মা রবিবার রাতেই ফোন করে জানিয়ে দেন যে তাঁরা ঠিক মতন বম্বে পৌঁছে গেছে আর ওদের বেড়ানোর খবরা খবর জিগাসাবাদ করেন। পরী ছোটমাকে জানিয়ে দেয় যে পরেরদিন, সোমবার, ওরা সকাল সকাল গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। রাতে পরী মাংস রান্না করে।
অভি পরীকে জিন্স পড়তে অনুরধ করে। পরী আঁতকে উঠে বলে, “তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? গ্রামের সবাই আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকবে তাহলে, যেন কোন ভুত দেখছে।”
অভি, “তাহলে কি পড়বে তুমি?”
পরী, “শাড়ি না হয় সালোয়ার কামিজ।”
অভি, “ওয়াকম্যান নিতে ভুলে যেওনা যেন।”
পরী, “ও নিয়ে চিন্তা করোনা।”
অভি আদর করে ওর গাল টিপে দিয়ে বলে, “আমার ছোট্ট পরী।”
পরেরদিন সকাল সকাল দুজনে তৈরি হয়ে পরীর গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যায়। দিদার বারি পৌছাতে প্রায় ঘন্টা তিনেক লেগে যাবে। পরী একটা লম্বা সাদা রঙের স্কার্ট পরে আর সাদা ফ্রিল শার্ট। একে ফর্সা তাঁর ওপরে সাদা রঙের পোশাকে ঠিক যেন দুধে স্নাত এক অপরূপ মূর্তি। কোলকাতায় গ্রীষ্ম কালে বড় ঘাম দেয়, তবে বাস চলার দরুন হাওয়ার জন্য কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। ওরা সেই বেড়ানোর গল্পে মেতে ছিল, লাহুল স্পিতির গল্প। পরী দুষ্টুমি করে ওকে রিতিকার স্নানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে খেপিয়ে তোলে।
অভি আদর করে মাথার পেছনে চাঁটি মারে। পরী বেশ ঘেমে যায় আর পিঠের দিকের শার্টএর কাপড় গায়ের সাথে লেপে যায়। পাতলা কাপড় ভিজে উঠে ভেতরের গাড় নীল অন্তর্বাসের ছবি ফুটে ওঠে। আসেপাশের লোকেদের নজর যেন পরীর চওড়া পিঠের ওপরে নীল অন্তর্বাস দেখে ওকে চোখ দিয়েই যেন গিলে ফেলে। অভি ওর গলায় জড়ানো স্টোল পিঠের ওপরে ঢেকে দেয়।
বিরক্ত হয়ে ওঠে অভি, “তোমাকে কি এই শার্ট টাই পড়তে হত?”
পরী, “কেন?”
অভি, “ঘামে তোমার পিঠ ভিজে গেছে, খেয়াল আছে?”
