ভালবাসার রাজপ্রাসাদ | পর্ব – ১৮ | বীরের প্রত্যাবর্তন

61 Min Read

কোমরের নিচে সজোর এক লাথির চোটে অভির ঘুম ভেঙ্গে যায়, ঘুম ঘুম চোখ খুলে দেখে সামনে সুপ্রতিমদা দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিচ্ছে।
সুপ্রতিমদা, “কিরে বোকা… উঠে পড়। সবাই ধাঙ্কার যাবার জন্য তৈরি আর আমাদের টিম লিডার নাক ডেকে ঘুমচ্ছে।”
অভি ঘুম চোখ রগড়ে সুপ্রতিমদাকে জিজ্ঞেস করে, “পরী কোথায়?”
সুপ্রতিমদা, “শালা, সারা রাত ধরে তুমি তোমার পেরেক গুঁজে যাবে আর ভাবছ যে সকাল বেলায় ও তোমার পাশে থাকবে? বোকা… ওঠ…”
মাথা চুলকে সুপ্রতিমদার দিকে হেসে বলে, “বোকা… তুই যেন হাতে নিয়ে নাড়াচ্ছিলি, তুই কি পেরেক গুঁজিসনি মাখনের মধ্যে?”
দুজনেই হেসে ফেলে গত রাতের কথা ভেবে। সুপ্রতিমদা বলে, “পাঁচটা মেয়েই সকালে উঠে পরে, হাঁটতে গেছে স্পিতির দিকে।”
অভির গায়ে কোন কাপড় নেই, সুপ্রতমদার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সুপ্রতিমদা মেঝে থেকে অভির প্যান্ট তুলে ছুঁড়ে মারে অভির মুখের ওপরে। শয়তানি হেসে বলে, “উঠে পর এবারে বোকা… তাড়াতাড়ি তৈরি হয়েনে, স্রে আটটা বাজে, এতক্ষণে মনে হয় মেয়েরা এসে গেছে।”

তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে স্নান সেরে, জামা কাপড় পরে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে অভি। বাইরের ঘাসের বাগানের ওপরে টেবিল পেতে ওদের সকালের খাওয়ার ব্যাবস্থা করেছে হোটেলের ম্যানেজার। আজকে ওরা ধাঙ্কার মঠ ঘুরতে যাবে। খাবার টেবিলে পরীর দিকে তাকায় অভি, পরী ওর উল্টো দিকে রিতিকা আর অরুনার মাঝে বসে। পরনে দুধ সাদা একটা সালোয়ার কামিজ আর তাঁর ওপরে গাড় নীল রঙের কার্ডিগান। সকালে উঠে স্নান সেরে নেওয়া ওর অভ্যেস, সদ্য স্নাত পরীকে দেখতে ঠিক এক দুধ সাদা অপ্সরার মতন লাগছে। দুপাশের, সুন্দরী নারী দের এক জন যেন মহামায়া আরেক জন শকুন্তলা। পরী মেয়েদের সাথে গল্প করে আর মাঝে মাঝে অভির দিকে আর চোখের তাকিয়ে হাসে।
চেহারায় এক অধভুত সুন্দর লালিমার ছটা। ভুরু নাচিয়ে পরীর দিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছো, দুষ্টু সোনা?”
শয়তানি করে জিব বের করে অভি আর প্লেটে থাকা চাটনি চেটে নেয়। অভির শয়তানি হাসি আর প্লেট চাটা দেখে পরীর বুঝতে অসুবিধে হয় না যে ওকি বুঝাতে চাইছে, লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে পরীর মুখ।
অভি ইশারায় জানায়, “তোমার মধু ভারী মিষ্টি, বেবি!”
সকালের খাওয়া শেষে অভির পরীকে অনুরধ করে জিন্স পড়ার জন্য। পরী নারাজ, জিন্স পড়তে, বলে যে অতে নাকি শরীরের প্রত্যেক আঁকিবুঁকি ভালো করে বোঝা যায় তাই লজ্জা করে ওর। বুঝিয়ে উঠতে পারে না অভি যে ওই পোশাকে পরীকে খুব আকর্ষণীয় দেখাবে। ওর কথা শুনে লজ্জায় কান লাল হয়ে যায়।
রিতিকা পরীর কাছে এসে কানে কানে বলে, “তোমার ফিগার এত সুন্দর, তোমাকে জিন্স আর টপে মারাত্মক দেখতে লাগবে, সবাই দেখে পাগল হয়ে যাবে।”
পরী ফিসফিস করে অভিকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি ইচ্ছে?”
ডান হাত কাঁধে রেখে পরীকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে অভি, দুজনে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। ঘড়ে ঢুকেই অভি পরীকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের লতি চুষে নেয় ঠোঁটের মাঝে।
পরী মোচর দিয়ে ককিয়ে বলে, “উফ, ছাড়ো ছাড়ো, এখন আর শয়তানি করোনা, ধাঙ্কার যেতে হবে, দেরি হয়ে যাবে।”
অভি পরীকে বাহুপাশ থেকে মুক্ত না করেই জিজ্ঞেস করে, “সকালে আমাকে একা ছেড়ে কেন পালিয়ে গেছিলে?”
পরী চোখ বন্ধ করে মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে দেয়, “তোমার চোখের দিকে তাকাতে আমার খুব লজ্জা করছিল, তাই আমি সকালে বেড়িয়ে পড়েছিলাম বাকিদের সাথে।”
পেটের ওপরে হাত চেপে, গালে গাল ঘষে কানে কানে বলে, “আই লাভ ইউ, পরী।”
পরী মৃদু সুরে ককিয়ে ওঠে, “ম্মম্মম্মম্মম… ছাড়ো আমাকে, না হলে কি করে জিন্স পড়ব?”
অভি পরীকে ছেড়ে দেয়, পরী আলমারি থেকে জিন্স আর মভ রঙের টপ বের করে বাথরুমে ঢুকে পরে। বাথরুমে ঢোকার আগে অভির দিকে একটু বিরক্তি, একটু দুষ্টু হাসি নিয়ে তাকিয়ে জিব বের করে ভেঙ্গিয়ে দেয়। অভি ওর দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে যে ওকে জিন্সে আর চাপা টপে প্রচন্ড আকর্ষণীয় দেখাবে। অভির দিকে হাত তুলে চাঁটি মারার ইশারা করে পরী, “শয়তান কোথাকার।” দরজা বন্ধ করে দেয়।
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে প্রেয়সীর অপেক্ষা করে। জিন্স আর টপ পরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসে পরী, পরীর সেই রুপ দেখে অভির মুখ হাঁ হয়ে যায়। সিগারেট টানা ভুলে নিস্পলক চোখে দেখতে থাকে পরীকে। কোমরের নিচে ত্বকের সাথে চেপে বসে জিন্সের মসৃণ কাপড়। কোমরের নিচের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন উন্মচিত, না, জিন্সের কাপড়ের পেছনে ঢাকা বটে, কিন্তু অভির চোখে যেন সেই কাপড় ফুঁরে সব কিছু দেখতে পায়। সামনে জানুমাঝে ছোটো চেন, যেন নারীসুখের দোরগোড়ার এক অধভুত অবয়াব ধারন করেছে। অভি যেন চোখ ফেরাতে পারেনা, পরীর দেহ পল্লব থেকে। পরনের টপ, পরীর শরীরে যেন দ্বিতীয় ত্বক, দেহের অবয়াব যেন অতি পুরাতন বালির ঘড়ির মতন।
মাথার ওপরে জাপানি পুতুলের মতন করে খোঁপা বাঁধা, খপার মধ্যে দুটি ছোটো ছোটো কাঠি গোঁজা। কানে মুক্তোর দুল, ঠোঁটে গাড় বাদামি রঙ, চোখের কোলে কাজল। সবমিলিয়ে পরীকে দেখে মনে হচ্ছে যে স্পিতির তীরে আগুন লাগানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে আজ।
অভি ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে পরীকে। অভির তপ্ত চোখের চাহনি দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে অভির বুকে মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমার না খুব লজ্জা করছে, সোনা। আমি বাইরে যাবো না।”
মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, “কেন বেবি?”
বুকের ওপরে দাঁত দিয়ে আলতো কামর কেটে পরী বলে, “তোমার চোখ দুটি যেন আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল, যেন আমার গায়ে কোন কাপড় নেই।”
ঠিক সেইসময়ে দরজায় টোকা মেরে রিতিকা ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। পরী আর অভিকে দৃঢ় আবেগের আলিঙ্গনে বদ্ধ থাকতে দেখে রিতিকা বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ায়। পরী অভির বুক আলতো করে ঠেলে দিয়ে আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে রিতিকাকে জিজ্ঞেস করে যে কি খুঁজতে এসেছে।
রিতিকা পরীকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপরে দৌড়ে গিয়ে পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি ছেলে হলে নিশ্চয় তোমার প্রেমে পরে যেতাম।”
রিতিকা অভির দিকে চোখ টিপে বলে, “এক দিনের জন্য তোমার বউকে দেবে আমায়?”
