ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৫৩

11 Min Read

চোখের পলকে ভবিতব্য বদলে গেল৷ মনের বাইরে চলা পরিকল্পনা গুলো হেরে গেল মনের ভিতরে চলা পরিকল্পনার কাছে। যারা মনের বাইরে পরিকল্পনা করেছিল তারা জানে না, ভেতরের পরিকল্পনাকারীর চিন্তাশক্তির প্রখরতা। জানে না তার বিচার বিশ্লেষণ আর পাঁচ জন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। খুবই শান্ত একটি পরিবেশ চোখের পলকে অশান্ত হয়ে ওঠেছিল। সারাজীবন শৃঙ্খলা মেনে চলা ছেলেটি বহু বছরের ভালোবাসা হারিয়ে উশৃংখল হয়ে ওঠেছিল প্রথম। এরপর দীর্ঘ একটি সময় কেটে যায়। নিজেকে পুরোপুরি ধাতস্থ করে ফেলার আগেই দ্বিতীয়বার এলোমেলো হয়ে যায় মানুষটা। ফলাফল দু’টো পরিবারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সেই পরিস্থিতিও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সাথে সামলে নেয়। একজন চৌকস রাজনীতিবিদ। সৌধর শ্রদ্ধেয় পিতা সুজা চৌধুরী।
গতরাতে সিমরানের শেষ ম্যাসেজটা পড়েই স্তব্ধ হয়ে যায় সৌধ। তার আড়ালে এতকিছু হয়ে গেল। অথচ সুহাস একটিবারও তাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করল না? বন্ধুত্বের জায়গা থেকে তীব্র অভিমান হয়৷ পরোক্ষণেই হিসেব করে মেলায় সুহাসেরও তার প্রতি চাপা অভিমান আছে৷ সেই অভিমান কী নিয়ে? টের পেতেই শিউরে ওঠে৷ মানুষের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেই থাকে। যাদের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নেই। তারা জীবনের ভিন্ন এক স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়৷ সৌধ বঞ্চিত হয়নি৷ সে পেয়েছে জীবনের ভিন্ন স্বাদ৷ সে দেখেছে প্রকৃতির অদলবদল। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই তো এই অদলবদল ঘটায়। গভীর রাতে ফাঁকা ঘরটায় দেহজুড়ে হঠাৎই অদ্ভুত রকমের অশান্তি শুরু হয় সৌধর। এতকাল যে চিন্তা, চেতনা বুকের গভীরে লুকায়িত ছিল। ক্রমশ তার উন্মোচন ঘটতে থাকে৷ নিজেকে স্থির রেখে আর বিছানায় বসে থাকতে পারে না৷ সেদিনের দেখা সিমরানের অসহায় মুখশ্রী, অশ্রুতে টলমল দৃষ্টিজোড়া মনে পড়ে আচমকা। কতগুলো মাস ধরে এই আচমকা মনে পড়ার রোগে হয়েছে তার৷ সে প্রাপ্তবয়স্ক এক যুবক। ভগ্ন হৃদয়ের অধিকারী। যে হৃদয় কেউ নির্মম ভাবে ভেঙে দেয়। সে হৃদয়ে কি আবারো নড়াচড়া করে? সে তো ভেবেছিল এইতো শেষ। ওখানেই জীবনের সমাপ্তি। রঙহীন এক বেরঙিন জীবন৷ কিন্তু সৃষ্টিকর্তার এ কী লীলা? কেঁপে ওঠে সৌধ। নিধিকে যেমন আকস্মিক ভালোবেসেছিল, হারিয়েছিলও আকস্মিক। নিধি তখন সম্পূর্ণরূপে অন্যকারো। জীবনের এ পর্যায়ে এসে সে অনুভব করে সৃষ্টিকর্তা চায়নি তাদের মিলন হোক। তাই তো পুরোপুরি অন্যকারো হয়েই তার দৃষ্টি খুলল। আর সিমরান? যে কিনা নিজের অনুভূতি উজার করে দিয়ে তাকে ভাবাতে বাধ্য করল। হ্যাঁ ভেবেছে সৌধ। সিমরানকে নিয়ে ভেবেছে সে। যে ভাবনাতে প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই৷ আছে শুধু অন্যরকম শান্ত, স্নিগ্ধ এক অনুভূতি। দু’টো নারী। দু’জনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দেহ আলাদা, দেখতে আলাদা। হৃদয়? সেটিও ভিন্ন৷ সে দেখেছে নিধির হৃদয়ের পাষাণত্ব। দেখেছে সিমরানের হৃদয়ের অসহায়ত্ব৷ আজ জীবনের এমন একটি পর্যায়ে এসে কোনটা তাকে বেশি টানছে? নিখুঁত ভাবনা ভেবে নেয়।
