ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৫২

22 Min Read

আগামীকাল শুক্রবার। সিমরানের এনগেজমেন্ট। অ্যাডভোকেড অণুজ সরকারের সঙ্গে। লোকটার গায়ের বর্ণ শ্যাম হলেও আকর্ষণীয় চেহেরা। ভীষণ সুদর্শন। সুহাস নিজে গিয়ে দেখা করেছে ছেলেটির সঙ্গে। প্রথম দেখা এবং আলাপচারিতায় চোখ, মন দুটোই কেড়েছে অণুজ। এক দুইদিনের পরিচয়ে মানুষ চেনা ভার৷ পারিবারিক বিয়ে অবশ্য অল্প পরিচয়েই হয়৷ তাছাড়া এনগেজমেন্ট হওয়ার পর বেশকিছু দিন সময় পাওয়া যাবে জানা শোনার। নিজের মনের সকল বিষণ্নতা দূরে ঠেলে আপাতত বোনকে সময় দিচ্ছে সুহাস৷ পাশাপাশি নামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা থেমে নেই। বাড়িতে বাবা, ছেলে আর বোন। তারা দু’টি ছেলে কি আর অতকিছু বোঝে? আত্মীয়, স্বজন সব দূরে দূরে থাকে। নানুমনি বৃদ্ধা। শারীরিক অবস্থা সুবিধার নয়। তাই তাকে এখন আর টানাহেঁচড়া করতে চাইল না। বিয়ে ঠিক হোক। একেবারে বিয়ের সময়ই সবাই আসবেনি৷ আবার ভাবল কালকের মতো দিনে সিমরানের পাশে একজন মেয়ে থাকা জরুরি। নামীকে মনে পড়ল খুব। মেয়েটা বড্ড পাষাণ। এমন পাষাণীকে কোন দুঃখে বিয়ে করল সে? পরোক্ষণেই মনে পড়ল, কোন দুঃখে আবার? বাবার হু’মকি নামক দুঃখে! অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল আইয়াজ, আর ফারাহকে খবর দিবে। ওরা দু’জন ছুটি কাটাতে বাড়ি আছে কিছুদিন। এ মুহুর্তে ওরা ছাড়া বড়ো কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নেই তার। ভেবেই বন্ধুকে ফোন করে নিজের অবস্থা জানায়। সব শুনে আইয়াজ, ফারাহ আর দেরি করেনি চলে এসেছে। সন্ধ্যা মাথায় করে এলো দু’জন৷ এসেই জানতে পারল, বন্ধুদের মধ্যে তাদেরই জানিয়েছে শুধু। সৌধর পরিবার বা সৌধকে জানায়নি। সিমরানের দুর্বলতা আছে ওদের প্রতি৷ তাই সুহাসই জানাতে নিষেধ করেছে বাবাকে। ছেলের নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়েছে সোহান খন্দকার। কারণ সেও জানে এতে সিমরানের মঙ্গল হবে। মেয়েটার মন ভীষণ নরম। ও বাড়ির সদস্যরা সামনে থাকলে নিজেকে যেটুকু শক্ত করেছিল সেটুকু ভেঙে পড়বে নিষ্ঠুরভাবে। একবার বাগদানটা হয়ে যায়। অণুজের সঙ্গে আলাপ হোক। ভালোলাগার জায়গা তৈরি হোক। এরপর না হয় বিয়েতে নিমন্ত্রণ জানাবে চৌধুরী বাড়ির সবাইকে। ড্রয়িংরুমে বসে সবাই অণুজ সরকারের ফটো দেখছে। প্রথম দর্শনেই সবার পছন্দ হয়ে যায়। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে সকলে। সিমরানের এসব ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি করছে সবাই। যেন বাচ্চা মেয়ে সে। মার্কেটে গিয়ে একটা ড্রেস পছন্দ করেছিল। সেটা কিনে না দিয়ে অন্যটা কিনে দিয়েছে। এখন সেটা পরার আগে বাড়িয়ে বাড়িয়ে প্রশংসা করে তার মন ভুলানোর চেষ্টা করছে। গোপনে তাচ্ছিল্য ভরে হাসল সে। ওঠে চলে গেল উপরে৷ আকস্মিক বোন ওঠে যাওয়ায় মুখে আঁধার নেমে এলো সুহাসের। আইয়াজ খেয়াল করে ফারাহকে ইশারায় সিমরানের কাছে যেতে বলল৷ ফারাহ মাথা দুলিয়ে ওঠে পা বাড়াল উপরের দিকে।
