ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৪৪

22 Min Read

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
|৪৪|
গভীর রাত। ধরণিতল বৃষ্টিতে ভিজে চুপ চুপ। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সুহাস ঘুমোচ্ছে বেঘোরে। তার এক হাত নামীর কাঁধ আঁকড়ে, এক পা কোমরে তোলা। বউকে ঠিক কোলবালিশের ন্যায় আঁকড়ে ঘুমোচ্ছে সে৷ ক্ষণে ক্ষণে মুখের ভারিক্কি, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে নামীর ঘাড়ে এবং কানে। সুহাস গভীর ঘুমে থাকলেও নামীর ঘুম গভীরতায় পৌঁছায়নি। তাই তো রাত বাড়ার সাথে সাথে সুহাসের দেহের প্রগাঢ় উষ্ণতা অনুভব করতে পারল সে৷ এক পর্যায়ে শঙ্কিত চিত্তে দৃষ্টি মেলে তাকাল। বলিষ্ঠ দেহে জড়ানো তার দেহখানি রয়েসয়ে সরিয়ে ওঠে বসল। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল সুহাসের কপাল। নিমেষে চোখ দু’টি বড়ো বড়ো হয়ে গেল৷ ভীত স্বরে বলল,
‘ হায় আল্লাহ, এত্ত জ্বর! ‘
বারকয়েক ঢোক গিলল সে। ত্বরিত সুহাসের ডান গালে হাত রেখে ডাকল,
‘ এই সুহাস, তোমার তো খুব জ্বর। এই সুহাস শুনছ?’
কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে নিল নামী। দু’টো বেজে একান্ন মিনিট৷ বুক ধুকপুক করে ওঠল৷ এগারোটায় পরীক্ষা৷ এদিকে সুহাসের ভয়াবহ জ্বর। আর বসে থাকতে পারল না৷ ছুটে গিয়ে মেডিসিন বক্স আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। সুহাসের ঘুম ছুটোতে পরিশ্রম হলো খুব। জ্বরে কাতর সুহাস বেঘোরেই মেজাজ দেখাল কিঞ্চিৎ। কত্ত বড়ো সাহস নামীদামির। তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়! মেজাজ টুকুতে
রাগ করল না নামী। সব সময় স্বামীর মেজাজকে তোয়াক্কা করতে নেই। মন খারাপ হতে নেই। কিছু পুরুষ মানুষ থাকেই আজন্মের বেআক্কল। এরা নিজের ভালো বুঝে না। বউ ভালো করতে এলেও দেমাক দেখায়। আবার ভালো করতে না এলে তকমা দিয়ে দেয় অযত্নশীল বউ। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা নেই ইত্যাদি, টিত্যাদি। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল নামী৷ বুঝিয়ে, অনুরোধ করে জোর পূর্বক জ্বর সেরে ওঠার প্রাথমিক ট্যাবলেট গুলো খাইয়ে দিল। এরপর নরম কাপড় ভিজিয়ে জলপট্টি দিল তিনটা পর্যন্ত। সুহাস ঘুমে কাঁদা। বেচারির আর ঘুম হবে না। তাই ওঠে গিয়ে টেবিল থেকে বই নিয়ে এলো৷ জলপট্টি দেয়ার পাশাপাশি পড়ে নিলো কিছু ইম্পর্ট্যান্ট টপিক।
সুহাসের জ্বর কমল চারটার দিক। এতক্ষণ পাঁচ মিনিট পর পরই কপালে, গলায় হাত দিয়ে অপেক্ষা করছিল কখন জ্বর কমবে? যদি না কমে আজকের পরীক্ষাটা তার মাটি। যতই হোক মানুষটাকে তো ভালোবাসে। এভাবে জ্বরে রেখে পরীক্ষার হলে মন টিকবে? একটুও টিকবে না৷ তাই জ্বর কমাতে খুশি হলো। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ফারাহকে টেক্সট করল একটি,
