হসপিটাল কোয়াটার৷ নিজের ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে বসে আছে ডক্টর. অর্পণ শিকদার। অবসর সময় গুলো বই পড়ে কাটায় সে৷ বাবা হওয়ার পর থেকে বই পড়ার সময় হয়ে ওঠে না তেমন৷ অবসর পেলেই ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ ছেলে এবং ছেলের মা। কেউই বাসায় নেই। বেড়াতে গিয়েছে। সেও কর্মহীন। তাই বই নিয়ে বসেছে। তার মা অপরূপা শিকদার। এক কাপ দুধ চা নিয়ে ছেলের কাছে এলেন৷ পাশে বসে চা হাতে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘ বউ মা কখন আসবে? ‘
এক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে অপর হাতে চোখের চশমা খুলল অর্পণ। কোলের ওপর রাখা বইয়ের ওপর চশমা রেখে মৃদু হেসে বলল,
‘ অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছে৷ একটু দেরি হবে বোধহয়। ‘
অপরূপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলের দিকে থম মেরে তাকিয়ে থেকে ওঠে গেলেন নির্লিপ্ত ভাবে। এ জীবন ভালো লাগে না তার৷ বেঁচে থাকতে ছেলের সুখ দেখে যেতে পারবে কিনা জানে না। সন্তান হয়ে গেল। তবু ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলো না। বিয়ে করল, সন্তান হলো। অথচ সংসার হয়ে ওঠল না। সংসারটা যেন ভাসমান পানা। ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে যতটা সংশয় তার চেয়েও অধিক সংশয় এখন নাতিকে নিয়ে৷ অর্পণ চুপচাপ চা পান করছে। তার মা নিজের ঘরে গিয়ে সব সময়ের মতো দুঃশ্চিন্তা করছে তার পরিবার নিয়ে। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠল৷ মৃদু চমকে ওঠে দাঁড়াল অর্পণ। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই নিধির ফ্যাকাশে মুখের দেখা মিলল। ঘুমন্ত অনিরূপকে জড়িয়ে ধরে বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার বউ। সহসা হাত বাড়াল সে। বিনাবাক্যে অনিরূপকে কোলে তুলে দিল নিধি। অর্পণ ছেলেকে বুকে আগলে নিয়ে সরে দাঁড়াল। নিধি নিশ্চুপ ভেতরে ঢুকে দরজা আঁটকে চলে গেল নিজের ঘরে৷ বরাবরই মুখে আঁধার নামিয়ে থাকে নিধি। কালেভদ্রে যদিও হাসি দেখা যায়। তা শুধু অনিরূপের সঙ্গেই। আজ বন্ধুদের সাথে দেখা করে এলো। সেখানে নিশ্চয়ই সৌধ ছিল। নিশ্চয়ই তাকে দেখে মনের মধ্যে থাকা অপরাধবোধ গাঢ় হয়েছে? মনে মনে ধারণা করে ছেলেকে নিয়ে বেডরুমে গেল অর্পণ। দেখতে পেল বিছানার একপাশে মলিন মুখে বসে নিধি। সে ঘরে যেতেই ত্বরিত ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছল৷ এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল অনিরূপের বিছানা গুছাতে। বিছানা গুছানো শেষ হলে অর্পণ শুইয়ে দিল অনিকে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠে অনিরূপ। তাকে সামলাতে বাইরের পোশাকেই শুয়ে পড়ে নিধি। ছেলেকে বুকে টেনে নেয়। মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে ফের ঘুমের দেশে ফিরে যায় অনি৷ অর্পণ কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় ড্রয়িংরুমে। আধঘন্টা পর যখন নিজের ঘরে ফিরে দেখতে পায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে নিধি। যে কান্না তাকে দেখে থেমে যায়। ধাতস্থ হয়ে ওঠে নিজের কাপড়, তোয়ালে নিয়ে ঢুকে পড়ে বাথরুমে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্পণ। ছেলের পাশে গিয়ে বসে। হাত বাড়িয়ে নিষ্পাপ বাচ্চাটার মাথায় আলতো করে স্পর্শ করে। বিরবিরিয়ে বলে,
‘ তোর বাবা, মায়ের সংসারটা আর হলো না অনি৷ তোর মুখ চেয়ে আমি কিছুই করতে পারছি না৷ জোর করে সংসার নামক মায়াজালে আর আঁটকে থাকতে ইচ্ছে করে না। ‘
.
.