নিধি, সিমরান এদের একজনকে বদ্ধ উন্মাদের মতো প্রেম নিবেদন করেছিল সৌধ। কিন্তু মানুষটি নির্বিকার ছিল। আর একজন যাকে নিয়ে কখনো ভুল ক্রমেও স্বপ্ন দেখেনি৷ সে তাকে শুদ্ধরূপে ভালোবেসে সঙ্গী হয়ে জীবনে আসার আবেদন দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান পেয়ে ফিরেও গেছে।
যে হারায় সেই তো জানে হারানোর বেদনা। যার হৃদয় ভাঙে সেই তো জানে হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণা। যার ভাঙে না সে কি জানে? সিমরানের অনুভূতি প্রগাঢ় ভাবে অনুভব করে সৌধ৷ ভালোবাসায় ভুল থাকে না। ভুল থাকে ভুল মানুষকে ভালোবাসাতে। তার জীবনে ভুল মানুষ এসেছিল। ভুলের মাশুল আজো দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে কারো জীবনে ভুল হতে চায় না। এক নিষ্পাপ হৃদয়ে ফুল হয়ে ফুটতে চায়৷ মানুষটি যদি হয় সিমরান তবে তো একদমই ভুল হওয়া উচিত নয়। তাই বলে সেদিন সিমরানকে প্রত্যাখ্যান করে কি সে ভুল করেছিল? একদমই নয়। সেদিন সে ভুল করেনি। আজো করবে না। কিন্তু আজ যদি সিমরানের এনগেজমেন্ট না ফেরায়৷ নিজের ভেতর জন্ম নেয়া সুপ্ত অনুভূতিদের স্বীকার না করে তবে ভুল হয়ে যাবে। মস্ত বড়ো ভুল। যে ভুলটা নিধির জীবনে হয়েছে। সে ভুল সে করতে চায় না। কারণ সে নিধি নয়। মানুষের জীবন কি অদ্ভুত তাই না? সময় কি চমৎকার ভাবেই মানুষের গতিবিধি বদলে দেয়৷ বদলে দেয় মনের ভেতরে চলা অনুভূতিদেরও সমীকরণ। নিজের ভাবনাচিন্তা গুলোর সমাপ্তি দিয়েই সিমরানকে ফোন করে সৌধ। ফোন বন্ধ পায়৷ যা তার ভেতরের অনুভূতিকে গাঢ় করে। বুকের ভেতরে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বারবার ফোন করেও যখন ফোন খোলা পায় না। তখন কল করে সুহাসকে। ফোন রিসিভ হয় না। নিমেষে ভয় জাপ্টে ধরে। তবে কি দ্বিতীয়বারের মতো সে হেরে যাবে? হার শব্দটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়েছে নিধি। দ্বিতীয় কোনো নারী আর তাকে এ শব্দের সঙ্গে পরিচয় না করাক। ভেবেই টালমাটাল হৃদয়টুকু নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। শুধু একটি মোবাইল ফোন আর ওয়ালেট ছাড়া কিছুই সঙ্গে নেয় না৷ তীব্র দুঃশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পুরো জার্নির সমাপ্তি ঘটায়। ভরদুপুর তখন। বাসস্ট্যান্ডে নামতেই তার স্মরণ হয় একবার বাবাকে কল করা উচিত। মুহুর্তেই বাবাকে কল করে। রিসিভ হতেই সালাম দিয়ে বলে,
‘ আপনি কোথায় আব্বা? ‘
ছেলের কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠেন সুজা চৌধুরী। আবার কী হলো ছেলেটার? উদ্বিগ্ন চিত্তে শুধায়,
‘ আমি একটি মিটিংয়ে আছি। লাঞ্চ করছ? ‘
‘ আমি মাত্র টাংগাইলে নামলাম। সুহাসদের বাড়ি যাচ্ছি। আজ সিনুর এনগেজমেন্ট। যে করেই হোক আটকাতে হবে। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ও কাউকে বিয়ে করতে পারবে না আব্বা। ‘
হতভম্ব হয়ে যায় সুজা চৌধুরী। নির্লপ্ত কণ্ঠে বলে,
‘ যেইখানে তুমি ওদের প্রত্যাখ্যান করছ। সেইখানে এমন মনোবাসনা নিয়ে যাবা না। ‘
‘ আমি সিনুকে বিয়ে করব আব্বা। আপনি কথা বলুন আংকেলের সাথে। আমি পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা বলব। ‘
‘ তুমি ভেবেচিন্তে বলছ সৌধ? তোমার এই সিদ্ধান্ত কতটুকু শক্ত?’