‘ সুহাসের খুব জ্বর ওঠেছিল। ঘুমাতে পারিনি ঠিকভাবে৷ এখন ঘুমাব। ন’টার আগে ওঠা সম্ভব না।
আমাদের রান্না তরকারিতে ঝাল বেশি৷ সুহাস ঝাল খেতে পারে না একদম। ওর জন্য ঝাল কম দিয়ে মাছ ভাজা করিস শুধু, এতেই হবে৷ পরীক্ষা আমাদের বুঝবে ও। তুই আবার টেনশন করিস না৷ ইলিশ মাছ প্রিয় ওর ভাজি খেতে পছন্দ করে, ক’টা পেঁয়াজ কুঁচি দিয়ে দিস। ‘
পরীক্ষা বলে নিজেদের রান্না করে রেখেছিল ওরা। সকালে শুধু গরম গরম ভাত করতে হতো। সুহাস আসাতে অল্প কাজ বাড়ল। যা ফারাহকে করতে বলে সুহাসের পাশে শুয়ে পড়ল নামী। চেষ্টা করল ঘুমুতে। আশ্চর্য! ঘুম এলো না৷ এপাশ-ওপাশ করতে করতে ওঠে বসল। হাত বাড়িয়ে সুহাসের গা স্পর্শ করে আবার দেখল জ্বর আছে কিনা। অনুভব করল জ্বর ছেড়ে ঘাম বেরুচ্ছে শরীর থেকে৷ তাই ত্বরিত টি-শার্ট খুলতে চেষ্টা করল। এতেই ঘুম ছেড়ে গেল সুহাসের। বৈদ্যুতিক তীক্ষ্ণ আলোয় নামীর শ্যামলাটে স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে থমকালো একটু৷ কয়েক পল নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে আচমকা দুষ্টু হাসি ফুটে ওঠল ঠোঁটে। নামী ওর টি-শার্ট উঁচিয়ে ধরেছিল মাত্র। সেই ধরে রাখা হাতটা চেপে ধরে হেঁচকা টান মারল। সহসা মুখ থুবড়ে পড়ল বুকে। সুহাস সাপের মতো প্যাঁচিয়ে ধরল বুকের মাঝে। ভীষণ গভীর করে। এরপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ আমাকে অচেতনে পেয়ে এতবেশি ডেস্পারেট হয়ে গেলে? সচেতনে কেন হও না ডার্লিং? পারবে না বলে? ‘
নিমেষে মুখ হা হয়ে গেল নামীর। রেগেমেগে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘ এইতো গর্তের ইদুর গর্ত থেকে মাথা তুলেছে। সারারাত যে জ্বরে কাতরাচ্ছিলে সেই খেয়াল আছে? ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে যে সেবা করলাম জানো? জ্বর ছেড়ে ঘেমে একাকার দেখে জাস্ট টি-শার্ট খুলার ট্রাই করছিলাম। অমনি শুরু হয়ে গেল অসভ্যতামি? ‘
কথার বলার ফাঁকে সুহাসের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করল নামী৷ কিন্তু সুহাস তাকে মুক্তি দিল না। তার রাগান্বিত চোখ, মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে তুলল। কতদিন, কতদিন পর এই পাগল আর পাগলামো আক্রমণ করল নামীকে? হিসেব করতেই বুকটা হুহু করে ওঠল। সহসা সেও জড়িয়ে ধরল সুহাসকে। বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল বাচ্চাদের মতো। বলল,
‘ খুব মিস করেছি সুহাস, খুব। ‘
আলতো হেসে মাথায় হাত বুলালো সুহাস। মুখ তুলে কপালে চুমু এঁটে মৃদুস্বরে বলল,
‘ বাতি নিভিয়ে এসো। ‘
গলার স্বরে পরিচিত আহ্বান। নামী লজ্জা পেল। বিস্ময়ে বলল,
‘ না, একদম না। পরীক্ষা আছে আমার, ওঠতে হবে।’
আড়চোখে ঘড়িতে সময় দেখে নিল সুহাস। জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই নামীর কোমরের পাশে দৃঢ়ভাবে চেপে ধরল। ভারিক্কি, উষ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘ ছ’ঘনটা সময়ের মধ্যে বরকে একঘন্টা দিতে পারবে না? কেমন বউ তুমি? ‘