মাগরিবের আজান দিয়েছে। প্রকৃতির আবছা আলোয় সৌধর গাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষা করছে সে। অভিমানী তরুণীর অপেক্ষা। গাড়ি পর্যন্ত কাজিনরা এগিয়ে দিল সিমরানকে। হবু দুলাভাইয়ের সঙ্গে আলাপও করে গেল। গাড়ির দরজা খুলে বসে ছিল সৌধ। সিমরান ওঠে এসে বসল তার পাশে৷ দরজা লক করে সম্মুখে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ বসে রইল। সৌধ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। এরপর লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে ড্রাইভারকে বলল,
‘ চলুন। ‘
ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলে নড়েচড়ে বসল সিমরান। তার পরনে হালকা গোলাপি রঙের ঢিলেঢালা জর্জেটের সেলোয়ার-কামিজ। বাদামি বর্ণ চুলগুলো পেছন দিকে উঁচু করে তুলে ঝুঁটি বাঁধা। মুখে কোনো প্রসাধনী মাখেনি। আর না ঠোঁটে ছুঁইয়েছে লিপস্টিক।
দু’কাধে ওড়নার দুই কোণা তুলে বুক ঢেকে রেখেছে। খুব সাধারণ, শালীন বেশ। সবই ঠিকঠাক। ঠিক নেই শুধু সিমরানের মুখ। এত ব্যস্ততার ভীড়ে সময় দিচ্ছে এই হাঁড়ির মতো মুখ দেখার জন্য? ভ্রু কুঁচকে রইল সৌধ। গাড়ি চলছে। সিমরান তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। এসি চলছে। তাই কাঁচ নামানো নেই। সৌধ জিজ্ঞেস করল,
‘ কোথায় যাবি? ‘
সিমরান সব সময় যেখান থেকে কেনাকাটা করে সেখানের নাম বলতেই ড্রাইভার সেদিকে গাড়ি ঘুরালো। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই সৌধ পুনরায় প্রশ্ন করল,
‘ আমি আজ তোকে বকিনি। একটা সাধারণ বিষয়, সাধারণ একটা কথা। এরজন্য এভাবে মুখ ভাড় করে রাখলে বিষয়টা আমার জন্য বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তুই বাইরের কোনো মানুষ না। খুব তাড়াতাড়ি আমার ব্যক্তিগত মানুষ হতে যাচ্ছিস। তোর সঙ্গে আমার সব ধরনের সম্পর্ক তৈরি হবে। প্রয়োজনে বকতে পারি৷ চার, পাঁচটা ধমক দিতে পারি। প্রয়োজনে মানুষ সবকিছুই করে। আর আমি মানুষটা অপ্রয়োজনে থুথুও ফেলি না। তখন যদি রাগ দেখিয়েও থাকি, চোখ রাঙিয়েও থাকি। সেটা প্রয়োজনীয় ছিল। এরজন্য মুখ ভাড় করে কী বোঝাতে চাইছিস? কী চাচ্ছিস? আমি সরি হই এটা চাচ্ছিস? যদি এটা তোর উদ্দেশ্য হয় তাহলে এক্ষুনি তুই আমার প্রতি সরি হবি। কারণ, আমি ভুল করিনি। অযথা, অন্যায় ভাবেও কিছু বলিনি। ‘
অভিমান হয়েছিল। এখনো ছিল৷ কিন্তু সৌধ ভাইয়ের কথাগুলো শুনে ধুকপুক করে ওঠল বুক। সে কি সত্যি সৌধ ভাই দুঃখীত হোক চাচ্ছিল? একদমই না৷ কিন্তু তার খুব অভিমান হয়েছিল। এখনো হচ্ছে। তাই বলল,
‘ তুমি সরি হও চাইনি আমি। ‘
‘ তাহলে কী চাচ্ছিস? ‘
‘ কিছু না৷ একটু মন খারাপ হয়েছিল। ‘
‘ কেন? ‘
মনে মনে সিমরান বলল,
‘ বলব না৷ বললে তুমি আমায় ভুল বুঝবে। নিধি আপুর প্রতি তোমার চোখে অদ্ভুত মায়া আমায় তীব্র কষ্ট দিচ্ছিল৷ ‘
মুখে বলল,
‘ তখনকার প্রশ্নের উত্তর পাইনি বলে। ‘
‘ কেন দেইনি? ‘
দৃঢ় কণ্ঠ সৌধর৷ সিমরান ঢোক গিলে বলল,
‘ বেডরুমে ছিলাম না তাই। ‘
অকস্মাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সৌধ। সিরিয়াসলি? পরোক্ষণেই আবার ভাবল, হ্যাঁ সিরিয়াসলি। সুহাসের বোন বলে কথা। হালকা কেশে ওঠল সৌধ। গলা পরিষ্কার করে বলল,
‘ তোর প্রশ্নটা কী ছিল? ‘
সহসা সৌধর পানে তাকাল সিমরান। মৃদু আলোয় সৌধর ভারিক্কি চোয়াল, সুগভীর দৃষ্টিদ্বয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ তুমি এখনো নিধি আপুকে ভালোবাসো? ‘
‘ যদি না বলি মিথ্যা হবে। যদি হ্যাঁ বলি তুই কষ্ট পাবি। আমি তোকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি না। ‘
বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠল সিমরানের। সৌধ ভাই বলল, তাকে কষ্ট দিতে চায় না। তাই উত্তরটা বুঝতে পেরেও সুপ্ত ক্লেশপূর্ণ অনুভূতিটুকু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সচেতন ভাবে। যেন পাশের মানুষটা টের না পায় ভালোবাসার মানুষটি অন্য কাউকে এখনো ভালোবাসে কিনা প্রশ্নটি করেই নিঃশ্বাস আঁটকে ছিল সে। এত সচেতন হয়েও লাভ হলো না। সৌধ স্পষ্ট শুনতে পেল সেই নিঃশ্বাসের শব্দ। তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি যে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি প্রখর। তা বোধহয় পাশের রমণীটি জানে না৷ ভেবেই মনে মনে হাসল কিঞ্চিৎ।
শপিংমলের সামনে গাড়ি থেমেছে। সৌধ ড্রাইভারকে নেমে দাঁড়াতে বলে। ড্রাইভার নেমে গেলে সিমরানও দরজা খুলতে উদ্যত হয়। সৌধ বাঁধা দেয়। তার পুরুষালি বলিষ্ঠ হাতের বাঁধা পেয়ে চমকে যায় সিমরান। হকচকিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। সৌধ একপেশে হেসে তার ফরসা নরম হাতটা টেনে কাছে নেয়। বা’হাতের অনামিকায় পরিয়ে দেয়া রিংটাতে দৃষ্টি স্থির রেখে শীতল কণ্ঠে বলে,
‘ হবু স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা মেনে নেয়া যন্ত্রণার৷ এটুকু যন্ত্রণা তোর প্রাপ্য ছিল সিনু। জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিস। একটু তো পুড়তেই হবে। ‘
এ পর্যন্ত বলেই নিজের দু’টো উষ্ণ হাতে সিমরানের বা’হাত জড়িয়ে রাখল। একটুখানি গা ঘেঁষেও বসল। সিমরান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা নিয়ে বসে। সৌধ ওর নরম হাতটা নিজের হাত দ্বারা জড়িয়ে। গভীর দৃষ্টিতে সেখানেই তাকিয়ে তাকিয়ে বলতে লাগল,
‘ একটি সত্যি কথা শুনবি? ‘
‘ হু? ‘
‘ আমি আমার প্রথম প্রেম হারিয়ে যে যন্ত্রণায় ভুগছিলাম। সেই যন্ত্রণা ক্ষীণ হয়ে এসেছে তোর যন্ত্রণা অনুভব করে। এই যে প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছিস, একটু একটু করে পুড়ছিস। এরজন্য ভিতর থেকে আমি খুব সরি হচ্ছি তোর প্রতি। ‘
একটুখানি চমকাল সিমরান। দু-চোখে ভর করল কিঞ্চিৎ বিস্ময়। সৌধ একটু থেমে পুনরায় বলল,
‘ সিনু, ভালোবাসা অন্যরকম এক অনুভূতি। এই অনুভূতি সহজে কারো প্রতি আসে না। আর যদি সহজে এসে যায়। তা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না৷ যদি সম্ভব হয় তাহলে ওটা ভালোবাসা না ক্ষনিকের মোহ। নিধি আমার মোহ ছিল না। ওকে আমি খুব সহজেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। একদম হুট করে। সবচেয়ে বড়ো কথা ভালোবাসার ঊর্ধ্বে আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। অনেক ঘনিষ্ঠ মুহুর্তও ছিল আমাদের! রাগ করি, যাই বলি ওকে ভুলা ওকে ভালো না বাসা আমার পক্ষে সম্ভব না। তার মানে এই না আমি দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারব না। ‘
এ পর্যায়ে সিমরানের চোখের দিকে তাকাল সৌধ। ধীরে ধীরে মেয়েটার চোখ ঝাপসা হয়ে এলে ত্বরিত দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ধরে রাখা হাতটা আরো গভীর করে ধরল। একটু শক্তভাবে। এরপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ আমি দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারব এই বিশ্বাস টা কবে থেকে হয়েছে জানিস? যেদিন ছোটো কাকুর বাংলোতো তোকে প্রত্যাখ্যান করে এলাম, সেদিন থেকে। তোর চোখ দু’টোতে তাকিয়ে যখন আমার বুক কেঁপে ওঠল। আমি বুঝে গেলাম, তুই আমাকে অসম্ভব ভালোবাসিস। তুই ব্যতীত আর কেউ আমাকে এভাবে ভালোবাসতে পারবে না। যুক্তি, তর্কের বাইরে গিয়ে বলছি, একটা মানুষ যদি ভেতর থেকে অনুভব করতে পারে অপর মানুষটি ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ তাকে এতবেশি ভালোবাসতে পারবে না। তাহলে নিঃসন্দেহে ওই মানুষটাই তার যোগ্য। বিকজ, সবাই এটা অনুভব করাতে পারে না। সে ছাড়া কেউ তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতে পারবে না। এই অনুভূতি যাকে ঘিরে তৈরি হয়৷ মানুষের উচিত তাকে আঁকড়ে ধরা। হারাতে না দেয়া। ‘
সিমরানের ধরে রাখা হাত দু’টো থেকে একটা হাত সরিয়ে নিল সৌধ। এরপর সে হাত নিজের বুকের বা’পাশে চেপে ধরে সিমরানের ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