অনেকক্ষণ ধরেই কথা বলছে ফারাহ৷ সিমরান হু, হা তে উত্তর দিচ্ছে। মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের যন্ত্রণা বোঝা সহজ। তাই তো ফারাহ বুঝে ফেলল সিমরানের বুকের ভেতর বিষাদ সিন্ধু তৈরি হয়েছে। যে সিন্ধুতে বইছে তীব্র তরঙ্গ। এমনই এক তরঙ্গে সে ভুগেছে বহুদিন। যা থেকে তাকে মুক্ত করেছে আইয়াজ নাম শুদ্ধ প্রেমিক পুরুষটি৷ বিষাদ সিন্ধুতে অঢেল প্রেম দিয়েছে। যে প্রেম সকল বিষণ্নতাকে গ্রাস করে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত ডুবিয়ে রাখছে প্রগাঢ় প্রেম তরঙ্গে। মুহুর্তেই মনে মনে প্রার্থনা করল ফারাহ, সিমরানের জীবনেও এমন একজন পুরুষ আসুক। যে তার মনের সব বিষণ্নতা শুষে নিয়ে অঢেল প্রেমে ভরিয়ে তুলবে, ডুবিয়ে রাখবে। যা পেয়ে সিমরানের এই পৃথিবীটা নরক না স্বর্গ মনে হবে। নিজের জীবনের সুখগুলোকে মনে হবে স্বর্গীয় সুখ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারাহ। সিমরানকে বলল,
‘ শুনলাম শপিং করেছ? দেখি কাল কী পরবে? শাড়ি, ল্যাহেঙ্গা না গাউন। ‘
নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল সিমরান। সে শপিং করেছে? ওহ হ্যাঁ করল তো গতকাল। ভাই ছিল সাথে। নিজে থেকে কিচ্ছু পছন্দ করেনি। সব সুহাসের পছন্দে কিনেছে। যেখানে সঙ্গীটাই নিজের পছন্দের হবে না। সেখানে এসব সাজ সজ্জার জিনিস নিজের পছন্দের হয়ে কী হবে? রুদ্ধশ্বাস ফেলল সিমরান। মৃদু হেসে যা যা কেনাকাটা করেছে সবই দেখাল। ফারাহ বেশ প্রশংসা করল প্রতিটি জিনিসের। সিমরানের মনে হলো আজ সবাই সবকিছুতে বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা করছে। যা দৃষ্টিকটুর পাশাপাশি কর্ণকটুও ঠেকল। ফারাহর সঙ্গে সময় গুলো কেটে গেল তাড়াতাড়িই। রাতে খাবার খাওয়ার সময় হয়ে এলো। সুহাস ডাকতে এলো ওদের। খেতে ইচ্ছে করছে না সিমরানের। চারদিকে বিষাদে ছেয়ে গেছে। তীব্র অবসাদে ভুগছে মনটা। তবু খেতে যেতে হলো। গলা দিয়ে খাবার নামছিল না ওর৷ পানি দিয়ে গিলে গিলে খেল। ওর অবস্থা দেখে আইয়াজের দিকে করুণ চোখে তাকাল ফারাহ। চোখের সামনে এসব দেখে সহ্য হয়? আইয়াজ চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল ওকে। বোনের অবস্থা খেয়াল করল সুহাসও৷ এই পরিস্থিতিতে আসলে কী করা উচিত, কী বলা উচিত বোধগম্য হলো না। শুধু গোপনে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। মনের কোথাও একটা যেন সৌধর প্রতি ওর ক্রোধ জন্মেছিল। যা সিমরানকে এই অবস্থায় দেখে জেগে ওঠল৷ প্রিয় বন্ধু সৌধকে এখন অপাত্র মনে হলো তার। আর বোনের তীব্র ভালোবাসাকে মনে হলো ঘি। অপাত্রে ঘি ঢালতে গেলে এভাবেই কষ্ট পেতে হয়৷ আফসোস হলো ভীষণ। আদরের বোন তার। ভুল মানুষকে ভালোবেসে এভাবে পস্তাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করল, কালকের পর থেকে যেন ধীরেধীরে সব ঠিক হয়ে যায়। নতুন মানুষে নতুন উদ্যমে যেন বাঁচতে শেখে সিমরান।
.
