ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৫৪

22 Min Read

গোধূলি বিকেল৷ দু’কাপ চা বানালো ফারাহ৷ সুহাসের ঘরের বেলকনিতে আইয়াজ, সুহাস বসে আছে নিশ্চুপ। চায়ের কাপ দু’টো নিয়ে সেখানেই উপস্থিত হলো সে৷ ভীষণ মাথা ধরেছে সুহাসের৷ আইয়াজের মুখটা এখনো হতভম্ব। চোখের পলকে কতকিছু ঘটে গেল৷ সে নীরব দর্শক হয়েও দোষের ভাগিদার। কেবলমাত্র বন্ধু সৌধর চোখে৷ ফারাহ চা নিয়ে এসেছে দেখে মৃদু হেসে চা নিল৷ সুহাসকে নিতে ইশারা করলে সুহাস চিন্তিত মুখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ সিনু কী করছে? কিছু বলেছে ও? ‘
ফারাহ চা এগিয়ে দিল। সুহাস কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল ধীরস্থির ভাবে। ফারাহ বসল আইয়াজের পাশে। বিনয়ের সুরে বলল,
‘ পোশাক পাল্টে, সাজ ধুয়ে চোখ বুজে চুপচাপ শুয়েছে। ঘুমিয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় ওর একটু সময় দরকার। যা কিছু ঘটে গেল এর জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না ঠিকই৷ কিন্তু সিনু এতে একটুও অখুশি হয়নি। কারণ ওর চোখেমুখে গতকাল থেকে যে বেদনার সুর ভাসছিল সেটা এখন আর নেই। ‘
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস৷ আইয়াজকে বলল,
‘ সৌধকে ফোন কর তো। ‘
আইয়াজ চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বলল,
‘ সরি দোস্ত। আমি ফোন করতে পারব না। তুই কর। ‘
ভ্রু কুঁচকে ফেলল সুহাস। চাপা ক্রোধ প্রকাশে বলল,
‘ আমি করব মানে? ও আমার কথা শুনবে? কোনো কোশ্চেন করলে আনসার দেবে? রাগ দেখাবে, জেদ দেখাবে। আর কিছু বড়োলোকি গালি ছুঁড়বে। ‘
‘ তোর কি মনে হয় আমি সৌধর গুরু? ফোন দিলেই ভক্তির সাথে রিসিভ করবে। কোনো প্রশ্ন করলে গড়গড় করে উত্তর দেবে? ‘
আইয়াজও চটে গেল৷ ওদের দু’জনকে থামালো ফারাহ৷ আইয়াজের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ উফফ চুপ করবে? নিজেদের মধ্যে ঝামেলা পাকাচ্ছ কেন? ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করো সব। ‘
এরপর সুহাসের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ সুহাস ভাইয়া, আমার মনে হয় সৌধ ভাই হুটহাট ডিসিশন নেয়ার মানুষ নন। উনি যখন সিনুকে বিয়ে করার কথা জানিয়েছে। নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই জানিয়েছে। সুজা আংকেল যখন ইনভলভ আমাদের চিন্তা করার কী দরকার? তাছাড়া যেখানে সিনু সৌধ ভাইয়াকে ভালোবাসে। সৌধ ভাইয়াও রাজি হয়েছে। বেশ জোরালো ভাবেই৷ সেখানে এত দুঃশ্চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি। এবার যা করার দু বাড়ির সিনিয়র পার্সনরাই করুক।’