‘ ট্রাস্ট মি. নিধির চোখে আমি সেই ভালোবাসা দেখিনি। এত বছর ওর সঙ্গে মিশেও আমি অনুভব করিনি ওর মতো কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। বরং ও সব সময় আমার প্রতি নির্লিপ্ত ছিল। কখনো কখনো মনে হতো গোপনে ভালোবাসে। বিয়ে করলেই পুরোপুরি প্রকাশ করবে। কখনো মনে হতো স্রেফ বন্ধুত্বটুকুই। আজ আমার জীবনে নিধির অস্তিত্ব ধোঁয়ার মতো। দীর্ঘসময় আগুন জ্বলার পর আগুন নেভালে যে ধোঁয়া ওঠে সেই ধোঁয়ার মতো। তুই সেই পানি যা আমার হৃদয়ে নিধি নামক আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছে। বাকি রয়েছে ধোঁয়া। এই ধোঁয়াটুকু যতদিন থাকবে। তোর কষ্ট ঠিক ততদিনই। এরপর হয়তো আর কষ্ট পাওয়ার সুযোগ পাবি না৷ সিনু, আমার তোকে চাই। তোর ভালোবাসা চাই আমার। বিনিময়ে আজন্ম সুখ দেব। অভিযোগ করার সুযোগ দিব না। আমি জানি না দ্বিতীয় বার হাঁকডাক করে বলতে পারব কিনা আমি ভালোবাসি। শুধু জানি আমি ভালোবাসতে পারব। কারণ প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ সব রহস্যই ভেদ করেছি আমি। ‘
দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল সিমরানের। কয়েক ফোঁটা অশ্রু পড়ল সৌধর হাতের পিঠে। অশ্রু স্পর্শে হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হলো সৌধর। গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সিমরানে অশ্রুসিক্ত রক্তিম মুখশ্রীতে। ওভাবে কত সময় কাটল তা বেহিসেবী। ঘোর কাটল ফোনের রিংটোনে। সৌধর ফোন বাজছে। নাক টেনে মুখ ঘুরিয়ে রইল সিমরান৷ সৌধকে বিচলিত দেখাল না৷ যেন ফোনের আওয়াজ সে শুনতেই পায়নি৷ এমন ভঙ্গিতে বলল,
‘ এদিকে ঘোর। ‘
সিমরান মুখ ফেরায়। সৌধ একহাতে ওর গাল বেয়ে পড়া অশ্রু মুছে পকেট থেকে টিস্যু বের করে দেয়। এরপর ধরে রাখা হাতটা একটু উঁচু করে ধরে প্রশ্ন করে
‘ এখনো ব্যথা আছে? ‘
সিমরান দু’দিকে মাথা নেড়ে না বোঝাল। দুপুরে যেখানটায় ব্যথা পেয়েছিল ওখানটায় বার বার আঙুল বুলাচ্ছে সৌধ। আকস্মিক উষ্ণ স্পর্শ পেতেই সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাতেই সৌধ মাথা তুলে। হাত ছেড়ে দিয়ে বাঁকা হেসে ভারিক্কি গলায় বলে,
‘ এনি প্রবলেম? ‘
ঢোক গিলে সিমরান৷ লজ্জায় আরক্ত মুখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়৷ বুকের গহীনে দ্রিমদ্রিম শব্দে তরঙ্গ বইতে শুরু করে। মনে মনে বলে,
‘ তুমি একজন পারফেক্ট হার্ট সার্জন সৌধ ভাই। আমার বুকের ব্যথা সারতে তোমার থেকে পাওয়া এই মেডিসিন টুকুই যথেষ্ট। ‘
আবেগে টইটম্বুর হয়ে রইল সিমরান। নিঃশ্বাস ফেলল ঘনঘন৷ সমস্তই অনুভব করল সৌধ। অদ্ভুত অনুভূতি হলো বুকজুড়ে। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ সজাগ হলো আচমকা। কান বেয়ে গেল এক উষ্ণ নরম হাওয়া। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিজোড়ার হাসি কত সুন্দর হয় কেউ কি জানে? সৌধ জানে। এই তো সিমরানের অশ্রুসিক্ত চোখ দু’টো কী সুন্দর হাসছে৷ তার বুকের ভেতর চেপে থাকা বিশাল পাথরটাও সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। যাকে পায়নি তার জন্য যাকে পেয়েছে তাকে কষ্ট পেতে দেয়া অসম্ভব তার পক্ষে। পুরোপুরি অসম্ভব।
লজ্জায় আর মাথা তুলতে পারছে না সিমরান। সৌধ বলল,
‘ আর কতক্ষণ লজ্জা পাবি? ‘
নিমেষে চোখ তুলে তাকাল মেয়েটা। সৌধ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ আর কতক্ষণ? ‘
লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে সিমরান বলল,
‘ তুমি বাইরে যাও। আমি পাঁচ মিনিট পর বেরুবো। ‘
‘ আরো পাঁচ মিনিট লজ্জা পাবি? ‘
ইশ! মুখ ঘুরিয়ে নিল সিমরান। সৌধ মিটিমিটি হাসতে হাসতে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালে দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল সে। গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলল,
‘ কী হলো এটা? একটু কষ্টের বিনিময়ে যদি এতটুকু সুখ পাওয়া যায়। আমি কষ্টগুলোকে হাসিমুখে বরণ করে নিব। ‘
.
