মুরুব্বিরা বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে খুব বেশি মিল, মহব্বত থাকলে তাদের মধ্যে একজন যদি আল্লাহর ডাকে পরপারে চলে যায়। তাহলে অপরজনের স্থায়িত্বও এই পৃথিবীতে খুব বেশি দীর্ঘ হয় না। এমনটা তারা বলেন, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে। উদয়িনী চলে গেছে আজ দেড় বছর। আজ আকস্মিকভাবে সোহান খন্দকারও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল। তবে কি তাদের মধ্যেও ছিল নিগূঢ় মহব্বত? নাহ, এমনটা কখনো পরিষ্কার করে বোঝা যায়নি। জানতে পারেনি কেউ। তবে নিঃসঙ্গতায় ভুগছিল সোহান খন্দকার। শেষ কিছুদিন উদয়িনীর সঙ্গে তার যে আন্তরিকতা তৈরি হয়েছিল। সেই অল্প সময়ের অল্প অনুভূতিটুকুর জন্যই আফসোস করত। হতাশায় ভুগত। কথার ছলে একদিন হেসে হেসে সিমরানকে বলেছিলও,
‘ সিনু মা, তোমার আম্মু আর কিছুদিন আমাদের সাথে থাকলে ক্ষতি হতো না বলো? ‘
‘ তুমি আম্মুকে খুব মিস করছ তাই না আব্বু। ইশ, আম্মু যদি একটিবার এ কথা জানত। কী যে খুশি হতো! ‘
এরপর খুব বেশিদিন গড়াল না। সিমরান শশুর বাড়ি চলে গেল। সেও ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে শরীর খারাপ লাগছিল। তার চারটা ক্লিনিক। তন্মধ্যে একটিতে গিয়ে নিজের পার্সনাল কেবিনে আরাম করছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর বেশি খারাপ লাগলে নার্স ডেকে প্রেশার মাপায়। এরপর ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে উদ্যত হতেই আকস্মিক নাক, মুখ দিয়ে র’ক্ত এসে তৎক্ষনাৎ মৃত্যুকে বরণ করে। গ্লাস পড়ে যাওয়ার বিকট শব্দ, গোঙানি শুনে দু’জন নার্স ছুটে আসে। রাত দশটার পর ক্লিনিকে ডাক্তার থাকে না। অবস্থার ভয়াবহতা দেখে তাই ওরা সোহান খন্দকারকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। অর্পণ শিকদার ডিউটিতে ছিল। সদ্যই দু’টো সিজার করে বেরিয়েছে। এমতাবস্থায় সোহান খন্দকারকে নিয়ে এলে চেকআপ করে দেখল, হি ইজ নো মোড়! তীব্র উত্তেজনা নিয়ে সেই মুহুর্তেই নিধিকে ফোন করে অর্পণ৷ ছেলেকে শাশুড়ির দায়িত্বে রেখে হসপিটালে ছুটে আসে নিধি। চোখের সামনে সোহান খন্দকারের মৃত দেহ দেখে ভেঙে পড়ে ভীষণ। মনে পড়ে যায় অতীতের মধুর স্মৃতিগুলো।
চারপাশে এত মানুষ। অথচ সোহান খন্দকারের আপন বলতে কেউ উপস্থিত নেই। নিধির বুক কেঁপে উঠে। কাঁপা হাতে নাম্বার খুঁজে সিমরানের ফোনে কল দিতে গিয়েও থেমে যায়। আশপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ উনার বাড়ির লোককে খবর দিয়েছেন আপনারা? ‘
একজন নার্স কান্না বিগলিত কণ্ঠে বলে,
‘ উনার মেয়ের শশুর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে। ‘
.