ফারাহর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে সুহাস। ফারাহ কথার সমাপ্তি দিতেই সে বলল,
‘ ও আমার বোনকে ভালোবাসতে পারবে? ‘
ফারাহ বলল,
‘ কেন পারবে না? সিনু অবশ্যই সৌধ ভাইয়ার ভালোবাসা ডিজার্ভ করে। ‘
‘ আমি মেনে নিতে পারছি না। সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। চোখের সামনে ওসব দেখে বোনের স্বামী হিসেবে… ‘
আইয়াজ বিস্মিত গলায় বলল,
‘ ওসব মানে কোন সব দেখেছিস? কী বলছিস তুই? ‘
চমকাল সুহাস। আমতা আমতা করে বলল,
‘ তুই গভীরে নিয়ে গেলি কথাটা৷ আমি সিম্পল ভাবে বলেছি। ‘
আসক্তিহীন কথাটা বলেই ফের তীব্র উত্তেজনা নিয়ে বলল,
‘ সৌধ আর সিনু! ব্যাপারটা কেমন লাগছে না? আমার ছোটো বোনের স্বামী হবে সৌধ৷ আমার শরীর খারাপ করছে ভাবতেই। ‘
আচমকা আইয়াজ দু-হাত বাড়িয়ে সুহাসের দুগাল ধরল। এদিক, ওদিক ঘুরিয়ে ভাবুক কণ্ঠে বলল,
‘ কীরে দোস্ত তুই কি আরো একটা ছ্যাঁকা খেতে চলেছিস? ‘
‘ মানে? ‘
চাপা হাসল আইয়াজ৷ ফারাহ টের পেয়ে মুখ লুকিয়ে হাসল৷ আইয়াজ বলল,
‘ ভাবি সাহেবা ভ্যানিশ হওয়ায় বড়ো মাপের ছ্যাঁকার পাশাপাশি বন্ধুর বউ তোর বোন হবে এটা কি কম ছ্যাঁকা নাকি?’
‘ আইয়াজ! ‘
চোখ রাঙালো সুহাস৷ আইয়াজ কিঞ্চিৎ দূরে সরে গিয়ে হাসতে থাকল। সুহাস রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
‘ মজা নেস? ফারাহ তুমি জানো তোমার সাথে প্রেম হবার আগে আইয়াজ কী করেছে? ‘
‘ কী করেছে? ‘
তীব্র উৎসুকভাব ফারাহর। সুহাস যেন তারই সুযোগ নিল৷ আইয়াজের বিরুদ্ধে নারী ক্যালেঙ্কারির বিস্তর এক বর্ণনা দিল সে৷ ফারাহ চুপচাপ শুনল। এরপর শীতল দৃষ্টিতে তাকালো আইয়াজের দিকে। দু’জোড়া চশমা এক হতেই আইয়াজ থমথমে গলায় বলল,
‘ আমি জানি তুমি বিশ্বাস করোনি ওর কথা। ‘
ফারাহ দৃঢ় গলায় বলল,
‘ তুমি ভুল জানো। আমি সুহাস ভাইকেই বিশ্বাস করেছি। ‘
নিমেষে আইয়াজের মুখটা চুপসে গেল। সুহাস এবার হো হো করে হাসতে লাগল। ফারাহ গোপনে গোপনে হাসলেও গম্ভীর হয়ে রইল প্রকাশ্যে। যা আইজারের বুকের ভেতর বাজনা বাজালো দ্রিমদ্রিম! সে শান্তশিষ্ট, ঝকঝকে হৃদয়ের অধিকারী। কোনো মানে হয় বউয়ের কাছে এভাবে ফাঁসিয়ে দেয়ার? ভেবেই রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। সুহাসের দিকে তাকিয়ে রইল নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে। সুহাস ওর দৃষ্টি খেয়াল করে দাঁত ক্যালিয়ে বলল,
‘ কী মাম্মা তাকাই থাকো ক্যান টাকা পাও নাকি? ‘
আইয়াজ বিরবির করে বলল,
‘ হিটলার কোথাকার! পারবি শুধু আমার সাথে। বউ আর বোন যে বাঁশ দিতেছে ওটা ঠেকাতে পারবি না। ‘
.
.