.
নিধির হাবভাব ভালো ঠেকছে না। সন্দেহ করল অর্পণ। মন দেয়া-নেয়া না হলেও দাম্পত্য জীবনের বহুদিন একসাথে কাটানোর ফলে একটু, আধটু বুঝতে পারে নিধিকে৷ খেতে বসে নিধি বার বার তার দিকে তাকিয়েছে। ঘরে আসার পর টের পেল কিছু একটা বলতে এসেও বারবার থেমে যাচ্ছে অনির মা। অনিরূপকে খাইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে নিধি। অর্পণ ডিভানে বসতে বসতে ভাবল, ছেলে ঘুমাক তারপর কথা বলবে। জিজ্ঞেস করবে সে কিছু বলতে চায় কিনা।
আইয়াজের কথাগুলো বারবার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাসায় ফেরার পর থেকে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করছে নিধি। তবু অর্পণের সাথে একটি শব্দও বিনিময় করতে পারেনি৷ অদ্ভুত জড়তা কাজ করে। সে প্রচণ্ড ইগোয়েস্টিক একজন নারী। জীবনের এ পর্যায়ে এসে খুব করে অনুভব করল তা। এতদিন সৌধর জন্য নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করত। সেই অশান্তি, সেই যন্ত্রণায় শান্তিতে নিঃশ্বাস ছাড়তে পারত না৷ আজ আইয়াজের পরামর্শে অর্পণের সাথে সব ঠিক করে নেয়ার চেষ্টায় শ্বাস নিতে পারছে না। কীভাবে শুরু করবে? কী বলবে? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। মাথা কাজ করছে না একদম। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। রাগ হচ্ছে নিজের পারিপার্শ্বিক সবকিছুর প্রতি। অভিযোগ তুলতে ইচ্ছে করছে গোটা পৃথিবীর দিকে। কী দোষ তার? কী অপরাধ তার? তার কি শান্তিতে নিঃশ্বাস ছাড়ার অধিকার নেই? তার কি অধিকার নেই সুখী জীবনযাপন করার? ভালোবাসা নামক সুখটা কি সে আঁকড়ে ধরতে পারে না? নিমেষে বুকের ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল যেন। অনিরূপ ঘুমিয়েছে বুঝতে পেরে বালিশের পাশে থাকা ফোনটা নিয়ে ছুটে গেল বাথরুমে। অকস্মাৎ নিধির এহেন কাণ্ড দেখে অর্পণ ওঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল বাথরুমের সামনে। আড়ি পাতার স্বভাব নেই তার। আজ স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে আড়ি পাতল শুনতে পেল নিধির কথা…।
সৌধর সঙ্গে ডিনার করে বাড়ি ফিরেছে সিমরান৷ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এখন। তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়েছে মাত্র। মামাত বোন তার সাথে ঘুমাতে চেয়েছিল। কারো সঙ্গে বেড শেয়ার করতে পারে না সে। ঘুম হয় না। সামনে অনুষ্ঠান। ঠিকঠাক ঘুম না হলে সমস্যা হবে। তাই বুঝিয়ে বোনকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার ঘুমাবে সে৷
ঘুমানোর পূর্বে বা’হাত উঁচু করে যেখানটায় সৌধ চুমু খেয়েছে ঠিক সেখানটায় পরপর নিজের ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিল। অনুভব করল বুকের ভেতর শিরশির করছে। অচেনা সুখে হৃদয় টালমাটাল। এমন মুহুর্তে আকস্মিক ফোনটা বেজে ওঠল। চমকে গিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখতে পেল, নিধিপু৷ নিমেষে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অস্বীকার করার জোর নেই। নিধি আপুকে হিংসে হয় তার। কারণ ওই মানুষটাই সৌধ ভাইয়ের প্রথম প্রেম। সৌধ ভাই এখনো মাথা উঁচু করে বলতে পারে নিধিকে ভালোবাসি। অথচ তোকে ভালোবাসি সিনু এটা বলতে পারে না। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সিমরান৷ হঠাৎ নিধি আপু কল করছে কেন তাকে? কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে ওঠে বসে ফোন রিসিভ করল।
‘ নিধি আপু! হঠাৎ? ‘
‘ কী করছিস? ‘
শুয়ে আছি বলতে পারত সিমরান৷ কিন্তু তার আগে কী করেছে সেটা জানানোর ইচ্ছে হলো খুব৷ কেন হলো? জানে না। তবে এটা না বললে তার কোথাও কোনোকিছু কম পড়বে অনুভূতি থেকে বলল,
