মা ধাক্কা মেরে অভি কে ঘুম থেকে তুলে দিলেন, “এই ছেলে ওঠ, সাড়ে নটা বাজে আর কত ঘুমাবি।” অভি, “আহ মা, আর একটু শুতে দাও না, আজ ছুটির দিন, আর একটু প্লিস।” মা, “তোর বাবা অফিসে বেড়িয়ে গেছেন আর সুব্রত আর মৈথিলী সেই সকাল বেলায় ঢাকুরিয়া বেড়িয়ে গেছে। তুই যদি আমাদের সাথে শপিঙে যেতে চাস তাহলে উঠে পর না হলে তুই ঘুমতে পারিস। আমি কিন্তু তোর জন্য কোন রান্না করিনি।”
ঘুম চোখে অভির মনে পড়ল যে কেনা কাটা করতে বের হতে হবে, যদিও পছন্দ নয় তবুও যেহেতু পরী সাথে থাকবে তাই ওর যেতেই হবে। পরী পাশে না থাক কাছে ত থাকবে।
মা, “চা তৈরি, স্নান সেরে তাড়াতাড়ি নিচে আয়।”
অভি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর তোমার মেয়ে কি করছে? ও শুয়ে থাকলে কিছু না আর আমি শুয়ে থাকলে যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়।”
মা, “ওর কথা তোকে জিজ্ঞেস করতে হবে না। পরী অনেক সকালে উঠে স্নান সেরে পুজো দিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে গেছে, ও লুচি ভাজচ্ছে, তোর মতন নয়, খালি পড়ে পড়ে ঘুমাতে পারলে যেন বেঁচে যাস।”
অভি মায়ের কথা শুনে মনে মনে হেসে ফেলল, “আমার সোনার পরী জানে কি করে ছোটো মায়ের মন জিততে হয়। মেয়ে নয় মা, তোমার ভাবি বউমা করে আনব আমি।”
স্নান সেরে দৌড়ে নিচে নেমে আসে, “টিং টিং টিং টিং … পেটে আগুন জ্বলছে, ফায়ার ব্রিগেড চাই।”
অভি খুব খুশি, পরী লুচি রান্না করছে।
পরী রান্না ঘর থেকে জোর গলায় বলে, “চিল্লিয়ো না, চুপ করে বসার ঘরে বসো, আমি তোমার লুচি নিয়ে এখুনি আসছি।”
বসার ঘরের পর্দা সরিয়ে পরী ঘরে ঢুকল, মনে হল সকালের আলো যেন ওর সদ্যস্নাত রুপের কাছে ম্লান হয়ে গেল। ভেজা চুল ঘাড়ের ওপর দিয়ে বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে সামনের দিকে ফেলা। পরনে ঘিয়ে রঙের শাড়ি আর লাল ব্লাউস। চেহারায় যেন দেবী প্রতিমার মতন আলোর ছটা দিচ্ছে। কপালে ছোট্ট লাল সিঁদুরের টিপ, পুজোর টিপ মনে হল, দুই বাঁকা ভুরুর মাঝে শোভা পাচ্ছে। কানে সমার দুল তাতে আবার দুটি ছোটো ছোটো মুক্ত ঝুলছে। বাঁ গালের ওপরে সেই ছোট্ট চুলের এক গুচ্ছ দুলে বেড়াচ্ছে।
গোলাপি ঠোঁটে কোন রঙ মাখা নেই তবুও কত গোলাপি আর নরম যেন গোলাপ ফুলের কুঁড়ি। কাজল কালো নয়নে অভির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। পরীর ওই লক্ষ্মীর মতন রুপ দেখে অভি থমকে যায়। পরী যেন চোখের ইশারায় ওকে বলে, “অভি এই অপরূপ সুন্দরী ছোঁয়ার নয়, শুধুমাত্র দুচোখ ভরে দেখার।”
সামনে এসে টেবিলের ওপরে খাওয়ার থালা রেখে অভির মাথায় ছোট্ট চাঁটি মেরে ফিসফিস করে বলে, “আমার দিকে ওই রকম ভাবে তাকিয়ে থেক না, তাড়াতাড়ি লুচি তরকারি শেষ করো।”
অভি ওর মুখের দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে, চোখের পলক যেন পরে না। পরী মুখের সামনে মুখ এনে বলে “ওই রকম ভাবে দেখতে থাক যদি তাহলে কিন্তু আমি তোমার সাথে যাবো না।”
অভি যেন এতক্ষণ মোহাচ্ছন্নে ছিল, ওর কথা শুনে যেন সেই ঘোর কেটে গেল। হাঁ করে পরীকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে?”
এক অদ্ভুত সুন্দর হাসি দেয় পরী, ফিসফিস করে বলে, “আমি তোমার পরী।”
উত্তর দিয়ে পরী ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।
প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ ওরা সবাই শপিঙ্গে বের হল। পরী খুব সুন্দর একটা গাড় নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পরে। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে পরীকে। মায়ের সাথে যেন পরী নয় একটা সুন্দর ময়ুর হেঁটে চলেছে আর অভি ওদের পেছন পেছন হাটছে। পরীর চেহারায় এক অনাবিল শান্তির ছটা, ও যে ছোটো মায়ের পাশে আর ভালবাসার কাছে আছে।
শপিং জিনিসটা অভির কোনদিন ভালো লাগে না তাও আবার মায়ের সাথে। দশটা দোকান ঘুরবে, একশ খানা শাড়ি নামিয়ে দেখবে তারপরে বলবে যে না ঠিক পছন্দ হচ্ছে না বলে আরও একটা দোকানে ঢুকবে। কিন্তু ওর সেই বিরক্তি আজ নেই কেননা ওর সাথে পরী আছে। প্রথমে ওরা শ্যামবাজারে গেল পরীর জন্য শাড়ি কিনতে। তিনটে শাড়ি কিনতে পৌনে ঘন্টা, বাপরে, মেয়েদের কেনাকাটা।
প্রতিবার অভি যখনি পরীর দিকে তাকায়, পরী ওর দিকে ইশারা করে, “আর পাঁচ মিনিট” কিন্তু সেই পাঁচ মিনিট আর আসেনা, শাড়ি দেখা থামেনা। অভি মনে মনে বিরক্তি বোধ করে, আমার সাথে বের হলে আগে থেকে রঙ পছন্দ করে রাখবে তারপরে শাড়ি কিনতে বের হবে। কেনাকাটা চলতে থাকে, বিছানার চাদর, শাড়ি আরও অনেক কিছু। অভির সহ্য শক্তির আর বাহুর শক্তির যেন পরীক্ষা চলছে, শপিঙ্গের ব্যাগ গুলো ত ওর হাতেই।
পরী ওর ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মাকে বলে, “দেখলে তো ছোটো মা, আমি বলেছিলাম না যে আমাদের ব্যাগ বওয়ার জন্য একটা গাধার দরকার ছিল।”
মা অভির ক্লান্ত চেহারা দিকে তাকিয়ে মিনতির সুরে বলল, “ব্যাস আর কয়েক ঘন্টা অভি।”
“বাপরে….. আরও কয়েক ঘন্টা!” মায়ের কথা শুনে অভির মাথায় যেন বাজ পড়ল।
অভি, “শোনো মা, তোমার মেয়ে যদি আর একবার আমাকে গাধা বলেছে তাহলে কিন্তু আমি ওকে এক লাত্থি মারব আর সব ব্যাগ ফেলে দেব। ওকে বারবার গাধা গাধা বলতে বারন করও।”
পরী অভিকে খ্যাপানোর জন্য আবার বলে, “গাধ গাধা গাধা, একশ বার বলব গাধা।”