সন্ধ্যার পর। আচমকা ঘুম ভেঙে গেল সিমরানের৷ ঘুম ভাঙতেই সে আশ্চর্য ভঙ্গিতে ওঠে বসল। অবিশ্বাস্য মনে বলল, ‘ আমি কখন ঘুমিয়েছি? ‘ দেহ সচল হওয়ার পাশাপাশি মস্তিষ্কও সচল হয়ে ওঠল। মনে পড়ে গেল দুপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। সৌধ ভাই! নামটা স্মরণ হতেই শিউরে ওঠল দেহ। ত্বরিত বিছানা ছেড়ে বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি ছিঁটাল৷ এরপর বেরিয়েই সর্ব প্রথম ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে নিজের বন্ধ ফোন বের করে চার্জে ঢুকাল। সন্ধ্যা হয়েছে। সোহান খন্দকার ফারাহকে পাঠিয়েছে সিমরানকে ডাকতে। ফারাহ দরজার বাইরে থেকেই দেখতে পেল সিমরান ওঠেছে। তাই মুচকি হেসে এগিয়ে এলো। বলল,
‘ আংকেল ডাকছে তোমায়। ‘
মৃদুভাবে চমকে ওঠল সিমরান। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল পলকহীন। অনুভব করল, খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে৷ নিমেষে মুখটা করুণ হয়ে গেল। অনুভব করল কতকাল সে কিছু খায় না। ঠিক যেমন বিছানায় শোয়ার আগে অনুভব হচ্ছিল কতকাল সে ঘুমায় না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান। অদ্ভুত গলায় ফারাহকে বলল,
‘ মানুষ একটা কিছু পাওয়ার জন্য কত স্ট্রাগল করেও পায় না৷ হতাশ হয়ে যেই স্ট্রাগল করা বাদ দেয় তখনি সফল হয়। এটা কেমন নিয়ম ফারাহ আপু? ‘
‘ কেমন নিয়ম তা জানি না। শুধু জানি ভালোবাসার স্ট্রাগলে তুমি জিতেছ মেয়ে। সৌধ ভাই তোমার মতো হীরের টুকরো চিনতে ভুল করেনি। ‘
সহসা লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠল সিমরান। সে লজ্জাটুকু আবার নিমেষে হারিয়ে গেল মুখশ্রী থেকে। নরম গলায় বলল,
‘ মোটেই হীরের টুকরো না আপু। আমি নিধি আপুর মতো গুণী মেয়ে নই। সৌধ ভাইয়ের ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য আমার হবে কিনা জানি না৷ কিন্তু এই যে হঠাৎ চমকটা পেলাম। এটার পেছনের কারণ জানা না পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। ‘
‘ আচ্ছা বুঝলাম চলো এবার আংকেল অপেক্ষায় আছে। ‘
নিচে নেমে আসার পর দেখতে পেল সোফায় বসে আছে বাবা, ভাই আর আইয়াজ ভাই। সিমরান বুঝতে পারল তারা কী নিয়ে কথা বলবে। তাই ফারাহকে জিজ্ঞেস করল,
‘ সেলিনা আপা এসেছে? ‘
ফারাহ হ্যাঁ বলতেই বলল,
‘ আমার খুব খিদে পেয়েছে আপু। সেলিনা আপাকে খাবার দিয়ে যেতে বলো এখানেই বসে খাই৷ খেতে খেতে কথা বলি আব্বুর সাথে। ‘
সেলিনা আপাকে বলল না ফারাহ। এমন একটি পরিস্থিতিতে নামীকে ভীষণ প্রয়োজন ছিল। নামী নেই। সে দু’দিনের অতিথি হয়ে এসেছে। তাতে কী? তার দ্বারা যতটুকু সম্ভব হচ্ছে ততটুকুই করবে। ভেবেই নিজেই খাবার বেড়ে আনল। ভাইয়ের পাশে সোফায় দু পা ওঠিয়ে হাঁটু মুড়িয়ে বসল সিমরান৷ কোলের ওপর কুশল রেখে তার ওপর ভাতের প্লেট রেখে খেতে আরম্ভ করল। দৃশ্যটা সোহান খন্দকারের এত ভালো লাগল। মায়াও হলো ভীষণ। কতদিন পর মেয়েটা তার আগ্রহের সাথে খেতে বসছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিল সে৷ এরপর বলল,