.
আজকের দিনটা যেন চোখের পলকে মিলিয়ে গেল। রাত যত বাড়তে লাগল ততই অদৃশ্য এক ভয় জাপ্টে ধরল সিমরানকে। কাল তার এনগেজমেন্ট হবে। সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একজন মানুষ। যাকে নিয়ে কখনো কল্পনা করেনি সে। এমন একজন মানুষ তাকে দেখবে। গভীরভাবে দেখবে। আংটি পরানোর সময় তার হাতও স্পর্শ করবে। সহসা গায়ে কাঁ টা দিয়ে ওঠল সিমরানের। বুকের ভেতর ভয়ংকর ভাবে কাঁপতে শুরু করল৷ কীভাবে মেনে নেবে সে? পারবে তো নিজেকে শক্ত রেখে সব সয়ে নিতে? প্রচণ্ড হাসফাস চিত্তে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে মেয়েটা। ঘুম চোখে ধরা দিচ্ছে না। কান্না পাচ্ছে খুব৷ একসময় বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে ওঠল। একবার মৃদু আর্তনাদে ডাকল, ‘ আম্মু… কেন চলে গেলে এভাবে? আমি যে আর পারছি না নিজেকে সামলাতে। ‘ আরেকবার ডাকল,’ সৌধ ভাই! কাল থেকে আমি অন্যকারো হয়ে যাব। আফসোস কেউ আমার হবে না। আমি মানিয়ে নিতে পারব ঐ লোকটাকে কিন্তু মনে নিতে পারব না। ‘
রাত একটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট৷ একটা পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সৌধ। মারাত্মক একটা ঘুম পেয়েছে। আগামীকাল শুক্রবার চাপ বেশি যাবে। তাই ঘুমানোর তোরজোর শুরু করল। বিছানায় গা এলিয়ে ফোনে এলার্ম দিতে গিয়ে খেয়াল করল, হোয়াটসঅ্যাপে বেশকিছু ম্যাসেজ এসেছে। একটা প্রাচীর। লিখেছে, “কেমন আছিস দোস্ত। ” আর গুলো এলাকার ছোটো ভাই আর বন্ধুর। হঠাৎ নোটিফিকেশন এলো দেখতে পেল সিমরানের ফেসবুক আইডি থেকে জাস্ট একটার দিকে একটি পোস্ট করা হয়েছে। এই মেয়ে রাত জাগাতে পটু৷ খেয়াল করেছে সে। অনেকদিন ভেবেছে কিছু বলবে, ঝাড়িটাড়ি দেবে। পরমুহূর্তে আর দেয়নি৷ কিন্তু রাতদুপুরে পোস্ট! এটা যেন বাড়াবাড়ি ঠেকল। তা কী পোস্ট করেছে দেখি। ভেবেই নোটিফিকেশনে ক্লিক করল। ভেসে ওঠল ইংরেজিতে লেখা কয়েক লাইন। ইংরেজির স্টুডেন্ট। পোস্ট ইংরেজিতে হবে এটাই স্বাভাবিক। বেশ মনোযোগী দৃষ্টিতে বিরবিরিয়ে পুরো লেখাটা পড়ল সৌধ।
“Why do people get lost? Tears flow in the eyes when a loved one dies. If you lose your life, why does the fire burn in the chest? A dreamer’s dream of a man will never come true The end of the dreamer’s dream. ”
ইংরেজিতে পোস্টটি পড়ে নিমেষে চোখ বুজে ফেলল সৌধ। সিমরানের ইংরেজি পোস্টটির বাংলা হলো-