অভি মাকে বিরক্তি হয়ে বলল, “আচ্ছা কি দরকার পরীর জন্য অত শাড়ি কিনে? ওর ত হাজার গন্ডা কেন কয়েক লক্ষ শাড়ি আছে। তুমি না পরীকে লাই দিয়ে মাথায় তুলছ।”
অভির কথা শুনে মা বিরক্ত হয়ে ওঠেন, “তোর যদি ভালো না লাগে তাহলে তুই বাড়ি চলে যা।”
পরী দেখল মা ছেলের মধ্যে আবার তুমুল কিছু একটা শুরু হতে দেরি লাগবে না। দু’জনের তিরিক্ষি মেজাজ। পরী ছোটো মায়ের হাত ধরে শান্ত করে দিল আর অভির দিকে তাকিয়ে ইশারা করল শান্ত হবার জন্য। বাজুতে পরীর হাতের স্পর্শ পেয়ে মা শান্ত হয়ে গেল। শ্যামবাজারে কেনাকাটা শেষ করার পরে হাতিবাগান থেকে পরীর জন্য সালোয়ার কামিজ কেনা হল। মা মৈথিলীর জন্য একটা দামী সিল্কের শাড়ি কিনল আর সুব্রতর জন্য রেমন্ডের সুটের কাপড়। অভি ওই দেখে একটু বিরক্ত হল, পরীর জন্য কিনছো কেন সুব্রত মৈথিলীর জন্য অত দামী উপহার কেনার কি মানে।
অভি মা’কে জিজ্ঞেস করল যে সুব্রত আর মৈথিলী, ঢাকুরিয়া থেকে কখন ফিরবে, মা জানালেন যে ওরা বিকেল ছ’টার মধ্যে ফিরে আসবে আর বাবাও সম্ভবত ততক্ষণে বাড়ি ফিরে আসবেন।
অভির খুব ক্লান্ত লাগছিল, কিন্তু পরীর হাসি মুখ চোখের সামনে দেখে অভির সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। প্রায় আড়াইটে নাগাদ মা পরীকে জিজ্ঞেস করলেন যে খিদে পেয়েছে কি না। অভি ভেবে পেলনা কি হল, ওযে সাথে আছে সেটা যেন মা বেমালুম ভুলে গেছে, হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে পেয়ে। পরী ওর দিকে তাকিয়ে অভির মনের কথা বুঝতে পারল, একটু ব্যাথা ভরা হাসি দিয়ে মনটাকে শান্ত করতে অনুরধ করল পরী।
মা পরীকে জিজ্ঞেস করল, “অনেক তো শাড়ি সালোয়ার কেনা হল, তুই জিন্স পরবি?”
মায়ের কথা শুনে পরী আর অভি দু’জনেই হতবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে চেষ্টা করে যে মা কি বলতে চাইছে। পরী যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, ওর ছোটো মা ওকে জিন্স কিনে দেবে?
মা ওদের হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “ওই রকম ভাবে তোরা আমাকে দেখছিস কেন? আজকালকার ফ্যাসান এটা, সব মেয়েরাই জিন্স টপ পরে। কিছুদিন পরে তুই ইউনিভারসিটি যাবি তখন তুই পড়তে পারিস।”
রাস্তার মাঝে পরী মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে, “তুমি সত্যি আমার আদরের ছোটো মা। কিন্তু ছোটো মা, আমি ত কোনদিন জিন্স পড়িনি? আমি জানি না আমাকে জিন্স পড়লে মানাবে কি না।”
মা, “আরে বোকা মেয়ে, সবকিছুর একটা প্রথম বার বলে কিছু আছে তো। আর তোকে ভালোই লাগবে দেখতে। তুই চাস কি না তাই বল।”
পরী অভির দিকে তাকায়, মায়ের চোখ লুকিয়ে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি গো কিনবো?”
অভি ওর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে ইশারায় জানায় যে জিন্স টপ পড়লে পরীকে দারুন দেখাবে, একদম যাকে বলে সেক্সি। পরীর চোখে লজ্জার লালিমা লাগে, চোখ নিচু করে নেয়।
মা, “ঠিক আছে তাহলে। বউবাজার আবার অন্যদিনে হবে। আজ চল নিউমারকেট না হলে ট্রেসার আইলান্ড, সেখানে তোর জিন্স টপ কেনা যাবে।”
পরী মায়ের দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলল, “ছোটো মা আমার খুব খিদে পেয়েছে।”
অভির আর পরীর দিকে তাকিয়ে মা বললেন, “ঠিক আছে চল, আমিনিয়ায় আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নেব খানে তারপরে ট্রেসার আইলান্ডে যাব।”
আমিনিয়ার মাটন বিরিয়ানি খেতে খেতে মা অভি আর পরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোদের দুজন কে আমার কিছু বলার আছে। আজ দেখলাম একটু সময় আছে তাই বলি।”
দুজনেই একে ওপরের মুখ চাওয়া চায়ি করে। বুকের ভেতর একটু দুরুদুরু শুরু হয়ে যায়, মা কি বলতে চলেছেন সেই ভেবে। পরীর চোখ যেন বলতে চাইছে অভিকে, “কি বলবে?”
মা, “পরী, অভি, আমাদের যা আছে তা আমাদের পরে তোদের দু’জনের হবে। মানে তোদের দুজনের মধ্যে সমান ভাগ হবে।”
মায়ের কথা শুনে অভির মাথা গরম হয়ে গেল, “এখন বলার কি দরকার ছিল?”
মা, “না মানে তোকে জানিয়ে রাখলাম এই আর কি। পরে বিস্তারিত কথা বলব তোদের সাথে। তুই হয়ত ভেবে বসবি যে মা পরীকে সব দিয়ে দিচ্ছে তাই একটু বলা আর কিছু না।”
অভি রেগে গেল, “তোমার সম্পত্তি তুমি নিজের কাছে রাখো। খুব সম্পত্তি আর পয়সার জোর দেখাও তাই না।”
মা, “ওই রকম ভাবে কেন বলছিস তুই, আমি শুধু তোদের কে জানিয়ে রাখলাম।”
পরী দেখল যে অভির আর ছোটো মায়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হতে চলেছে, কেউ একজনকে শান্ত না করতে পারলে মহা মুশকিলে পরে যাবে। অভির দিকে মিনতির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে শান্ত হতে অনুরোধ করে আর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “ছোটো মা, এই সব কথা এখন থাক, এই সব কথা বলার অনেক সময় পরে আছে।”
অভি বিরক্তি ভরা দৃষ্টি তে মায়ের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। পরী ওকে ইশারা করল “রেগে যেও না প্লিস।”
ট্রেসার আইলান্ডে ঢুকে পরী অভিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি সত্যি আমাকে জিন্স পরা দেখতে চাও?”
অভি পরীকে একবার জিন্স আর টপে মনের আঁখিতে দেখে নিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বলে, “তোমাকে টাইট জিন্সে আর টপ পড়লে যা দেখাবে না, কিযে বলব, একদম দারুন সেক্সি লাগবে।”
পরী লাজুক হেসে মায়ের চোখ এড়িয়ে অভির হাতে চাঁটি মারে, “ধুত শয়তান!”