‘ মামনি, তোমার আন্টি কল করেছিল। সুজা ভাইয়ের ওয়াইফ। তোমার ফোন নাকি বন্ধ? কথা বলতে চান উনি। খেয়ে কল দিও। ‘
মাথা কাত করল সিমরান। সুহাস ভেবেচিন্তে কথা বলে না। আর না তার কথাগুলো গুছাল হয়। তাই সে ফটাফট প্রশ্ন করল,
‘ তুই এখনো সৌধকে বিয়ে করতে চাস? ভেবে উত্তর দিবি। ‘
সুহাস বোনকে ভীষণ আদর করে। অন্যান্য ভাই বোনের মতো তারা সব সময় তুই তুকারি করে না। বেশিরভাগ তুমি করেই বলে। কেবল রেগে বা সিরিয়াস মুহুর্তে তুই বলে। অর্থাৎ সুসাহ এখন হয় রেগে আছে নয়তো সিরিয়াস আছে৷ টের পেল সিমরান। সোহান খন্দকার বলল,
‘ আহ হা এ আবার কেমন প্রশ্ন সুহাস। উত্তরটা কি তুমি জানো না? ‘
সিমরান ভাইয়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে খেতে খেতেই বাবার দিকে তাকাল। শান্ত দৃষ্টি। সোহান খন্দকারও মেয়ের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করল আবার। সিমরান বলল,
‘ আমার উত্তর না হবে না। পারিবারিক ভাবে তোমরা কথা আগাও। আমি সৌধ ভাইয়ের সঙ্গে বাকি কথা পার্সনালি বলে নিব। ‘
বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সুহাস৷ তার বোনকে বড়ো বড়ো লাগছে৷ এই যে কথাগুলো বলল, মনে হলো কত জ্ঞানী একটা মেয়ে। অথচ বোন তার ছোটো। কত ছোটো? অনার্স তৃতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। বয়স বাইশ চলছে। সে এমন উত্তর দিতেই পারে। কিন্তু সুহাস মেনে নিতে হিমশিম খেলো। পরোক্ষণেই ভাবল, বোন আসলে বড়ো হচ্ছে। ধীরেধীরে আরো হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম যা তাকে মেনে নিতে হবে৷ কিন্তু সৌধকে কীভাবে মানবে? ও বন্ধু হিসেবেই ঠিক। বোন জামাই হিসেবে কি ঠিক? সৌধ ভীষণ রাগি। ওর চলন বলন আর সিমরানের চলনবলনে পার্থক্য অনেক। সহজ কথায় দু’জন ঠিক মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। মনের গভীর ভাবনা গুলো প্রকাশ করল সুহাস বলল,
‘ সৌধর সঙ্গে তুই মানিয়ে নিতে পারবি না সিনু। ও আর তুই সম্পূর্ণ আলাদা। তোদের ভাবনা, চিন্তা, চলাফেরা সব আলাদা। ও অনেক ম্যাচিওরড। তুই ওর পর্যায়ে ম্যাচিওর না। ভয়টা আমার এখানেই। তোদের দু’জনের মিলবে না। নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হবে। ‘
সুহাসের এহেন বক্তব্যে প্রথম বিরোধীতা করল সোহান খন্দকার,
‘ ও কী পারবে না পারবে তা তুমি কী করে বলে দিতে পারো? ‘
‘ ও আমার বোন। আর সৌধ আমার বন্ধু। আমি দু’জন সম্পর্কেই জানি বাবা। ‘
‘ আমি তোমার সম্পর্কেও জানি। সিনু অন্তত তোমার মতো গর্দভ নয়। ‘
সহসা চুপ হয়ে গেল সুহাস। তখন আইয়াজ ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ আমি যদি বলি ওরা মুদ্রার এমপি ওপিঠ বলেই ওদের কম্বিনেশন দারুণ হবে। যা নিধির সাথে হয়ে ওঠত না। ‘