রিতিকার দেহের গঠনও খুব সুন্দর আর কমনীয়। পরনে গাড় নীল রঙের আঁটো জিন্স আর সাদা শার্ট। অভি বেশ কিছুক্ষণ রিতিকার দিকে তাকিয়ে থাকে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবে চোখের সামনে এই দুই সুন্দরী আজ স্পিতির তীরে আগুন জ্বালিয়ে দেবে।
অভি পরীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে বাম হাত নিজের হাতে নিয়ে ছোটো একটা চুমু খায়। তারপরে গেয়ে ওঠে,
“আমি জামিনী তুমি শশী হে ভঠিচ্ছ গগন মাঝে,
মম সরসীতে তব উজ্বল প্রভাত, বিম্বিত যেন লাজে,
আমি জামিনী তুমি শশী হে ভঠিচ্ছ গগন মাঝে,……”
পরীকে সঙ্গে নিয়ে রিতিকা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল, পেছন পেছন অভি। অরুনাও পরীকে জিন্সে দেখে অবাক। অরুনা পরীর দিকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি সত্যি পরী, শুচিদি। তুমি যা পর তাই তোমাকে মানায়।”
পরী নতুন বউয়ের মতন লজ্জা পেয়ে যায় অরুনার কথা শুনে।
সুপ্রতিমদা ওর কাছে এসে মৃদু সুরে বলে, “লজ্জাবতি লতা, গালের লালিমা বিয়ের রাতের জন্য বাঁচিয়ে রাখো। এখন প্রান খুলে আনন্দ কর, ডার্লিং।”
কল্যাণী আর রানীও পরীকে জিন্সে দেখে অবাক, জীবনের প্রথম বার পরী অইরকমের পোশাক পড়েছে।
কিছুপরেই অভিরা ধাঙ্কার মঠের দিকে রওনা দেয়। গাড়ির চালক সুপ্রতিমদা, পাশে বসে রিতিকা। অরুনাকে নিয়ে পরী আর অভি পেছনে বসে।
কাজা থেকে ধাঙ্কার বেশ কিছু দুরে। ধাঙ্কার মঠ, উঁচু পাহাড়ের মাথায়। পাহাড়ের অধিকাংশ ঝুরঝুরে হয়ে ঝরে গেছে, পুরানো মঠের বেশির ভাগ অংশ খতিগ্রস্থ হয়ে গেছে। দূর থেকে সেই পাহাড় দেখলে মনে হয় যেন উঁচু এক উইয়ের ঢিবি। খুব কম বৌদ্ধ সাধু বসবাস করে পুরানো মঠে, একটি নতুন মঠ রাস্তার পাশে তৈরি করা হয়েছে। দুপুরের খাওয়া ওরা ধাঙ্কারে সেরে নেয়।
অভি আর সুপ্রতিমদা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার কে কাজার আগের রাস্তার খবর জিজ্ঞেস করে। ম্যানেজার জানায় যে কাজা ঠেলে লোসার নামক একটি গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা মোটামুটি ভালো, তারপরে ঠিক রাস্তা বলে কিছু নেই। আগের রাস্তা পাথর, বালি আর ঝরনায় ঢাকা, সুউচ্চ হিমালয়ের বুক চিড়ে রাস্তা, খুব ভয়ঙ্কর আর অতিব সুন্দর। কাজা থেকে মানালি, আরাইশ কিলোমিটারের মতন আর পুর রাস্তা একদিনে পার করতে হবে। কারন মাঝপথে থাকার কোন জায়গা নেই, আছে শুধু পাহাড় আর গভীর খাদ। রাস্তার মাঝে প্রচুর চড়াই উতরাই আছে আর কুঞ্জুম পাস নামক একজায়াগয় চড়াই পনেরো হাজার ফিটের ওপরে।
সবাই অভির দিকে তাকায়, এমন কি পরীও তাকায়, যেন ওই রাস্তার জন্য অভি দায়ী।
মাথার ওপরে হাত ছুঁড়ে সবার মনে উৎসাহ জাগাতে চেঁচিয়ে বলে, “আরে বাবা, চিয়ার আপ। ভগবান তোমাদের একটা জীবন দিয়েছে, আনন্দ করও, খুশিতে মন ভরিয়ে নাও গুরু। যতক্ষণ অভিমন্যু সাথে আছে, তোমাদের কোন ভিয় নেই।”
অরুনা অভির দিকে চেঁচিয়ে বলে, “হ্যাঁ, সে কথা ত শুধু শুচিদির জন্য, বাকিদের কি?”
অরুনাকে ক্ষেপানোর জন্য অভি বলে, “তোকে না হয় এখান থেকে ছুঁড়ে সমুদ্র নীলের কোলে ফেলে দেব, তাহলে ত খুশি? এবারে হাস হাস…”
ঠিক করা হল যে বিকেলে কোথাও না বেড়িয়ে সবাই হোটেলে বিশ্রাম করবে, কাল খুব ভরে রওনা দেবে কাজা থেকে। ধাঙ্কার থেকে কাজা ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটে বেজে যায়। ফেরার পথে মেয়েরা দীপঙ্কর আর রামানুজ বাজারের কাছে নেমে গেল। অরুনা আর পরী জানাল যে ওরা বারিতে ফোন করতে চায়। অভি পরীকে বলল যে ওর ছোটমায়ের সাথে ও কথা বললেই হবে, পরী একটু বিরক্তি বোধ করে। রিতিকা আর বাকি মেয়েরা একটু কেনাকাটা করবে। ইনোভা ওদের জন্য রেখে সুপ্রতিমদা আর অভি হোটেলে ফিরে আসে।
কাজায় শেষ দিন। সূর্য ডোবার পরে, পরী অভিকে অনুরধ করে নদীতে ঘুরতে যেতে। অরুনা ওর ঘরে বসে রানী আর কল্যাণীর সাথে গল্প করছিল। পরী চাইছিল যে ওরা একটু একা একা ঘুরতে যাক, অভির ও একি অভিপ্রায়। হোটেলে থেকে বের হতে যাবে তখন রিতিকার সাথে দেখা, রিতিকা ওদের জিজ্ঞেস করাতে, পরী জানায় যে ওরা নদীর দিকে ঘুরতে যাচ্ছে আর রাতে খাওয়ার আগে ফিরবে। সেই শুনে রিতিকা সুপ্রতমদাকে ডাক দেয় আর অভিদের সঙ্গে বেড়িয়ে পরে। হোটেল থেকে বেশ দুরে নদী, সুপ্রতিমদা অতি সন্তর্পণে গাড়ি সেই পাথুরে রাস্তার ওপরে দিয়ে, নদী গর্ভে নামিয়ে দেয়।
সূর্য ডুবে গেছে, পশ্চিমের আকাশ কমলা রঙের। পায়ের তলায় কুলুকুলু বয়ে চলেছে স্পিতি নদী। কোথাও হাঁটু, কোথাও গোড়ালি পর্যন্ত জল। নদী গর্ভ ছোটো ছোটো গোল গোল পাথরে ঢাকা। নদী অনেক চওড়া হলেও জল নেই তাতে, মাঝে মাঝে অতি সরু জলধারার রেখা।
দুই রমণীর পরনে জিন্স আর টপ, যেন ওদের নধর কমনীয় দেহ পল্লবের সাথে আঠার মতন সেটে। অভি আর সুপ্রতিমদা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে অল্প অল্প চুমুক দেয়। দুই কপোতের দুই প্রেয়সী জলে নেমে ঘুরে বেড়ায় আর জল নিয়ে খেলা করে। দূর থেকে অভি আর সুপ্রতিমদা দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখে। মনে হয় যেন জল ছেড়ে উঠে দুই সুন্দরী মৎস্যকন্যা ওদের সামনে কেলি করছে।
কিছু পরে সুপ্রতিমদা নদীর তীরের দিকে গিয়ে কিছু কাঠ আর শুকনো ঝোপ ঝার উপড়ে নিয়ে আসে।অভি জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দেয় যে আগুন জ্বালাবে, কেননা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া থেকে বাঁচতে হবে। আকাশের লালিমা ধিরে ধিরে কমে আসে, আস্তে আস্তে ওদের চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে। স্পিতির গর্ভে শুধু মাত্র ওর চারজন, দুরে শহরের ছোটো ছোটো আলো দেখা যায়, মাথার ওপরে পরিষ্কার আকাশ।
সুপ্রতিমদা আগুন জ্বালায়, রিতিকা আর পরী গাড়ির বনেটের ওপরে বসে পরে। রিতিকার পাশে সুপ্রতিমদা ওর কোমর জড়িয়ে ধরে আছে আর রিতিকা ওর গলা। পরী অভির কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে, অভির হাত পরীর কোমরে। দুই জোড়া কপোত কপোতী প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ। সবার দৃষ্টি দুরে পশ্চিমে উঁচু পাহাড়ের দিকে, দুরে বরফে ঢাকা পাহাড়।
রিতিকা উদাস সুরে বলে, “এখানে আসা উচিত হয়নি।”
গলা যেন একটু ধরে এসেছে ওর।
সুপ্রতিমদা ওকে জিজ্ঞেস করে, “কেন বেবি? সামনে ত খুব সুন্দর দৃশ্য।”
রিতিকা সুপ্রতিমদার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধরা গলায় বলে ওঠে, “কাল আমরা কাজা ছেড়ে চলে যাবো, আর আজ এই সুন্দর সূর্যাস্ত আমার বুকের ভেতরে কেন জানিনা উদাসিন ভাব এনে দিয়েছে, আমার খুব কান্না পাচ্ছে।”
অভি পরীর চোখের দিকে তাকায়, কি বলতে চায় প্রেয়সীর কাজল কালো আঁখি। পরী কাঁধে মাথা গুঁজে ধরা গলায় বলে, “এই কাজা যেন আমার জায়গা, এই সূর্যাস্ত আমার বুকের মাঝে এক অন্তহীন উদাসীনতা তৈরি করেছে। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো, আমি হোটেলে ফিরে যেতে চাই।”
“হটাত করে কি হল এই সুন্দরী দুই নারীর হৃদয়ে?” অভি ভাবে। নারী মাতৃময়ি ধরিত্রীর আরেক রুপ। নারী এই পৃথিবীকে জীবনের মলয় দিয়ে জিবন্ত করে তোলে, নারী হৃদয়ের স্নেহের পরশে এই পৃথিবী অপরূপ সুন্দর হয়ে ওঠে। ওদের প্রেয়সী সেই মাতৃময়ি ধরিত্রীর আরেক রুপ, ওদের হৃদয়ে নারী স্নেহ মায়া মমতা আছে। ওরাই এই পৃথিবীর হৃদয় ঠিক মতন বুঝতে পারে, আর সেইজন্য সেই সন্ধায় ওদের চোখে জল।
অভি সুপ্রতিমদাকে বলে, “চল রে, হোটেলে ফিরে যাই। কাল সকাল সকাল উঠে আবার মানালির দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে, বিকেলের মধ্যে মানালি পৌছাতে হবে।”
সারা সন্ধ্যে দুই রমণী খুব চুপচাপ হয়ে যায়, বুকের মাঝে যেন কাজা ছেড়ে যাওয়ার বিরহ সুর বাজে।
পরদিন মঙ্গলবার, সকাল সকাল অভিরা বেড়িয়ে পরে কাজা থেকে। এবারে যেন এক নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা। সবার মুখে একই কথা, রাস্তা কি রকম হবে। হোটেলের ম্যানেজার বার বার করে সাবধান করে দিয়েছে যে যে রাস্তা দিয়ে ওরা যাচ্ছে, সেই রাস্তা অতি জনবিরল, কিছু ঈগল পাখি আর গাধা বাঁ শেয়াল ছাড়া মানুষ জনের চিনহ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওরা যেন কোথাও বেশি দেরি না করে, না হলে মানালি পৌছাতে রাত হয়ে গেলে মাঝ পথে তাকার কোন জায়গা পাবে না।