“মানুষ কেন হারিয়ে যায়? ভালোবাসার মানুষ মরে হারালে চোখে অশ্রু ঝড়ে। জীবন্ত হারালে বুকের ভেতর আগুন জ্বলে কেন? স্বপ্নচারিণীর স্বপ্ন পুরুষ কখনো সত্যি হবে না৷ স্বপ্নচারিণীর স্বপ্নের সমাপ্তি। ”
বাংলা অর্থ বুঝতেই বুক ধক করে ওঠে সৌধর। ঘুম ছুটে যায় নিমেষে। মুখ হয়ে ওঠে গম্ভীর। অধর কামড়ে বিচলিত চিত্তে হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে সিমরানের নাম্বারে ম্যাসেজ পাঠায়,
‘ ঘটনা কী বলত সিনু, তোর কি ইংরেজি সাহিত্যিক হতে ইচ্ছে করেছে? ওহ হ্যাঁ তুই তো ইংরেজি সাহিত্য নিয়েই পড়ছিস। তা মাইকেল মধুসূদনের জীবন কাহিনি জানিস? ‘
ম্যাসেজটা দিল। সিন হলো। অথচ উত্তর নেই। শুয়ে থাকা ভারিক্কি দেহটি আচমকা ওঠে বসল। সিনু তার ম্যাসেজ সিন করল আর রিপ্লাই দিল না? আশ্চর্য! চোখ, মুখ কুঁচকে গেল সৌধর৷ ত্বরিত আঙুল চালিয়ে ফের টেক্সট দিল,
‘ ঘুমোসনি কেন এখনো? ‘
আবারো সিন হলো। সৌধ ত্বরিত লিখল,
‘ রিপ্লাই কর। ‘
সৌধর ম্যাসেজ পেয়ে ধাতস্থ হতে সময় লাগল সিমরানের। মধ্যরাতে সৌধ ভাইয়ের ম্যাসেজ অপ্রত্যাশিত ছিল। আবারো কান্না পেয়ে গেল মেয়েটার। কাঁদতে কাঁদতে কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। মন, মস্তিষ্ক সবটাই বিধ্বস্ত। শেষে ‘রিপ্লাই কর’ ম্যাসেজটি দেখে চমকে ওঠল। এটা ধমক ছিল। বুঝতে পারল সে। তাই তীব্র অভিমান বুকে চেপে উত্তর দিল,
‘ আজ দুপুরে আমার এনগেজমেন্ট সৌধ ভাই। সেই খুশিতে ঘুমাতে পারছি না। কেমন আছো তুমি? ‘
সিমরানের ফোনে চার্জ শেষের পথে ছিল। সারাদিন এত দুঃশ্চিন্তা, মানসিক অশান্তিতে ভুগেছে যে ফোন চার্জ দিতেও খেয়াল নেই। সবকিছু থেকে এমনি ভাবে মন ওঠে গেছে তার। তাই এটুকু রিপ্লাই দেয়ার পর পরই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। আচমকা ফোন বন্ধ হওয়াতে একটুও বিচলিত হয় না সিমরান। বিরবির করে আফসোসের সুরে বলল,
‘ এই ফোনটাও চায় না তোমার সাথে আমার কথা হোক। ‘
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান। সহসা তীব্র ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ফোনটা নিয়ে চার্জ দেয়ার পরিবর্তে বন্ধ অবস্থাতেই ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ফেলে রাখল। কিচ্ছু দরকার নেই তার, কিচ্ছু না। বিছানায় ফিরে এলো আবার। ধপাস করে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে হুহু করে কাঁদতে লাগল। সারারাত কেঁদেকেটেই শেষ করে দিল৷ ঘুমালো না একটুও। সকালের দিকে একটু চোখ লেগেছিল বটে। কিন্তু তা কি আর দেহ, মনের ক্লান্তি দূর করতে পারে?
.
.