পরীর জন্য খান চারেক জিন্স আর বেশ কিছু টপ কেনা হল। ট্রেসার আইলান্ড থেকে যখন ওরা বের হল ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমে অস্ত গেছে। ট্যাক্সির পেছনে বসে মা আর পরী গল্প করছে। অভি চুপ করে সামনে বসে, মাঝে মাঝে আয়নায় পরীর চোখের সাথে চোখাচুখি হয়ে যাচ্ছে।
বাড়িতে ওদের জন্য কিছু অজ্ঞাত বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল। বাড়িতে ঢুকেই পরী আর অভি অরুনিমা কে দেখে চমকে যায়। লম্বা সোফায় অরুনিমা মৈথিলীর পাশে বসে চা খাচ্ছিল। ওদের দেখে অরুনিমা লাফিয়ে উঠে পরীকে জড়িয়ে ধরে। ক্ষণিকের জন্য অভির মনে বিরক্তি ভাব জাগে। পরীর মাথা ক্ষণিকের জন্য গরম হয়ে যায় অরুনিমাকে দেখে কিন্তু খুব সংযত ভাবে মনের ভাব লুকিয়ে মিষ্টি হেসে অরুনিমাকে জড়িয়ে ধরে।
পরী, “বাপরে অনেক দিন পরে দেখা, সেই যে সুব্রতদার বিয়ের সময়ে এসেছিলে তারপরে ত আর দেখাই দিলে না।”
অরুনিমার দৃষ্টি অভির মুখের দিকে নিবদ্ধ।
অরুনিমা পরীকে বলে, “আমি যখন চুরনিদির মুখে শুনলাম যে তুমিও এসেছ তাই আর থাকতে পারলাম না চলে এলাম তোমার সাথে দেখা করতে।”
অভি মনে মনে ভাবল, “কি শয়তান মেয়েরে বাবা, অকাট মিথ্যে কথা বলে দিল।”
অরুনিমা অভির দিকে ঠোঁটে এক সুন্দর হাসি মাখিয়ে মৃদু মাথা হেলালো। মাও দেখি অরুনিমা কে দেখে খুব খুশি, মৈথিলীকে ধন্যবাদ জানাল যে অরুনিমাকে সাথে এনেছে বলে। অভির মনে যেন খই ফুটছে, বাড়িতে তিন তিন টে সুন্দরী, সন্ধ্যে মাটি যাবে না হয় রাত রঙ্গিন হবে, কিছু একটা ত হবেই।
অভি ওদের কে বলল যে ও খুব ক্লান্ত সারাদিন কেনা কাটা করে তাই নিজের ঘরে যাচ্ছে। পরী আগেই নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছে ওর জিনিস পত্রের ব্যাগ নিয়ে। বসার ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার আগে অভি একবার অরুনিমার দিকে তাকাল। অরুনিমার দৃষ্টি অভির দিকে নিবদ্ধ যেন একটু কাতর আশা নিয়ে বসে আছে।
অরুনিমার পাতলা গঠন, মৈথিলীর মতন সুখবর্ধক নধর কাঠামো নয়, বা পরীর মতন অত সুন্দরী নয়, তবুও সারা শরীরে এক অধভুত লাবন্য ছড়িয়ে আছে, যা কারুর নজর সহজে এড়ায় না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চড়ার সময়ে অভি ভাবে, আজ রাতে এই ছাদের নিচে যেন চাঁদের হাট বসেছে, একজন তন্বী প্রনয়কৌতুকী, একজন আবেদনাময়ি, একজন জলপরীর ন্যায় সুন্দরী। অভি নিজের মাথায় চাঁটি মারল, কি উলটো পাল্টা ভাবছে অভি, পরীর চোখে ও ঈর্ষার আগুন দেখেছে।
হাত মুখ ধুয়ে নিচে এসে মাকে বলল যে ওর চা যেন ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মা জানালেন যে কেউ ওর চা নিয়ে ওপরে দিয়ে আসবে। ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার আগে পরীর দিকে তাকাল, পরী ডিভানে বসে কেনা কাটার গল্পে ব্যাস্ত। ক্ষণিকের জন্য অভির সাথে চোখাচুখি হয়ে গেল, চোখ যেন বলে উঠল, সাবধান অভি।
অভি নিজের ঘরে ঢুকে প্রাক্টিকাল খাতা খুলে বসে পড়ল। অনেক কিছু লেখার বাকি, ওদিকে যদি সোমবারে না নিয়ে যায় খাতা তাহলে অরুনা ওর মাথা খেয়ে ফেলবে। ঠিক সেই সময়ে দরজায় টোকা পরে। অভি ভাবল যে হয়ত মা বাঁ পরী ওর জন্য চা এনেছে তাই হসি মুখ নিয়ে দরজার দিকে তাকায়, কিন্তু মৈথিলী কে ট্রে নিয়ে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে যায়।
অভি হাঁ করে মৈথিলীর নধর অবয়াব দেখতে থাকে, দু’চোখে এক অধভুত হসি, সে হাসির মানে অভি খুঁজে পায় না। মৈথিলী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, অনুধাবন করতে চেষ্টা করে অভির মনের অভিপ্রায়। অভির দৃষ্টি মৈথিলীর পীনোন্নত বুকের ওপরে নিবদ্ধ হয়ে যায়। মৈথিলীর পরনে গত রাতের টু-পিস নাইটড্রেস। ইচ্ছে করে যেন ঘরে ঢোকার আগে কোমরের বাঁধন খুলে দিয়েছে মৈথিলী। ভেতরের স্লিপ যেন বুকের ওপরে এটে বসে, উপরি বক্ষের অধিকাংশ অনাবৃত, বুকের বিভাজন পরিষ্কার অভির চোখের সামনে মেলে ধরা। ভেতরের স্লিপটা ওর শরীরের সাথে লেপটে আছে, যেন ওর কমনীয় শরীরে এক রঙের প্রলেপ মাখান।
ফোলা গোল পেটের মাঝে সুগভীর নাভি ফুলের মতন ফুটে রয়েছে, সরু কোমরের পরেই ফুলে রয়েছে ইন্দ্রিয়ঘন পুরুষ্টু নিতম্ব। ভেতরের স্লিপ, জানুর মাঝে এসে শেষ হয়ে গেছে, পেলব মসৃণ জানুর ওপরে ঘরের আলো পেছল খেয়ে পড়ছে। অভির কান মাথা জৈবিক ক্ষুধায় গরম হয়ে উঠল। মৈথিলী টেবলের ওপরে চায়ের ট্রে রেখে ওর চুলের ওপরে আলতো বিলি কেটে দেয়। অভি ওর আচরনে হতবাক হয়ে যায়, কে এই নারী, কি তার অভিপ্রায়, নিচে তাঁর স্বামী বসে আর সে অভির সামনে এমন ভাবে মেলে ধরেছে নিজেকে, কেনও? উত্তর খুঁজে পায় না অভি।
কানের কাছে মুখ এনে মৈথিলী জিজ্ঞেস করে, “আমি কি এখানে একটু বসতে পারি?”
অভির নাকে মৈথিলীর গায়ের সুবাস যায়, অভি যেন এক স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে রয়েছে। মাথা নাড়ায় অভি, গলা শুকিয়ে এসেছে ওর, কথা বলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে।
মৈথিলী বিছানায় উঠে ওর দিকে ফিরে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরে যেন ঢেউ খেলে উঠেছে। জানুর মাঝে স্লিপ টা খুব নিষ্ঠুর ভাবে মৈথিলীর নারিত্তের সাথে লেপটে রয়েছে। মৈথিলী যেন ইচ্ছে করেই নিজেকে ঢেকে রাখার কোন প্রবণতা দেখাল না। হাটুর মাঝ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত অনাবৃত। সারা অঙ্গে একবার চোখ বুলিয়ে নিল অভি, ত্বকের সাথে লেপটে থাকা পাতলা কাপড়ের নিচে কোথাও কোন দাগ দেখতে পেল না। অভির মানসচোখ বুঝে নিল যে মৈথিলী কাপড়ের নিচে কোন অন্তর্বাস পরেনি।
একবারের জন্য মনে হয় যে ঝাঁপিয়ে পরে মৈথিলীর কামত্তেজক নধর শরীরের ওপরে আর ছিঁড়ে কুটে খেয়ে নেয় ওর যৌবন রস। মন বলছে যে, যদি অভি ওর দিকে হাত বাড়ায় তাহলে মৈথিলী থেমে থাকবে না, হয়ত নিজেকে সঁপে দেবে অভির বাহু পাশে। কিন্তু দাতে দাঁত চেপে নিজেকে সংবরণ করে অভি।
মৈথিলী ওকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি অরুনিমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো?”