‘ সব সময় বাড়াবাড়ি তাই না? ‘
‘ মেয়েরা তো বাড়াবাড়ি রোমান্স করা ছেলেদেরই পছন্দ করে। ‘
‘ হ্যাঁ সেই। তুমি তো মেয়েদের নিয়ে পিএইচডি করেছ। ‘
‘ মেয়েদের নিয়ে না করলেও নামীদামিকে নিয়ে করেছি৷ একদম আপাদমস্তক। পা থেকে মাথার চুলের প্রতিটি গোড়া পর্যন্ত। প্রুফ চাই? ‘
শেষে প্রশ্নবোধক দু শব্দের বাক্যটি বলেই নামীর দিকে দুর্বোধ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুহাস। অমনি তার
বুকের বা’পাশে আচমকা কিল বসাল নামী। নিচু গলায় বলল,
‘ অসভ্য, খুব খারাপ তুমি। ‘
সুহাস টোপ করে অসভ্য বলা মুখটায় চুমু খেল। এরপর চট করে ওঠে গিয়ে রুমের বাতি নিভিয়ে ফিরে এলো৷ নামী ঢোক গিলে ত্বরিত স্বরে বলল,
‘ সারারাত জ্বরে কাতরাচ্ছিলে সুহাস। অসুস্থতা কাটেনি পুরোপুরি। ‘
সুহাস হেঁচকা টানে ফের বুকে জড়াল ওকে। কানের লতিতে আলতো কামড় দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ এইতো এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাব আমি। ‘
‘ সুহাস… ‘
তর্জনী দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে সুহাস বলল,
‘ আদর করার সময় বাঁধা দেওয়ার অভ্যেস ছাড়ো৷ জানোই তো বাঁধা দিলে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠি আমি৷ নাকি ইচ্ছে করেই এমন করো। আমার বেপরোয়া ভালোবাসা পাওয়ার নেশায় পড়েছ নাকি?’
চুপসে গেল নামী। লজ্জায় যাচ্ছেতাই হয়ে গেল যেন।
বুকে ধুকপুক শুরু হলো। সুহাস যেন আজ খুব বেশিই বেপরোয়া। দূরত্বই বুঝি পেছনের কারণ? দেহ শিরশির করল। তিরতির করে কেঁপে ওঠল ঠোঁটদ্বয়৷ সুহাস টের পেল৷ আদুরে স্পর্শে কাছে টেনে নিল গভীরভাবে। লজ্জা ভয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নামী। সুহাস হাসল৷ বেগ পেতে হলো বক্ষঃতলে নামীর দেহশ্রী বিছাতে। ধীরেধীরে একচ্ছত্র ভারিক্কি নিঃশ্বাসে দু’টো শরীর এলোমেলো হয়ে গেল। সময়ের প্রবাহে একজন সুখকর স্পর্শে বুঁদ হলো। আর অপরজন সুখদায়ক অশ্রুতে।
.
.
পরীক্ষা শেষ করে বেরুতেই সুহাসের মুখোমুখি হলো নামী৷ সুহাস তার হাতটা ধরে রিকশা নিল একটা৷ বলল,
‘ চলো। লেকের পাড়ে বসব কিছুক্ষণ। ‘
নামী মৃদু হেসে ওঠে বসল। সে জানে সুহাস এবার সিমরানকে নিয়ে আলোচনা করবে৷ সকালে খেতে বসে কথা তুলেছিল একবার৷ সে বলেছে পরীক্ষা শেষ করে ফ্রি মুডে সব শুনবে। আট মিনিটের পথে সুহাসের ফোন বাজছিল অনবরত। বারবার কেটে দিচ্ছল সুহাস৷ নামী জিজ্ঞেস করল,
‘ কে ফোন করেছে? ‘
‘ সৌধ। ‘
‘ ধরছ না কেন? ‘
‘ ইচ্ছে করছে না তাই। ‘
ক্রোধের সঙ্গে অভিমান স্পষ্ট। এই ক্রোধ, এই অভিমানের পেছনের কারণ খুঁজে পেল না নামী৷ এত ভালো বন্ধু ওরা৷ ওদের বন্ধুত্ব ভাই, ভাই সম্পর্ককেও হার মানায়। তাহলে এই অভিমান, ক্রোধের উপসর্গ কী?