গাড়ির চালক অভি, পাশে যথারীতি পরী বসে। অরুনাকে মাঝখানে বসিয়ে পেছনে রিতিকা আর সুপ্রতিমদা। রিতিকা জিন্স পড়েছিল তাই পরীকেও অনুরধ করেছিল জিন্স পড়তে। পরী ধুসর রঙের জিন্স পরে, গায়ে ভারী সাদা জ্যাকেট। রিতিকা কে ওর হাল্কা নীল জিন্স আর লম্বা কালো জ্যাকেটে বেশ মানিয়ে গেছে।
অভি গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে আয়নায় অরুনার দিকে তাকায়। অরুনার মন বেশ হাল্কা, অনেক বিপদ অনেক বেদনা কাটিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিয়েছে। ওর মুখে সেই হাসি পুরানো হাসি দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে অভি। তবে সেই পুরান চঞ্চল অরুনা যেন এখন কোথাও লুকিয়ে আছে, সেই অরুনা যে কিনা অভিকে মারত, বোকত সেই অরুনাকে ফিরে পেতে এখন অনেক সময় লাগবে।
গাড়িতে সবাই বেশ গল্প গুজবে মেতে ওঠে। লোসার পর্যন্ত পিচের রাস্তা কিন্তু একটু এবর খাবর। লোসারের পুলিস চেক পোষ্ট পার করেই আর যেন রাস্তা নেই, রাস্তা যেন পাহাড়ের মাঝে কোথাও হারিয়ে গেছে, তার জায়গায় ওদের সামনে এক পাথরে ঢাকা পথ। গাড়ি বারে বারে দোল খায়, একবার এদিক একবার ওদিকে বেঁকে যায় গাড়ি। অভির চোয়াল শক্ত, খুব ধিরে ধিরে গাড়ি চালায়। একদিকে উঁচু পাহাড়, একদিকে নেমে গেছে গভীর খাদ। এখানে মানুষ হারিয়ে গেলে তার মৃত্যু নিশ্চিত।
চারিদিকে ছড়িয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর হিমালয়, কোথাও পাহাড় থেকে ঝরনা গড়িয়ে পড়ছে রাস্তার ওপরে, কোথাও পাহাড় ঝুরঝুরে হয়ে রাস্তার ওপরে ধসে যাচ্ছে। পথে মানুষের চিনহ মাত্র নেই, প্রাণী বলতে কিছু বন্য গাধা আর শেয়ালের দেখা পায়। মাথার ওপরে গাড় নীল আকাশ, কিছু ঈগল উড়ে বেড়ায় ওই নীল আকাশের বুকে। কিছু দুরে বরফে ঢাকা পর্বত শৃঙ্গ। সবাই হাঁ করে জানালার বাইরে চেয়ে থাকে আর দেখে হিমালয়ের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য। ওদের কেউ ভাবেনি যে হিমালয়কে এত কাছ থেকে ওরা কোনদিন দেখতে পাবে।
পরী যেন এর মধ্যে এডভেঞ্চারের গন্ধ পায়, অতি উতসাহে চেঁচিয়ে ওঠে, “উফ, কি মারাত্মক জায়গা। আমি এই জায়গার সাথে প্রেমে পরে গেছি অভি। আমার প্রেমিক সত্যি এক অসাধারন মানুষ, শুধু ওই পারে এই রকম জায়গা খুঁজে বের করতে।”
অরুনার ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে রাস্তা আর আশপাশ দেখে, ভয়ার্ত চোখে অভিকে বলে, “এটা কি একটা ঘোরার জায়গা? মানুষ ছাড়, এমন কি পশু পাখীর দেখা মেলা ভার এখানে। তোর আর শুচিদির মতন পাগলদের জন্য এই জায়গা।”
অরুনার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে, পরী ওকে অভয় দেয়।
রিতিকা সুপ্রতিমদাকে বলে, “উফফ… সত্যি পাগল করে দেওয়া জায়গা এটা। তোমার বন্ধু যদি এখানে না নিয়ে আসতো তাহলে হয়ত আমরা কোনদিন এখানে আসতাম না, আর কোনদিন এই ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্য দেখতেও পেতাম না। দূর থেকে হিমালয় দেখে চলে যেতাম। এর জন্য অভিকে আর পরীকে সত্যি ধ্যনাবাদ জানানো উচিত।”
সুপ্রতিমদা অভির দিকে মজা করে বলে ওঠে, “বোকা… কোথা থেকে এই রকম জায়গার খবর পেলি রে তুই? শালা আমার যদি কিছু হয়ে যায় এখানে তাহলে শালা রিতিকা মা হওয়ার আগেই বিধবা হয়ে যাবে রে।”
রিতিকা লজ্জায় সুপ্রতিমদার কাঁধে মুখ লুকিয়ে নেয়। পরী অভির কাছে এসে গলা জড়িয়ে ধরে। গালে আঙ্গুল ছোঁয়াতেই অভি ব্রেক কষে দেয়, নরম আঙ্গুলের স্পর্শ অভির মন বিচলিত করে দেয়, গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয়। গাড়ি ব্রেক কষতেই সবাই ঝটকা দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পরে।
সুপ্রতিমদা পরীকে বলে, “ডারলিং, অভির গিয়ার বদলাতে যেওনা এখানে, আমরা কিন্তু পেছনে বসে আছি।”
পরী লজ্জায় লাল হয়ে যায় কিন্তু অভির গালে ছোটো চুমু খেয়ে নেয়।
আরও কিছু দূর চলার পরে অভির গাড়ি এক সমতল ফাঁকা জায়গায় চড়ে। কুঞ্জুম পাস, সমুদ্রতল থেকে পনেরো হাজার ফুট উঁচুতে। চারপাশের দৃশ্য মন মুগ্ধ করে দেয়। চারপাশে বরফে ঢাকা উন্নত শৃঙ্গ, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ওদের চারপাশে বয়ে চলেছে। একদিকে ছোটো একটি উঁচু ঢিপি, তার পরেই একটা বৌদ্ধ স্তুপ। কুঞ্জুম পাস পৌছাতে ওদের দুপুর এগারটা বেজে গেল। কুঞ্জুম পাস পৌঁছে, বৌদ্ধ স্তুপের কাছে এসে গাড়ি থামায় অভি, পেছনের গাড়িও এসে থামে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে পরে।
গাড়ি থেকে নেমেই পরী দৌড়ে এসে অভির ওপরে ঝাঁপিয়ে পরে, শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে। অভি ওর কোমরের নিচে হাত দিয়ে, আঁকড়ে ধরে পরীর শরীর আর টেনে মাটি থেকে হাওয়ায় উঠিয়ে দেয়। পরী ঝাপ দেয় উপরে আর মাথার ওপরে আকাশের দিকে দু’হাত ছড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, “আই লাভ ইউ অভিমন্যু।”
পরীকে দেখে মনে যেন হিমালয়ের পাহাড়ি ঈগল পাখি তাঁর বিশাল দুই ডানা মেলে অভির কোলে দাঁড়িয়ে।
ওর আনন্দের চিৎকার শুনে সবাই অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকায়। অরুনা মৃদু হেসে বৌদ্ধ স্তুপের দিকে চলে যায়।
পরীর বুকে থেকে আনন্দের এক শ্বাস বেড়িয়ে আসে। মুখ নিচু করে দুহাতের তালুর মাঝে অভির মুখ আঁজলা করে ধরে গভীর চাহনি নিয়ে অভির চোখের দিকে তাকায়। পরীর উষ্ণ শ্বাস অভির সারা মুখের ওপরে বয়ে চলে। ঠোঁট লেগে থাকে মিষ্টি হাসি, চোখে প্রেমের জল চিকচিক করে। আলতো করে ঠোঁট ফাঁক করে মাথা নামিয়ে অভির ঠোঁটের ওপরে চেপে ধরে ঠোঁট। অনাবিল আনন্দে ভেসে যায় দুই প্রান।
রিতিকা ওদের দেখে খিলখিল করে হেসে অভিকে বলে, “প্রেমের জোয়ারে ভেসে এখানেই কিছু শুরু করে দিওনা যেন।”
চুম্বনের ফলে পরীর শ্বাস বর্ধিত হয়ে ওঠে কিন্তু রিতিকার কথা শুনে ওরা দুজনেই সম্বিৎ ফিরে পায়, ওদের চারপাশে লোকজন আছে যে, না হলে ওরা প্রেমের জোয়ারে ভেসেই যেত। পরীকে কোল থেকে নামিয়ে অভি রিতিকার দিকে শয়তানি হাসি দেয়।
রিতিকা সুপ্রতিমদা কে বলে, “হানি, আমরা টেন্ট এনেছি তাই না? আজ রাতে আমরা এই খোলা, অন্তহীন শূন্যতার মাঝে থেকে যাই না কেন?”
পরী ওর কথা শুনে লাফিয়ে ওঠে, অভিকে নিজের অভিপ্রায় জানায় যে ও রাতে এখানে থাকতে চায়। অভি আর সুপ্রতিমদা দুজনকেই বুঝাতে চেষ্টা করে যে ওই জায়গায় রাত কাটানো অসম্ভব ব্যাপার। কোথাও কিছু নেই, চারদিকে শুধু উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড়। নিকটবর্তি লোকালয় লোসার প্রায় ষাট সত্তর কিলোমিটার দুরে। ওদের কথা শুনে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতন রেগে ওঠে রিতিকা আর পরী।
কল্যাণী আর দীপঙ্কর জানায় যে ওরা থাকতে পারবে না। সুপ্রতিমদা রিতিকার চোখ দেখে আর আশেপাশের জায়গা দকেহে ঠিক করে উঠতে পারছে না, পরাজিত সৈনিকের মতন অভির দিকে তাকায়। অভি পরীর দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করে যে রাত ওরা কুঞ্জুম পাসে কাটাবে।
দীপঙ্কর আর রামানুজ অভির কাছে এসে জানায় যে ওরা থাকতে পারবে না। ওদের ট্রেনের টিকিট আগে থেকে কাঁটা আছে আর ওরা বাড়ি থেকে বলে বেড়িয়েছে যে ওরা বারো দিনের মতন ঘুরতে যাবে। অভি, পরী আর অরুনার হাতে অঢেল সময়, ওদের বাড়ি ফেরার বিশেষ তাড়া নেই কেননা ওদের প্লেনের টিকিটে ফিরে যাবার দিন লেখা নেই। ওরা যে কোনদিন ফিরতে পারে।
রিতিকা সুপ্রতিমদার দিকে তাকায়। সুপ্রতিমদা মুখ কাচুমাচু করে কিছু বলতে যাবার আগেই রিতিকা ঝাজিয়ে ওঠে, “আমি জানি তুমি অফিসে কি কাজ কর। মানালি গিয়ে বস কে একটা ফোন করে দেবে যে শরীর খারাপ ব্যাস। আমি তোমার আর কোন কথা শুনতে চাই না, আমি রাতে এখানে টেন্টে থাকব।”
পরী বেঁকে বসে আছে যে রাতে কুঞ্জুম থাকবে। সব মিলিয়ে এক ধন্দের মধ্যে পরে গেল সুপ্রতিমদা আর অভি। দীপঙ্কররা থাকতে চাইছে না আর ওদিকে ওদের প্রেয়সীরা থাকতে চায়।
শেষ পর্যন্ত পরীর মাথায় একটা সুন্দর উপায় আসে। পরী বলে, “আমাদের কাছে দুটো গাড়ি আছে আর দুটো ড্রাইভার আছে। কল্যাণী আর রানীরা, ইনোভা নিয়ে আমজাদ কে নিয়ে চলে যাক, তাহলে আমরা আরও কিছুদিন এই জায়গায় ঘুরতে পারব।”
অভি মাথা নাড়ে, পরীর মাথার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। রিতিকা পরীকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে, “সত্যি তুমি না থাকলে আমাদের টিম হ্যাবা টিমলিডারের যে কি হত ভগবান জানে।”
অরুনার দিকে তাকাল অভি, জানতে চায় ওর অভিপ্রায় কি। অরুনা মৃদু হেসে বলে, “আমার কি কোন উপায় আছে না থেকে?”