আজ সিমরানের সব দায়িত্ব ফারাহর ওপর পড়েছে। ফারাহ অনেক বুঝিয়ে সকালে একটু খাইয়ে দিয়েছিল৷ এরপর আর খাওয়াতে পারেনি৷ এখন সময় হয়ে এসেছে। অনেক বলে বলে গোসলে পাঠাল মেয়েটাকে৷ ততক্ষণে সে সবকিছু গুছিয়ে রাখল। সিমরান বেরিয়ে আসতেই একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ফারাহ৷ এতক্ষণ কী ভয়ংকর লাগছিল মেয়েটা। মুখের বর্ণ পুরোপুরি লাল ছিল। চোখ দু’টো এখনো ফোলা। সারারাত কী পরিমাণ কান্নাকাটি করেছে। তার প্রমাণ ফুলো ফুলো চোখেই দেখতে পাচ্ছে ফারাহ। চুলগুলো মুছে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে পুরোপুরি শুঁকিয়ে ফেলল সিমরান। ফারাহ ওকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসতে বললেই একবার শান্ত চোখে তাকাল। পরোক্ষণেই স্মিত হেসে এগিয়ে এসে বসল চুপচাপ। ফারাহ মৃদু হেসে কাঁধে হাত রাখল। বলল,
‘ আগে চুল বাঁধি তারপর মুখ সাজাই কী বলো? শেষে ল্যাহেঙ্গা পরো। এতে গরম কম লাগবে। এসির পাওয়ার কি আরেকটু কমাব? ‘
‘ না ঠিক আছে। তোমার যেমন খুশি তেমনি সাজাও নো প্রবলেম। ‘
নির্লিপ্ত স্বর সিমরানেও। ফারাহ মৃদু হেসে একে একে সাজাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বিষণ্ন মুখের সিমরান হয়ে ওঠল বিষাদ রাজ্যের রাজকুমারী। যার সব আছে সব। নেই মুখে হাসি। চোখে আনন্দের ঝিলিক। সাজ সম্পন্ন হওয়ার পর পুরোপুরি তৈরি হয়ে নিল সিমরান। ফারাহ যেন ওর দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারল না। অবাক গলায় বলল,
‘ কী কিউট লাগছে! তুমি কিন্তু মারাত্মক সুন্দরী সিনু। ‘
একপেশে হাসল সিমরান। মনে মনে বলল,
‘ এই সৌন্দর্যও এক সময় আমার অহংকার ছিল। কিন্তু আজ মূল্যহীন! ‘
মৃদু পায় ড্রেসিং টেবিলের খুব কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল সে। আয়নায় দেখতে পেল আপাদমস্তক সুসজ্জিত নিজেকে। তার শুভ্র ত্বকে লাইট পিঙ্ক কালার ল্যাহেঙ্গাটি দারুণ মানিয়েছে। ল্যাহেঙ্গার সাথে মিলিয়ে ব্রাইডাল জুয়েলারি গুলোও ভীষণ সুন্দর। গলায় একটি নেকলেস পরেছে হীরের। যা ইন্ডিয়া থেকে তার বাবা এনেছিল তার জন্য। আলতো স্পর্শ করল নেকলেসটায়। মনে মনে কিঞ্চিৎ হাসল। তার বাবা, ভাইয়ার পছন্দ আছে বলতে হয়। এরপর তাকাল নিজের পানে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ফারাহ আপুর দিকে। আপু এত সুন্দর সাজাতে পারে জানা ছিল না৷ সে বরাবরই ব্রাইডাল সাজতে পছন্দ করে। যদিও সৌধর পছন্দকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ইদানীং ব্রাইডাল সাজত না। তবে আজ নিজেকে সম্পূর্ণ ব্রাইডার লুকে দেখে পছন্দ হলো ঠিক৷ কিন্তু মনের ভিতর দানা বেঁধে রইল একটাই। এই সাজ কাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্য নয়। মুহুর্তেই বুকের ভেতরটা ডুকরে ওঠল। কান্না উপচে এলো গলা পর্যন্ত। সেই মুহুর্তেই দরজায় টোকা পড়ল সুহাসের।
‘ এই ফারাহ, অণুজরা এসে পড়েছে। তাড়াতাড়ি দরজা খোল। ‘
সহসা বাক্যে শিউরে ওঠল সিমরান। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করল তার৷ নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে তীব্র কষ্ট অনুভব করল। চারিদিকে ঝকঝকে আলো তবু যেন কী গভীর অন্ধকারে ডুবতে শুরু করল সে। তবে কী সবাই মিলে এক আঁধার থেকে অন্য আঁধারে নিক্ষেপ করছে তাকে?