সুহাস হঠাৎ রেগে গেল। সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। বহু বছর একটা মেয়ের প্রতি দুর্বলতা ছিল সিনু। আজ তোর এসব গায়ে লাগছে না৷ বিয়ের যে লাগবে না তার গ্যারান্টি কী? আমি তোকে কোনোভাবেই কষ্টে দেখতে পারব না৷ তোর হাজব্যন্ড তোকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে এটা দেখে শান্তি পেতে চাই আমি। ‘
সিমরান চুপচাপ রইল কিছুক্ষণ। তাকাল বাবার দিকে। সোহান খন্দকার ভরসার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তবু কথাগুলো বলতে লজ্জা পেল সে। না বলে উপায়ও নেই। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ তোমার বন্ধু যখন চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসে তোমার বোনের এনগেজমেন্ট বরবাদ করেছে। তখন বিয়ের পর তোমার বোনকে ভালোবাসতেও পারবে৷ আর বললে নিধি আপুর কথা? আমি নিধি আপুর বিষয়ে জানার বহু আগে থেকে সৌধ ভাইকে ভালোবাসি। আমার পছন্দ, আমার ভালোবাসা, আমার সিদ্ধান্ত ঠুনকো নয়। এটার প্রমাণ এতদিন না পেলেও আজ পেয়েছি। যদি এক্সিডেন্টলি, আমি আমার হাজব্যন্ডের ভালোবাসা না পাই তাহলেও কখনো কষ্ট পাবো না। সারাজীবন তো আমি এটা নিয়েই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব আমাকে আজ জীবিত মৃত হওয়া থেকে উদ্ধার করেছে সে। ‘
একদমে কথাগুলো বলে নিঃশ্বাস ছাড়ল সিমরান। সোহান খন্দকার মেয়ের কথা শুনে আপ্লুত চোখে তাকিয়ে রইল। সুহাস বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। আইয়াজ মনে মনে বলল,
‘ পারফেক্ট। সৌধ তো এমন কাউকেই ডিজার্ভ করে। কে বলেছে সৌধ সিনুকে ভালোবাসতে পারবে না? আমি কাগজে লিখে দিতে পারি একদিন সৌধ সিনুকে এতটাই ভালোবেসে ফেলবে যে ও নিজের প্রতিই নিজে অবাক হয়ে থাকবে! ‘
সিমরানের খাওয়া শেষ হলো ইতিমধ্যেই। সোহান খন্দকার সুহাসকে বলল,
‘ আগামী বাইশ সেপ্টেম্বর সৌধর জন্মদিন। দু’দিন ছুটিও আছে শুনলাম। হুট করে এসেছে তাই চলে যেতে হবে ওকে। একুশ তারিখ আসবে আবার। বাইশ তারিখ ওদের এনগেজমেন্ট হবে। এর পরের মাসে বিয়ে। আমাদের সিদ্ধান্ত এটাই। তোমার কিছু বলার আছে? ‘
‘ আমার বলার থাকলেই শুনছে কে? ‘
কপট রাগ দেখিয়ে সুহাস এ কথা বলতেই বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধুতে ধুতে সিমরান বলল,
‘ সুহাস খন্দকারের অনুমতি না পেলে বিয়েই করব না৷ ‘
সুহাস অদ্ভুত ভাবে ভেঙচি কাটল বোনকে। বলল,
‘ আর ভালোবাসা দেখাতে হবে না। বোন খুশি থাকলেই সুহাস খুশি। ‘
ঠোঁট টিপে হাসল সিমরান৷ সুহাস বোনের থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আইয়াজকে বলল,
‘ তোর বন্ধুকে বলে দিস, আমার বোনকে খুশি রাখতে হবে, সুখী করতে হবে। এর হেরফের হলে দেখে নিব আমি। ‘
আইয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ সে কী! সৌধ আমার একার বন্ধু? ‘
ফারাহ খোঁচা দিল আইয়াজকে। ফিসফিস করে বলল,
‘ আহ বলুক না। তুমি তর্ক দিও না। ‘
সোহান খন্দকার প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ কথা তাহলে ঠিকঠাক। সৌধ কাল চলে যাবে। বাকি কথা সেরে ফেলি সুজা ভাইয়ের সাথে। কী বলো সুহাস? ‘
নিচু কণ্ঠে সুহাস উত্তর দিল,
‘ ওকে। ‘
.