পরী, “তুমি কি আমাকে কিছু বলেছিলে যে তোমার কি পছন্দ? কিছুই ত বলনি যখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।”
অভি, “কেন, কাল রাতে তুমি বলেছিলে যে তুমি নাকি শাড়ি না হলে সালোয়ার পরে আসবে। এই বাসের মধ্যে শুরু হয়ে যেওনা যেন আবার।”
পরী, “বাহ রে, তুমি কিছু একটা পছন্দ করে দিতে পারতে, সেটাই পড়তাম। সেবেলায় ত কিছু করনি।”
অভি ওর কানে কানে বলে, “যাই হোক, তুমি না সাদা ড্রেসে দারুন দেখাচ্ছ, জানো।”
পরী, “হয়েছে, যাই হোক ভালো লাগল যে তুমি আমার পিঠ ঢেকে দিয়েছ।”
বসিরহাট পৌছাতে পৌছাতে দুপুর হয়ে গেল। মাথার ওপরে তপ্ত সূর্য ওদের যেন পুড়িয়ে ছারখার কর দেয়। বাসস্টান্ড থেকে রিক্সা নিয়ে বাড়ির দিকে যাত্রা করে। রিক্সা অনেক আমের কাঁঠালের বাগানের ভেতর দিয়ে চলতে শুর করে। কোথাও দুপাশে সবুজ ধানের খেত। বাতাসে যেন আম কাঁঠালের তীব্র মাদকতা ময় গন্ধ ছড়িয়ে। পরী তাঁর জন্মস্থানে প্রায় তিন মাস পরে ফিরছে। বাচ্চা মেয়ের মতন খিলখিল করে হেসে ওঠে বার বার, অভিকে বোঝায় কি করে কাঁচা আম আর সরষের তেল দিয়ে মাখিয়ে খেতে হয়।
অভি আদর করে বলে, “হ্যাঁ কাঁচা আম হয়ত খুব ভাল লাগবে খেতে, কিন্তু তোমার ঠোঁটের চেয়ে মিষ্টি নয়।” লাজুক হেসে ফেলে পরী অভির মুখে প্রেমের কথা শুনে।
দিদা ওদের জন্য উঠানে বসে অপেক্ষা করছিল। রিক্সা থামতেই পরী দৌড়ে গিয়ে দিদাকে জড়িয়ে ধরে। অনেক দিন পরে মা মেয়ের মিলন দেখে অভির মন খুশিতে ভরে ওঠে। অভি ব্যাগ হাতে নিয়ে গিয়ে দিদাকে প্রনাম করে। দিদা ওর মাথার চুল ধরে উঠিয়ে কপালে চুমু খায়। অভি দিদাকে জড়িয়ে ধরে।
দিদা হেসে বলেন, “এই ছাড় ছাড়, আমার বুড়ো হাড় ভেঙ্গে যাবে যে। এখন কি আর তুই সেই ছোটো অভি আছিস নাকি যাকে কোলে করে আমি রাজা রানীর গল্প, পরীর গল্প, ভুত পেত্নির গল্প বলতাম।”
অভি, “তুমি সেই একই আছো দিদা। আজ রাতে আমাকে সাত ভাই চম্পার গল্প শুনাবে?”
পরী দিদাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল তাই দিদা ওর মুখের অভিব্যাক্তি দেখতে পারছিল না, পরী ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে দেয়।
দিদা হেসে বলে, “ভেতরে আয় রে ছেলে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নে। আমি এখন খায়নি তোদের জন্য বয়সে আছি। মেঘনা আর মৈথিলী না খেয়ে বসে। সুমন্ত মাঠে গেছে বিকেলে ফিরবে। বাকিরা অফিস থেকে বিকেলে ফিরবে।”
মৈথিলীর নাম শোনা মাত্রই অভির চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, ওর কঠিন মুখ দেখে পরী বুঝতে পারে অভির বুকের উত্তাল ঝড়। চোখ টিপে ইশারায় জানায়, “চিন্তা করোনা, আমি আছি।”
পরীকে দেখে মেঘনা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে। রান্না ঘরের দরজার ফাঁক থেকে মৈথিলী উঁকি মেরে ওদের দিকে তাকায়। পরী ওকে হাত নাড়িয়ে বাইরে ডাকে। অভির সাথে চোখা চুখি হয়ে যায় মৈথিলীর, লাল হয়ে ওঠে ওর কান, লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় মৈথিলী। পরী একবার অভির দিকে তাকায় তারপরে মৈথিলীর দিকে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। আসেপাশের কেউ মৈথিলীর বাঁ অভির মনের অবস্থা বুঝতে পারে না।
দুপুরে খাওয়ার সময়ে দিদার সাথে অনেক গল্প হয়ে, দিদা মায়ের কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করেন। পরী বেড়ানোর কথা দিদাকে জানায়। সবাই পরীর মুখে বেড়ানোর গল্প শুনে অভিভূত হয়ে যায়।