পাশাপাশি বসে অণুজ, সিমরান। সিমরানের মস্তক নত৷ বড়োরা কথা বলছে। আংটি বদল হয়ে গেলেই একসঙ্গে খেতে বসবে সবাই। বর্তমান যুগের স্মার্ট কোনো মেয়ে এত লাজুক হয় নাকি? অণুজের ভারিক্কি জ্ঞানে প্রশ্নটি বার বার উঁকি দিতে লাগল৷ এর আগে দু’বার কথা হয়েছে সিমরানের সাথে। তখনও টের পেয়েছিল সিমরান বেশ লজ্জা পাচ্ছে। তার সঙ্গে কথা বলতে জড়তা কাজ করে মেয়েটার৷ সে যা প্রশ্ন করত তাই উত্তর দিত। নিজে থেকে একটি প্রশ্ন করত না৷ আজ সামনাসামনি দেখা হলো। কিন্তু কথা বলল সে একাই৷ সিমরান মুখে হু, হা উত্তর দিয়েছে। আর মাথা নাড়িয়ে। এর বাইরে একটি কথাও বলেনি। ভেতরে ভেতরে এটা নিয়ে কিঞ্চিৎ অস্বস্তি অনুভব করছিল অণুজ৷ তার মা বিষয়টা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল,
‘ কোনো সমস্যা? ‘
অণুজ মাথা নাড়াল। কোনো সমস্যা নেই। দু’পক্ষের আলাপচারিতা শেষ হলো। অণুজ অনুমতি পেল সিমরানকে আংটি পরিয়ে দেয়ার জন্য। ফারাহ এসে বসল সিমরানের অপর পাশে। মেয়েটার বুক কম্পন হচ্ছিল বহুক্ষণ ধরেই৷ সে কম্পন এবার শরীরে শুরু হয়েছে। দূর থেকে খেয়াল করেই চলে এসেছে ফারাহ। অণুজ খুব সুন্দর একটি হীরের আংটি বৃদ্ধা এবং তর্জনী আঙুল দিয়ে ধরে সিমরানের সামনে নিয়ে এলো। এ সময় আইয়াজ বলল,
‘ অণুজ ভাই দাঁড়িয়ে পড়ুন। সিনু ওঠে দাঁড়া। ‘
আইয়াজের হাতে ক্যামেরা। অণুজের চোখ দু’টোয় দীপ্তি ফুটে ওঠল। ওঠে দাঁড়াল সে। ফারাহ ফিসফিস করে ওঠতে বলল সিমরানকে। সিমরান ওঠল না৷ তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখা গেল না। যেন এ জগতে সে নেই। ঢোক গিলল ফারাহ। কী হচ্ছে এসব? সিমরান কেন বুঝতে পারছে না? এটা কোনো সিনেমার অংশ নয় এটা বাস্তব জীবন। আজ এ মুহুর্তে একটু ভুলচুক হয়ে গেলে দু’পক্ষকেই বিব্রত হতে হবে। পড়তে হবে তীব্র লজ্জায়। সবশেষে অসম্মানিত হতে হবে আংকেল আর সুহাস ভাইকে।
অনেক বলে ধাক্কাধাক্কি করে অবশেষে ওঠানো হলো সিমরানকে। যা খেয়াল করে অণুজের মুখে আঁধার নেমে এলো। তবে কী এই বাগদানে সিমরানের মত নেই? যা হচ্ছে পারিবারিক চাপে পড়ে? শ্বাস রোধ হয়ে এলো অণুজের। বিয়ে ব্যাপারটা তার কাছে খুব ইম্পর্ট্যান্ট। তার বউ হতে এলে আলাদা উৎসাহ নিয়ে হতে হবে। তার প্রতি তীব্র আগ্রহী থাকতে হবে মেয়েকে। এসব না হলে, না থাকলে বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না৷ সে কোনো ফেলনা পুরুষ নয়। সিমরান নিঃসন্দেহে সুন্দরী নারী। ছবিতে প্রথম দেখেই আকৃষ্ট হয়েছে সে। বাস্তবে দেখে সেই আগ্রহ গাঢ় হয়েছে।