.
ন’টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে মাত্র ওঠল সৌধ। ফোন বাজছে তার৷ স্ক্রিনে তাকাতেই দেখল, ‘সিনু’। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ওঠে ফোন কেটে দিল সে। আড়মোড়া ভেঙে ওঠে গেল বাথরুমে। হাতমুখ ধুয়ে খিদে খিদে টের পেল। রুম ছেড়ে বেরুতেই দেখল তার কাজিনরা নিচে মিটিং করছে। কিসের মিটিং হতে পারে বুঝেই বিরক্ত হলো। যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই মতোন অবস্থা। দূর সম্পর্কের দু’জন কাকাত ভাই। আর ফুপাত ভাই, বোন রয়েছে সেখানে। ছোট্ট তাহানীও আছে। সে ধীর পায়ে নিচে নামতেই সবার কণ্ঠ নিচু হলো। মুখে লেপ্টে রইল মৃদু মৃদু হাসি। দূর সম্পর্কের কাকাত দুই ভাইয়ের নাম, শেখ সাদি ছোটো করে সবাই সাদি নামে ডাকে। আরেকজনের নাম, সালমান। ফুপাত ভাই শান আর ফুপাত বোন উর্মিও রয়েছে। সবাই বয়সে ছোটো। সাদি অনার্স ফোর্থ ইয়ার। সালমান ফার্স্ট ইয়ার। শানও ফোর্থ ইয়ার শুধু উর্মি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। সামনে সৌধ ভাইয়ের এনগেজমেন্ট এরপর বিয়ে৷ সেই নিয়েই তাদের উত্তেজনা এবং পরিকল্পনা চলছিল। যা সৌধ আসাতে ক্ষ্যান্ত দিল। সৌধ তার আম্মাকে ডাকল,
‘ আম্মা খেতে দিন৷ খিদে পেয়েছে। ‘
তাহানী ছুটে গেল বড়ো মায়ের কাছে। এরপর আম্মা এসে ছেলেকে খেতে দিল৷ খাওয়া শেষে সৌধ ভাই, বোনদের সাথে বসল কিছুক্ষণ। সবার পড়াশোনা কেমন চলছে? সাদি আর সালমান রাজনীতিতে যুক্ত৷ মূলত এজন্যই এ বাড়িতে তাদের আনাগোনা বেশি। চাচা এমপি কিনা…। তাই তাদের থেকে রাজনীতির খবরাখবরও নিল। এরপর আম্মাকে বলল, কাজের মেয়েকে দিয়ে তার ঘরে এক মগ কফি পাঠাতে৷ কাল ভোরে চলে যেতে হবে তাকে। তাই যতটুকু পারা যায় বিশ্রামে থাকবে এখন। নিজের ঘরে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। কাজের মেয়েটা কফি দিয়ে গেলে কফির মগ হাতে চলে গেল বেলকনিতে। পকেটে ফোন ছিল। ফোন বের করে কফি খেতে খেতে কল করল সিমরানের ফোনে। রিসিভ হতে সময় নিল না। শুনতে পেল মিহি কণ্ঠের রমণীর চার শব্দের বাক্যটি,
‘ তুমি ব্যস্ত সৌধ ভাই? ‘
তখন ফোন কেটে দিয়েছে বলেই শুরুতে এমন প্রশ্ন। সৌধ সে উত্তর না দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ ফোন অন না করলেও সমস্যা ছিল না। ফোন বন্ধ করাতে আমার বিন্দু পরিমাণও সমস্যা হয়নি। ‘
নিমেষে বুকের ভেতর মৃদু এক চাপ অনুভব করল সিমরান। সৌধ ভাই ফোন করেছিল তাকে?কতবার করেছিল? ইশ! মনটা খচখচ করে ওঠে। বলে,
‘ রাতে হঠাৎ ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর মন এত খারাপ ছিল যে চার্জ দেয়ার আগ্রহ পাইনি। সরি আমি। ‘
কফির মগে চুমুক দিল সৌধ। এরপর উত্তর দিল,