খাওয়ার পরে অভি মেয়েদের গল্পে থাকে না, মাঠের দিকে হাটা দেয়। দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের খেত। আম কাঁঠালের বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকে অভি। বাগানের শেষে পুকুর পাড়ের দিকে পা বাড়ায় অভি। পুকুরের এক কোনে অভির পোঁতা আমের গাছ। গাছের ওপরে তাকিয়ে দেখে যে আমের বোল ফুটেছে আর কাঁচা আম ঝুলছে গাছে। আম দেখে অভির খুব খেতে ইচ্ছে হয় তাই গাছে চেপে একটা কাঁচা আম ছিঁড়ে একটা ডালে বসে আম খেতে শুরু করে দেয়। আম গাছের ডালে বাঁদরের মতন ঝুলে থাকে কিছুক্ষণ। গ্রীষ্মের মৃদু বাতাসে অভির ঘুম পেয়ে যায়, গাছের ডালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরে অভি।
ঘুম ভাঙ্গে দিদার ডাকে। অভি চোখ খুলে দিদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে যে দিদা ওকে কি করে খুঁজে পেল। দিদা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “নাতির খবর দিদা জানবে না ত আর কে জানবে।” পশ্চিম আকাশে দিকে সূর্য ঢলে গেছে। দিদা ওকে বলে, “তুই এখানে থাকবি সেটা জানতাম, কিন্তু তুই যে বাঁদরের মতন গাছের ডালে ঝুলে ঘুমিয়ে পড়বি সেটা ভাবিনি। নেমে আয়, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাড়ির সবাই তোকে খুঁজছে।”
অভি গাছ থেকে নেমে এসে দিদাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছ যে রাতে আমাকে গল্প বলবে। আমার সোনা দিদা।”
দিদা, “আমি বুড়ি হয়ে গেছি, চুল পেকে গেছে, দাঁত পড়ে গেছে, চোখে ছানি, আর তুই আমার সাথে মশকরা করছিস?”
অভি, “কে বলেছে তুমি বুড়ি হয়ে গেছ?”
দিদা আর অভি বাড়ির দিকে হাটা লাগায়, পেছনে পশ্চিম দিগন্তের আড়ালে সূর্যি ডোবে। পুব আকাশে ঘনিয়ে আসে রাতের অন্ধকার। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে গ্রামের আকাশে বাতাসে। দুরে কোথাও কোন বাড়ি থেকে শঙ্খের আওয়াজ শোনা যায়। গ্রামের কোন বধু তুলসি তলায় সন্ধ্যে প্রদিপ দিচ্ছে। বাতাসে ধুপ ধুনর গন্ধ যেন, অভির মন আনমনা হয়ে যায়। দিদার সাথে পুজোর ঘরে গিয়ে দিদার পেছনে বসে যায়।
সন্ধ্যে প্রদিপ দেওয়ার পরে দিদা ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “ছোট্ট কুট্টি ছিলিস তুই, আর ঠিক এই রকম ভাবে সন্ধ্যে প্রদিপের সময়ে আমার পেছনে বসে থাকতিস। পুজো শেষ হলে তুই ছোটো ছোটো হাত বাড়িয়ে মিষ্টি আর প্রসাদ চাইতিস।”
অভি ডান হাত বাড়িয়ে দেয় দিদার দিকে, “আজ আমাকে প্রসাদ দেবে না দিদা?”
অভির মুখের দিকে তাকিয়ে চোকের কোনে জল চলে আসে দিদার। ঠাকুরের থালা থেকে প্রসাদের মিষ্টি তুলে অভির মেলে ধরা হাতে দেয়।
প্রসাদ খেতে খেতে নিচে নেমে আসে অভি। শশাঙ্ক মামা, সুমন্ত মামা ফিরে এসেছেন নিজের নিজের কাজ থেকে। সুব্রত কে দেখা গেল না, ওদের সাথে। বাড়ির বারান্দায় বসে সবাই মিলে গল্প শুরু করে দেয়। অভির মন থেকে থেকে পরীর খোঁজ করে, কিন্তু পরীর দেখা নেই।
কিছু পরে মেঘনা মুরি, সরষের তেল আর পেয়াজ নিয়ে আসে ওদের জন্য। শহরের লোক মুড়ির স্বাদ ভুলে গেছে, তারা বিকেলে চায়ের সাথে পাউরুটি খায় বা কেক খায়। অভির জিবে বাড়ির ভাজা মুড়ি যেন অমৃতের মতন মনে হয়। মুড়ি খেতে খেতে অভির মন আনন্দে ভরে ওঠে, কত কাল পরে মুড়ি খাচ্ছে অভি।
কোথা থেকে দুষ্টু দৌড়ে আসে ওকে দেখে। ছোটো দুষ্টু, অনেকদিন পরে ওর পরী পিসির সাথে দেখা হয়েছে। চোখে মুখে যেন হাজার প্রশ্ন নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে থাকে, শিশু হৃদয়।
দুষ্টু, “তোমাকে অভি কাকু বলে ডাকবো?”
