা নিয়ে। এরপর রোমান্টিক মুহুর্ত তৈরি করেছিল৷ স্বামী হিসেবে মেয়েটার থেকে অনুমতিও নিয়েছিল। বলেছিল,
‘ নামী, আমরা একে অপরের পূর্ব পরিচিত নই। পরিচয় হবার আগেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। এবার আমাদের জানাশোনা ধীরেধীরে হবে। তোমার প্রতি আমার তেমন আগ্রহ নেই। আমি সিওর, আমার প্রতিও তুমি খুব একটা আগ্রহী নও। এর ওপর তখনকার ঘটনায় কিছুটা নেগেটিভ ভাবনাও এসেছে। এসব তো দূর করা প্রয়োজন। তাছাড়া বিয়ের প্রথম রাতে বউকে কিছু না কিছু দিতে হয়। আমি সঙ্গে তেমন কিছুই আনিনি৷ আপাতত প্রথম ভালোবাসার কিছু স্পর্শ ছাড়া কিছুই দিতে পারব না। আমি তোমাকে হলফ করে বলতে পারি, আমি তোমাকে যা দিতে চাই৷ তুমি যদি স্বামী হিসেবে মান্য করে তা গ্রহণ করো। এ জীবনে তোমার পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার হবে এটা। ‘
নামী বুঝেছিল তার কথার মানে। তাই বলেছিল,
‘ এতে তো ভালোবাসা থাকবে না। ‘
সে বলেছিল,
‘ অনুভূতি থাকবে। ভালোবাসার সূচনাটা এখান থেকেই হবে। সাইন্সের স্টুডেন্ট তো? মনের স্পর্শ যেমন দেহ পর্যন্ত নিয়ে যায়, দেহের স্পর্শও মন অবধি পৌঁছায় জানো? ‘
নামী উত্তর করেনি। লজ্জায় মস্তক নত করেছে শুধু।
এরপর সব ঠিকঠাকই ছিল। অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছিল দু’জন! একে-অপরের নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছিল মুখে। নামীর শ্যামলা মুখটাও তীব্র লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠেছিল। শ্যামলাটে গোলাকৃতি মুখটার লাল আভা সুহাসকে আচমকাই মাতাল করে তুলেছিল৷ সে নামীর চোখা নাকটায় নিজের নাক ছোঁয়াতেই তীব্র আড়ষ্টতা নিয়ে ঘন পাপড়ি বিশিষ্ট চোখজোড়া বন্ধ করে নেয় নামী। তিরতির করে কাঁপতে থাকে ওর পাতলা মসৃণ ওষ্ঠজোড়া দেখে সুহাসের ভীষণ মায়া হয়৷ ফিসফিসানো কণ্ঠে শুধায়,
‘ সত্যিই তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল না? ‘
নামী আড়ষ্টতা নিয়ে মাথা দুদিকে নাড়ায়৷ আচম্বিতে বুকজুড়ে সুখের ঢেউ খেলে সুহাসের। দু’হাতে নামীর নরম কপোলদ্বয় আবদ্ধ করে নেয়। নিজের গোলাপি রঙা পুরু ঠোঁটজোড়া এগোয় অধর চুম্বনের জন্য৷ ঠোঁটের খুব কাছে সুহাসের উষ্ণ নিঃশ্বাস পেতেই নামীর কাঁপাকাঁপি বেড়ে যায়। দু-হাতে বিছানায় চাদর খামচে ধরে সে৷ সুহাস টের পায়৷ অবিশ্বাস্য সুরে প্রশ্ন করে,
‘ সিরিয়াসলি আমিই প্রথম এভাবে স্পর্শ করছি তোমায়? ‘
নামী মাথা দুলায়৷ সুহাস খেয়াল করে নামীর বদ্ধ চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। যা দেখে হতবাক হয়ে পড়ে সে। নামীর স্বচ্ছতা, পবিত্রতা মুগ্ধ করে দেয় ওকে। তীব্র সম্মানবোধ জাগ্রত হয়। গর্বে বুক ভরে ওঠে। মুখটা কিঞ্চিৎ উঁচুতে নিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় ছোট্ট ললাটে। সহসা চোখ খুলে নামী। অদ্ভুত ভালোলাগায় সুহাসের মুখাবয়ে চেয়ে রয়। সে চাউনি দেখে সুহাস নরম স্বরে বলে,
‘ অভিজ্ঞতা নেই তো, লিপ কিস করব? ‘
নামী চোখ নামিয়ে নেয়। নিঃশ্বাস ফেলে ভারিক্কি। সুহাস মৃদু হাসে। ভাবে দু’জোড়া ঠোঁট খুব কয়েক সেকেণ্ডের জন্য একবারি এক করবে। প্রথম স্পর্শে শিহরণ জাগাবে নামীর দেহ, মনে। এরপর দু’চোখ ভরে বউটির লজ্জা দেখবে। সাক্ষী হবে উত্তাল নিঃশ্বাসের। সুহাসের মনে হলো এটিই যেন স্বর্গীয় সুখ। যে সুখের খোঁজ এতদিন পায়নি সে। আজ পেয়ে উপলব্ধি করছে এতদিন সে নরককেই স্বর্গ ভেবে বসেছিল। সবকিছু তুচ্ছ করে এক নামীতে মত্ত হতে চাইল সে। চোখ খিঁচে শক্ত হাতে নামী যখন তার শার্ট খামচে ধরল। সে যখন দুইজোড়া ঠোঁটের একত্রিত করণে উন্মত্ত হতে উদ্যত হলো। সারা ঘর জুড়ে হলো দুইজোড়া হৃদয়ের উত্তাল নিঃশ্বাসের ছড়াছড়ি। ঠিক সে মুহুর্তেই বিকট শব্দে বেজে ওঠল সুহাসের ফোন। স্ক্রিনে অরিন নামটা দেখেই আঁতকে ওঠল সে। আচমকা চোখ খুলে শুষ্ক মুখে তাকানো নামীকে দেখে ঢোক গিলল৷ ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘ আমার বন্ধু কল করেছে। কথা বলে আসি? ‘
নামী মাথা কাৎ করতেই সে বাইরে চলে যায়। কথা শেষে এসে দেখে নামী নেই। রাত তখন বারোটা ছুঁয়েছে বলে সেও অবসন্ন মনে শুয়ে পড়ে। সবটা পরিষ্কার মনে পড়তে থাকে সুহাসের আর বাড়তে থাকে রাগ। এক পর্যায়ে রাগটা এতই বেড়ে যায় যে, অরিনের কোনো ম্যাসেজেরই উত্তর না দিয়ে সোজা ব্লক করে দেয়। এরপর নিঃশ্বাস ছাড়ে স্বস্তি ভরে।
সহসা দরজায় টোকা পড়লে ভাবুক সুহাস চমকে ওঠে।
‘ আসব? ‘
আচমকা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সুহাস। নামীকে দেখে চওড়া হাসি টানল ঠোঁটে। ত্বরিত কণ্ঠে বলল,
‘ ইয়েস কাম।‘
Leave a comment