.
পাশাপাশি লেকের ধারে চুপচাপ বসে আছে দু’জন। নামী আশপাশে তাকিয়ে দেখছে একজোড়া কিশোর, কিশোরীকে। তারা একে অপরের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মুচকি হাসল সে। তাকাল সুহাসের পানে৷ সুহাস তার দিকেই স্থির নেত্রে তাকিয়ে। সে তাকাতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ সিনু সৌধকে ভালোবাসে। ‘
সুহাস অপেক্ষায় ছিল নামীর চোখে বিস্ময় দেখতে। মুখে বিস্ময় ভরা কিছু বুলিও শুনতে চেয়েছিল৷ কিন্তু এমনটা হলো না৷ নামী নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
‘ এরজন্য এত রাগ কেন সুহাস? একটা মেয়ে কি একটা ছেলেকে ভালোবাসতে পারে না? ‘
‘ পারে৷ কিন্তু মেয়েটা আমার বোন হলে পারে না। ছেলেটা সৌধ হলে ভালোবাসা অন্যায়। ‘
তাচ্ছিল্য ভরে হাসল নামী। বলল,
‘ ভালোবাসা কখনো অন্যায় হতে পারে না। সিনুর ভালোবাসায় আমি কোনো দোষ খুঁজে পাইনি। ‘
‘ সবকিছু জেনেও এভাবে বলতে পারছ? ‘
‘ কেন পারব না? ‘
‘ সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। নিধির প্রতি ওর অনুভূতির প্রগাঢ়তা তুমি জানতে। ‘
‘ আমি সিনুর ভালোবাসার প্রগাঢ়তাও জানি। ‘
‘ হোয়াট! ‘
বিস্ফোরিত কণ্ঠ সুহাসের। সহসা ওর হাত চেপে ধরল নামী৷ বলল,
‘ ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শুনো। আমি সবটা আগে থেকেই জানি। বলতে পারিনি কারণ সৌধ ভাই নিধিকে ভালোবাসত। তাছাড়া যখন জানতে পারি তখন তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কে দূরত্ব ছিল। আর যখন থেকে সম্পর্ক ভালো হয়েছে। বলতে চেয়েছি ব্যাপারটা, কোনো না কোনোভাবে বাঁধা পেয়েছি। মানসিক দ্বন্দ্বের কবলে পড়েছি৷ তাই বলা হয়নি। ‘
সুহাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল। দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ সব জেনেও সিনুকে বাঁধা দাওনি কেন? ‘
‘ তোমার বোন নাবালিকা নয় সুহাস। আর না সে আমার বাধ্যগত। ‘
‘ ও তোমাকে মানে। ‘
‘ এক্ষেত্রে ও কাউকে মানে না। ‘
নিভে গেল সুহাস। কিয়ৎক্ষণ থম মেরে থেকে বলল,
‘ আমার কী করা উচিত? ‘
নামী এবার ওর কাঁধ স্পর্শ করল। বলল,
‘ আমরা সবাই মিলে কি পারি না সৌধ ভাই আর সিনুকে এক করতে? ট্রাস্ট মি, এণ্ড ট্রাস্ট হার। ও খুব ভালোবাসে সৌধ ভাইকে৷ আমি ওর ভালোবাসাকে সম্মান করি৷ খুব কাছ থেকে দেখেছি, অনুভব করেছি সিনুর গভীর ভালোবাসাকে। এতদিন পুরোপুরি সমর্থন করতে পারিনি নিধি আপুর জন্য। কিন্তু নিধি আপু যখন সৌধ ভাইকে ভালোই বাসে না৷ নিজের জীবনে অন্য একজনকে বেছে নিয়েছে তখন সৌধ ভাইয়ের পাশে যোগ্য হিসেবে সিনুকেই পাচ্ছি আমি।’
‘ অসম্ভব। ‘
‘ কেন অসম্ভব সুহাস? সিনুর জন্য কি তুমি এমন একজনকেই চাইতে না? ‘
‘ চাইতাম কিন্তু তার হৃদয়ে সিনুর প্রতি গভীর ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে চাইতাম৷ সৌধ দ্বিতীয় কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না নামী। আমি আমার বোনকে খুব ভালোবাসি। আমি ওকে স্বামীর ভালোবাসা বিহীন সংসারী দেখতে চাই না। আমি আমার মাকে যে জায়গায় দেখেছি সে জায়গায় সিনুকে দেখতে চাই না। ‘
‘ দেখবে না। ‘
তীব্র আত্মবিশ্বাসী স্বর নামীর। সুহাস ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
‘ তুমি কী করে নিশ্চিত হচ্ছো?’
কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল নামী। মনে মনে ভাবল বলাটা ঠিক হবে না। সুহাসের মা অন্যের ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিল বলেই সে সংসার জীবনে সুখী হতে পারেনি। কিন্তু সিমরান তা নয়৷ সে কারো ভালোবাসা কেড়ে নিচ্ছে না। বরং নিজের ভালোবাসাকেই মনে, প্রাণে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটির ভগ্ন হৃদয় নিজের ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করতে চাচ্ছে। উদ্দেশ্য সৎ থাকলে জীবনে সুখী হওয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু এসব সুহাসকে বলতে পারল না। মায়ের বিরুদ্ধে সন্তানকে বলে লাভ নেই। বলা উচিতও নয়৷ তাই শুধু বলল,
‘ সিনুর ভালোবাসায় আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে৷ আস্থা আছে সৌধ ভাইয়ের বিচক্ষণতায়ও। তার দ্বারা ভুল একবারি হয়েছে। ভুল মানুষকে বাছাই করে। দ্বিতীয়বার হবে না আশা করি৷ এবার নিজের জীবনে সঠিক মানুষকে চিনে ঠিক বাছাই করে নিবে। ‘
তাচ্ছিল্যতার হাসি হাসল সুহাস। নামীর কথাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ ও এক কথার মানুষ নামী। ও যখন বলেছে সিনুকে বিয়ে করবে না এর মানে করবেই না। গতকাল আন্টি বুঝিয়েছে। লাভ হয়নি। ‘
নামী সুক্ষ্ম চোখে তাকাল। রয়েসয়ে বলল,
‘ আমি যদি ভুল না করি সুহাস তুমি সৌধ ভাইয়ের ওপর কিছুটা রেগে আছো। সৌধ ভাই তোমার বোনকে রিজেক্ট করেছে এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মনকে বুঝ দিচ্ছ এত বছরের পরিচিত সৌধর অনুভূতি গুলোকে সম্মান করে। শতহোক সিনু তোমার বোন। নিঃসন্দেহে সৌধ ভাই তার উপযুক্ত। এভাবে রিজেক্ট হলে খারাপ তো লাগবেই। কিন্তু কী জানো সৌধ ভাই এখন যা বলছে, যা করছে এগুলো একটাও সে তার স্বীয় সত্তা থেকে বলছে, করছে না৷ সে এখন একজন ভঙ্গুর মানুষ। নিজের আবেগ, অনুভূতি ভেঙেচুরে নিঃস্ব প্রায়। এমতাবস্থায় তার কোনো কথা বা সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়া অনুচিত। ‘
নামীর বিচক্ষণতা মুগ্ধ হওয়ার মতোই। কিন্তু ধরা পড়ে গিয়ে রাগান্বিত হলো সুহাস। বলল,
‘ ভুল তুমি। সৌধ নিধিকে ভালোবেসে ছ্যাঁকা খেয়েছে। আমি কোনো ছ্যাঁকা খাওয়া মানুষের কাছে আমার নিষ্পাপ বোনকে দিতে রাজি নই। রাগ আমার সিনুর প্রতি। পৃথিবীতে এত এত ছেলে থাকতে ও কেন সৌধর মতো ব্যাকুবকে বেছে নিল? ‘
মুখে এ কথা বলে মনে মনে ভাবতে লাগল নামীর শেষ কথাগুলো নিয়ে। এদিকে তার কথা শুনে আচমকা হেসে ফেলল নামী৷ সে হাসিতে সুহাসের ক্রোধ গাঢ় হলো। হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে ওঠে নামী বলল,
‘ উহুম বোনের প্রতি রাগ না অভিমান তোমার। ইশ বোন তার ভালোবাসার মানুষকে পাবে না৷ আজ বন্ধুকে যে অবস্থায় দেখছ কাল বোনকে সে অবস্থায় দেখার ভয়ে আছো খুব৷ ‘