‘ শপিংয়ে গিয়েছিলাম সৌধ ভাইয়ের সঙ্গে। একসঙ্গে ডিনার করে মাত্র ফিরেছি। ঘুমাব ভাবছিলাম। তুমি কী করছ আপু? ‘
মুখটা দৃঢ় হয়ে গেল নিধির। নিজেকে বড্ড ছোটো অনুভব করল। কারণ সে টের পেয়ে গেছে সিমরান তাকে জানাতে চাইছে সে সৌধর সঙ্গে টাইম স্পেন্ট করেছে। বোঝাতে চাইছে সৌধ এখন শুধুই তার। তাচ্ছিল্য ভরে হাসল সে। কথা না বাড়িয়ে যে উদ্দেশ্যে ফোন করেছে সেদিকে মন দিল। রয়েসয়ে বলল,
‘ তুই সৌধকে বিয়ে করিস না সিনু। ‘
বুক ধড়াস করে ওঠল সিমরানের। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,
‘ কেন! কী বলছ নিধি আপু? তুমি এ কথা কেন বলছ! তুমিই তো সেদিন অনুরোধ করেছিলে আমি যেন সৌধ ভাইকে না ছাড়ি তাহলে? তুমি কি সৌধকে ভাইয়ের লাইফে ফিরতে চাও? ‘
কণ্ঠ কাঁপছিল সিমরানের। বাঁকা হেসে নিধি বলল,
‘ আমার খুব পরিচিত একজন সৌধকে ভালোবাসে। ওকে না পেলে মেয়েটা ভয়ংকর কিছু করে ফেলবে। তুই যদি সরে দাঁড়াস মেয়েটার লাইফ বেঁচে যায়। ‘
মাথা ঘুরে গেল সিমরানের। থমকানো স্বরে বলল,
‘ কে মেয়েটা? ‘
‘ ধরে নে আমার আপন কেউ। ‘
চমকে ওঠল সিমরান। কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ রইল। চোখ দু’টো বন্ধ করে অনুভব করল কেবল সৌধকে। আর তার বলা সেই কথা, সেই স্পর্শ। নিজের বা’হাত মুখের সামনে নিল। ঠোঁট বাড়িয়ে আবারো চুমু খেল সেখানটায় যেখানে সৌধ তার পুরুষালি ঠোঁটের উষ্ণ পরশ এঁকেছে আজ। এরপর গলায় মৃদু ক্রোধ মিশিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলল,
‘ তুমি খুব স্বার্থপর নিধিপু। নিজের সুখের জন্য তুমি সবাইকে কষ্ট দিতে পারো সবাইকে। বিলিভ মি তুমি যদি বলতে তুমি সৌধ ভাইয়ের জীবনে ফিরে আসবে। আমি যদি দেখতাম সৌধভাই সবকিছু ভুলে তোমাকে গ্রহণ করতে আগ্রহী। তাহলে সব স্বার্থ ত্যাগ করে, আমার আবেগ, ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে ঠিক কোনো নাটকীয় চরিত্রের মতোই বিয়েটা ভেঙে দিতাম। কিন্তু না তুমি নিজের সুখের জন্য সৌধ ভাইকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছ আজ এসেছ আমাকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে৷ আ’ ম সরি নিধিপু। সৌধ ভাইকে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে দান করার মতো শক্তি আমার নেই। আম্মু ঠিক বলত জানো? আমি অতিরিক্ত সরল বলে সবাই এই সরলতার সুযোগ নেয়। আজ তুমি প্রমাণ করে দিলে আপু। তোমাকে আমি দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষ ভেবেছিলাম। সৌধ ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষ নিশ্চয়ই সাধারণ কেউ হবে না৷ আজ বুঝতে পারলাম, তুমি সৌধ ভাইয়ের জীবনের বিগ মিস্টেক! ইয়েসস, ইউ আর অ্যা বিগ মিস্টেক ইন সৌধ ভাই’স লাইফ! ‘
নিজের বক্তব্য শেষ করে তীব্র ক্রোধ আর চরম বিরক্তি নিয়ে ফোন কেটে দিল। সিমরান ফোন কেটে দিয়েছে বুঝতে পেরে চোখ দু’টি সন্তর্পণে বুজে ফেলল নিধি৷ ফিরে গেল সে দিনটায়। যেদিন দুর্বল হৃদয়ের অধিকারিনী সিমরান নিজের ভালোবাসার কথা ভুলে গিয়ে তার দুপা ধরে অনুরোধ করেছিল। সৌধর ভালোবাসা ভিক্ষা চেয়ে। সময়ের স্রোতে আজ সব বদলে গেছে। ওই মেয়েটা এখন নিজেরটা বুঝে নিতে শিখেছে। সিনু বুঝে গেছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কারো সাথেই আপোষ করতে নেই। নিধির চোখের কার্ণিশ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ বুকের বা’পাশে চেপে ধরে বিরবির করে বলল,
‘ আমি সৌধর লাইফে মিস্টেক হয়েই থাকতে চাই। আজ যে কথা তুই বলেছিস ভবিষ্যতে একই কথা সৌধর মুখে শুনতে চাই। যদি না শুনি তাহলে তুই হেরে যাবি সিনু। ‘
.
.