শুরু থেকেই সৌধর বন্ধুমহলের স্বয়ংক্রিয় একটি অভ্যেস। ওদের যে কারো বিপদ ঘটুক। সর্বপ্রথম যে নামটি মাথায় আসবে সে হলো সৌধ। এই মানুষটা যেন ওদের জীবনে গোড়া থেকেই জাদুর মতো অবস্থান করছে। মানুষটা তার অসাধারণ জাদুবলে বন্ধুদের সব সমস্যার সমাধান এনে দেয়। তাই আজ সোহান আংকেলের নিথর দেহের পাশে বসে, চোখে অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল নিধি। সৌধর নাম্বারে কল করেই ভেঙে পড়ল কান্নায়। ওপাশে কল রিসিভ করতেই জানিয়ে দিল, ‘সোহান আংকেল আর নেই। ‘
অ্যাম্বুলেন্সের বিকট শব্দ। আর নিধির কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলা অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য। দুইয়ে মিলে নিস্পন্দ হয়ে গেল সৌধ। নিঃশ্বাস আঁটকে, অবিশ্বাস্য স্বরে শুধাল,
‘ তুই কোথায়? ‘
ক্রন্দনরত নিধি থামল হঠাৎ। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘ হসপিটালে, ডিউটি ছিল অর্পণের। ওই ফোন করে জানাল আমাকে। সুহাস কোথায় সৌধ? ‘
অস্থিরচিত্তে উঠে দাঁড়িয়েছে সৌধ। একটি হাত দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরা। অপর হাতে ফোন ধরে আছে কানে। চোখ দুটো পলকহীন। ধীরেধীরে লালচে বর্ণে রূপ নিচ্ছে। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ প্রায়। তবু ক্ষীণ গলায় উত্তর দিল,
‘ সুহাস এখানে নেই। ও নামীর কাছে। ‘
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল সৌধ। ধপাস করে বসে পড়ল বিছানায়। সে কি আবারো দুঃস্বপ্ন দেখল? স্থবির হয়ে তাকাল ফোনের স্ক্রিনে। এ তো স্বপ্ন নয় সত্যি! হৃৎপিণ্ড ছটফটিয়ে উঠল নিমেষে। অন্তঃকোণে ভেসে উঠল সেদিনের দেখা সেই স্বপ্ন। রুগ্নদেহী সিমরান। আকস্মিক দাঁড়িয়ে পড়ল দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ মানুষটা। জেনেভার তীব্র শীতে শরীর বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম নেমে গেল। না পারে এক্ষুনি ছুটে যায় বাংলাদেশে। সোহান আংকেল আর নেই এই খবর লুকিয়ে সিমরানকে নিয়ে চলে যায় বহুদূর। কিন্তু হায়! নিরুপায় হয়ে ঠাঁই বসে পড়ে আবার। বিধ্বস্ত হয়ে উঠে চোখমুখ। কাঁপতে শুরু করে বুক, হাত, পা সর্বদেহ। জীবনে এতকিছু ঘটে গেল। কত মানুষ হারাল। কখনো এতটা অসহায় অনুভব করেনি। এতটা ভীতিগ্রস্ত হয়নি। এই মুহুর্তে সুহাসকে নিয়ে ভাবছে না সে। খবরটা সুহাসের কান পর্যন্ত এক্ষুনি যেতে না৷ যত ভাবনা সিমরানকে নিয়ে।
তার সিনুর কী হবে? কে সামলাবে তার নরম হৃদয়ের মানুষটাকে।
কাঁপা হাতে, রুদ্ধশ্বাসে, শূন্য মস্তিষ্কে আম্মাকে ফোন করল সৌধ। ফোন ধরলেন না তানজিম চৌধুরী। আম্মাকে না পেয়ে আব্বাকে কল দিল। একই অবস্থা রিসিভ হলো না৷ একে একে বাড়ির প্রত্যেককে কল করল নিরুপায় সৌধ। ব্যর্থ হলো বারংবার। শেষে ভয়ে ভয়ে কল করল, সিনুর ফোনে। মুহুর্তেই কলটা রিসিভ হলো। উৎকণ্ঠিত গলায় সিমরান বলল,
‘ তুমি ফোন দিয়েছ! কী ব্যাপার? এত্ত সকালে উঠেছ আজ। ‘
হতভম্ব সৌধ। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। ঢোক গিলল সচেতন ভাবে। সিমরান ফের বলল,
‘ শুনছ? হ্যালো। ‘
গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না সৌধর৷ অস্থিরতা অনুভব করছে খুব৷ তার বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দ শুনতে পেল সিমরান৷ বিচলিত হয়ে বলল,
‘ হ্যালো, কথা বলছ না কেন? কী অদ্ভুত! আম্মা এসে তৈরি হতে বলল। সকাল সকাল কোথায় যাব সেটাই বুঝতে পারছি না৷ আর তুমি ফোন করে কথা বলছ না। আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে এখন। এই শীতেও আমার গরম গরম অনুভব হচ্ছে জানো? কেন হচ্ছে বুঝো? টেনশন লাগছে, টেনশন। হঠাৎ এত টেনশন লাগছে কেন বলো তো? এই প্রথম আম্মা কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে তাই কী? ‘
সাধারণত সৌধর সঙ্গে কখনো এমন অস্থির অস্থির আচরণ করে না সিমরান। একদমে এতবেশি কথাও বলে না। আজ করছে, বলছে। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কিছু জানে না এখনো। তবু এমন হাসফাস করছে? করবে নাই বা কেন? সকাল সকাল বিনা নোটিশে শাশুড়ি এসে বেরুবার জন্য তৈরি হতে বললে বুঝি দুঃশ্চিন্তা হয় না?