এটুকু বলেই সুহাসের কাঁধে মাথা রাখল। বলল,
‘ শোনো সুহাস। বউ আমি তোমার। তোমাকে তোমার থেকেও বেশি আমি চিনি, বুঝি। ‘
এক নির্মল ভালো লাগায় সহসা বুক শীতল হয়ে ওঠল সুহাসের। বলল,
‘ সৌধ সিনুকে জীবনসঙ্গী রূপে চায় না নামী। কী করব এখন আমি? সিনুকে কীভাবে সামলাব। ও যে শেষ হয়ে যাবে৷ কী দরকার ছিল সৌধকে ভালোবাসার? আমরা সবাই মিলে ওর জন্য একজন বেস্ট পার্সন এনে দিতে পারব না বলো? ‘
‘ এত টেনশন করছ কেন তুমি? উপরে যিনি আছেন তার পরিকল্পনার চেয়ে বেস্ট কিছু হতে পারে?’
‘ তুমি সিনুকে বুঝাও৷ তুমিই পারবে ওকে বুঝাতে। সৌধ ওর জন্য ঠিক নয়, একদম ঠিক নয়। ‘
নামী পাত্তা দিল না সে কথায়। মনে মনে বলল,
‘ আগে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় দেখি। তারপর না বোঝানোর পালা। ‘
মুখে বলল,
‘ সৌধ ভাইয়ের বাবা, মা কী বলেন দেখো৷ এরপর তোমার বাবা, মায়ের সিদ্ধান্ত দেখো৷ বড়োদের সিদ্ধান্ত জানার পর আমরা সিনুকে বুঝাব৷ তার আগে নিজেকে শান্ত করো। সিনুর গায়ে হাত তুলেছ না? ভুল করেছ। কারো অনুভূতিকে আঘাত করতে নেই। তুমি কাল ওর গায়ে আঘাত করোনি৷ করেছ অনুভূতিকে। বাবা, মায়ের থেকে ও তোমাকে বেশি ভরসা করে৷ সেই তুমিই যদি এমন করো ও কোথায় যাবে? কার কাছে আশ্রয় নিবে?
.
.
গুটিগুটি পায়ে কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। লক্ষ ভ্রষ্ট সৌধ৷ বন্ধুরা যে যার মতো ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছে। অথচ সে নিরাসক্ত, লক্ষ হীন জীবন কাটাচ্ছে। মাত্র দুই কি তিন মাসের ব্যবধান। অর্পণ স্যার বাবা হবে। একেবারে সফল পুরুষ। নিধি মা হবে। ক্যারিয়ার গুছানো। স্বামী, সন্তান নিয়ে এবার সুখের সংসার৷ সুহাস, আইয়াজ সবাই সবার পথে এগিয়ে চলেছে। থেমে আছে শুধু সৌধ। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব অবশ্য পেছন থেকে ধাক্কাধাক্কি করছে। এগিয়ে চলার বিন্দু উৎসাহ, ইচ্ছে কোনোটাই পাচ্ছে না সৌধ। সে আপতত বিয়ার খেতে খেতে ল্যাপটপে মুভি দেখছে। ভারতীয় মুভি। দিন গুলো অবশ কাটে তার। রাতগুলো কাটে তীব্র বিষাদে। মনকে একটু হালকা রাখার জন্যই রোজ সিগারেট, বিয়ার আর মুভিতে ডুবে থাকে। ‘একজন এমপির যোগ্য পুত্র কি একেই বলে?’ ভেড়ানো দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে করতে প্রশ্নটি করলেন সুজা চৌধুরী। এতক্ষণ জানালা দিয়ে ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করে আর চুপ থাকতে পারেনি মানুষটা। সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি পরনে। চিবুক ভরা মেহেদি রাঙা দাঁড়ি। দৃষ্টি জোড়া চৌকস। তুখোড় রাজনীতিবিদ। বাবা সামনে দাঁড়িয়ে। কোলের ওপর থাকা ল্যাপটপটা কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত সহকারে বা’পাশে রাখল সৌধ৷ বা’হাতে থাকা বিয়ারের বোতল অত্যন্ত কৌশলে বিছানার ওপাশে ফেলে দিল৷ বিপত্তি ঘটল ফ্লোরে পড়ে তা অদ্ভুত শব্দ করল বলে৷ সুজা চৌধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সৌধ মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বাবাকে বসার জায়গা করে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ বসুন আব্বা। ‘
দৃঢ় চোয়ালে, ভারিক্কি কদম ফেলে ছেলের কাছাকাছি এলো সুজা চৌধুরী। অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বসল একপাশে। ততক্ষণে সৌধ পাশ থেকে টি-শার্ট পরে নিজের আকর্ষণীয় বলিষ্ঠ, উদাম শরীরটা ঢেকে নিয়েছে।
‘ এত খেটেখুটে ডাক্তারি পাশ করলা রাতে ঘরে বসে বিয়ার পান করার জন্য? এটাত বুঝিনাই আব্বা। ‘
সৌধর বুকটা ভার হয়ে ওঠল৷ করুণ চোখে তাকিয়ে রইল শ্রদ্ধেয় আব্বার পানে। সুজা চৌধুরী ছেলের দৃষ্টি দেখে গম্ভীরতা কমিয়ে নিলেন। বললেন,
‘ আগামীকাল সোহান আসতেছে। তোমার আর সিনুর বিয়ে উপলক্ষে কথা বলব আমরা। তোমার আপত্তি আছে জানি৷ কিছু কিছু সময় সন্তানদের আপত্তি থাকলেও বাবা, মাকে বিরোধিতা করতে হয়। আমাদের এখন সেই সময়টা আসছে। ‘
এ পর্যন্ত বলেই ছেলের দিকে তাকালেন। সৌধ যেন নিঃশ্বাস আঁটকে রয়েছে। টের পেয়ে বললেন,
‘ নিঃশ্বাস ছাড়ো। আর কত আঁটকে রাখবা? আমার ছেলে এত দুর্বল প্রকৃতির জানা ছিল না। সবল হও। সুজা চৌধুরীর ছেলেদের এভাবে মানায় না। ‘
‘ আব্বা…।’
‘ এ বিষয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাই না। তুমি এত বড়োও হয়ে যাও নাই যে নিজের সব ভালো বুঝবা। নিজের সব সিদ্ধান্ত নিবা। যেদিন আমার মতো আব্বা হবা সেদিন নিজের সব সিদ্ধান্ত নিয়ো। আর শুনলাম কোনো হসপিটালে জয়েন দিতেছ না। আর দিয়ে কাজ নাই। যেখানে পড়াশোনা করছ ঐখানেই লেকচারার হিসেবে ঢুইকা যাও। নাকি বাইরে টাইরে যাবা? ‘
সৌধ নিশ্চুপ। অত্যন্ত সচেতনতার সাথে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে। ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কখনো বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে, গলা উঁচিয়ে কথা বলেনি। আজ বড্ড ইচ্ছে করছে বলতে। ইচ্ছে করছে ভয়ানক বেয়াদব রূপে উপস্থাপন করতে নিজেকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিদ্ধান্ত বদলালো। বাবা, মায়ের সঙ্গে তর্ক করে লাভ হবে না। হয় তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে নয়তো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যেতে হবে। দু’টো কাজই তার জন্য অত্যন্ত কঠিন এবং অসম্ভব ব্যাপার। তাই ভাবল, আগামীকাল সে উদয়িনী আন্টির সাথে দেখা করবে। এরপর কথা বলবে সিনুর সঙ্গে। এই দু’জনই পারে তাকে সাহায্য করতে। নিজের জীবনে এত বড়ো বিপর্যয়ের পেছনে যার হাত রয়েছে তাকে একবার স্মরণ করল সৌধ। মনে মনে বলল,