অভি মজা করে বলে, “একটা আছে। তোকে এখান থেকে ছুঁড়ে দিচ্ছি, তুই সোজা সমুদ্রনীলের কোলে গিয়ে বসে পড়বি।”
অরুনা হেসে উত্তর দেয়, “ঠিক আছে তাহলে, আমি তৈরি, তুই আমাকে ছুঁড়ে দে দেখি।”
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, কল্যাণীরা ইনোভা নিয়ে চলে যাবে আর অভিরা আরও কয়েকটা দিন এই দুর্গম স্থানে কাটিয়ে বাটি ফিরবে। আমজাদ আর বল্বিন্দারকেও পাঠিয়ে দেওয়া হল, ঠিক হল যে গাড়ি অভি আর সুপ্রতিমদা ভাগ করে চালিয়ে নেবে। কল্যাণীদের বিদায় জানিয়ে সবাই মিলে বৌদ্ধ স্তুপের কাছে মাটিতে বসে পরে।
পরপর তিনটে সাদা বৌদ্ধ স্তুপ, পাশাপাশি সাজান, দেখে মনে হয় যেন শীতল মরুভুমির মাঝে এক মরুদ্যান। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, ভারী জ্যাকেট টাও যেন সেই ঠাণ্ডা হাওয়াকে দমিয়ে রাখতে পারছেনা। জ্যাকেট ফুঁরে যেন হাওয়া ওদের শরীরে তীরের মতন বিঁধছে। রিতিকা সুপ্রতিমদার বুকের কাছে জড়সড় হয়ে বসে। একপাসে অরুনা আরেক পাসে পরীকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে অভি। পৃথিবীর সব থেকে ধনী মানুষ অভিমন্যু, একপাসে ওর হৃদয় আরেক পাসে ওর চোখের মণি।
মাথার ওপরে সূর্য, এবারে এখান থেকে যাত্রা শুর করা উচিত। পরী অভিকে জিজ্ঞেস করে যে কোথায় যাচ্ছে, অ জানায় যে আগে কোন ভালো ক্যাম্পিঙের জায়গা দেখে ওরা তাবু ফেলবে। সুপ্রতিমদা গাড়ি চালাতে শুরু করে। কিছু দূর গিয়ে বাতাল নামে এক জায়গায় একটা ছোটো দোকান দেখতে পেয়ে ওরা অবাক হয়ে যায়। সেখান থেকে কিছু খাবার দাবার কেনা হয়। পরী দোকানের মালিককে জিজ্ঞেস করে যে এখানে লোক জন আসে কি আদৌ? লোকটা জানায় যে গ্রীষ্ম কালে বেশ কিছু পর্যটক এই পথে আসে আর মাঝে মাঝে একটা বাস আসে মানালি থেকে কাজা।
লোকটা দুরে একটা পাহাড় দেখিয়ে ওদের বলে যে ওই পাহাড়ের অপাসে একটা ছোটো কিন্তু খুব সুন্দর, চন্দ্রতাল নামে একটা হ্রদ আছে। অভি লোকটাকে জিজ্ঞেস করে রাতের থাকার কোন ভালো জায়গার কথা। লোকটা জানায় যে কিছু দুরে নাকি একটা সরকারি রেস্ট হাউস আছে, তবে সেখানে কেউ থাকবে কিন জানেনা, সেই রেস্ট হাউসের বাগানে ওরা ক্যাম্পিং করতে পারে। সবাই খুব খুশি হয়ে যায় যে শেষ পর্যন্ত একটা নিরাপদ জায়গার খোঁজ পাওয়া গেছে।
ছত্রুর সেই সরকারি রেস্ট হাউসের বাগানে অভিরা তাবু খাটায়। ওখানকার কেয়ার টেকার ওদের সাহায্য করে কাঠ, জল আর কিছু খাবার দাবার যোগাড় করতে। টেন্টের সামনের দৃশ্য মন মুগ্ধকর, পায়ের নিচে খাদ আর সেই খাদের মাঝ দিয়ে বলে চলেছে পাহাড়ি স্রোতস্বিনী চন্দ্রা নদী। নদীর ওপর তীরে কিছু উঁচু পাহাড়, বরফে ঢাকা। কয়েকটা পাহাড়ের গা বেয়ে বরফ নেমে এসেছে নদীর তির পর্যন্ত। সমুদ্রতল থেকে ওরা অনেক উঁচুতে উঠে এসেছে, এখানে বায়ুর ঘনত্ব বেশ কম।
কনকনে ঠাণ্ডা রাতে, আগুন জ্বালিয়ে ওরা পাঁচ প্রান আগুনের চারদিকে বসে গল্প করে। চারপাশে যেন ঠাণ্ডা হাওয়া এক উন্মত্ত যুদ্ধে মেতেছে। হু হু করে হাওয়া যেন ওদের উরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত, পরী অভির দিকে তাকায়, ওদের মনে পরে যায় চিতকুলের প্রথম রাতের কথা।
রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে, রিতিকা আর সুপ্রতিমদা একটা বড় টেন্টে ঢুকে পরে। অরুনা ছোটো টেন্টে নিজের স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পরে। খোলা আকাশের নিচে বসে থাকে অভি আর চেয়ে থাকে মাথার ওপরে তারাদের দিকে। পরী ওর পাসে একটা স্লিপিং ব্যাগে নিজেকে বন্দি করে ওরা মেলে ধরা পায়ের ওপরে মাথা রেখে শুয়ে থাকে। কিছু পরে অভি ওর পায়ের ওপরে চুম্বনের স্পর্শ পায়, চেয়ে দেখে পরী ওর জানুর ওপরে ঠোঁট চেপে ধরেছে। পরীর মাথার ওপরে হাত এনে অভি ওর চুল আঁচরে দেয় আর গালে আদর করতে শুরু করে। সামনের দিকে ঝুঁকে পরে পরীর মুখের ওপরে, পরী গভীর চোখে অভির দিকে তাকায়। অভি অল্প ঠোঁট খুলে ঠোঁট নামিয়ে আনে পরীর ঠোঁটের ওপরে।
চুম্বন দেবার আগেই কাঁধের ওপরে আলতো ছোঁয়ায় অভি চমকে ওঠে। পেছন ফিরে দেখে যে অরুনা ওর দিকে তাকিয়ে। পরী উঠে বসে আর অরুনার দিকে জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে তাকায়। অরুনা অভির বাঁ দিকে বসে পড়ে।
অরুনা অভিকে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি কথা বলবি আমাকে? তুই আমার বাবা মা কে কি বলে এনেছিস?”
পরী আর অভি একে ওপরের মুখ চাওয়া চায়ি করে। ওরা যেন নিজেদের ভাষা হারিয়ে ফেলছে, কি উত্তর দেবে অরুনার প্রশ্নের। অরুনা কাঁপা গলায় ওদের কে বলে, “তোরা দুজনে আমার বাবা মাকে কিছু একটা বলছিস যেটা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিস।”
পরী অরুনাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে, “আমরা তোর বাবা মা কে এই টুকু অনুরধ করেছিলাম যে যাতে অনারা আমাদের সাথে তোকে ঘুরতে যেতে দেয়, ব্যাস।”
অরুনার দু’চোখে জল চিকচিক করে আসে, বিশ্বাস করতে পারে না পরীর কথা, “না, তুমি আমাকে মিথ্যে কথা বলছ, শুচিদি।”
পরী অভির দিকে তাকায়। অভি অরুনাকে জিজ্ঞেস করে, “কি জানতে চাস তুই?”
অরুনা চেঁচিয়ে ওঠে, “আমি তোর কাছে সত্যি কথা জানতে চাই। কেন বার বার আমার মা আমকে জিজ্ঞেস করছিল যে তুই আমার ঠিক মতন খেয়াল রাখছিস কি না? কেন জিজ্ঞেস করছিল? বল, কেন?”