শশাঙ্ক মামা ওর কথা শুনে হেসে ফেলে, দুষ্টু কে বলে যে অভি ওর কাকু নয় ওর দূর সম্পর্কের দাদা হয়। বিশ্বাস করে না দুষ্টু, দাদা কি এত বড় হয় নাকি?
দুষ্টু, “না, তোমরা মিথ্যে কথা বলছ আমাকে। দাদার কি এত বড় হয় নাকি? দাদার চোখে চশমা থাকে না। আর দাদা যদি হল তাহলে পরী পিসি কে নাম ধরে ডাকে কেন?” ওর শিশু হৃদয়ের প্রশ্ন শুনে সবাই হেসে ফেলে। দুষ্টু অভিকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি গল্প জানো? ভুত পেত্নির গল্প, রাজা রানীর গল্প?”
অভি, “হ্যাঁ আমি অনেক গল্প জানি।”
দুষ্টু, “আজ রাতে আমায় গল্প বলবে?”
অভি, “নিশ্চয় বলব, তবে তাঁর আগে তোকে স্কুলের পড়াশুনা শেষ করতে হবে, তাই ত।”
দুষ্টু, “ঠিক আছে, আমি পড়াশুনা করে নেই, তারপরে কিন্তু আমাকে গল্প শুনাতে হবে। শুয়ে পরোনা যেন।” বলেই ওর মায়ের কাছে দৌড়ে চলে গেল স্কুলের পড়াশুনা শেষ করতে।
অভি লক্ষ্য করল যে বাড়ির মাঝে দেয়াল উঠে গেছে, সবার আলাদা আলাদা রান্না ঘর। দিদা সুমন্ত মামার সাথেই থাকেন। বাড়িতে লোকজন এলে তবে একসাথে খেতে বসা হয়, না হলে সবার উনুন আলাদা। অনেকদিন পরে সুমন্ত মামার স্ত্রীকে দেখতে পেল অভি। ভদ্রমহিলা খুব নরম হৃদয়ের মানুষ, বেশি লেখাপড়া করেননি তাই বিয়ের সময়ে তাঁর উপস্থিতি কম ছিল, আর সেই জন্য তার দিকে অভির নজর যায়নি। মামি কে দেখতে মা দুর্গার মতন, লাল পাড় সাদা শাড়ি আটপৌরে ভাবে পরে আছেন, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ, সেই মাতৃময়ি মূর্তি বাড়ির সব বউমাদের থেকে আলাদা, যেন মন্দিরের দেবী।
অভি ছাদে উঠে গিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। কিছু পরে পরী আর দুষ্টু ওর পেছনে এসে দাঁড়ায়। পরী ওর কাঁধে আলত করে টোকা দেয়। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে দুষ্টুকে কোলে করে পরী ওর পেছনে দাঁড়িয়ে। পরী ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হেসে ফেলে, চোখের ভাষায় জিজ্ঞেস করে, “আমাকে মিস করছিলে?”
পরী ওকে বলে, “রাতে সবাই কিন্তু তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। সবাইকে সকাল সকাল উঠতে হয় এখানে। সুমন্তদা ভোরবেলা মাঠে চলে যায়, আর বাড়ির বউমাদের বাড়ির কাজ থাকে। দেরি না করে ঠিক সময়ে নিচে খেতে চলে এসো।”
দুষ্টু তাঁর শিশু সুলভ গলায় বলে, “তুমি আমাকে গল্প না বলে শুয়ে পড়ো না কিন্তু?”