‘ তোকে আসলে ক্ষমা করা যায় না নিধি। বেইমান একটা। তোর জন্য সারাজীবন যুদ্ধ করে গেলাম আমি৷ এতদিন মনের সঙ্গে করেছি। এখন পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে করব। ‘
সুজা চৌধুরী চলে গেলেন। আগামীকাল শুধু সোহান খন্দকারই আসবে। উদয়িনী বা সুহাস আসবে না৷ সৌধ জানে এই দু’জনের কেউই রাজি নয় সিনু আর তার বিয়েতে৷
সৌধ চোখ বুজে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার ভাবনায় এখন সিমরান এসে ভর করেছে। কখনো ভাবেনি সিমরানের সঙ্গে তার সম্পর্কের সমীকরণ এভাবে বদলে যাবে। কিঞ্চিৎ আফসোস হলো। বিরবির করে বলল,
‘ তুই অনেক ভালো মেয়ে সিনু। এতবড়ো ভুল কী করে, করে ফেললি তুই? আমার চেয়ে অনেক ব্যাটার কাউকে ডিজার্ভ করিস তুই। প্রে ফর ইউ, আমার প্রতি তোর সব অনুভূতি মুছে যাক। ‘
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। সিমরান সুহাসের বোন৷ মেয়েটাকে ছোটো থেকে দেখছে সে। ব্যক্তিত্বে চঞ্চলতা আছে,প্রচণ্ড রাগ, জেদও আছে। ম্যাচিওরিটি নেই। ও ঠিক নিধির বিপরীত স্বভাবের। ভেবেই অস্থিরতা অনুভব করল। ফের ভাবল, বিপরীত হওয়াটাই ভালো। সিনু আর যাইহোক নিধির মতো স্বার্থপর, বেইমান না৷ অনেস্ট একটা মেয়ে৷ এ পর্যায়ে সৌধর কাছে নিধির চেয়ে সিমরানের ব্যক্তিত্ব অনেক উঁচুতে ওঠে গেল।
সব ছাপিয়ে সিমরানের মাঝে নরম একটা মনও আছে। ওই মনটুকুতে আঘাত করতে চায় না সৌধ। কাল সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার পর হয়তো ক্ষণিকের জন্য আঘাত পাবে৷ কিন্তু বেঁচে যাবে চিরজীবনের জন্য। সৌধ নামক অগ্নিকুণ্ডতে জেনেশুনে ও পুড়বে না। পুড়তে চাইলেও সৌধ পুড়তে দিবে না। কিছু জিনিস থাকে খুব নরম আদরের। সিমরান তার জীবনে এমনই একজন। যাকে কষ্ট দিতে চায় না, কাঁদাতে চায় না বলেই জীবনে জড়াবে না৷ কারণ এ জীবনে দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসা তার পক্ষে সম্ভব না। ভালোবাসা বিহীন, অনুভূতি ছাড়া সিমরানকে নিজের বউ করার প্রশ্নই ওঠে না। অন্য কোনো ছেলে হয়তো পারত৷ কিন্তু সৌধ পারবে না। সে সবার ব্যক্তিত্বের ঊর্ধ্বে জীবন যাপন করে৷ সবাই যা পারে সে তা পারে না। আর সবাই যা পারে না তাই সে করে দেখাতে পছন্দ করে।
সৌধ জীবনে বিয়ের সম্পর্কে জড়াব কিনা তার ইয়ত্তা নেই। যদিও বা জড়ায় তা কারো চাপে পড়ে নয়৷ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় জড়াবে৷ পরিস্থিতি যেমনি হোক নিজ সিদ্ধান্তে সে অটল। হোক তা বাবা, মায়ের সামনে বিরোধীতা করে বা আড়ালে, চতুরতা খাঁটিয়ে।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।