অভি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল, “কই না ত, আমি কাউকে এড়িয়ে যাচ্ছি না। আজ আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম আর সোমবারে প্রাক্টিকাল আছে তাই আমি ঘরে চলে এসেছি।”
মাথা নাড়াল মৈথিলী, “ঠিক আছে।”
মৈথিলীর চোখ অভির চোখের দিকে নিবদ্ধ, অনাবৃত মসৃণ জানুর ওপরে হাত বলাতে থাকে আর ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে। মাঝে মাঝে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে এক অদ্ভুত হাসি দেয় অভির দিকে তাকিয়ে। অভির বুকের মাঝে আলোড়ন শুরু হয়ে যায়।
মৈথিলী ওকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার নাকি এক বান্ধবী আছে?”
অভি, “হ্যাঁ আছে।”
মৈথিলী, “কি নাম?”
অভি, “আমার কলেজের বান্ধবী, নাম জেনে কি করেবে?”
মৈথিলী চোরা হাসি দিয়ে বলে, “ধ্যাত দুষ্টু ছেলে, মিথ্যে কথা বলছ, কলেজে তোমার কোন বান্ধবী নেই।”
শেষ পর্যন্ত ওর দেবী কে এই ঘোলা জলের মধ্যে টেনে আনতে হবে ভেবে মাথা গরম হয়ে যায়। দাতে দাঁত পিষে উত্তর দেয় অভি, “অরুন্ধতি, আমার বান্ধবীর নাম।”
মৈথিলী, “প্রোপোজ করও নি কেন?”
“অরুনা আমি খুবই দুঃখিত রে, আমি তোকে এই ঘোলা জলে টেনে এনেছি” অভির মন কেঁদে ওঠে, অভি গম্ভির সুরে উত্তর দেয়, “সময় চাই, এখন সময় আসেনি তাই প্রোপোজ করিনি।”
মৈথিলী, “তোমার মনে হয় না যে তোমার ভবিতব্য তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারে?”
অভি, “মানে?”
মৈথিলী, “মানে, তুমি তোমার বান্ধবীকে এখন প্রোপোজ করনি আর আমার বোন তোমার জীবনে চলে এল, তাহলে?”
অভি, “তাহলে?”
মৈথিলী, “তাহলে কি, অরুনিমার সাথে কথা বলে দেখ, ভাল মেয়ে আমার বোন।”
অভি, “আর তারপরে?”
মৈথিলী, “তারপরে আর কি নিজেকে ছেড়ে দাও নদীর সাথে, দেখ নদীর জল কোথা থেকে কোথায় গড়ায়।”
চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে ওঠে মৈথিলীর, ঠোঁটে কামনার এক চিলতে হসি লেগে।
নিজেকে বাচানর জন্য অভি প্রশ্ন করে, “সুব্রত জানে যে তুমি আমার ঘরে এসেছ?”
দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নাড়ায় মৈথিলী, “হ্যাঁ, সুব্রত জানে আমি এখানে এসেছি। এমন কি বাড়ির সবাই জানে যে আমি তোমাকে চা দিতে এসেছি।”
অভি ভাবল যে, অরুনিমা বা পরী যদি ওর ঘরে চা দিতে আসত তাহলে হয়ত বাবা মায়ের একটু খটকা লাগত, কিন্তু কেউ মৈথিলী কে সন্দেহ করবে না।
অভি মনে মনে ভাবল, দেখা যাক এই আগুনের খেলা কোথায় নিয়ে যায়, ঠোঁটে এক শয়তানি হাসি দিয়ে বলে, “আমি তোমার বোনের সাথে দেখা নিশ্চয় করব।”
মৈথিলী অভির কথা শুনে, বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে পরে। টেবিলের একদম পাশে এসে ওর গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে সামনে ঝুঁকে পরে। নরম তুলতুলে বক্ষ অভির ঘাড়ের ওপরে চেপে যায়, ঝুঁকে পড়ার জন্য, নিতম্ব পেছনের দিকে ফুলে ওঠে। অভি নিজেকে আয়ত্তে রাখে, মনের গভিরে ওই নিতম্বে হাত দিয়ে পিষে ফেলার ইচ্ছে টাকে দমন করে দেয়। ঘাড়ের কাছে চেপে থাকা বুকের বিভাজনে যেন মুখ ঘুরালেই চেপে যাবে, অভির মনে হয় ওই নরম বক্ষ দুটি হাতের মধ্যে নিয়ে চিপে পিষে নিংড়ে নেয়, ওর কামনার শরীর টিকে মেঝের ওপরে চেপে ধরে সব রস পান করে নেয়।
অভির সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলা করে চলেছে। মৈথিলী অভির চুলে বিলি কাটে। অভির সারা শরীরের পেশি শক্ত হয়ে যায়, কোনক্রমে নিজেকে প্রাণপণে আয়ত্তে রাখতে আপ্রান চেষ্টা করে যায়। মৈথিলী ওর মুখ অভির কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে, “মনে থাকে যেন, আমাকে কথা দিয়েছ যে তুমি অরুনিমার সাথে দেখা করবে।”
কথা বলার সময়ে মৈথিলীর নাকের ডগা অভির কানের লতি ছুঁয়ে যায়, অভির বুকের ভেতরে কামনার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে, চিৎকার করে যেন বলতে চায়, “চুরনি, তোমার লাল কোমল ঠোঁট আমি চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতাম, আমি তোমার পরিনের কাপড় ছিঁড়ে কুটিকুটি করে, তোমার দুই নরম তুলতুলে স্তন চেপে পিষে একাকার করে দিতাম আর তোমার নধর পুরুষ্টু নিতম্বে চাঁটি মেরে পিষে লাল করে দিতাম।
তোমাকে মেঝেতে শুয়ে তোমার জানু ফাঁক করে তোমার সব মধু পান করে নিতাম আর তোমার কমনীয় শরীর টাকে নিয়ে আছড়ে পিছরে মত্ত খেলায় খেলতাম আমি। ততক্ষণ খেলে যেতাম যতক্ষণ আমাদের দুজনের শরীরের সব রস এঁকে অপরকে ধুয়ে না দিত, তোমাকে শেষ করে দিতাম আর নিজেও তোমার মধুর আলিঙ্গনে শেষ হয়ে যেতাম।”
কিন্তু অভির গলা অস্বাভাবিক রকমে শুকিয়ে গেছে, কোন আওয়াজ বের হল না গলা থেকে।
কোমরে এক মত্ত ছন্দ তুলে অভির মাথা আর মন নিয়ে খেলা করে বেড়িয়ে গেল মৈথিলী। দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যাবার আগে, অভির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি মনের মধ্যে যা যা বলেছ, আমি সব শুনে ফেলেছি মিস্টার অভিমন্যু তালুকদার।”
অভি হতবাক হয়ে চেয়ারে বসে থাকে, নড়ার শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলেছে অভি।
মেনকার রথ
সকালের রোদ বড় মিষ্টি, মৃদু মন্দ বাতাসে বইছে, বাতাসে ঠাণ্ডার লেশ নেই। সকালের খাওয়ার পরে বাড়ির মধ্যে যেন কান্নার আভাস ওঠে। পরী আর তাঁর ছোটো মা, দু’জনের চেহারায় ভারী বেদনার ছায়া। মা পরীকে নিয়ে নিজের ঘরে বসে, পরী চুপ করে ব্যাগ গুছাচ্ছে আর মাঝে মাঝে চোখের কোল মুছছে।
অভি ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে কিছুক্ষণ, তারপরে মায়ের আর পরীর কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে বলে, “এত দুঃখ কিসের জন্যে?”