অভি ওদের কাছে গিয়ে দুষ্টুর মাথার চুলে বিলি কেটে পরীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আজ রাতে আমি তোকে একটা চোরের গল্প শুনাব, যে একটা সুন্দরী পরীকে চুরি করে পাহাড়ে পালিয়ে যায়।”
দুষ্টু, “এই রকম গল্প ত আগে শুনিনি, আমি ত শুধু রাজা রানীর গল্প শুনেছি।”
পরীর চোখে লাজুক হাসি, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে, প্রেমের আবেগে দুচোখ চিকচিক করে ওঠে।
দুষ্টুর ছোট্ট নাকের ওপরে নাক ঘষে অভি ওকে বলে, “এটা একটা নতুন গল্প।”
আর ঠিক সেই সময়ে দুষ্টুর চোখ এড়িয়ে পরী আলতো করে অভির গালে চুমু খেয়ে নেয়।
পরী, “সিগারেট শেষ করে নিচে নেমে এস, খাবার বাড়া হয়ে গেছে মনে হয়।”
পরী দুষ্টুকে কোলে করে নিচে নেমে যায়, অভি ওর পেছনে আসে।
নিচে নামার সমেয়ে অভি পরীকে জিজ্ঞেস করে, “আমি কোন ঘরে থাকব?”
পরী পেছনে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “তুমি রাতে আমার ঘরে শুয়ে পরো, আমি রাতে মায়ের সাথে শুয়ে পরবো।”
রাতের খাওয়ার সময়ে অভি লক্ষ্য করল যে ডাইনিং টেবিলে ছেলেদের বসার জায়গা করা হয়েছে আর কাঁসার থালা, বাটিতে খাবার বাড়া হয়েছে। অভির মনে হল, ডাইনিং টেবিলের সাথে কাঁসার থালা মানাচ্ছে না, দিদাকে অনুরোধ করে মাটির ওপরে পিঁড়ি পেতে বসতে দিতে। ওর কথা শুনে সবাই একটু অবাক হয়ে যায়।
শশাঙ্ক মামা ওকে বলে, “তুমি সহরে থাক, তাও তুমি মাটির খুব কাছের মানুষ।”
মাটির ওপরে পিঁড়িতে বসে খাওয়া শুরু করে, অভির পাসে দিদা হাত পাখা নিয়ে বসে। আতিথিয়েতা দেখে অভি আপ্লুত হয়ে ওঠে। দিদাকে জিজ্ঞেস করে, “এত ব্যাবস্থা কেন, আজ কি কোন উৎসব আছে বাড়িতে?”
দিদা, “আমার হারানো নাতি আমার কাছে ফিরে এসেছে, এর চেয়ে বড় উৎসব কি হতে পারে।”
বড় মামি আর পরী খাবার বেড়ে দিচ্ছিল, মেঘনা খাবার এগিয়ে দিচ্ছিল রান্না ঘর থেকে আর মৈথিলী রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে। অভিদের সাথে সুব্রতও খেতে বসে ছিল কিন্তু এক কোনায়, খাবার সময়ে খুব চুপচাপ ছিল সুব্রত। পরী ওকে জানাল, পুকুরের মাছ, ক্ষেতের চাল আর ডাল, বাড়ির গরুর দুধ, যা খাবার তৈরি তাঁর বেশির ভাগ ওদের বাড়ির। জীবনের প্রথম বার অভির মনে হল এই রকম ভাবে ওকে কোন আত্মীয় আদর করে খাইয়েছে।
খাবার পরে পরী ওকে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। বিছানার ওপরে বসে পরীর কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নেয় অভি। পরী আদর করে ওর গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে, মিষ্টি হেসে ওর মুখের দিকে তাকায়। অভি নিস্পলক চোখে ওর কাজল কালো চোখের পানে তাকিয়ে থাকে।
পরী ফিসফিস করে বলে, “আমাকে ছাড় এবারে, খেয়েদেয়ে মায়ের সাথে শুতে যেতে হবে আমাকে।”
অভি, “একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে যাও আমাকে।”
পরী মৃদুকনে বলে, “আগে খেয়ে নেই তারপরে দেখব।”
আরও কাছে টেনে নেয় অভি, নাকে ভেসে আসে এক অজানা ঝাঁঝাল ঘ্রান। ভুরু কুঁচকে তাকায় পরীর দিকে। পরী ওর কানেকানে বলে, “আমার সাইকেল শুরু হয়েছে।”
অভি, “মানে? সেত তিনদিন পরে হওয়ার কথা।”
পরী অবাক হয়ে যায় অভির কথা শুনে, মাথায় একটা গাট্টা মেরে জিজ্ঞেস করে, “শয়তান ছেলে, তুমি আবার অইসব দিন গোনো নাকি?”