কিন্তু সিমরান? সে তো তার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। আকর্ষণ দূরে থাক একবিন্দু আগ্রহীও নয়। জীবনের কাঙ্ক্ষিত একটি মুহুর্তে এসে অণুজ যেন ভেঙে পড়ল৷ মা, বাবা, ভাইরা তাকে উৎসাহ দিচ্ছে আংটি পরাতে। নিমেষে ভাবনা ফুরালো। মন বলল, সে যা ভাবছে এমন কিছু নয়। তাই হলে এত সুন্দর করে সেজে তৈরি হয়ে সামনে আসত না সিমরান। আজকালকার মেয়েরা এত বোকা নয়। বুকটা হালকা হলো এবার৷ মৃদু হেসে বা’হাতে সিমরানের বা’হাতটায় প্রগাঢ়ভাবে স্পর্শ করল। অনুভব করল একটুখানি কেঁপে ওঠেছে সিমরান। যা অবিরত চলতেই থাকল।
কাঙ্ক্ষিত সেই মুহুর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আগমন ঘটল সৌধর। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় সুহাসদের উন্মুক্ত সদর দরোজা পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল সে! প্রথমে সামনে পড়ল আইয়াজ। যে ক্যামেরা তাঁক করে আছে অণুজ আর সিমরানের দিকে। সৌধ অবিশ্বাস্য, থমকানো দৃষ্টিতে একবার আইয়াজ আরেকবার সিমরানের দিকে তাকাল৷ এরপর আচমকা আইয়াজের থেকে থাবা মে রে ক্যামেরা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল ফ্লোরে। বিধ্বস্ত মুখ, উষ্কখুষ্ক চুল কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পরনে ইস্ত্রি বিহীন কালো শার্ট। দু’হাতের হাতাই গোটানো। বুকের কাছটায় দু’টো বোতাম খোলা। ফর্সা বুকে কালো লোম গুলো উঁকি দিচ্ছে স্পষ্ট। সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে খেয়াল করে দেখা গেল ওর পরনে প্যান্ট নয় ট্রাউজার! সৌধ চট্টগ্রামে ছিল। গতকাল সকালেও কথা হয়েছে আইয়াজের সাথে। তাহলে আচমকা সৌধর আগমন কী করে? তাও কিনা এই রূপে। যে রূপে সৌধর বেডরুম ব্যতীত নিজের বাড়ির ড্রয়িং রুমেও দেখেনি কখনো। সেই রূপে দেখে আইয়াজ, ওপাশে থাকা সুহাস, ফারাহ, সোহান খন্দকার প্রত্যেকেই হতভম্ব। উপস্থিত প্রত্যেকে ধাতস্থ হতে সময় নিল। সৌধ হঠাৎ এসে এমন বিশৃঙ্খলা করছে কেন? ও তো এমন ছেলে নয়। নিমেষে সবার কর্ণকুহরে পৌঁছাল আইয়াজের কলার ধরে বলা সৌধর গমগমে কণ্ঠস্বর,
‘ ভেবেছিলাম সুহাসই আমার চরম শত্রু হয়ে গেছে। এখন দেখছি তুইও! ‘
বলেই কলার ছেড়ে দিল। হাত ঝাড়া দিয়ে আশপাশে তাকিয়ে দেখল সকলের স্তম্ভিত মুখ৷ কেবল একজনই নির্লিপ্ত। আচমকা চোখ বুজে নিজের মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করল সৌধ৷ নিমেষে আবার চোখ খুলল। সোহান খন্দকার ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। কিছু বলতে উদ্যত হতেই সে দৃঢ় গলায় বলল,
‘ আমি খুব দুঃখীত আংকেল। নিরুপায় আমি। ‘
থেমে গেল সোহান খন্দকার। সৌধ চোখ ফিরিয়ে নিল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল অণুজ, সিমরানের দিকে। নিমেষে পথে বাঁধা হয়ে সুহাস দাঁড়াল। অনুরোধের সুরে বলল,
‘ কী করছিস এসব? ওদিকে যাচ্ছিস কেন? ‘
‘ তোর সাথে তো আমার কথাই চলে না। পথ ছাড়।’
ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল সৌধ। সুহাস আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘ নাটক করবি না। ‘