দুজনেই অভির দিকে ব্যাথা ভরা দৃষ্টিতে তাকায়, দুজনেই বাক্যহীন। মাকে বলল, “মা, তোমার পরী তোমাকে ছেড়ে ত যাচ্ছে না, এই বাসন্তি পুজোর পরে ও ত তোমার কাছেই আসছে। আর তুমি ত যখন ইচ্ছে দিদার বাড়ি যেতে পারো।”
মা অভির গালে আদর করে বলে, “বাবা, এখন বাবা হওনি ত তাই বলছ। বাবা মা হলে বুঝতে আমার কষ্ট।”
পরী মায়ের দিকে জল ভরা চোখে তাকিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে, “তুমি আমাকে কথা দিয়েছ যে স্কুলের পরে আমাদের বাড়ি আসবে আমার সাথে দেখা করতে।”
মা পরীর মুখ আঁজলা করে নিয়ে মাথায় চুমু খেয়ে বলল, “হ্যাঁ মা আমি তোর সাথে দেখা করতে যাব।”
সারা বাড়িতে যেন এক ব্যাথার ছায়া। মৈথিলীর আচরন আমুল বদলে গেছে কাল রাত্রের ঘটনার পরে। অভি যত বার ওর দিকে তাকায়, মৈথিলী ওর সাথে চোখ মেলায় না।
সুব্রত অভির কাছে এসে বলে, “মামা আসছি, আমাদের বাড়িতে এসো।”
অভি উত্তর দিল, “দিদাকে আমার প্রনাম দিও”, পরীর দিকে তাকিয়ে সুব্রতকে বলল, “আর আমাকে যেতে ত হবেই।”
মা অভিকে ওদের কে বাস স্টান্ডে ছেড়ে আসতে বললেন, আর তারপরে অরুনিমাকে ওর বাড়ি ছেড়ে আসতে বললেন। অরুনিমা মায়ের কথা শুনে অভির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে আছে অভি আর পরী, দু’জনে নিরুপায়, সর্বসমক্ষে কেউ কাউকে ঠিক ভাবে বিদায় পর্যন্ত জানাতে পারছে না। বড় ব্যাথা নিয়ে দুজনে একে অপরকে দেখে যায়। পরীর চোখ ছলছল, বাস এসে গেল।
শেষ পর্যন্ত পরী ওর কাছে এসে নিচু গলায় চোখ টিপে বলল, “ভাল ভাবে পড়াশুনা কোরো, তোমার জন্য না করলেও আমার জন্য ভালো রেসাল্ট কোরো, আর অপ্টিস্কের বইটা ভাল করে দেখবে।”
বাসে উঠে পড়ার আগে বাকিদের চোখ এড়িয়ে হটাত করে বাঁ হাতের তর্জনী ঠোঁটের ভিজিয়ে অভির গালে লাগিয়ে দিল। অভি হাত বাড়িয়ে পরীকে ছুঁতে চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণে পরী বাসে উঠে পরে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁদে ওঠে অভির। নিজের গালে পরীর লালা লেগে, বড় মধুর সেই অনুভব। সুব্রতদের পেছনের সিটে জানালার ধারে বসে পরী, বাস ছেড়ে দেওয়ার আগে, বাঁ হাতের তর্জনী ঠোঁটের কাছে এনে, ডগায় একটা আলতো চুমু খেয়ে অভির দিকে ছুঁড়ে দেয়। বাস ছেড়ে দেয়, অভি ওর ছুঁড়ে দেওয়া চুমুটা হাওয়া থেকে টেনে নিয়ে পকেটের মধ্যে পুরে নেয়।
বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে অপ্টিস্কের বই খোলে। পরীর চোখ টেপার ইশারা, অভি নিশ্চিত যে পরী অপ্টিস্কের বইয়ের পাতায় কিছু রেখে গেছে। বইয়ের ভেতর পনের নাম্বার পাতায় খুব ছোটো অক্ষরে লেখা।
“মিস ইউ, ছোট্ট রাজকুমার। কল্যাণীর ফোন নাম্বার xxx-xxxx। ফোন কোরো, আমি অপেক্ষা করে থাকব।”
সেই একটা ছোটো লাইন অনেক কিছু অভির কাছে, সারা ঘরের মধ্যে যেন পরীর গন্ধ আর ছোঁয়া খুঁজে পেল অভি।
অরুনিমা ফিরে যাবার জন্য তৈরি। মা অভিকে বললেন যে ওদের বাড়ি গিয়ে যেন ওর ভদ্রতার খাতিরে ওর বাবা মায়ের সাথেও দেখা করে আসে।
ট্যাক্সি তে পাশাপাশি বসে, অভি অরুনিমার দিকে তাকাল। পরনে একটা হাঁটু পর্যন্ত সাদা জিন্স আর গাড় নীল রঙের টাইট টপ। জিন্স টা যেন অত্যধিক ভাবে ওর কোমরের নিচের অঙ্গের সাথে আঠার মতন লেপটে আছে আর টপের অবস্থাও সেই একি রকমের। গোলাপের কুঁড়ি যেন অভির পাশে বসে। মাঝে মাঝে অভির চোখ চলে যায় ওর ফুটন্ত শরীরের দিকে, অরুনিমা ওর পাশে বসে ওর দিকে আময়িক হাসে। অনেকক্ষণ দুজনে চুপ চাপ, অভির মনে পরীর কাছ থেকে বিচ্ছন্ন হওয়ার বেদনা যেন এক দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল।
অরুনিমা, “তুমি কি আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছ?”
অভি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “কই না ত।”
অরুনিমা, “তাহলে এত দিনে আমাকে ফোন কেন করলে না?”
অভি, “হুম, তোমার দেওয়া কাগজ টা আমার সুটের পকেটে ছিল, আর বিয়ে থেকে আসার পরে মা সুট টা ড্রাই ক্লিনিঙ্গে দিয়ে দিল তাই তারপরে কাগজ টা হারিয়ে গেল। কিন্তু…”
অরুনিমা, “কিন্তু কি?”
অভি, “কিন্তু তুমি আমার ফোনের অপেক্ষায় কেন ছিলে?”
অরুনিমা, “কেন ভদ্রতার খাতিরে কি একবার ফোন করতে নেই? তুমি কেমন ভদ্রলোক অভিমন্যু কেমন করে মহিলার মন জয় করতে হয় তাও জানো না?”
অভি মনে মনে বলে, “আমাকে শিখাতে যেও না, কেমন করে মেয়েদের মন জয় করতে হয়।”
অভি ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। অরুনিমা ওর পাশে সরে এসে বসল। কাঁধে কাঁধ ছুঁয়ে গেল, বাজুর সাথে ওর বাজু। দু’হাত কোলের ওপরে জড় করে রাখা। অরুনিমা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে, অভি ওই হাসি দেখে হেরে যায়।
অভি, “আচ্ছা বাবা তুমি জিতলে।”
অরুনিমার চোখে আহবানের মৃদুহাসি, “কি জিতলাম, শুধু একটা ফোন কল, তাও ভদ্রতার জন্য?”