অভি পরীর নাকে নাক ঘষে দেয়, “তোমার নাড়ীর খবর যে আমাকে রাখতে হয় সোনা। যাই হোক বাড়ি ফিরে গায়নকলজিস্ট দেখাতে হবে।”
অভি মাথা উঁচু করে পরীর ঠোঁটের দিকে ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে যায়। পরীর ঠোঁট নিচে নেমে আসে, আলতো করে ছুঁয়ে যায় দু’জোড়া ঠোঁট। ঠিকভাবে চেপে ধরার আগেই দুষ্টু দৌড়ে ঘরে ঢুকে পরে আর ওদের ওপরে যেন একটা বাজ পরে। সঙ্গে সঙ্গে দুজনে পৃথক হয়ে দাঁড়ায়।
দুষ্টু এক লাফে বিছানায় উঠে অভির বালিশের পাসে একটা বালিস নিয়ে শুয়ে পরে। খিলখিল করে হেসে অভিকে আব্দার করে বলে, “এবারে সেই চোর আর পরীর গল্প বল।”
পরী অভির দিকে চোখ টিপে ইশারা করে, “নাও এবারে সামলাও, আমি চললাম।” দুষ্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “অভি কাকু কে বেশি বিরক্ত করিস না কিন্তু।”
পরের দিন এগারটা নাগাদ অভি বড় মামির রান্না ঘরে ঢোকে। বড় মামি একটা থালায় ভাত আর একটা বাটিতে ডাল বাড়ছিলেন। অভি মামি কে জিজ্ঞেস করে যে কার জন্য খাবার নেওয়া হচ্ছে। সুমন্ত মামার জন্য মাঠে খাবার নিয়ে যেতে হয় মামি কে তাই মামি খাবার বাড়ছেন। অভি মামির সাথে মাঠে যাবার জন্য জেদ ধরে। মামি ওর কথা শুনে অবাক হয়ে বলেন যে এই দুপুর রোদে ও যেতে পারবে না।
অভি, “বুকে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা থাকলে, গ্রীষ্মের রোদ চাঁদের আলোর মতন মনে হয় মামি।”
মমতা ভরা হাসি নিয়ে বড় মামি বলেন, “তুমি সত্যি দুষ্টু ছেলে, চলো তাহলে।”
দিদা আর পরী ওকে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছে, উত্তর দেয় অভি যে সুমন্ত মামার জন্য খাবার দিতে বড় মামির সাথে মাঠে যাচ্ছে। পরী একটু মাথা নাড়ায়, হে ভগবান, কি ছেলেরে বাবা।
যেতে যেতে অভি বড় মামি কে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কোন ছেলে পুলে নেই তাই না?”
ব্যাথিত হয়ে ওঠেন মামি, “হ্যাঁ, শারিরিক কিছু অসুবিধে আছে তাই।”
অভি, “সুব্রতর বিয়ের সময়ে তোমাকে দেখিনি কেন?”