অভি মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, কি উত্তর দেবে অরুনার প্রশ্নের। পরী ঠোঁট চেপে, আলতো হেসে বলে, “সত্যি হচ্ছে যে তুই এখন আমাদের সাথে আছিস আর তুই আবার হাসছিস। তোকে আমরা ফিরে পেয়েছি সেটাই সত্যি।”
অরুনা থাকতে না পেরে কেঁদে ফেলে, “কেন কেন, তোমরা আমাকে সত্যি কথা বলছ না।”
পরীর চোখ ছলছল করে ওঠে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলে নেয় বুদ্ধিমতী মেয়ে। অরুনা পরীর জ্যাকেটের কলার শক্ত করে ধরে ওর জল ভরা চোখের দিকে তাকায়।
পরী বুক ভরে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে, “তাহলে তুই সত্যি জানতে চাস। তোর বাবা মা আর অভির বাবা মা তোদের আসল সম্পর্কের কথা জানে না, জানে যে তোরা একে ওপরের খুব কাছের মানুষ। তোর শরীর যখন খারাপ হতে শুরু করে, তুই যখন পাগলের মতন প্রায়, তখন বাড়ির সবাই মিলে অভিকে ধরে তোকে কিছু করে হোক, ফিরিয়ে আনার জন্য। তোর মা ওর হাত ধরে অনুরধ করে যে তাঁর মেয়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে দিলে অভি যা চাইবে তাই পাবে। নিরুপায় হয়ে আর তোর মুখের দিকে চেয়ে, অভি কথা দেয়। অভি পুবালি কেও কথা দিয়েছিল যে তোর আর সমুদ্রনীলের ভালোবাসা যেন বৃথা না যায়। ওর অবস্থা, একদিকে খাদ একদিকে পাহাড়, কি করবে কিছু না ভেবেই কথা দিয়ে দিয়েছিল।”
অরুনার দুচোখ বেয়ে অবিরাম ধারায় অশ্রু বয়ে চলে। পরী বলতে থাকে, “আমি জানি না, কি করে ওর মাথায় এক উপায় আসে, তোকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার। তোর মুখে হসি ফুটে উঠেছে, সেটাই অনেক বড় পাওনা। কোলকাতা ফিরে গিয়ে ও ব্যানারজি কাকুকে তোর আর সমুদ্রনীলের সম্পর্কের কথা জানিয়ে দেবে, কেননা, ব্যানারজি কাকু ওকে কথা দিয়েছেন যে ও যা বলবে ব্যানারজি কাকু তাই মেনে নেবেন।”
অভি চশমা খুলে চোখের কোল মোছে। এমন সময়ে অভির মাথার পেছনে রিতিকা একটা ছোট্ট চাঁটি মারে। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দেখে যে রিতিকা আর সুপ্রতিমদা দাঁড়িয়ে। সুপ্রতিমদা আবেগপ্রবন হয়ে অভিকে বলে, “আমরা অরুনার চিৎকার শুনে বেড়িয়ে এসে এই ট্রিপের আসল উদ্দেশ্য শুনে অবাক হয়ে যাই।”
রিতিকা অভির পিঠের কাছে বসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে পরীর দিকে তাকিয়ে বলে, “ভগবান যেন কাউকে এই রুকম হৃদয় না দেয় না হলে তোমার অভি আর তোমার থাকবে না সবার হয়ে যাবে। বড় অমুল্য এই অভি। আমার আর কিছু বলার ভাষা নেই তোমাদের।”
সব কথা শুনে অরুনা আর থাকতে না পেরে পরীর বুকে মাথা গুঁজে কেঁদে ফেলে। বারে বারে কেঁদে উঠে বলে, “তোর এটা করা ঠিক হয়নি রে, তোর এটা করা ঠিক হয়নি। এখন তোর আর শুচিদির কথা সবাই জেনে যাবে। তুই আমার জন্য এত কেন করতে গেলি, অভি।”
অভি, “ভবিষ্যতের কথা ভালো ভাবে দেখতে হবে। এখনো পর্যন্ত আমাদের কথা কেউ জানেনা আর আমাদের সেই রকম করেই থাকতে হবে পরের দুই বছর। এর মাঝে আমাকে একটা ভালো চাকরি পেতে হবে আর পরী ওর মাস্টার্স শেষ করবে। তারপরে বাবা মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারব আর কিছু বলতে পারব। অরুনা তুই চিন্তা করিস না।”
সুপ্রতিমদা, “অভি, তুই এক কাজ কর, দিল্লী চলে আয়, এখানে অনেক আই.টি কম্পানি আছে তোর চাকরি আমি করিয়ে দেবো।”
অভি, “নারে, পরী আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না, আমাকে ওর সাথে থাকতেই হবে। আমাকে কোলকাতায় চাকরি খুঁজতে হবে যতদিন না পরীর পড়াশুনা শেষ হয়।”
সুপ্রতিমদা, “পরী ওর মাস্টার্স দিল্লীতে করতে পারে।”
অভি, “না রে, সেখানেও এক বাধা আছে, সেটা তুই বুঝবি না। আমার মা আর পরী, খুবই এঁকে ওপরের অনুরক্ত, ওদের দুজন কে ছারানো বড় মুশকিল হয়ে যাবে। মা পরীকে কিছুতেই কাছ ছাড়া করবে না। ওর ছোটো মায়ের আর ওর মাঝে এক অদৃশ্য বন্ধন আছে যেটা পৃথিবীর কোন শক্তি খন্ডন করতে পারে না, এমন কি আমিও নয়।”
ছত্রুর সেই রাত বড় আবেগময় রাত হয়ে ওঠে সবার জন্য। কারুর চোখে ভালবাসার জল, কারুর চোখে প্রেমের জল, কারুর চোখে কৃতজ্ঞতার।
পরদিন সকালে অভিরা মানালির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। গ্রীষ্ম কালে মানালি যে খুব ভিড় ভর্তি হবে সেটা ওদের অজানা নয়। সুপ্রতিমদা গাড়ি চালাচ্ছিল। গতকাল রাতের আবেগ ময় সময়ের পড়ে, সবাই আবার আনন্দে মেতে উঠেছে। সবাই উচ্চ হিমালয়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে আর এবর খাবর রাস্তার ওপরে দোল খেতে খেতে এগিয়ে চলে। বিকেলের মধ্যে রহটাং পাস পৌঁছে যায় ওরা। বেশ কিছুক্ষণ ওরা রোহতাং পাসে বসে থেকে হিমালয়ের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। অবশেষে রোহতাং পাস পেরিয়ে এসে ওরা মানুষের দর্শন পায়। এতক্ষণ পরে লোকজন দেখতে পেয়ে যেন ওদের ধড়ে প্রান ফিরে আসে। অরুনার দিকে তাকায় অভি, অরুনা যেন লোক দেখে খুব খুশি।
অভি ওকে মজা করে বলে, “কিরে এবারে ভিড় দেখে খুশি ত?”
মানালির দিকে রোহতাং পাসে গাড়ি থেকে আবার নামে। মেয়েদের চেহারায় যেন আনন্দ আর ধরে না। মানালির দিকের রোহতাং পাসে লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল যে মানালিতে খুব ভিড়, হোটেল পাওয়া একটু মুশকিল হতে পারে। অভির মুখ শুকিয়ে এল, কি করা যায় এবারে। একটা ফেরিওয়ালা ওদের জানাল যে, মানালি থেকে কিছু দুরে নাগর নামে একটা জায়গা আছে, ছোটো আর সুন্দর, মানালি থেকে বেশি দুরেও নয়, সেখানে কিছু হোটেল ওরা পেয়ে যাবে। অভি ভেবে দেখল, যেহেতু ওদের কাছে গাড়ি আছে সুতরাং নাগরে হোটেলে থেকে ওরা সহজেই মানালি ঘুরে যেতে পারে। এই পর্যন্ত যত জায়গায় ওরা ঘুরে এসেছে, তাঁর তুলনায় মানালিতে অনেক গরম। সবাই গায়ের থেকে গরম জামা কাপড় খুলে ফেলে।
নাগর পৌঁছতে ওদের একটু দেরি হয়ে যায়, তাঁর কারন মানালিতে খুব ভিড় ছিল। তবে নাগরে হোটেল পেতে ওদের বিশেষ অসুবিধে হয় না। নাগর, কুলু এবং মানালির মাঝে খুব ছোটো এক শান্তি পূর্ণ জায়গা। কিছু হোটেল আর কিছু দোকান পসার আছে সেখানে। হোটেলে নিজেদের ব্যাগ রেখে রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে ফেলে ওরা।
পরী আর অরুনা বলে যে ওদের বাড়িতে ফোন করতে হবে। অভি পরীকে বলে যে ছোটমায়ের সাথে ওর কথা বললেই হবে। পরী বিরক্ত হয়ে ওঠে কেননা বেড়াতে আসা পর্যন্ত ওই ছোটমায়ের সাথে কথা বলে গেছে, অভি একবারও বাড়ির সাথে কথা বলেনি।
পরী ওর ছোটমাকে ফোন করে জানায় যে ওরা ভালো ভাবে ঘুরে এসেছে আর নাগর নামে এক জায়গায় পৌঁছে গেছে। মা মনে হয় পরীকে জিজ্ঞেস করে যে কবে ফিরবে, পরী অভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে সেই প্রশ্ন। অভি জানায় যে সম্ভবত রবিবারের মধ্যে ওরা কোলকাতা ফিরে যাবে। মা পরীকে অনুরধ করে অভির স্তাহে কথা বলার জন্য। পরী অভিকে ফোন ধরিয়ে দেয়।
মা, “হ্যালো, কেমন আছিস?”
অভি, “ভালো আছি, তোমাদের কি খবর?”
মা, “আমরা সবাই ভালো। অরুন্ধুতির কি খবর?”
অভি, “ও খুব ভালো আছে, বেশ আনন্দে আছে আর মজা করছে। আমাদের এই বেড়ানটা ওর পক্ষে বেশ ভালোই হয়েছে। ব্যানারজি কাকুকে জানিও যে অরুনা ঠিক আছে।”
মা, “অরুন্ধুতিকে ফোন দে।”
অভি অরুনাকে ফোন দেয়, মা অরুনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পড়ে অরুনা আবার ফোন অভির হাতে ধরিয়ে দেয়।
মা, “আমার কিছু বলার আছে।”
অভি, “কি বলো?”
মা, “তুই তো বলেছিলি যে তোদের বেড়ান বারো দিনের, তাহলে তোরা রবিবার কেন ফিরবি?”
অভি, “আমার, অরুনার বা পরীর বাড়িতে কোন কাজ নেই তাই আমি ভাবলাম একটু ঘুরে বেড়িয়ে ফিরি, কেন দেরি করে ফিরলে কি কোন অসুবিধে আছে?”
মা, “না মানে, তোর ইন্দ্রানি মাসি কয়েক দিন আগে ফোন করেছিল, আমাদের বম্বে ডেকেছে। তাই আমি ভাবছিলাম যে পরীকে নিয়ে বম্বে যাবো।”
অভি, “তুমি যাবে বম্বে পরীকে নিয়ে তা আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ, পরীকে সোজা জিজ্ঞেস করে নাও ও যেতে চায় কিনা।”
মা, “তুই যদি শুক্রবার ফিরে আসিস তাহলে নিয়ে যেতে পারি না হলে নয়। সেই জন্যেই তোকে জিজ্ঞেস করা। আমি ভালো করে জানি যে পরীর যাওয়ার হয়ত ইচ্ছে নেই কিন্তু যদি তুই শুক্রবার ফিরিস তাহলে হয়ত আমি বলে কয়ে রাজি করাতে পারব। আমরা শনিবারের রাতের প্লেনে বম্বে যাচ্ছি।”
অভি পরীকে জিজ্ঞেস করে যে ও বম্বে যেতে চায় কিনা, পরী মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে বম্বে যাবে না ও।
অভি, “না ও বম্বে যেতে চাইছে না। তোমরা কত দিনের জন্য বম্বে যাচ্ছও?”