অভি, “তুমি আমাকে চেন না, আমি কে, আমি কি।”
মিষ্টি হেসে অরুনিমা অভির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “সবকিছু কখন না কখন জীবনে প্রথম বার হয়, তাই না। আমাদের চেনা পরিচয় হতে দোষ কি? আমি অরুনিমা, আমাকে তুমি তুলি বলে ডেক।”
অভি ওর হাত হাতে নিয়ে করমর্দন করল। অরুনিমার যেন হাতটা টেনে নেওয়ার ইচ্ছে নেই, রেখে দেয় অভির হাতের ওপরে। অভির মাথায় শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল, দেখা যাক এই সেদিনের মেয়ে কি করতে পারে। একটু অভিনয় করেই দেখা যাক, জল কত দূর গড়ায়।
অভি, “তুমি আমার নাম ভাল করে জানো।”
কিছুক্ষণ ওর চোখের দিকে একভাবে তাকিয়ে বলল, “তুলি আমি জানি তুমি গতকাল কেন আমার বাড়িতে এসেছিলে।”
অরুনিমা ধরা পরে গেছে এমন ভান করে একটু লজ্জা পেয়ে গেল। অভির দৃষ্টি অরুনিমার ঠোঁটে, নাকে আর মুখের দিকে নিবদ্ধ।
অরুনিমা কিছুক্ষণ পরে অভিকে জিজ্ঞেস করে, “কাল রাতে খাওয়ার সময়ে তুমি খুব চুপচাপ ছিলে, কেন কারন কি?”
দীর্ঘশ্বাস ছারল অভি, “মা আর পরীকে কাঁদতে দেখে মন একটু খারাপ হয়ে গেছিল তাই চুপচাপ ছিলাম আমি।”
অরুনিমার পরের প্রশ্ন বান অভিকে বিঁধে দিল, “কাল রাতে তোমার ঘর থেকে ফেরার পরে চুরনিদি খুব চুপচাপ ছিল? কি ব্যাপার।”
অভি অরুনিমার চোখের দিকে তাকাল, বুঝতে চেষ্টা করল যে অরুনিমা কি জানে গত কাল রাতের ঘটনা। গম্ভির আওয়াজে উত্তর দিল, “ওকে জিজ্ঞেস করে নিও, আমি কি করে বলব।”
অরুনিমা নিচের ঠোঁট কামড়ে দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বলল, “আমি আমার দিদি কে চিনি।”
অভি অবাক হয়ে গেল উত্তর শুনে, এবারে ওর কি কর্তব্য। অরুনিমা বলল, “আমার বড়দি, আমি বিগত আঠার বছর ধরে চুরনিদি কে চিনি।”
চিবুকে হাত রেখে ভাবতে শুরু করে অভি, দুই বোনে মিলে কি করতে চলেছে। ট্যাক্সি তখন শিয়ালদা রেল স্টেসান পার করে এ.যে.সি বোস রোড ধরে এগোচ্ছে।
অরুনিমা, “গত পাঁচ বছরে আমি চুরচনিদি কে খুব ভাল ভাবে চিনেছি, বিশেষ করে সুব্রত জিজুর সাথে দেখা হওয়ার পরে। আমাদের মধ্যে বয়সের ব্যাবধান থাকতে পারে, চুরনিদি পঁচিশ আর আমি উনিশ কিন্তু আমরা দুজনে খুব কাছের মানুষ। আমার দিদি সত্যি খুব মিষ্টি আর সুন্দরী আর জিজুর ত কথাই আলাদা। ওরা দুজনেই আমাকে খুব ভালবাসে।”
না অভি ওর কথার কোন মাথামুন্ডু খুঁজে পাচ্ছে না, কি বলতে চাইছে অরুনিমা।
অরুনিমা, “ওরা দুজনেই আমার সম্পর্কের ব্যাপারে খুব চিন্তিত, ওরা চাইত যে এমন কারুর সাথে আমার সম্পর্ক হোক যে ওদেরও খুব কাছের আর চেনা জানা লোক হবে।”
অভি এতক্ষণে কিছু বুঝে উঠতে পারল, “আচ্ছা তাই আমাকে নিয়ে টানাটানি।”
গাল লাল হয়ে গেল অরুনিমার, হেসে ফেলল, “হ্যাঁ তাই।”
অভি ওকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি তোমার দিদির ব্যপারে আর কিছু বলতে চাও আমাকে?”
অরুনিমা, “আগে তুমি বলো যে গতকাল রাতে কি হয়েছে? চুরনিদি কেন চুপ ছিল কিন্তু ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল যে মনের মধ্যে খই ফুটছে? তুমি যদি আমাকে বলো তাহলে আমি জানাব চুরনিদির ব্যাপারে।”
“হুম তাহলে খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে, সাপ আর বেজির খেলা। দেখা যাক এই খেলায় কে যেতে আর কে হারে” আপনমনে বলল অভি, “আমি সাধারন বাঙালি ছেলে নই যা তুমি ভাবছ। আমি কিন্তু আগুনে ঝাপ দেবার জন্য সবসময়ে তৎপর, সুতরাং আমার সাথে খেলার আগে যাচাই করে নেবে একটু যে আগুনের খেলা কার সাথে খেলছ।”
না, অভি অরুনিমাকে সাবধান করে নি, নিজের মনে বলেছে। দাতে দাঁত পিষে অরুনিমাকে গম্ভির স্বরে উত্তর দিল, “এত জানার ইচ্ছে থাকলে তোমার চুরনিদিকে জিজ্ঞেস করে নিও।”
গাড়ি ঢাকুরিয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। অভির আর ইচ্ছে করল না যে অরুনিমার বাড়িতে যায়, তাই ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি কিছু মনে না কর তাহলে আজ আর তোমার বাড়ি যাব না, তোমাকে বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে আমি ফিরে যাব।”
একটা দুষ্টুমিষ্টি হাসি হেসে অরুনিমা বলে, “তুমি যদি আমার বাড়ি না আস তাহলে আমি তোমার মাকে ফোন করে বলে দেব যে তুমি আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেছো। সেটা কি ভাল হবে?”
উত্তরে অভি হেসে বলে, “ব্লাকমেল করছ আমাকে?”
“দেখা যাক কি হয়, হাত না পুড়লে হল।” মনে মনে ভাবল অভি।
বাড়িতে গিয়ে ছাড়তে হল অরুনিমাকে, দেখা করতে হল অরুনিমার বাবা মায়ের সাথে। অরুনিমার পরিবার বেশ সচ্ছল আর রুচিসম্পন্ন। চা খেতে খেতে গল্পের মাঝে জানা গেল যে অরুনিমার এক ভাই, আরুনাভ ক্লাস এইটে পড়ে। অরুনিমার বাবা রাইটারসে চাকরি করেন আর মা গৃহবধু। মৈথিলী অরুনিমার জেঠুর মেয়ে, কলেজের পড়াশুনা ঢাকুরিয়া থেকে করেছে আর সেই সময়ে তুলি আর চুরনি এঁকে ওপরের কাছাকাছি এসেছে। চুরনি তুলি কে নাকি খুব ভালবাসে।
বিদায় নেবার সময়ে, তুলি অভিকে ছাড়তে রাস্তা পর্যন্ত আসে। অভি ট্যাক্সিতে চড়ার আগে তুলিকে বলে, “এবারে খুশিত, এই যে আমি তোমার বাড়ি এসেছি।”
তুলি মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ খুশি, কিন্তু এটা নিশ্চয় আমাদের শেষ দেখা নয়, তুমি চুরনিদিকে কথা দিয়েছ।”
অভি, “সত্যি কথা বলতে কি জান, আমি তোমার মন ভাঙ্গতে চাই না।”
তুলি হটাত করে ওর হাত ধরে ফেলে, “কে বলেছে যে তুমি আমার মন ভেঙ্গে দেবে? আমি ত শুদু একটা সুযোগ চাই তোমার কাছে নিজেকে মেলে ধরার জন্য।”
ট্যাক্সিতে চেপে গেল অভি, জানালার কাছে এসে তুলি ফিসফিস করে বলল, “তোমার জন্য অনেক কিছু লুকিয়ে রেখেছি আমি, তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করে দেব।”
শেষের কথা ঠিক অনুধাবন করতে পারল না অভি, গাড়ি ছেড়ে দিল। মনের মধ্যে উত্তাল তরঙ্গ দোলা দিচ্ছে, চুরনি তুলি, তুলি চুরনি, কি করতে চলেছে ওর সাথে। না বেশি কিছু ভাবতে পারছে না অভি, শেষমেস হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবল, আগুন যখন সামনে জ্বলছে তাতে ঝাপ দিয়েই দেখুক না জ্বলে কি না।
রম্ভার বাঁশি
দু’দিন পরে সকাল বেলায় এক অপ্রত্যাশিত ফোন এল। বাবা মা দুজনেই কাজে বেড়িয়ে গেছেন, অভি কিছুক্ষণের মধ্যে কলেজের জন্য বের হবে। ঠিক এমন সময়ে ফোন বেজে ওঠে।
ওপার থেকে তুলির গলা, “একদম ভুলে গেছ না আমাকে?”