‘ ফোনের চার্জ কখনো হঠাৎ শেষ হয় না। আস্তেধীরেই হয়। যাক সে কথা, কী জন্য ফোন করেছিস সেটা বল। ‘
ঠোঁট কামড়াল সিমরান৷ একটু ভাবুক হলো যেন। এরপর বলল,
‘ তুমি হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলে? ‘
‘ জানি না। ‘
হতভম্ব হয়ে গেল মেয়েটা। এ আবার কেমন উত্তর? কেন জানো না আর জিজ্ঞেস করল না। যদি বেয়াদবি ধরে নেয়? তাই বলল,
‘ আচ্ছা। মন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছ? ‘
‘ অভিনয় আমি জানি না। মনে না এলে কিছু করা সম্ভব হয় না আমাকে দিয়ে। ‘
আচমকা চোখ দু’টোয় ঝলমলে হাসি খেলা করল সিমরানের। নরম গলায় ফের প্রশ্ন করল,
‘ আমাকে তো ভালোবাসো না তাই না? ‘
‘ না। ‘
‘ পছন্দ করো? ‘
‘ হু। ‘
‘ পারিবারিক বিয়ে তো পছন্দতেই হয় তাই না? ‘
‘ হ্যাঁ। ‘
এ পর্যায়ে সিমরান একটু রয়েসয়ে প্রশ্ন করল। এগুলোকে অবশ্য প্রশ্ন বলা যায় না৷ পরীক্ষা বলা চলে। সেই সঙ্গে নিজের ব্যাপারে সবটাই প্রকাশ করা বলে। কারণ সে নিধি আপুর মতো পারফেক্ট গার্ল না। সৌধ যেমন সঙ্গিনী চাইত সে তেমনও না। দু’টো মানুষ একসঙ্গে থাকতে হলে নিজেদের পছন্দ, অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়। তাই বলল,
‘ তোমার বউ হলে তার মাঝে কী কী গুণ থাকতে হবে বলবে? ‘
‘ কেন? ‘
‘ আসলে আমি তো অনেক কিছুই বুঝি না, পারি না। শুধু এটুকু বুঝে গেছি শুধু ভালোবাসতে পারলেই কারো বউ হয়ে ওঠা সম্ভব না৷ ‘
‘ তোর বেলায় আমার বউ হওয়া সম্ভব। ভালোবাসাটাই যথেষ্ট। ‘
সহসা বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠল সিমরানের। বুকে ধুকপুকানি নিয়ে বলল,
‘ আমি এতটাই গুণহীন যে মেয়ে হয়েও শাড়ি পরা শিখিনি। ‘
‘ দরকার নেই তো। খুব দরকার পড়লে আমি শিখে নিব। ‘
বিস্ময়ে টালমাটাল সিমরান। নিঃশ্বাস আঁটকে ফের বলল,
‘ রান্নাবান্না পারি না আমি। ‘
‘ পৃথিবীর সব পুরুষকে রাঁধতে জানা মেয়ে বিয়ে করতে হবে। এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ‘
‘ ঠিকঠাক কোনো কাজই পারি না। ‘
‘ আমার বউ কাজ না পারলেও চলবে। আমাকে ভালোবাসাই তার একমাত্র কাজ। ‘
‘ জামাকাপড়ও পরিষ্কার করতে পারি না। ‘
‘ ঘর ভর্তি মেইড এনে দিব। তবু এসব ভেল্যুলেস টপিক নিয়ে মাথা ঘামাস না। রাখছি। ‘
চমকে ওঠল সিমরান৷ ত্বরিত শুধাল,
‘ তোমার কোনো প্রশ্ন নেই? ‘
‘ কেন থাকবে? তোর সম্পর্কে কী জানি না আমি? ‘
মিইয়ে গেল সিমরান। নিচু কণ্ঠে বলল,
‘ আচ্ছা রাখি। ‘
বলেই ফোন কটে দিয়ে মনে মনে বলল,
‘ আমি সব শিখে নিব সৌধ ভাই। শাড়ি পরা, রান্নাবান্না সব। বিনিময়ে সারাজীবন তোমার বুকে ঠাঁই চাই৷ আমি ভালোবাসি তোমাকে, ভীষণ ভালোবাসি। যতখানি ভালোবাসলে তোমাকে হারানোর বেদনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ততখানি ভালোবাসি। ‘
.