মা, “আগামি সাত দিনের জন্য। পরীকে ফোন দে।”
অভি পরীকে ফোন ধরিয়ে দেয়, বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পরে পরী ফোন রেখে দেয়। তারপরে অরুনা ওর বাড়িতে ফোন করে কুশল জানিয়ে দেয়।
হোটেলের ঘরে ঢুকে পরীকে অভি জিজ্ঞেস করে যে ওর ছোটমা কি বলল। পরী জানায়, “আমরা সময় মতন পৌঁছাবো না শুনে ছোটমা মনঃক্ষুণ্ণ। আমি ভাড়াটের কাছে চাবি রেখে যেতে বলে দিয়েছি। ছোটমা বলছিল যে গ্রামের বাড়ি চলে যেতে, সেটাই ভালো হবে, এপ্রিলের পড়ে মায়ের সাথে দেখা হয়নি আর তুমিও অনেকদিন আমাদের বাড়ি যাওনই। ছোটমা মনে হয় চায় না যে আমরা একা একা বাড়িতে থাকি। আমরা রবিবারের মধ্যে যদি কোলকাতা ফিরে যাই তাহলে সোমবার সকালে বসিরহাট চলে যাবো।”
অভি, “কেন বসিরহাট কেন যেতে হবে? আমরা বাড়িতেই ত দুজনে থাকতে পারি, তাতে অসুবিধে কোথায়?”
পরী, “ছোটমা নিশ্চয় মাকে আগে থেকে জানিয়ে দেইয়ে থাকবে যে আমরা আসব।”
অভি একটু গম্ভির হয়ে যায় গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা ভেবে, “তুমি বুঝতে পারছ না পরী, গ্রামের বাড়ি গেলে কি হবে।”
পরী, “কি হবে, অসুবিধে কোথায় আমার বাড়িতে যাওয়ার? আমি আমার মায়ের বাড়ি যাবো, তুমি তোমার দিদার বাড়ি যাবে তাতে অসুবিধে কি?”
অভি মাথা নাড়ায়, “পরী পরী পরী, অসুবিধে দিদাকে নিয়ে বা বাড়ি নিয়ে নয়, সোনা। অসুবিধে সুব্রত আর মৈথিলী কে নিয়ে।”
পরী বেমালুম ভুলে গেছিল সেই ঘটনা। কপালে করাঘাত করে বলে, “উফ ভগবান, আমি একদম ভুলে গেছিলাম সেই কথা। যাই হোক, আমি জানি তুমি কি করেছ আর তুমি কোন ভুল করনি। যদি কেউ কিছু করে থাকে তাহলে ওরা করেছে। ভয় ওদের পাওয়া উচিত।”
হেসে বলে পরী, “আর বেশি কিছু হলে আমার কাছে তুরুপের তাস রাখা আছে, সেই ক্যাসেট টা।”
অভি গম্ভির হেসে উত্তর দেয়, “বেশ দারুন খেলা জমবে তাহলে।”
পরী ওকে সাবধান করে বলে, “মনে রেখো, আমি কিন্তু এই সব বিষয়ে কিছু জানিনা, সুতরাং ওদের সামনে আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারবো না। যদিও আমি মার্চের পরে ওদের সাথে বিশেষ কথা বলিনি।”
অভি পরীর টোপা গাল টিপে আদর করে বলে, “মিষ্টি সোনা।”
পরী ঠোঁট গোল করে চুমুর ইশারা করে বলে, “অনেক আদর হয়েছে, তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে শুতে এস।”
অভি মাথা নুইয়ে বলে, “যথাআজ্ঞা মহারানী।”
পরের দিন অভিরা মানালি ঘুরে বেরাল। মানালি বিয়াস নদীর তীরে এক ছোটো উপত্যকা, চার পাসে উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। মানালি খুব সুন্দর এক পাহাড়ি জায়গা, কিন্তু অভির আর পরীর মানালি দেখে ঠিক পছন্দ হল না, যে জায়গা থেকে ঘুরে এসেছে সেই জায়গার পরে মানালি ঠিক মনে ধরল না। হাডিম্বা মন্দির আর একটা শিবের মন্দির ঘুরে দেখল।
বিকেলবেলা মেয়েরা কেনাকাটা করতেই ব্যাস্ত হয়ে যায়। জুন মাসে স্কুল কলেজের ছুটি তাই মানালিতে পর্যটকের ভিড়। পরী বাড়ির সবার জন্য কিছু কিনে নেয়, ছোটমার আর দিদার জন্য শাল, ওর বউদিদের জন্য স্টোল। ওকে জিজ্ঞেস করে যে কি কিনতে চায়, অভির সেই রেকং পিওর কথা মনে পরে গিয়ে হাসি পেয়ে যায়। কেনাকাটা সেরে সন্ধের দিকে নাগর ফিরে আসে ওরা।
পরী আর অরুনা কাসেলের কাছে গাড়ি থেকে নেমে পরে, ওদের বলে যে ওরা কিছু কেনাকাটা করে ফিরবে। অগত্যা অভি একা একা হোটেলের ঘরে বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করে।
অনেক ক্ষণ হয়ে যায়, কিন্তু পরী আর অরুনাকে ফিরতে না দেখে অভি সুপ্রতিমদার ঘরে গিয়ে ঢোকে। ঘরে ঢুকে দেখে যে সুপ্রতিমদা বিয়ার সাথে সিগারেট টানছে। বিছানার ওপরে বসে পরে অভি, সুপ্রতিমদা ওকে এক ক্যান বিয়ার দেয় আর একটা সিগরেট জ্বালায় অভি। রিতিকার কথা জিজ্ঞেস করাতে সুপ্রতিমদা বলে যে বউ স্নান করতে ঢুকেছে।
সুপ্রতিমদা, “তোর বউ কোথায়?”
অভি্, “শপিং শপিং আর শপিং…” দুজনেই হেসে ফেলে।
সুপ্রতিমদা জিজ্ঞেস করে অভিকে, “কালকের কি প্লান?”
অভি উত্তর দেয়, “কাল, মান্ডি স্বারঘাট হয়ে দিল্লী ফিরে যাওয়া। বেশি দেরি হলে মান্ডি না হয় স্বারঘাটে থেকে যাবো আমরা।”
সুপ্রতিমদা, “শেষ পর্যন্ত আমাদের বেড়ান শেষ হল বল। বাপরে তুই যে যে জায়গা ঘুরিয়ে দেখালি মাইরি। আমি অনেক পাহাড় ঘুরেছি, মানালি, ফাগু, চায়েল, ডালহউসি, সব ঘুরেছি, ওদিকে নইনিতাল বল কউসানি বল, আবার পুবে দারজিলিং বা সিকিম বল, সব জায়গা ঘুরেছি কিন্তু শালা এই জায়গার মতন কোন জায়গা দেখিনি। সব জায়গায় হাজার হাজার লোক আর আমরা এই জায়গায় কোন লোকজন খুঁজে পেলাম না। সত্যি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।”
বুক ভরে সিগারেটের ধোঁয়া টেনে একটু দার্শনিক উত্তর দেয় অভি, “গুরু, যে কোন জায়গা ভালো লাগে, যদি মনের মতন সাথি থাকে পাশে।”
সুপ্রতিমদা হেসে বলে, “বাঃবা তোর মধ্যে যে কবি কবি ভাব আর একটা দার্শনিক লুকিয়ে আছে জানতাম না ত।”
অভি, “রাতের খাওয়ার কি ব্যাবস্থা।”
সুপ্রতিমদা, “আমি মানালি আগেও এসেছি…”
চোখ টিপে অভি জিজ্ঞেস করে, “ওয়ান ডে পিচ নিয়ে খেলতে এসেছিলি?”
সুপ্রতিমদা অভিকে চুপ করতে বলে, “আরে জোরে বলিস না, রিতিকা কিছু জানে না কিন্তু ওইসব ব্যাপারে।”
অভি, “ছাড় না, টি.ভি র আওয়াজে কিছু শুনতে পাবে না।”
সুপ্রতিমদা টি.ভি’র আওয়াজ একটু জোর করে দিয়ে ওকে বলে, “গুরু, অয়ান ডে পিচে খেলে মজা আছে আনন্দ বাঁ শান্তি নেই। তুই বল হাঁকালি, ক্যাচ হবে না ছয় হবে জানিস না। আসল খেলা হচ্ছে টেস্ট পিচে।”
অভি, “কটা পিচে খেললি তুই?”
সুপ্রতিমদা হেসে বলে, “দুটো অয়ান ডে খেলেছি রে, তারপরে টেস্ট ম্যাচ।”
অভি, “রিতিকা কে জানাস নি কেন? যাকে ভালবাসিস তার কাছে হৃদয় খুলে রাখতে হয় রে।”
সুপ্রতিমদা, “ছাড় না পুরানো কথা।”
অভিকে একবার পরী বলেছিল, সেই কথা অভি সুপ্রতিমদাকে বলে, “অতীত ঠিক অতীত নয়। আমাদের অতীতকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়, অতীতের কাছ থেকে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করি, ভবিষ্যতের সিঁড়ি তৈরি করি। বর্তমান যদি সঠিক না হয় তাহলে কোন এক সময়ে কিন্তু আমাদের অতীত আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে।”
সুপ্রতিমদা বিরক্ত হয়ে ওঠে, “বোকা… জ্ঞান মারতে যাস না, দারু গেল শালা। তুই কি মদ ঢাললেই দার্শনিক হয়ে যাস নাকি?”