অভি, “না ভুলবো কেন, সবে মাত্র দু’দিন কেটেছে।”
তুলি, “তুমি আমার সাথে দেখা করতে পার?”
অভি, “মানে? কোথায়?”
তুলি, “মানে বাইরে কোথাও। তুমি ভবানিপুর মেট্রো স্টেসানে আসতে পার, ঠিক দুটো নাগাদ আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব গেটের কাছে।”
অভি, “ঠিক আছে, আসব।”
কলেজে গিয়ে অরুনাকে অরুনিমার কথা বলল। সব শুনে অরুনা রেগে গেল অভির উপরে, “তুই একটা শয়তান কুত্তা। তোর কোন বোধ জ্ঞান নেই, শুচিস্মিতার কি হবে?”
অভি মজা করে বলল, “অয়ান ডে ম্যাচ দেখা যাক না কি হয়। ক্রিকেটে যারা টেস্ট ম্যাচ খেলে তারা কি অয়ান ডে খেলে না?”
অরুনা রেগে গিয়ে বলল, “অভি, জীবন কিন্তু ক্রিকেট খেলা নয়, একটু সিরিয়াস হ।”
অভি ওর দিকে চোখ টিপে বলল, “আরে বাবা দাবার ছক সাজান, ঘুটি এগিয়ে গিয়েছে, পরের চাল আমার। আমাকে দেখতে হবে এই খেলার শেষ কোথায় কেননা আমি বুঝতে পারছি যে এর পেছনে অন্য কোন গুড় মতলব আছে আমি তাঁর শেষ দেখতে চাই।” বিশেষ কিছু খোলসা করে না বলে বলল, “সাপ আর ঈগলের খেলা, অরুনা, দেখা যাক কে যেতে।”
অরুনা জিজ্ঞেস করে, “কে সাপ আর কে ঈগল?”
অভি, “অবশ্যই আমি ঈগল।”
তর্জনী তুলে ওকে সাবধান করে বলে অরুনা, “অভি, আগুন নিয়ে খেলিস না। খুব সাঙ্ঘাতিক কিছুর গন্ধ পাচ্ছি আমি। তুই যদি হাত পুড়িয়ে আমার কাছে আসিস তাহলে কিন্তু আমি তোর পিঠের চামড়া নামিয়ে দেব, তারপরে অবশ্য ওই পিঠে আবার বারনল লাগিয়ে দেব।”
দাবার ছকে ঘুঁটি বসানো, চাল একদিকে চেলে দিয়েছে, এখন অভির অপেক্ষায়। অভি ঠিক সময়ে মেট্রো স্টেসানে পৌঁছে যায়। তুলি ওর জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সাদা জিন্স নীল টপ, জিন্স টা যেন তুলির কোমরের নিচে চামড়ার সাথে লেপটে আছে, টপের অবস্থা সেই রকম। কাঁধে একটা ব্যাগ, দেখে মনে হল কলেজ পালিয়ে এসেছে।
অভি ওকে জিজ্ঞেস করল, “কি কলেজ পালানো হয়েছে নাকি? তা কোথায় যেতে চাও?”
তুলি ওকে দেখে হেসে বলল, “রবীন্দ্র সরবোর যাবে?”
অভি, “নাহ, অসব জায়গায় আমি যাই না, শুধু জোড়ায় জোড়ায় ছেলে মেয়েরা বসে থাকে ওখানে, আমার কেমন বিরক্ত বোধ হয় ওই সব জায়গায়।”
তুলি, “ত বন্ধুদের সাথে তুমি কোথায় যাও?”
অভি, “কফি হাওস না হলে এস্প্লানেড না হলে ফ্লুরিস। তুমি কোথায় যেতে চাও বল?”
তুলি, “নন্দন যাবে?” সারা টা বিকেল ওরা দু’জনে নন্দনে গল্প করে কাটিয়ে দিল। অভি খুব সন্তর্পণে নিজের কথা চেপে গেল, গল্প কিছু এদিক ওদিক বিষয়ে চলল।
ঘন্টা থেকে দিন কেটে গেল। অভির আর তুলির মাঝে এক নতুন সম্পর্ক তৈরি হল। রাতে অভি চিন্তা করে যে কি চায় তুলি, কিন্তু তুলি যেন খুব সতর্ক মেয়ে, ওর চাল অভিকে বুঝতে দেয় না আর অভিও নাছরবান্দা, প্রন করেছে যে এই সম্পকের শেষ কি। তুলির বাঁশির শুর অভিকে মোহিত করে দিয়েছে, অভি অজান্তেই কখন যে নিজেকে ধরা দিয়ে দিয়েছে সেটা আর টের পায়না। অভি ওর ব্যাপারে বেশ কিছু কথা জানতে পারল, যেমন তুলি গান শুনতে খুব ভালবাসে, সমুদ্র আর বিচ ভালবাসে, ইংরাজি রোম্যান্টিক সিনেমা ভালবাসে।
অভির ও গান ভাললাগে, সেই শুনে একদিন তুলি ওকে একটা সোনি অয়াকম্যান উপহার দিল। মান্না দের গান অভির খুব প্রিয়, অভি বেশির ভাগ সময়ে অয়াকম্যানটা কলেজের ব্যাগে রেখে দিত।
কলেজে অরুনার সাথে দেখা হলেই অরুনা হেসে জিজ্ঞেস করত ওর কথা। অরুনা দিনে দিনে অভির চালচলনে পরিবর্তন দেখে মনক্ষুণ্ণ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে অরুনার অভির ওপরে খুব রাগ হয়, কিন্তু অভির মেজাজ দেখে কিছু বলে না।
একদিন অভি অরুনাকে বুঝাতে চেষ্টা করে, “দ্যাখ ভাই, আমি অরুনিমার পেছনে পরে নেই, চিন্তা করিস না।”
অরুনা ওর দিকে প্রশ্ন ভরা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুই নিজেকে জিজ্ঞেস করে উত্তর দিচ্ছিস ত?”
অরুনার চোখের চাহনি যেন অভিকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল, “তুই বুকের ওপরে হাত রেখে আমাকে উত্তর দে, আমি বিশ্বাস করে নেব।”
অভি পারেনা বুকে হাত রেখে উত্তর দিতে, তাও অরুনাকে শান্ত করার জন্য বলে, “দ্যাখ আমি পরীকেই ভালবাসি। পরীর প্রতি আমার ভালবাসায় কোন ভাটা পরেনি। আমি শুধু এই খেলার শেষ দেখতে চাই, আমি জানতে চাই ওদের মাথায় কি চলছে।”
অরুনা, “কেন তোর জেনে কি হবে?”
