ভালবাসার রাজপ্রাসাদ | পর্ব – ২৪ | দেখি নাই ফিরে (সর্বশেষ পর্ব)

9 Min Read

সুপ্রতিমদা ওকে চাকরি পেতে সাহায্য করে আর দিল্লীর একটা বড় আই টি কম্পানি তে চাকরি পেয়ে যায়। অভি নিজেকে কাজে আর মদে ডুবিয়ে ফেলে। ভালোবাসা শব্দটি ওর জীবনের খাতা থেকে মুছে ফেলে।
একদিন অভি রিতিকাকে বাড়িতে ফোন করতে বলে। রিতিকা কোলকাতায় অভির বাড়ি ফোন করে, ফোন স্পিকারে দেওয়া ছিল যাতে সবাই কথা শুনতে পারে।
বাবা, “কে বলছেন?”
রিতিকা, “আমি রিতিকা, শুচিস্মিতার বান্ধবী। ওর সাথে কি একটু কথা বলা যাবে?”
বাবা, “কোথা থেকে বলছ?”
রিতিকা, “দিল্লী থেকে বলছি আমি।”
বাবা ওপাসে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে ঠাণ্ডা স্বরে উত্তর দেন, “শুচিস্মিতা এখানে আর থাকে না। কিছু কারনে শুচিস্মিতা এ বাড়ি থেকে চলে গেছে।”