কথা অন্য খাতে বয়ে যায়, গল্পে দুজনে মেতে ওঠে।
হটাত বাথরুমের দরজা খুলে রিতিকা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেড়িয়ে আসে। ওকে দেখে সুপ্রতিমদার আর অভির মুখ হাঁ হয়ে যায়। দুজনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়, নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে রিতিকার দিকে।
সাদা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে থাকে রিতিকা, সর্বাঙ্গে একটি সুতা পর্যন্ত নেই। সারা গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলের ফোঁটা। দেখে মনে হয় যেন এক মৎস্যকন্যে সবে সাগরজল থেকে উঠে এসে ওদের সামনে নিজেকে মেলে ধরেছে। অভি বিস্ফুরিত নয়নে রিতিকার নধর পেলব দেহের অপরূপ রুপ সুধা পান করে।
মুখখানি দেখে মনে হচ্ছে যেন সদ্যস্নাত ম্যাগ্নলিয়া ফুল, সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। মাথার চুল পরীর মতন লম্বা নাহলেও ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। ভিজে চুলের থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ছে। ছোটো গোল কাঁধ, ঢেউ খেলে উঠেছে উন্নত বক্ষ জোড়ায়। দেহের অবয়াব যেন অতি প্রাচিন বালির ঘড়ির মতন। ত্রুটিহীন নিটোল বক্ষ যুগলের ওপরে দুটি গাড় বাদামি নুড়ি সাজানো। কিছু ক্ষুদ্র জলের ফোঁটা ওই বৃন্তের কাছে লেগে তারপরে গড়িয়ে পড়েছে নিচের দিকে। পীনোন্নত বক্ষ যুগল যেন ঠেলে বেড়িয়ে এসেছে ওর শরীরের থেকে আর হাতছানি দিচ্ছে সামনে বসে থাকা দুই বুভুক্ষু হায়নার দিকে।
মধ্যচ্ছদা যেন স্পিতি নদী, বুকের নিচ থেকে নেমে গেছে ছোটো গোল পেটের দিকে, হারিয়ে গেছে সুগভীর নাভির ভেতরে। পাতলা কোমর আর তাঁর নিচে ফুলে উঠেছে সুডৌল নিতম্ব। নিতম্ব জোড়া বেশ পুরুষ্টু আর তলপেট টাও বেশ মান্সল আর ফোলা। ঠিক তলপেটের নিচের দিকে অভির দৃষ্টি যায়, দুই নমনীয় নধর জানু, সদ্য স্নাত হওয়ার ফলে ত্বকের ওপরে ঘরের আলো পিছল খেয়ে যায়। তলপেটের বাম দিকে বেশ নিচে একটা ছোটো কালো তিল। নাভিদেশ থেকে বেশ কয়েকটা সরু জলের ধারা নেমে এসেছে তলপেটের ওপরে দিয়ে গড়িয়ে হারিয়ে গেছে জানুমাঝের উপদ্বীপে।
রিতিকা ওদের দেখতে পায়নি কারন ও মাথা মুছতে ব্যাস্ত ছিল। চলনের ফলে নিতম্ব জোড়া বেশ দুলে দুলে উঠছিল, জানুমাঝের উপদ্বীপে ওপরে দিকে অতি যত্নে সাজান একটি ছোটো বাগান। একটু সরু ধারা যেন ওর সুন্দর ত্রিকোনা উপদ্বিপের মাঝখান থেকে নিচের দিকে বয়ে চলেছে। বাগানে জলের ফোঁটা লেগে, মনে হচ্ছে যেন শরতের ঘাসের আগায় শিশির রেখা।
রিতিকা অপার রুপ দেখে অভি আর সুপ্রতিমদা হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কান লাল হয়ে উঠেছে অভির, গলা শুকিয়ে গেছে রিতিকাকে দেখে, মাথার মধ্যে থেকে যেন দুচোখ ঠিকরে বেড়িয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
রিতিকা আপনমনে মাথা মুছতে মুছতে সুন্দর কোন গান গুনগুন করতে থাকে। কিছু পরে সুপ্রতিমদা কে বলে, “হানি, আমার গাউন টা দেবে প্লিস।”
রিতিকার গলার আওয়াজ পেয়ে সুপ্রতিমদার আর অভির ঘোর কেটে যায়।
অভির যেন হাতে পায়ে প্রান ফিরে আসে, অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে, “যাঃ শালা।”
বলেই এক লাফে রুমের দরজা ঠেলে বেড়িয়ে যায়। সারা গায়ে বিয়ার পরে যায়।
রিতিকা হকচকিয়ে যায় অভির গলার আওয়াজ শুনে, কোন রকমে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে একলাফে বাথরুমে ঢুকে পরে। বাথরুমের দরজার পেছন থেকে রিতিকা ওদের দিকে চেঁচিয়ে ওঠে, “ফা… ইউ ব্লাডি শূয়র। অভি রুমে ছিল সেটা আগে জানাতে পারনি?”
সুপ্রতিমদা তোতলাতে তোতলাতে বলে, “বেবি তুমি যে জন্মদিনের পোশাকে বেড়িয়ে আসবে তা কি আর জানতাম?”
রিতিকা ভেতর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, “আমি কি করে জানব যে অভি রুমের মধ্যে আছে? তোমরা দুজনে যা জোরে টি.ভি চালিয়েছ, তাতে ঘাটের মড়া জেগে যাবে।”
অভি দরজা থেকে চেঁচিয়ে রিতিকাকে বলে, “আমি দুঃখিত, রিতিকা।”
রিতিকা অভির দিকে চিৎকার করে ওঠে, “বের হ, রুম থেকে শয়তান ছেলে, না হলে এখুনি মেরে ফেলব।”
দরজা বন্ধ করে বেড়িয়ে এসে অভি নিজের রুমে ঢুকে পরে। পরী আর অরুনার দেখা নেই, চুপ করে বিছানার ওপরে বস বিয়ারের ক্যানে চুমুক দেয় আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে রিতিকা অনাবৃত অপরূপ দেহ পল্লব। অভির পেটের মধ্যে তরল আগুন জ্বলে ওঠে সেই মনোরম আকর্ষণীয় দৃশ্য মনে পরাতে। কিছু পরে পরী ফিরে আসে, অভি ওর দিকে বুভুক্ষু হায়নার মতন চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ভেতরের সিংহ যেন গর্জে উঠেছে রিতিকার শরীর দেখে।
পরী ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “আমার দিকে ওই রকম ভাবে কেন তাকিয়ে আছো? এক মিনিট্বের জন্যেও কি আমি তোমার থেকে দুরে থাকতে পারব না?”
গোলাপি রঙের স্কার্ট আর সাদা ফ্রিল শার্টএ পরীকে খুব আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে, গলায় একটা স্টোল জড়ানো। অভি ওর দিকে উঠে গিয়ে পেটের ওপরে হাত রেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। পরীর পেছনে নিজেকে চেপে ধরে অভি। পরী হাতের ব্যাগ বিছানার ওপরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর নিজের কোমল গোলায় অভির কঠিন সিংহের পরশ অনুভব করে।
আদর করে জিজ্ঞেস করে অভিকে, “কি হল তোমার?”
অভি, “কিনা না সোনা। তোমাকে খুব মিস করছিলাম আমি। এত দেরি করলে কেন?”
পরী, “আরে বাবা, আমরা কাসেলে গেছিলাম। জানো কাসেল্টা খুব সুন্দর, অকানে আবার একটা রেস্টুরেন্টও আছে।”
পরী পেছন দিকে মাথা হেলিয়ে অভির গালে গাল ঘষে দেয়। অভির নাকে ভেসে আসে পরীর গায়ের জুঁই ফুলের গন্ধ, পাগল করে তোলে অভির হৃদয় কে।
পরী, “প্লিস আমাকে ছেড়ে দাও সোনা, আমি খেতে যাবার আগে একবার স্নান করব। এখানে বড় গরম।”
অভি, “উম্মম… ছাড়তে পারি যদি তুমি আমাকেও স্নান করার জন্য সঙ্গে নাও।”
পেটের ওপরে অভির চেপে ধরা হাতের ওপরে চাঁটি মারে পরী, একটু বিরক্তি সুরে বলে, “না, আমি জানি তুমি বাথরুমে ঢুকে আমার সাথে দুষ্টুমি শুরু করে দেবে। কেন সবসময়ে তোমার মাথায় দুষ্টুমির করার চিন্তা ঘোরে?”
অভি ওর কানে কানে বলে, “উম্মম… সোনা, আমি তোমার আকর্ষণীয় দেহের হাতছানি থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে রাখতে পারি না যে, তাই ত মনে হয় যেন তোমাকে নিয়ে সবসময়ে উম্মত্ত খেলায় মেতে উঠি।”
পরী একটু গম্ভির হয়ে যায়, “অভি, এই চিন্তাধারা ভালো লক্ষণ নয়। প্রেমের সিঁড়ি তে রতিখেলা শুধু মাত্র একটা ধাপ, সেই ধাপ যেন বুভুক্ষু খিদে না হয়ে ওঠে। যেদিন মানুষের মাথায় সেই খিদে চড়ে যাবে সেদিন মানুষ ভয়ঙ্কর জানোয়ারে পরিবর্তিত হয়ে যাবে, আর ভয়ঙ্কর জানোয়ারের হৃদয়ে প্রেম ভালবাসার লেশ মাত্র থাকে না, অভি। নিজেকে সামলাও, আমি চাই না আমার অভি বুভুক্ষু জানোয়ার হয়ে উঠুক।”
পরীর ওই কথা শুনে অভির বুভুক্ষু আগুন নিভে যায়, সেই স্থানে হৃদয়ে এক অনাবিল প্রেমের আলো ছড়িয়ে পরে। ঘাড়ের ওপরে আলতো চুমু খেয়ে পরীকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে দেয়। পরী ওর জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পরে স্নান সেরে নিতে।
কিছু পরে সুপ্রতিমদা ওদের ঘরে এসে টোকা মেরে খেতে যাওয়ার জন্য ডাক দেয়। অভি মনে মনে প্রস্তুতি নেয় কি করে রিতিকার সামনে যাবে, অভির কান লাল হয়ে ওঠে। পরীকে জানায় যে ও খেতে যাবে না। সুপ্রতিমদা বুঝতে পারে অভির মনের উত্তেজনা আর সেই দেখে হেসে ফেলে।
সুপ্রতিমদা পরীকে বলে, “রিতিকা ও খাবার খেতে যাচ্ছে না। পরী, তুমি নাহয় একবার গিয়ে দেখ কি হয়েছে।”
পরী উৎসুক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপরে সুপ্রতিমদা কে জিজ্ঞেস করে, “এদের দুজনের হটাত করে কি হয়ে গেল যে দুজনেই খেতে যাচ্ছে না?”
সুপ্রতিমদা অভির লাল মুখ দেখে আর থাকতে না পেরে হেসে ফেলে। অভি ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে লজ্জা লুকানোর জন্য। পরী কিছু বুঝতে না পেরে দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুপ্রতিমদা মাথা চুলকে পরীকে জানায়, “আমি আর অভি আমার রুমে বসে বিয়ার খাচ্ছিলাম আর এমন সময়ে রিতিকা স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে পরে। ব্যাপারটা হল যে রিতিকা তখন একদম বার্থডে পোশাকে ছিল।”
সুপ্রতিমদার কথা শুনে পরী আর হাসি ধরে রাখতে পারেনা, পেট চেপে হাসতে হাসতে বিছানার ওপরে গড়িয়ে পরে।
অভি মৃদু চেঁচিয়ে ওঠে ওদের দিকে, “আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি যে কি করে রিতিকার সামনে যাবো আর তোমারা হাসছ?”