তীব্র আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ সৌধর,
‘ যতটুকু শক্ত থাকলে আমাকে আর কেউ ভাঙতে পারবে না। ‘
.
.
প্রধান দপ্তরে নোটিশ দেয়ায় সৌধর কাজ সহজ হয়ে গেল। যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন শান্ত। প্রকট এক ঝড় বয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতি যেমন শান্ত, শীতলতায় রূপ নেয়। সোহান খন্দকারের বাড়ি এবং উপস্থিত সদস্যরা তেমনি শান্ত আর শীতল হয়ে আছে। সৌধ, অণুজ পাশাপাশি বসে আছে। অণুজের বাবাকে সোহান খন্দকার কি বোঝাবে? এমপি সাহেবের সঙ্গে দীর্ঘ বিশ মিনিট কথার সমাপ্তি দিয়ে সেই বোঝাচ্ছে সোহান খন্দকারকে,
‘ দেখুন আজকাল এমন হয়েই থাকে। ছেলেমেয়েরা তাদের পছন্দ মুখ ফুটে বলতে পারে না। ভাগ্যিস এমপি সাহেবের ছেলে সাহস করে ছুটে এসেছিল৷ নয়তো কতবড়ো বিপদ ঘটে যেত। আপনার মেয়েকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম। বুক ফাটছে তবু মুখ ফুটে কিছু বলছে না৷ ‘
সৌধ মেকি হাসল উনার কথা শুনে। কারণ ভদ্রলোক মুখে যতই মধু মিশিয়ে কথা বলুক। ভিতরে ভিতরে ঠিকই এমপি সাহেবের চৌদ্দ গুষ্টি তুলে গালি দেয়া শেষ৷ দেয়ারই কথা। বড়োসড় ছ্যাঁকা খেয়েছে কিনা…। সৌধর এসবে যায় আসে না। সে আপাতত নিজেকে নিয়েই ভাবতে চায়। নিজের সুখ, শান্তিকেই প্রাধান্য দিতে চায়। ভাবতে ভাবতেই দোতলা সিমরানের ঘরের দিকে একবার তাকাল। এতকিছুর ভীড়ে সিমরান কখন চলে গেছে খেয়াল করেছে সে৷ কিন্তু যে খুশিটা ওর মুখে দেখার প্রত্যাশা ছিল তা দেখেনি। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। তাকাল সুহাসের দিকে। গম্ভীর মুখে আইয়াজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ দৃঢ় দৃষ্টিতে দুই বন্ধুকে পরোখ করল সে। সুহাসকে উদ্দেশ্য করে বিরবির করে বলল,
‘ মীর জাফর কোথাকার! বাঙালির সম্পদ ইংরেজের হাতে তুলে দিচ্ছিল। ‘
.
.