বড় মামির চোখের কোনে চিকচিক করে ওঠে, “আমি গেঁয়ো চাষার বউ, তোমার ইন্দ্রানি মাসি বাঁ চন্দ্রানি মাসির মতন বড়লোক নই আমি, আমার বর চাষা, শশাঙ্ক বাঁ সুব্রতর মতন পড়াশুনা করতে পারেনি।”
অভি বড় মামি কে মাঠের মাঝে দাঁড় করিয়ে বলে, “কে বলেছে তুমি গরিব মানুষ? তুমি ত এ বাড়ির দেবী অন্নপূর্ণা। ছাড় অসব কথা, মামার কাছে চলো।”
শাড়ির আঁচলে চোখের কোল মুছে অভির দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসেন বড় মামি। আরও কিছু দূর হাঁটার পরে অভি বড় মামি কে জিজ্ঞেস করে, “তুমি পরীকে খুব ভালোবাসো তাই না।”
মাথা নাড়ায় বড় মামি, “হ্যাঁ, বাড়ির ছোটো মেয়ে, আর আমি আমার ছোটো বেলা ওর মধ্যে দেখতে পাই তাই।”
অভি, “পরী চলে গেছে বলে দুঃখ হয়, তোমার?”
বড় মামি, “না দুঃখ বিশেষ হয় না, যখন ভাবি যে এই পাঁক থেকে বেড়িয়ে গেছে তখন মন হালকা হয়ে যায়।”
অভি, “আমার বাড়ির দরজা তোমার জন্য সর্বদা খোলা, তুমি যখন চাইবে আমার বাড়িতে এসে পরীর সাথে দেখা করে যেও।”
বড় মামি, “পরীর জন্য মাঝে মাঝে দুঃখ হয়, সেই ছোটো বেলা থেকে ওর দিদিদের কাছে বকুনি খেয়ে বড় হয়েছে, তখন দুঃখ হয় এই ভেবে যে এই মেয়েটার কপালে আর কি আছে। বুকের মাঝে অনেক ব্যাথা লুকিয়ে রেখেছে পরী, ওর মিষ্টি হাসির পেছনে অনেক বেদনা লুকিয়ে আছে। এই প্রথম বার ওর মুখে এক শান্তির হাসি দেখছি, সেই ব্যাথা বেদনা যেন আর নেই ওর বুকে। জানিনা, কত দিন ওই হাসি, ওই আনন্দ পরীর সাথে থাকবে।”
অভি, “আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি পরীর মুখের হাসি ম্লান হয়ে যেতে দেব না।”
বড় মামি কি বুঝলেন, জানেনা, তবে অভির দিকে তাকিয়ে সুন্দর হাসি দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “আমার জন্য নয়, ওর জন্য যেন কথাটা মনে রেখ।”
ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলে অভি আর বড় মামি। কথায় কথায় বড় মামি, বাড়ির খবর জানান, ক্ষেতের আলু পটল চিনিয়ে দেন, আরও অনেক কিছু।
সেদিন বিকেলে, খাবার পরে দুষ্টু ওর কাছে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করে যে অভি মাছ ধরতে জানে কিনা। অভি অবাক ওর কথা শুনে, মাথা নাড়ায় অভি, “না রে আমি কোনদিন মাছ ধরিনি।”
দুষ্টু একটু দুঃখ পায়, “ঠানু বলল যে তুমি নাকি ছোটো বেলায় সুব্রত কাকার সাথে পুকুরে গিয়ে মাছ ধরতে।”
অভি, “ঠিক আছে, একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।”
দুষ্টু লাফিয়ে ওঠে আনন্দে, অভি কাকুর সাথে মাছ ধরতে যাবে।
পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে অভি দুষ্টুকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে আমাদের ত ছিপ নেই, কি করে মাছ ধরব?”