বাবা হয়ত অনুধাবন করে ফেলেছিলেন যে রিতিকার ফোনের পেছনে অভি দাঁড়িয়ে। হয়ত পরী বাবার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু সেই সত্য কোনদিন অভি জানতে পারেনা। সেই রাতে একা একা কাঁদে অভি, দুখের সাথি এক বোতল মদ।
কয়েক মাস পরে রিতিকা আর সুপ্রতিমদার বিয়ে হয়ে যায় আর ওরা ব্যাঙ্গালর চলে যায়। তারপরে অভির সাথে তাদের বিশেষ কোন যোগাযোগ থাকেনা।
প্রতি রাতে পরী অভির স্বপ্নে এসে দেখা দিত। পরী এক বিশাল নৌকায় চেপে সাগর পাড়ি দেয়, আর সেই নৌকার মাস্তুল দিগন্তের কোলে ধিরে ধিরে লুকিয়ে যায়। শত চেষ্টা করেও অভি সেই নৌকার দিকে সাঁতরে যেতে পারে না। রোজ রাতে পরীর সেই সিল্কের রুমাল খানি মুখের ওপরে মেলে ধরত আর সকাল বেলা সেটা আবার মানি ব্যাগের পকেটে গুছিয়ে রেখে দিত। প্রত্যেক রাতে সেই রুমাল থেকে পরীর গায়ের জুঁই ফুলের গন্ধ নেবার জন্য আপ্রান চেষ্টা করত অভি, কিন্তু হায়, সিল্কের রুমাল, গন্ধ ত অনেক দিন আগেই হারিয়ে গেছে, যে গন্ধের আভাস টুকু বেঁচে থাকে সেটা অভির ভাঙ্গা হৃদয়ের এককনে বেঁচে থাকে।
অরুনার সাথে অনেক দিন পর্যন্ত অভির যোগাযোগ ছিল। মাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞার ফলে অরুনার বিয়ের সময়ে কোলকাতা আসতে পারেনি অভি।
জুলাই 2009, এক শনিবারের সকালে অভির সেলফোন বেজে ওঠে, অন্যদিকে সমুদ্রনীল।
সমুদ্রনীল, “হ্যাঁরে, তুই মামা হয়ে গেছিস। এই মাত্র একটি মেয়ে হয়েছে আমাদের। কথা বলবি অরুনার সাথে?”
অভি, “উফফফফ দারুন খবর শোনালি তুই, কুত্তা টা একটা রাজকুমারীর মা হয়ে গেছে দেখছি যে। দে দে তাড়াতাড়ি ফোন দে।”
অরুনার সেই পুরানো মিষ্টি গালাগালি, “কিরে শুয়োর, কুত্তা, হারগিলে, কেমন আছিস?”
অভি, “আমি ভালো আছি রে, কাক, হারগিলে। শেষ পর্যন্ত আমার চোখের মনি মা হয়ে গেল আর আমি চোখের দেখা পর্যন্ত দেখতে পারলাম না।”
অভির গলা ধরে এসেছিল কথা বলার সময়ে।
কিছু থেমে অরুনা অভিকে ধরা গলায় উত্তর দেয়, “হ্যাঁ রে, কুত্তা। আমরা ওর নাম রেখেছি শুচিস্মিতা, ডাক নাম পরী।”
অভি ফোন চেপে ধরে কেঁদে ফেলে।
ছোট্ট পরী জন্মাবার কয়েক মাস পরে অরুন্ধতি আর সমুদ্রনীল অস্ট্রেলিয়া চলে যায় আর তাদের সাথে অভির শেষ বন্ধন টুকুও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
দশটি বছর কেটে যায়। এপ্রিল 2011, শীতকাল, রাত প্রায় সাড়ে এগারটা। অভি দিল্লীর T-3 টারমিনালের আন্তরজাতিক জায়গায় প্লেনের জন্য অপেক্ষা করছিল। অফিসের কাজে অভি কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া যাচ্ছে। হাতের ট্যাবলেটে মেইল দেখছিল অভি আর অপেক্ষা করছিল কখন প্লেনে ওঠার ডাক আসে।
ঠিক সেইসময়ে ওই খানে কেউ ওর নামে ধরে ডাক দেয় তাও বাঙ্গালয়। ভদ্রমহিলার আওয়াজ, “অভিমন্যু ওই রকম দৌড়ায় না সোনা, পরে যাবে।”
অত রাতে, দিল্লীর টারমিনালে দাঁড়িয়ে অভি নিজের নাম শুনে চমকে ওঠে অভি। মাথা উঁচু করে খুঁজতে চেষ্টা করে সেই ভদ্রমহিলাকে। আবার সেই ভদ্রমহিলার আওয়াজ কানে আসে, “অভি, ওখানে যায় না সোনা।”
কেঁপে ওঠে অভি, এই মিষ্টি সুর তার খুব চেনা, এই স্বর অনেক অনেক দিন আগেই ওর হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল। বুকের মাঝে ধুকপুকানি শত গুন বেড়ে যায়, সত্যি কি সামনে, কি করে হতে পারে যার কথা চিন্তা করছে অভি?
ঠিক সেই সময়ে প্লেনের গেটের কাছের মহিলা ওকে প্লেনে ওঠার জন্য অনুরোধ করে। অভি ওর দিকে হাত নাড়িয়ে বলে, “এক মিনিট ম্যাডাম।”
মাথা ঘুরিয়ে আসেপাসে দেখে অভি, শেষ পর্যন্ত সেই সুরেলা কন্ঠস্বরের ভদ্রমহিলা কে খুঁজে পায়। বেশি দুরে দাঁড়িয়ে নয় সেই ভদ্রমহিলা, ওর দিকে পেছন ফিরে সামনে এক ছোটো বাচ্চা কে ডাক দেয়। ছোট্ট শাবক, খিল খিল করে হেসে উঠে সেই ভদ্রমহিলার থেকে দুরে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
সেই ভদ্রমহিলা একটি নীল রঙের জিন্স পরে আর গায়ে সাদা কোট। মাথার চুল ঘাড়ের একটু নিচ পর্যন্ত নেমে এসে চওড়া পিঠের ওপরে দুলছে। অভির দিকে পেছন ফিরে থাকার জন্য অভি অনার মুখ ঠিক ভাবে দেখতে পারে না। কিন্তু পাশ থেকে বুঝতে পারে যে চোখে সোনালি চশমা। মাথার চুল একটু বাদামি রঙের, ভদ্রমহিলা সম্ভবত তিরিশের মাঝামাঝি বয়স। বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের দেখে মনে হল কেননা গায়ের কোট অনেক দামী। ভদ্রমহিলার শরীরের অবয়াব বেশ সুন্দর। বাম হাতের কব্জিতে দামী ওমেগা ঘড়ি, আর অনামিকায় একটা হীরের আঙটি জ্বল জ্বল করছে।