দুপুরের খাবার খেয়ে অণুজ সহ অণুজের পরিবার বিদায় নিল৷ খুবই আন্তরিকতার সাথে। তারা বিদায় নেয়ার পরই সোহান খন্দকার পুরোপুরি হাঁপ ছাড়লেন৷ একজন বাবার কাছে মেয়ের সুখের চেয়ে বড়ো কোনো প্রাপ্তি থাকতে পারে না৷ তাই তো সৌধর আকস্মিক আগমনে প্রথমে হকচকালেও এখন তার বুকে প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে। কারণ মেয়েটাকে যে আর বুকে পাথর চেপে কিছু মেনে নিতে হবে না৷
অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে গেছে। তিন বন্ধুর কেউই কারো সাথে কথা বলেনি। অতিথি বিদায় নিলে সুহাসই প্রথম মুখ খুলল। তেড়ে এসে সৌধর বুক বরাবর মৃদু ঘু ষি দিয়ে বলল,
‘ মাতলামি করবি না সৌধ। যা করেছিস খুব খারাপ করেছিস। ‘
সুহাসের রাগান্বিত মুখে তাকিয়ে ফিচেল হাসল সৌধ। খুব যত্নসহকারেই এড়িয়ে গেল বন্ধুকে। সম্মুখীন হলো, হবু শশুর মশাইয়ের। দৃঢ় গলায় বলল,
‘ আসছি আংকেল। আব্বার সাথে তো কথা হয়েছেই৷ বাকি কথাও সেরে নেবেন পারিবারিক ভাবে। আমি ভীষণ টায়ার্ড। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিতে হবে। ‘
সোহান খন্দকার এতদিন এই ছেলেকে দেখে শুধু অবাকই হয়েছে। কিন্তু আজ ঝড়ের মতো উড়ে এসে কী শান্ত ভঙ্গিমায় সমস্তটা সামলে নিয়ে বিদায় নিল। চোখের সামনে এমন অমায়িক ঘটনা এবং ঘটনার কেন্দ্রে থাকা মানুষটিকে দেখে মুগ্ধ হলো। তার অনুমতি নিয়ে সুহাস, আইয়াজকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গেল সৌধ। না বন্ধু আর না সিমরান। আপাতত কারো সাথেই কথা বলার প্রয়োজন মনে করল না।
ক্লান্ত দেহে বাড়িতে পৌঁছাল সৌধ। ড্রয়িংরুমে গিজগিজে মানুষ দেখতে পেল। অমনি তার মস্তিষ্ক সজাগ হলো। তার বিয়ের ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে আব্বা। প্রথম সে চোখে পড়ল তার আম্মার। তানজিম চৌধুরী ছেলেকে দেখেই খুশিতে গদগদ হয়ে এগিয়ে এলেন। সৌধর ঘর্মাক্ত কপালে চুমু খেতে একটুও দ্বিধা করলেন না। সন্তর্পণে স্নেহময় একটি চুমু খেয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। সৌধও মায়ের আলিঙ্গন উপভোগ করে শান্ত কণ্ঠে বলে,
‘ মাথা ধরেছে আম্মা। জাস্ট ঘরে যাব, শাওয়ার নিব। এরপর লম্বা ঘুম। ‘
ছেলের অবস্থা বুঝতে পারলেন তানজিম চৌধুরী। সৌধ উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে শুধু দাদুনিকে সালাম দিয়ে শুধাল কেমন আছেন? দাদুনি অদ্ভুত সুরে উত্তর দিল। সৌধ সেসবে খেয়াল না দিয়ে নিজের অবস্থা জানিয়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই শুনতে পেল দাদুনির বলা কিছু কথা,
‘ সুহাসের বোনকে আমার পছন্দ না জানোই বউ মা। তোমরা যদি ওরেই বউ করবা ঠিক করে থাকো। সৌধ যদি নিজের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়। তাহলে ওই মেয়েকে শিখায়, পড়ায় নিয়ো। অতো ফটর ফটর কথা বলা যাবে না৷ চলনবলনেও পরিবর্তন আনতে হবে। ধেই ধেই করে পুরা বাড়ি নাচাও যাবে না। ‘
সিঁড়ির দু ধাপ উঠতেই রেলিং ধরে থেমে গেল সৌধ। ঘাড় বাঁকিয়ে, ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ সুহাসের বোন বোবা না দাদুনি৷ আর তোমার প্রাণপ্রিয় নাতি কোনো বোবা বা খোঁড়া মেয়েকে বউ করে আনছে না। অল্প বয়সী মেয়ে যখন তখন মুখও চলবে, পা দু’টোও দৌড়াবে। তোমার বয়সী হলে এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। নো প্রবলেম।‘
আকস্মিক কথায় দাদুনির চোখ কপালে ওঠে গেল! সৌধ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে গেল নিজের ঘরে।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।