বাথরুমের দরজা খুলতেই অর্পণের মুখোমুখি হলো নিধি৷ স্তব্ধ মুখে তাকিয়ে অর্পণ। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার কোন আপনজন সৌধকে ভালোবাসে? ‘
‘ আড়ি পাতছিলেন? ‘
রাগান্বিত কণ্ঠ নিধির৷ আজ অর্পণের ধৈর্য্যের বাঁধ যেন ভেঙে গেল। ক্রোধে জর্জরিত হয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ পাতছিলাম। বলো কোন আপনজন সৌধকে ভালোবাসে? আপনজনটা তোমার হৃদয় না তো? ‘
সহসা কেঁপে ওঠল নিধি। দৃষ্টি জোড়া ঝাপসা হয়ে গেল তার। ধরা গলায় বলল,
‘ আপনি আমাকে অপমান করছেন। ‘
‘ না করছি না। সত্যিটা বলছি। এভাবে আর নয় নিধি। আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স! ‘
‘ হোয়াট! ‘
‘ ইয়েস। ‘
‘ অনির কী হবে? ‘
‘ সেই চিন্তা তোমার থাকলে আজ তুমি এখানে এভাবে থাকতে না৷ ‘
ক্রোধে ফুঁসছে অর্পণ। নিধির সামনে এক মুহুর্ত দাঁড়াতে চাইল না সে। সরে যেতে উদ্যত হলো। মাথা ঘুরতে শুরু করল নিধির। কী করবে? কী বলবে কিচ্ছু ভেবে না পেয়ে আচমকা অর্পণের হাত টেনে ধরে বলল,
‘ প্লিজ আপনি মাথা ঠান্ডা করুন। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিন। ‘
ফুঁসে ওঠা আগুন নিভে গেল আচমকা। নিধির থেকে এই অনুনয় নতুন তার জন্য। তাই নিভল। চুপচাপ গিয়ে ডিভানে বসে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,
‘ বলো কী বলার আছে? ‘
নিধি দাঁড়িয়ে ছিল। অর্পণ এ কথা বলায় গিয়ে পাশে বসল। যা অর্পণকে অনেক বেশিই অবাক করে। নিধি হঠাৎ মাথা নিচু করে কান্নারত কণ্ঠে বলল,
‘ আমি মিথ্যা বলেছি সিনুকে। ‘
‘ কেন? ‘
‘ যাচাই করে নিলাম সৌধর জন্য ও কতটুকু যোগ্য। কারণ একদিন ও অনায়াসে সৌধর থেকে সরে যেতে চেয়েছিল। ‘
‘ তোমার লাভ? ‘
‘ সৌধ আমার বন্ধু। মিথ্যা বলব না৷ অতীতে অনুভব না করলেও এখন করি, ও আমার জীবনে বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু ছিল। তাই ওর জীবনে সত্যি কারের ভালোবাসা আসুক। তাকে নিয়ে ও সুখী হোক। এটুকুই চাই এখন। ‘
‘ পরীক্ষা করছিলে সৌধর হবু ওয়াইফকে? ‘
বুদ্ধিমান অর্পণ। তাই বুঝে নিল সবটাই। নিধি মাথা তুলে ঘুরে তাকাল। অর্পণ তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে তার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বলল,
‘ আমি সুখ চাই অর্পণ। আমি শান্তি চাই। আমি ডিভোর্স চাই না। সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাই আপনার কাছে। ‘
চোখ দিয়ে নোনাপানির ধারা নামল নিধির। অর্পণ চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করল। মনটা তার বিধ্বস্ত। সুখ কী জিনিস ভুলেই গেছে। শান্তি! সেটা কী? ডিভোর্স? রাগের মাথায় উচ্চারণ করেছে। তাই বলে কি দিতে পারবে? বহুদিনের পছন্দের মানুষ ছিল নিধি। ভাগ্যক্রমে বউ হিসেবে পেয়ে ভালোবাসতে শুরু করেছিল গভীরভাবে। সেই ভালোবাসায় ভাঁটা পড়ল মেয়েটার থেকে দিনের পর দিন অপমান আর অসম্মান পেয়ে। আজো তার হৃদয়ে কোথাও না কোথাও নিধির গভীর অস্তিত্ব রয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা তারা স্বামী, স্ত্রী। তাদের ফুটফুটে একটি সন্তান রয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্পণ। নম্র স্বরে বলল,
‘ সরি। রাগের মাথার ডিভোর্সের কথা বলেছি। মন থেকে না। ‘
অবাক হয়ে তাকাল নিধি। নিজের প্রতি ঘৃণা হলো তার। এই মানুষটা কত বিনয়ী। সৎচরিত্রের অধিকারী। অথচ এর সাথে সে দিনের পর দিন অন্যায় করে যাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো নিধি। অর্পণ ওঠে দাঁড়ালে সেও আচমকা ওঠে দাঁড়াল। বার বার স্মরণ করতে লাগল আইয়াজের বলা কথাগুলো। তারও মন বলছে সব ইগো দূরে সরিয়ে, সবকিছু ভুলে গিয়ে যে মানুষটার সঙ্গে সে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেই সব সমস্যার সমাধান। সব যন্ত্রণার অবসান।