পরী হাসতে হাসতে বলে, “আমার শয়তান সোনা, সুপ্রতিমদার ভালবাসার মেনকাকে একদম নিস্কলঙ্ক রুপে দেখে ফেলেছে তাই আমি আর হাসি থামাতে পারছি না।”
কোন রকমে হাসি থামিয়ে, “আচ্ছা বাবা, আমি রিতিকার কাছে গিয়ে দেখছি।”
রিতিকা কিছু পরে পরীর পেছনে মুখ লুকিয়ে ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসে। অভির অন্য দিকে মুখ করে তাকায়, রিতিকার চোখে চোখ রাখতে পারছে না অভি। লজ্জায় লাল রিতিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সুপ্রতিমদা আর পরী ওদের মুখের ভাব দেখে হেসে কুটপুটি খায়। অরুনা কিছুই বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সবার মুখ চাওয়াচায়ি করে।
সুপ্রতিমদা ওদের নিয়ে যায় একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে। রিতিকা লাজানিয়ারর অর্ডার দেয় সাথে গ্রিল ট্রাউট মাছ। এর আগে অভিরা কোন দিন ইটালিয়ান খানা খায়নি, পরী রিতিকাকে সেই লাজানিয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। রিতিকা ওদের কে বুঝিয়ে দেয়। অভি আর সুপ্রতিমদা সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল রিতিকার লজ্জা কাটেনা, পরীর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। পরী শেষ পর্যন্ত রিতিকার লজ্জা কাটানোর জন্য একরকম টেনে ঠেলে দেয় সুপ্রতিমদার দিকে।
হেসে বলে, “আমরা সবাই পূর্ণবয়স্ক, এই রকম ভাবে লজ্জা পেলে হয়? যা হয়েছে, হটাত করেই না হয়ে গেছে।”
বলেই সুপ্রতিমদা আর পরী ওদের দিকে বিদ্রুপে হেসে ওঠে।
রাতের খাওয়ার সময়ে সুপ্রতিমদা জানায় যে ওরা ডিসেম্বরে বিয়ে করবে। পরী আর অভিকে নিমন্ত্রন জানায়। রিতিকার দিকে তাকায় অভি, রিতিকা সুপ্রতিমদার কোল ঘেঁসে বসে থাকে আর জুলুজুলু চোখে ওর দিকে তাকায় একবারের জন্য।
সুপ্রতিমদার দিকে উপহাস করে বলে, “কিরে শেষ পর্যন্ত গাধার টুপি পরছিস তাহলে?”
পরেরদিন সবাই একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে। ওদের বেড়ানোর শেষদিন, সবার মন খানিক বিষণ্ণ। সুপ্রতিমদা গাড়ি চালায় আর অভি পাশে বসে। বিকেলের মধ্যে ওরা মান্ডি পৌঁছে যায়। সুপ্রতিমদা মেয়েদের জিজ্ঞেস করে যে রাতে মান্ডি থেকে যাবে কিনা না সোজা বাড়ি। মেয়েরা প্রথমে একটু দনামনা করে থাকার জন্য, অভি জানায় যে গাড়ি চালাতে ওর কোন অসুবিধে নেই। চন্ডিগড় পৌছাতে ওদের সন্ধ্যে হয়ে যায়। সুপ্রতিমদা একবার অভিকে জিজ্ঞেস করে গাড়ি চালানর ব্যাপারে, অভি মানা করে দেয়। শেষ পর্যন্ত সুপ্রতিমদা গাড়ি চালায়, প্রায় রাত দুটো নাগাদ ওরা দিল্লী পৌঁছে যায়।
পরের দিন সবাই সুপ্রতিমদার বাড়িতে বিশ্রাম করে। রবিবার সকালের প্লেনে ওরা সবাই কোলকাতা ফিরে যাবে।
দিল্লী পৌঁছে পরী ওর ছোটমাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় ওদের খবর, অরুনাও বাড়িতে ফোন করে দেয়। ব্যানারজিকাকু জানায় যে তিনি এবং অরুনার মা, এয়ারপোর্টে ওদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন।
এর মাঝে অভি সমুদ্রনীলকে ফোন করে এয়ারপোর্টে আসতে বলে। সমুদ্রনীল কি বুঝল, জানেনা কিন্তু জানাল যে ও এয়ারপোর্টে ওদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।
রবিবার সকালে, যথারীতি মেয়েদের চোখে বিদায়ের জল, মন ভারী। সুপ্রতিমদা অভির হাত ধরে বলে, “তুই না এলে আমি কিন্তু বিয়ের পিঁড়িতে বসব না। তোর আর পরীর আসা চাই-ই-চাই।”
প্লেনে চড়ে অভি আরেকবার অরুনাকে ওর মতলবের কথা জানায়, “প্লেন থেকে নেম, অরুনা আমার একদম পাশে হাটবে, যেন কেউ কোন সন্দেহ না করে, পরী আমাদের পেছনে হাটবে। আমি ব্যানারজি কাকু আর কাকিমা কে সব কথা খুলে বলব, আমি বলব যে তিনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে আমার কথা রাখবেন।”
পরীর বুক দুরুদুরু করে ওঠে, অরুনা ভয়ে ভয়ে পরীর দিকে তাকায়। পরী নিজের মনের ভাব লুকিয়ে হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে আশস্থ করে, বলে যে সব ঠিক হয়ে যাবে। ব্যাগ হাতে নিয়ে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করে ওরা। দূর থেকে দেখতে পায় যে ব্যানারজি কাকু আর কাকিমা অধির অপেক্ষায় ওদের জন্য দাঁড়িয়ে। অভি ভিড়ের মধ্যে সমুদ্রনীলকে খোঁজে, সমুদ্রনীল ভিড়ে এক কোনায় সবার চোখ বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, অভি ওকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে।
উৎকণ্ঠায় অরুনার চোখে জল চলে আসে, বুকের মাঝে ঝড় ওঠে, বাবা মা সত্যি কথা জানতে পেরে কি রকম প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করবেন। অভি পিঠের ওপরে হাত বুলিয়ে আসস্থ করে অরুনাকে, নিচু গলায় জানায়, “কোন চিন্তা করিস না, মাথা ঠাণ্ডা রাখ, আমি সব ঠিক করে দেব।”
অরুনা কাকিমার দিকে তাকাল তারপরে অভির দিকে। মেয়ের মুখে হাসি দেখে কাকিমার চোখে আনন্দের জল, ব্যানারজি কাকুর মুখে স্বস্তির হাসি। কাকিমা বারে বারে চোখ মোছেন। অভি অরুনাকে একটু ঠেলে দিয়ে বলে, “কাকিমা কাঁদছে, জড়িয়ে ধরবি না? আমি শেষ পর্যন্ত আমার কথা রেখেছি, আমি তাদের মেয়েকে তাদের কোলে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি, যা তুই।”
পরী অভির মুখের দিকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাকায়, বুক ভরে ওঠে গর্বে, যেন এক যুদ্ধ জয় করে ফিরছে ওর প্রানের ছোটো রাজকুমার। অরুনা দৌড়ে গিয়ে কাকিমার কোলে ঝাঁপিয়ে পরে কেঁদে ফেল। কাকিমা আর ব্যানারজি কাকু মেয়ের মুখে হাসি দেখে আপ্লুত হয়ে ওঠেন।
ব্যানারজি কাকু অভির কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা অভিমন্যু। তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে এখুনি দিয়ে দেব। ভদ্রলোকের এক কথা, অভিমন্যু।”
অভি ব্যানারজি কাকুর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে, গভীর জলে ঝাপ দেওয়ার আগে বুক ভরে এক শ্বাস নেয়। পরীর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় একবার, পরী মৃদু মাথা নুইয়ে ইশারা করে তাঁর সাধের রাজকুমার কে, “এগিয়ে চলো রাজকুমার, তুমি বিজয়ী হবে।”
অভি, সমুদ্রনীলকে ইশারায় কাছে ডাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অভি ব্যানারজি কাকুকে বলে, “আমি অরুনার খুব ভালো বন্ধু মাত্র। কিন্তু ওর মনের মানুষ আমি নয়” সমুদ্রনীলের দিকে দেখিয়ে বলে, “আমার বন্ধু, সমুদ্রনীল অরুন্ধতিকে ভালবাসে।”
অভির কথা শুনে ব্যানারজি কাকু অবাক হয়ে যায়, নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারেনা। অরুনা কাকিমাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে, কাকিমা অরুনার মুখের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
ব্যানারজি কাকু মাথা দোলায়, “না না, এ হতে পারে না। এ কি করে সম্ভব, আমরা ত জানি যে তুমি অরুনাকে ভালোবাসো।”
অভি, “হতে কেন পারেনা, সমুদ্রনীল ভালো ছেলে, প্রেসিডেন্সি তে রসায়নে মাস্টারস করছে আর অরুনাকে খুব ভালবাসে।”
ব্যানারজি কাকু, “কিন্তু তোমার বাবা মা?”
অভি, “আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে আমি যা বলব সেটা আপনি মেনে নেবেন।”
ব্যানারজি কাকু অভিকে জড়িয়ে ধরে মাথায় ঠোঁট চেপে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে বাবা?”
অভি নিজেকে ছাড়িয়ে বলে, “আপনি আমার কথা রাখছেন তাহলে।”
ব্যানারজি কাকু, “হ্যাঁ, রাখছি।”
সমুদ্রনীলকে কাছে ডেকে ওর হাতে অরুনার হাত দিয়ে দুজন কে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে অভি। ধরা গলায় ওদের বলে, “পুবালির কাছে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোদের এক সাথে দেখব বলে, আজ আমি সেই কথা রেখেছি।”
অরুনার কান্না থামছিল না, পরী ওকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করে।
ব্যানারজি কাকু অভিকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার বাবা মা, তারা ত এই ভেবে বসে আছেন যে আমার মেয়ে তাদের বাড়ির বউমা হয়ে আসছে। তাদের কি করে বুঝাবে যখন তারা এই সত্যি জানবে।”
অভি, “আপনাকে আরও একটা কথা দিতে হবে আমাকে। আমি যতদিন আপনাকে বলতে না বলব, ততদিন আপনি আমার বাবা মাকে কিছু জানাবেন না।”
কাকিমা অভির কাছে এসে, গালে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “তোমার হৃদয় অনেক বিশাল, তোমার হৃদয় সোনার তৈরি, আর সেটাই হচ্ছে অসুবিধে। আমি কথা দিচ্ছি, তুমি যতদিন আমাদের বলতে না বলবে, আমরা তোমার বাবা মাকে কিছু জানাব না। আমি ভগবানের কাছে প্রান দিয়ে প্রার্থনা করব, তুমি যা চাও তাই যেন জীবনে পাও।”
পরী আর অরুনাকে যেন এঁকে ওপরের কাছে থেকে ছাড়িয়ে আনা যাচ্ছিল না। অরুনা অভির গালে আলতো চাঁটি মেরে বলে, “তোরা দুজনে আমার জীবনের সব থেকে মুল্যবান মানুষ।”
বাড়ি ফেরার পথে, পরী চুপ করে অভির গা ঘেঁসে বসে বারে বারে চোখ মোছে। অভি পরীকে জড়িয়ে ধরে আদর করে।
পরী অভির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার প্রানের ছোট্ট রাজকুমার আজ বিজয়ী হয়ে ফিরছে। আই লাভ ইউ, অভিমন্যু।”

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।