ভদ্রমহিলা সেই ছোট্ট শাবক কে দুহাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে। ডাক শুনে সেই ছোট্ট শাবক খিলখিল করে হেসে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পরে ভদ্রমহিলার কোলে। সেই ছোট্ট শাবকের মুখ খানি নিস্পাপ ফুলের মতন আর খুব মিষ্টি। যে ভাবে সেই বাচ্চাটা ভদ্রমহিলাকে আঁকড়ে ধরে তাতে অভির মনে হল যে ভদ্রমহিলা সেই বাচ্চার মা। ব্যাগের ভেতরে ট্যাবলেট রেখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসে অভি। অভির হাসি দেখে সেই ছোট্ট ছানা হেসে ফেলে। অভি সেই ছোট্ট ছানার দিকে একটা চুমু ছুঁড়ে দেয়। মায়ের কোল থেকে সেই ছোট্ট ছানা, ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ায়।
হাতে ব্যাগ নিয়ে অভি দাঁড়িয়ে পরে, প্লেনের দিকে যাবার জন্য পা বাড়ায়, কিন্তু চোখ থেকে যায় সেই মায়ের কোলে বাচ্চাটার দিকে। ভদ্রমহিলা কোলের ছানাকে কানে কানে কিছু জিজ্ঞেস করেন, আর সেই ছোট্ট বাচ্চা ওর দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়।
ভদ্রমহিলা ঘুরে দাঁড়ান দেখার জন্য যে কে ওর হৃদয়ের পাঁজরের দিকে হাত নাড়ায় এই অজানা ভুমিতে।
ভদ্রমুহিলার চোখে চোখ মেলে অভির। পা বাড়াতে ভুলে যায়, শ্বাস নিতে ভুলে যায় অভিমন্যু, ভুলে যায় যে অফিসের কাজে ওকে কোথাও যেতে হবে, ভুলে যায় যে ওর জন্য প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। বুকের মাঝে যেন সহস্র ঘোড়া একসাথে টগবগ করে দৌড়াতে শুরু করে দেয়। সারা শরীরের সব শিরা উপসিরা একসাথে ওর বুকের মাঝে রক্ত ঢালতে শুরু করে। বুকের মাঝে দামামা বেজে ওঠে অভিমন্যুর।
চোখের সামনে সেই মাতৃ মূর্তি ওর দিকে তাকিয়ে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে পরে। কোলের সেই ছোট্ট শাবক তাঁর মায়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সেই মাতৃ মূর্তি বাচ্চাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে। ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে ওর, চোখের সামনে অভিমন্যু কে দেখে। সেই পুরানো স্মৃতি ভরে আসে দু নয়নে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে কান্না সামলানোর জন্য। ফর্সা নাকের ডগা, গোলাপি হয়ে ওঠে। বুক কেঁপে ওঠে ওর কোন এক অভূতপূর্ব বেদনায়।
প্রশান্ত মহাসাগরের তলে ডুবে থাকা মহা-দ্বীপে যেন ভাঙ্গন ধরে, চোখের সামনে সেই পুরানো স্মৃতি ফুটে ওঠে সেই ফাটলের ভেতর থেকে।
সোনার চশমার পেছনে থাকা সেই চোখ দুটিকে অভি মনে পরে, সেই টোল পরা গোলাপি গালের দৃশ্য, সেই চুলের এক গুচ্ছ, গালের ওপরে দোলা খায়, না অভিমন্যু কিছুই ভলেনি তার প্রাণ প্রেয়সীর রুপ। আজ পর্যন্ত প্রতি রাতে ওই কাজল কালো চোখ ওকে জাগিয়ে রাখে।
কোটের পকেটে রাখা মানি ব্যাগের দিকে হাত বাড়ায় অভিমন্যু, সেই পকেটে এখন সেই সিল্কের রুমাল রাখা। একবার বার করতে চেষ্টা করে সেই রুমাল, কিন্তু অনামিকায় জ্বলজ্বল করে হীরের আঙটি। সেই দেখে অভিমন্যু আর সেই রুমাল বের করে না, থমকে দাঁড়িয়ে পরে।
প্লেনের দরজায় দাঁড়ান সেই মহিলা আবার অভিমন্যুকে ডাক দেয়, “স্যার, প্লিস বোর্ড দা প্লেন।”
প্লেনের দিকে পা বাড়ানোর আগে শেষবারের মতন সেই মাতৃ ময়ি মূর্তির জল ভরা চোখের দিকে তাকায় অভিমন্যু।
সামনে দাঁড়িয়ে তার প্রেয়সী, দশ বছর আগে সেই প্রেয়সীর গালে চুম্বন এঁকে দিয়েছিল।
কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে তার প্রেয়সী আজ এক মমতা ময়ি মাতৃ মূর্তি, কোলে তার প্রানের ধন, চোখের মনি, তার শাবক – যাকে সে “অভিমন্যু” নামে ডাকছিল।
কোন প্লেনে চেপে, কোন দেশে পাড়ি দেবে সে কথা এই দাঁড়িয়ে থাকা অভিমন্যু জানেনা। জানে শুধু একটা কথা, আজও তাঁর বুকের মাঝে খুঁজে বেড়ায় সেই পুরানো পরীকে।
সামনে দাঁড়িয়ে সেই মমতাময়ী মাতৃ মূর্তি এখন মিসেস শুচিস্মিতা……… অভিমন্যু তালুকদার তাঁর পদবি জানে না।
====== সমাপ্ত ======

এই গল্পের পরের সিজন এর নাম: মধ্যরাত্রে সূর্যোদয়

এই সিজন পড়লে আপনি পরের ঘটনা জানতে পারবেন।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।