সৌধ তার লাল টকটকে চোখ দু’টো বুজে ফেলল আচমকা। চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা নোনাপানি। এপাশে সিমরান অধৈর্য্য হয়ে ফোন কে টে দিতে উদ্যত হলো। তক্ষুনি সে ভরাট স্বরে বলে উঠল,
‘ সিনুপাকনি, আমি আসব। খুব তাড়াতাড়ি আসব তোমার কাছে। তুমি প্লিজ প্রমিজ করো আমাকে। নিজেকে সামলে রাখবে। অন্তত আমি না আসা পর্যন্ত। তোমার ভাবি, ভাইয়া, তোমার সৌধ আর ছোটো আব্বু সুহৃদ আসছে তোমার কাছে। খুব শিঘ্রই আসছে। ‘
‘ তোমার কণ্ঠ এমন লাগছে কেন সৌধভাই? ‘
সহসা সিরিয়াস হয়ে প্রশ্নটি করল সিমরান। অতীতের অভ্যেস মতো তাই কখন সোধভাই বলে ফেলল টেরও পেল না৷ সৌধও অতিরিক্ত চিন্তায়, আবেগপ্রবণ হয়ে কী করবে দিশা পেল না। এদিকে তানজিম চৌধুরী দরজায় টোকা দিচ্ছেন। বেদনার্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ সিনু মা হলো তোমার? ‘
পরিস্থিতি ঘুরে গেল ত্বরিত। সিমরান বলল,
‘ হ্যালো, ডক্টর শুনছ? আমি তৈরি হচ্ছি। পরে ফোন করব তোমাকে। তুমি আরেকটু ঘুমাও বা ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে নাও কেমন। ‘
কথা শেষে ফোন রেখে দিল সিমরান। সৌধ হাত, পা ছেড়ে বসে রইল ফ্লোরে। দীর্ঘক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর আকস্মিক আইয়াজের কথা মনে পড়ল। অনুভব করল ওকে এক্ষুনি ফোন করার। ফোন করে জানতে পারল আইয়াজ রওনা দিয়েছে। ইতিমধ্যে খবর পৌঁছে গেছে তার কাছে। তাই আর দেরি করেনি। আইয়াজকে ফোন করার পরই মনে পড়ল ফারাহ প্র্যাগনেন্ট। এই অবস্থায় সে নিশ্চয়ই আসবে না। একমাত্র আম্মা ছাড়া তেমন কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নেই। অসহ্য এক যন্ত্রণা হলো বুকে। নিরাসক্ত হয়ে কল করল নিধির ফোনে। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো কলটা। নিধি বলল,
‘ সুলল কাকু এসেছে সৌধ। আমি আর অর্পণ যাচ্ছি সুহাসদের বাড়ি। তুই টেনশন করিস না৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফেরার চেষ্টা কর। ‘
‘ নিধি.. ‘
আকুল স্বর সৌধর। চুপ হয়ে গেল নিধি৷ এই আকুলতা কিসের? বুঝে নিল সে। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ভাঙা কণ্ঠে বলল,
‘ আমি আছি সৌধ। তোরা না আসা পর্যন্ত আমি তোর বউয়ের পাশে আছি। টেনশন করিস না। এমন সিচুয়েশনে যদিও সান্ত্বনা বাণী দিয়ে লাভ নেই৷ তবু মেয়েটাকে সামলানোর জন্য কাউকে না কাউকে দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তুই আর সুহাস। তোরা যখন নেই তোদের এই খারাপ, অপরাধী বন্ধুকে কষ্ট করে হলেও একটু ভরসা কর। ‘
না চাইতেও এক চিলতে ভরসা পেল সৌধ। ফোন কেটে দিল নিঃশব্দে। সময়ের স্রোতে আজ পরিস্থিতিটা এমনই দাঁড়াল যে, সৌধ ভুলে গেল এক সময়ে নিধির প্রতি থাকা প্রগাঢ় অনুভূতিটুকুর কথা। নিধি ভুলে গেল অতীতের তিক্ত স্মৃতি। অতীত যেন অতীতেই রয়ে গেল। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেবল বর্তমান। বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা থেকে তৎপর হয়ে উঠল নিধি৷ সুহাস নেই, সৌধ নেই। কিন্তু ওদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আপন আর আদরনীয় মানুষটি রয়েছে। সোহান আংকেল বিয়োগের শোকে শোকাহত মেয়েটার পাশে থাকতে হবে তাকে। থাকতেই হবে।
Leave a comment