সৌধ ওর বুক সই করে ধাক্কা দিয়ে বলল ‘ওটা তোর স্বভাব। আমার না। ‘
ধাক্কা খেয়ে কিঞ্চিৎ দূরে সরে গেল সুহাস। চোখের পলকে সিমরানের মুখোমুখি হলো সৌধ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল একবার৷ এরপর নিজের বলিষ্ঠ ডানহাতটা তুলে সিমরানের স্নিগ্ধ, মসৃণ গাল দু’টো আলতো চেপে ধরল। ব্যথা যেন না পায় এভাবেই ধরল। অদ্ভুত করে হাসল কিঞ্চিৎ। সে হাসিতে এক টুকরো ব্যথা মিশে ছিল কী? জানা নেই। অদ্ভুত সে হাসি হেসে সিমরানের মুখশ্রীতে গাঢ় চোখে তাকাল। দৃঢ় গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘তোর কি পার্বতী হওয়ার শখ হয়েছে সিনু? ‘
সকলেই হতভম্ব হয়ে গেল। অণুজ বাকহারা। আর তার পরিবার স্তম্ভিত মুখে সোহান খন্দকারের পানে তাকিয়ে। সিমরান নিষ্পলকে সৌধকে দেখছে। সত্যি সৌধ ভাই এসেছে? এটুকু বিশ্বাস করতেই সময় লাগল বেশ। এরপর হুট করেই বুকটা মুচড়ে ওঠল। পার্বতী কে? সে কেন পার্বতী হতে যাবে!
এদিকে সৌধ উত্তর না পেয়ে একটুও বিচলিত হলো না৷ সে ঘাড় বাঁকিয়ে সিমরানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির পানে তাকাল। দেখল সিমরানের বা’হাত ছেলেটির বাঁহাতে ধরা। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল এ দৃশ্য দেখে। বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে গেল যেন দৃশ্যটি। ভেবেই সিমরানের দিকে একবার নিজের রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই দৃষ্টিটাকে শীতল করে ফের তাকাল অণুজের পানে। অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিমায় হাত বাড়িয়ে সিমরানের হাত থেকে অণুজের হাতটা সন্তর্পণে ছাড়িয়ে নিল। এরপর অণুজের ডানহাতের দিকে নিজের ডানহাত এগিয়ে ধরে জোরপূর্বক হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল,
‘ হ্যালো আমি সৌধ চৌধুরী। সন অফ এমপি সুজা চৌধুরী। ‘
অণুজ বাকশূন্য। সৌধর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে হাত ছেড়ে দিয়েছে। পুনরায় তাকিয়েছে সিমরানের বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে। ওর বিস্মিত মুখ তার মনকে চনমনে করে তুলল। মুখ বলল,
‘ তুই কি চাস দেবদাস হতে গিয়ে ফিরে এসে আমি আবার দেবদাস হয়ে যাই? ‘
একটু থামল। উপস্থিত সকলের দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলল,
‘ যদি না চাস চুপচাপ আমার পাশে এসে দাঁড়াবি। ভয় নেই। লজ্জিত হবারও কারণ নেই। আর না আছে কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত হবার। লাইফে অনেক সিনেমা দেখেছিস৷ মনে কর আজ এ বাড়িতে তোর আমার জীবন্ত একটি সিনেমা হচ্ছে। যা ইতিহাসের পাতায় যুগের পর যুগ লিখিত ভাবে বেঁচে থাকবে। কাম অন সিনু।‘

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।