প্রচণ্ড জড়তা, মানসিক টানাপোড়েন পেরিয়ে আচমকা অর্পণের সামনে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিধি। ভুলে গেল সে একজন ডক্টর, কারো মা। আটাশ বছর বয়সী এক নারী। একদম বাচ্চাদের মতো করে স্বামীর বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কান্নারত কণ্ঠে কী বলল কিচ্ছু বুঝল না অর্পণ। শুধু থেকে থেকে সরি শব্দটি শুনতে পেল। এরপর? এরপর আর কী? অর্পণ কী পারে নিজেকে ধরে রাখতে? দীর্ঘদিন গুমোট হয়ে থাকা অনুভূতিগুলো সম্পূর্ণ উগরে বেরুলো। স্ত্রীকে জড়িয়ে নিল বুকের মধ্যিখানে। এভাবে কতক্ষণ সময় পেরুলো তাদের জানা নেই।
নিধির কান্না কমে এলে অর্পণ দু’হাতের তালুতে ওর গোলাকৃতি মুখটা আলতো করে চেপে ধরল। চোখে চোখ রেখে গাঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ অনির আব্বু অনির আম্মুকে ভীষণ ভালোবাসে। আফসোস অনির আম্মুর সে ভালোবাসা চোখে পড়ে না। ফেলে আসা ভালোবাসায় বিভোর হয়ে সামনের ভালোবাসা দেখতে বড্ড অনীহা তার। ‘
অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল নিধি। ধীরেধীরে আবারো জড়িয়ে ধরল অর্পণকে। বুকে মাথা রেখে বিরবির করে বলল,
‘ আমায় ভালোবাসুন অনির আব্বু৷ প্রমিজ করছি আর অনীহা দেখাব না। শুধু ভালোবাসুন আমায়। প্লিজ আমি মরে যাব, ভালোবাসার অভাবে মরে যাব আমি৷ ভালোবাসুন আমায়। ‘
নিধি কথাগুলো বলতে বলতে প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অর্পণকে। অর্পণ অনুভব করল তার বুকের ভেতর যেন ঢুকে যাবে নিধি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। নিধির সম্পূর্ণ অনুভূতি টের পাচ্ছে অর্পণ। তাই কিছু সময় শান্ত করার চেষ্টা করল ওকে। এরপর ভালোবাসার কাঙালিনীকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে পা বাড়াল বিছানার দিকে। নিধির চোখ দু’টো বন্ধ। পুরো মুখশ্রীতে অশ্রুজল লেপ্টে আঠালো হয়ে আছে। সন্তর্পণে স্ত্রীকে শুইয়ে দিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। এরপর ঘরের ডানপাশে গিয়ে দোলনায় সযত্নে শুইয়ে দিল অনিকে ৷ দু’পাশে দু’টো কোল বালিশ রাখল আপাতত বাবা, মায়ের প্রক্সি হিসেবে। এরপর রুমের বাতি নিভিয়ে সে চলে গেল বউয়ের কাছে। দীর্ঘদিন এক ঘরে এক বিছানায় থেকেও কাছাকাছি আসা হয়নি। আজ অনেকদিন পর সুযোগ পেয়েও অর্পণ সৎ ব্যবহার করল না। নিধির মন বিধ্বস্ত। দেহের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাদের। হয়নি কেবল মনের। তাই বুকে আগলে নিয়ে কপালে চুমু খেল। একে একে আদুরে স্পর্শে ভরিয়ে তুলল পুরো মুখশ্রীতে। এরবেশি এগুলো না। নিধি না চাইলে এরবেশি আগাবেও না। সময় গড়াল বেশ। হঠাৎ নিধির সম্পূর্ণ দেহশ্রী আগলে নিয়ে ওর কানের কাছে মুখ রাখল অর্পণ। মৃদুস্বরে বলল,
‘ পৃথিবীতে সব মানুষ এক নয়। এক নয় সব মানুষের ভালোবাসার নিয়মও। সৌধ তোমাকে কীভাবে ভালোবেসেছে জানি না৷ জানতেও চাই না। আমি সৌধ নই৷ আমি অর্পণ। আমি আলাদা। আমি তোমার স্বামী৷ তোমার সন্তানের বাবা৷ আমি যেমন আলাদা একজন মানুষ তেমনি আমার ভালোবাসাও আলাদা। আমি তোমাকে ভালোবাসি নিধি। তুমি যদি আমার ভালোবাসা অনুভব করতে না পারো তাহলে শুধু একটা কথা মনে রেখো, সৌধ তোমার জন্য হারাম। আমি হালাল। আমাদের এই পবিত্র সম্পর্কের ঊর্ধ্বে কোনোকিছুই হতে পারে না৷ শুনতে খারাপ লাগলেও বলছি তোমাদের বন্ধুত্বও আমাদের সম্পর্কে ঠুনকো। নিধি, ফোকাস করো আমার স্পর্শে, আমার কথায়। দেখো শুধু তুমি আর আমি। আর কেউ নেই আর কিচ্ছু নেই।‘
Leave a comment