দুষ্টু দুষ্টু এদিক ওদিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “এখানে কেউ আসবে না এখন, আমরা পুকুরে নেমে মাছ ধরব।”
অভি হেসে ফেলে ওর কথা শুনে, “ধুর বোকা ছেলে, জামা কাপড় ভিজে যাবে ত।”
দুষ্টু খিলখিল করে হেসে ওঠে, “না না, আমরা জামা কাপড় খুলে পুকুরে ঝাপ দেব।”
অভি আর দুষ্টু চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়, কেউ ওদের দেখছে না ত। তারপরে দুজনেই জামা কাপড় খুলে শুধু মাত্র জাঙ্গিয়া পরে দাঁড়িয়ে থাকে। দুজনেই দুজনকে দেখে হেসে ফেলে। অভি এক লাফে জলে ঝাপ দেয়। দুষ্টু আম গাছে চড়ে, একটা বাঁকা ডাল থেকে পুকুরে ঝাপ দেয়।
দুষ্টু অভিকে বলে, “তুমি পুকুর পাড় থেকে ঝাপ দিচ্ছ কেন? গাছের ডাল থেকে ঝাপ দাও আরও মজা লাগবে।”
অভি, “গাছের ডাল থেকে কি করে?”
দুষ্টু আবার আম গাছে চড়ে যায়, তারপরে ঝাপ লাগায়, বুকের কাছে হাঁটু ভাঁজ করে নিয়ে জলের মধ্যে ঝপাং করে পরে যায়। ওর দেখাদেখি অভিও গাছে উঠে ডাল ধরে ঝুলে জলে ঝাপ দেয়। পুকুরে নেমে বেশ কিছুক্ষণ ওরা খালি হাতে মাছ ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু মাছ ওদের নাগালে আসে না, বার বার পিছলে পালিয়ে যায়।
দুষ্টু ওকে একটা উপায় বলে, “জামা দিয়ে একটা জাল বানিয়ে আমরা মাছ ধরলে কেমন হয়।”
অভি মাথা নাড়ায়, “ভালো হয়।”
জামায় গিঁঠ বেঁধে, জাল বানিয়ে অনেক চেষ্টা করার পরে একটা মাছ ওদের জামায় ধরা পরে। অভি মাছ টাকে দুষ্টু হাতে দেয়। জল থেকে বেড়িয়ে মাছ খাবি খেতে থাকে, বারে বারে পিছলে যায় দুষ্টু ছোটো ছোটো হাতের মুঠি থেকে। দুষ্টু আরও শক্ত করে ধরে থাকে মাছ।
কিছু পরে উদাস হয়ে মাছের দিকে তাকিয়ে বলে, “মাছটা বড় খাবি খাচ্ছে কাকা, জলে ছেড়ে দেই একে।”
অভি ওর ভেজা চুলে আঁচড় কেটে বলে, “ছেড়ে দে।”
দুষ্টু মাছটা জলের মধ্যে ছেড়ে দিতেই হাত ফস্কে মাছ সাঁতরে পালিয়ে যায়।
পুকুর পাড়ে বসে থাকে দুষ্টু আর অভি যতক্ষণ না ওদের জাঙ্গিয়া শোকায়। ওদিকে পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে।
দুষ্টু শিশু সুলভ গলায় অভিকে জিজ্ঞেস করে, “পরী পিসি কে আমার কাছ থেকে কেন নিয়ে গেছ তুমি?”
অভি ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কে বলেছে যে আমি তোর পরী পিসিকে নিয়ে গেছি?”
দুষ্টু, “হ্যাঁ ত, তুমি নিয়ে গেছও ত। পরী পিসি এখন তোমার বাড়িতে থাকে যে।”
অভি হাসি থামাতে পারে না, “আমার বাড়িতে থাকে পরী পিসি, তাঁর মানে এই নয় যে আমি তোর পরী পিসিকে নিয়ে গেছি।”
দুষ্টু উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে অভির মুখের দিকে, “বাঃ রে, তুমিই ত নিয়ে গেছ। এই দেখ না, সুব্রত কাকার সাথে মৈথিলী কাকি যেমন আমাদের বাড়িতে এসে থাকে, এখন এটাই ত কাকির বাড়ি, তাই না।”
অভি উত্তর দেবার ভাষা খুঁজে পায় না, এই নিষ্কলঙ্ক নিশপাপ শিশু হৃদয়কে কি বলে বুঝাবে।