অভি, “দ্যাখ, আমি আগেই সুব্রত আর মৈথিলীকে জানিয়েছিলাম যে আমি একজন কে ভালবাসি। সেটা জানার পরেও ওরা আমাকে তুলির সাথে দেখা করতে বলে। আমি হলফ করে বলতে পারি যে তুলিও জানে যে আমি একজন কে ভালবাসি। সবকিছু জানার পরেও যে তুলি আমার সাথে খেলে যাচ্ছে তার আমি শেষ দেখব না? এর পেছনে সুব্রত বা মৈথিলীর হাত আছে, সেটা আমি জানতে চাই।”
অভি খুব চেষ্টা করে মৈথিলীর ব্যাপারে জানার জন্য, কিন্তু চালাক মেয়ে তুলি, ঘুণাক্ষরেও অভিকে ওদের অভিপ্রায় জানায় না। একদিন অভি আর থাকতে না পেরে সোজা তুলিকে চুরনির কথা জিজ্ঞেস করে।
অভি, “তুলি, তোমাকে যখনি আমি চুরনির কথা জিজ্ঞেস করি, তখনি তুমি এড়িয়ে যাও আমার প্রশ্ন। কেন?”
তুলি, “তুমি দিদির ব্যাপারে কেন জানতে চাও? ওর ত বিয়ে হয়ে গেছে।”
অভি একবার ভাবে যে তুলিকে বলে সেই রাতের ঘটনা কিন্তু চেপে যায় অভি।
তুলি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে এক দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি দিদিকে খুব পছন্দ হয়েছে।”
একি প্রশ্ন করল, জোরে মাথা নাড়ায় অভি, “না না না… একদম না।”
তুলি চোখ টিপে বলে, “সত্যি করে বল, দিদিকে তোমার খুব পছন্দ?”
অভি, “এই প্রশ্ন কেন করছ? আমি এমনি চুরনির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি, আর কিছু না। যেদিন তোমাকে তোমার বাড়িতে ছেড়ে এসেছিলাম সেদিন তুমি বলেছিলে যে তুমি আর চুরনি খুব ক্লোস রিলেসান সেয়ার করো, তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম।”
তুলি, “তাহলে তুমি আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে চাও?” চোখ টিপে তুলি উত্তর দিল, “হ্যাঁ আমাদের দুজনে মাঝে খুব কাছের এক সম্পর্ক আছে। আমরা দুজনে সব কিছু ভাগ ভাগ করে নেই।”
চশমার পেছন থেকে অভি ওদের মাঝের সম্পর্কের ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে।
তুলি, “ওইরকম করে কেন দেখছ। বললাম ত চুরনি আমার দিদি আর ও আমাকে ওর সব কথা বলে আর আমি ওকে আমার সব কথা বলি। দুজনের মাঝে আমরা কিছুই লুকিয়ে রাখি না।”
অভি, “হুম বেশ ভাল কথা, জেঠতুত খুড়তুত বোনেদের মধ্যে এই রকম সম্পর্ক খুব কম দেখেছি।”
তুলি এর চেয়ে বেশি আর কিছু জানায় না অভি কে।
অভি সামনে বসা গোলাপের কুঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি বারে বারে ওর বুকের দিকে চলে যায়, পাতলা হলেও বেশ সুন্দর গঠন তুলির। দেখে মনে হয় যেন, নব্য অঙ্কুরিত এক ধানের শিষ, এখন দলিত হয়নি কারুর ছোঁয়ায়। ঠোঁটে সর্বদা এক মিষ্টি হাসির প্রলেপ লাগান থাকে, দু’চোখ যেন অত্যধিক কথা বলে।
চুরনিকে দেখতে অনেক আলাদা। চুরনির চেহারা অনেক বেশি নধর আর কামনাময়ি। অভি ওর কামুক চিন্তায় চুরনিকে নগ্ন করে পড়িয়ে দেয় সুব্রতর দেওয়া সেই লাল রঙের বিকিনি। খোলা চোখের সামনে চুরনির ছোট্ট লাল বিকিনি পরিহিত আকর্ষণীয় শরীর দেখতে পায়। মাথার মধ্যে যেন কামনার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। না অভির মনে চুরনির প্রতি কোন ভালবাসা নেই আছে শুধু কামনার আগুন, চুরনিকে নিংড়ে নেবার প্রচন্ড লিপ্সা।
হটাত তুলি অভিকে জিজ্ঞেস ক্করে, “আচ্ছা একটা কথা মাকে বলবে?”
অভি, “কি কথা।”
তুলি, “আমাকে তোমার কেমন মনে হয়?”
অভি ওদের দু বোনের কাউকেই ভালবাসে না, মনের মধ্যে একটা প্রচন্ড খিদের উদ্রেক হয়, এই দুই কামতারিত নারীর যৌবন সুধা পান করার জন্য। মনের ভাব অতি সন্তর্পণে লুকিয়ে নেয় অভি।
চোখে চোখ রেখে মিথে বলে অভি, “হুম মানে হ্যাঁ একটু, কিন্তু ভবিষ্যতের কথা জানি না।”
ওর কথা শুনে হাসি ফুটে ওঠে তুলির ঠোঁটে, “বর্তমান টাকে আনন্দে বাঁচ অভি, ভবিষ্যৎ কে দেখেছে।”
ওদিকে অরুনা বুঝতে পারে অভির আর তুলির মাঝের সম্পর্ক। নিজেকে ধিরে ধিরে অভির কাছ থেকে দুরে সরিয়ে নেয় অরুনা। অভিকে দেখে খুব কষ্ট হয় ওর, কিছুতেই কথা শুনছে না অভি। পরী রাতের বেলা স্বপ্নে দেখা দেয় কিন্তু আজকাল সেই স্বপ্ন যেন অনেক দুরের মরিচিকার মতন মনে হয় অভির।
তুলির সাতে দেখা হওয়ার প্রায় দিন বারো কেটে গেছে। এক মঙ্গলবারে তুলি রাতে অভিকে ফোন করে।
তুলি, “হ্যালো অভি।”
অভি, “হ্যাঁ বল, কিছু জরুরি আছে নাকি?”
তুলি, “না মানে হ্যাঁ। কাল বিকেলে আমি বাড়িতে একটা ছোট্ট পার্টি দিচ্ছি। তাই আমি চাই যে তুমিও এস আমার পা+টিতে।”
অভি, “কি খুশিতে পার্টি।”
তুলি, “কিছু না, এমনি এমনি পা+টি। তুমি আমি আর আমার কিছু কাছের লোকজন।”
কেন তুলি একা নয় বাড়িতে, কেন তুলিকে একা পেতে পারেনা, একবার একবার একা পেলে কি করবে অভি। না আর ভাবতে পারে না অভি, ও যেন এক অতল অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।
অভি, “তুমি একা নিশ্চয় থাকবে না, তাই ত?”
তুলির হাসি কানে আসে, “তুমি কি চাও আমি বাড়িতে একা থাকি?”
অভি, “না মানে আমি চাই না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”
তুলি, “তাহলে গুড নাইট, ভালো থেক। কাল বিকেলে ঠিক পাচটায় আমার বাড়িতে। তোমাকে আমি নিরাশ করব না, তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে।”
রাতের খাবার পরে ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে অভি। একমনে আকাশ দেখে, বসন্তের আকাশে মেঘ কিছু কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দূর আকাশের কোলে একটা ছোট্ট নৌকা দেখতে পেল, নৌকাটি একটা ছোট্ট দ্বিপের দিকে বেয়ে আসছে। সেই দ্বীপের তীরে এক মোহময়ি নারী একটা গাছের গুঁড়ির ওপরে বসে খুব সুন্দর বাঁশি বাজাচ্ছে। বাঁশির সুর ওকে যেন এক অধভুত মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। যে নৌকা চালাচ্ছে সে অভির দিকে তাকাল, অভি অবাক হয়ে গেল নিজেকে নৌকায় দেখে।
দিগন্তের দিকে তাকাল অভি, আকাশে চাঁদ এবং সূর্য দুটোই পশ্চিম আকাশে দিগন্তের কোলে হারিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুটো খগোল বস্তুর আলো বড় ম্লান, অভির নৌকা যত ওই দ্বিপের কাছে যায়, আলো যেন আরও ম্লান হয়ে আসে।