.
সিমরান ফোন রাখার পর। সৌধ কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে ম্যাসেন্জারে ঢুকতেই দেখতে পেল তার এক বন্ধু কিছু ম্যাসেজ এবং ফটো পাঠিয়েছে। বন্ধুটির এয়ার লাইনে নতুন জব হয়েছে। ছবিতে দেখতে পেল, নিধি আর নামীকে। নিধির কোলে তার ছোট্ট ছেলে। কয়েকটা ছবি দিয়ে বন্ধু লিখেছে,
‘ নিধি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড না? দেখা হয়েছিল একবার তোদের সাথে। তাই দ্বিতীয় দেখায় চিনে ফেলেছি। বিয়ে হয়ে গেছে ওর। বেবিটা কী কিউটরে। ‘
সৌধর কপালে ভাঁজ পড়ল তৎক্ষনাৎ। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাসেজ দিল,
‘ ওদের কোথায় পেলি? ‘
‘ নিধির পাশের মেয়েটার নাম নামী৷ নিধির ফ্রেন্ড বলল। আমেরিকার পারি দিল গতকাল। ওকেই বিদায় দিতে এসেছিল। পিএইচডি করতে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ফ্লাইটে ওঠার আগে রেষ্টুরেন্টে বসেছিল কিছুক্ষণ। সেখানেই দেখা। ‘
উত্তর পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল সৌধ। নামী চলে গেছে দেশ ছেড়ে? সুহাসকে ছেড়ে? এতবড়ো ঘটনা কীভাবে ঘটাল মেয়েটা? সত্যি মেয়েটার দম আছে। কিন্তু কাজটা কতটুকু সঠিক হলো বুঝতে পারল না সৌধ। আর নিধি? মেজাজ বিগড়ে গেল নিমেষে। নিধি তাকে না জানাক অন্তত সুহাস, আইয়াজকে জানাতে পারত ব্যাপারটা। বিতৃষ্ণায় বুকটা ভার হয়ে ওঠল। ভাবল সুহাসকে ফোন করে বিষয়টা জানাবে। পরোক্ষণেই মত ঘুরালো। সে দেখতে চায় নিধি নিজে থেকে সুহাসকে জানায় কিনা। নামী তো চলেই গেছে। সুহাস জানতই যাবে। আলাদা করে এখনি জানানোর দরকার নেই। আপাতত অপেক্ষা নিধির মধ্যে বন্ধুত্ব কতটুকু বেঁচে আছে৷ সেটা দেখার। আবার ভাবল,
নামী কি নিধিকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে গেছে? তাহলে তো হয়েই গেল। নীতিবাদী নিধি মরে গেলেও মুখ খুলবে না। পারলে চোখ দু’টোও বুজে থাকবে। বন্ধুত্ব রসাতলে যাক। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। আকাশে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। প্রকৃতি চন্দ্রিমায় ভরা। হাসছে যেন প্রকৃতি৷ এত হাসছে কেন চাঁদের মেয়ে চন্দ্রিমা? মুহুর্তেই সিমরানের কথা মনে পড়ল ওর। সিমরানের মুখটি এই চন্দ্রিমার মতোই স্নিগ্ধ, আদুরে৷ আজ বুঝি চন্দ্রিমার মতোই হাসছে সে? হাসবে না? মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকে পাওয়ার সম্ভাবনায় এভাবেই তো হাসে৷ সে হাসি হয় স্নিগ্ধ, নরম রাতের আকাশে চন্দ্রিমার মতোই নিগূঢ় আদুরে।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।