ইট পাটকেল | পর্ব – ৩৯

9 Min Read

বিপুল ভোটে জয় লাভ করেছে আশমিন। সারাদিন অনেক ব্যস্ত ছিল সে। কয়েকটি কেন্দ্রে গন্ডগোল হয়েছে।দলের প্রায় বিশ জন মানুষ আহত হয়েছে।তার মধ্যে দুই জনের অবস্থা আশংকাজনক। আশমিন ঠিক করেছে কাজ শেষ করেই একবার হসপিটালে যাবে। নূরের সাথে কথা হয়েছে ঘন্টা দুয়েক আগে।মেয়েদের নিয়ে ঘুমাবে বলায় কথা দীর্ঘ হয় নি। তানভীর আজ সারাদিন আশমিনের সাথেই ছিল। ছেলেটা তাকে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করে। নূর কেও নিজের বোনের মতো ভালবাসে।কিন্তু আশমিনের হিংসুটে মন সব জেনেও তানভীর কে হিংসা করতে পিছ পা হয় না। সারাদিনের ধকলে সবাই খুব ক্লান্ত। আশমিন নিজের কেবিনের ডিভানে গা এলিয়ে বসে আছে। অমি, সানভি,আশিয়ান, তানভীর এখনো কাজ সামলাতে ব্যস্ত।
আশমিনের ফোন বাজছে। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোন বের করে ভ্রু কুচকে ফেললো আশমিন। বাসার ল্যান্ড লাইন থেকে কল এসেছে। কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে কল রিসিভ করলো আশমিন। হ্যালো বলার আগেই মায়া বেগমের আটকে আটকে যাওয়া আওয়াজ পিলে চমকে দিলো তার।
— ব বাবা আ আশ মিন। ব বউ ম মাকে ব বাচাও। ও ওরা ম মে রে ফ ফেলবে ওদ দের।
আশমিন চিৎকার করে উঠলো। হাত পা থরথর করে কাপছে তার। অস্থির হয়ে মায়া বেগম কে ডাকতে ডাকতে বলল,
— কি হয়েছে মায়া আন্টি? নূর কোথায়? আল্লাহ! আমার মেয়েরা কোথায় আন্টি?
ততক্ষণে মায়া বেগমের কথা চিরতরে থেমে গেছে। আশমিন কথা বলতে বলতেই পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে বেরিয়ে গেছে।বাহাদুর সহ বাকি গার্ড রা ও তার সাথেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল। বাহাদুর অমি আর সানভি কে কল করে আশমিনের বেরিয়ে যাওয়ার খবর বলতে বলতে অন্য একটা গাড়ি তে উঠলো। আশমিন নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। বাহাদুর ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। আশমিন কে একা ছাড়া মারাত্মক রিস্ক। তাই যেভাবেই হোক আশমিনের গাড়ি ধরতে হবে।
অমি বাহাদুরের কল পাওয়ার পর আশিয়ান কে কল করলো। বাড়ির কাছাকাছি আশিয়ান আছে। আশিয়ান কে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতেই আশিয়ান অমি কে আসতে নিষেধ করলো। সে গিয়ে পরিস্থিতি জানাবে বলে আস্বস্ত করে ফোন রেখে বাসার দিকে রওনা হয়ে গেলো।
আশমিন পাগলের মতো গাড়ি চালাচ্ছে। চিন্তায় উত্তেজনায় মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। ভয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। এক হাতে চোখ মুছে আবার কল করলো বাড়ির সিকিউরিটি হেড কে। কয়েকবার রিং হতেই কল ধরলো সে। আশমিন কল ধরেই অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— রাফিক বাসায় কি হয়েছে? সবাই ঠিক আছে তো? তোমাদের ম্যাম কল ধরছে না কেন?
রফিক হতভম্ব হয়ে গেলো আশমিনের কথা শুনে। সে তো সারাদিন আশমিনের আশেপাশে ই ছিল। কয়েকজন কে অফিসের সামনে রেখে একটু ওয়াশরুমে গিয়েছিল। এখনো সে ওয়াশরুমের ভিতর। এই টুকু সময়ে কি হয়ে গেলো!
রফিক কাপাকাপা গলায় বলল,
— স্যার, আমাদের কে ম্যাম আজ আপনাকে প্রোটেক্ট করতে বলেছে। আমারা সারাদিন আপনার আশেপাশে ই ছিলাম। বাসার খবর তো কিছু জানি না।
আশমিন রেগে কয়েকটা বিশ্রী গালি দিলো। চিৎকার করে বললো,
— জা*নো*য়ারের বা*চ্চা,তোদের কি আমি আমাকে পাহারা দিতে রেখেছি? আমার সাথে কি আমার গার্ড নেই? তোরা কেন আমার পিছু আসলি? আমার পরিবারের কিছু হলে সব কয়টা কে আমি জ্যান্ত পু*তে দিবো।
রফিক তরতর করে ঘামছে। ভয়ের চোটে ডায়রিয়া হয়ে যাবে এমন অবস্থা। মিনমিনে গলায় বলল,
— স্যার,,আমি আসতে চাই নি।ম্যাম কে তো চিনেন। আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে।তবুও আমি পাচজনকে রেখে এসেছি ম্যাম কে না জানিয়ে। আমি ওদের কল করে দেখছি।
রফিক কল কেটে দ্রুত ওই গার্ডদের কল করলো। কেউ কল রিসিভ করছে না। আমজাদ চৌধুরী সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে গেছে। এখন প্রায় ভোর হতে চললো। সারা রাত ভোট গননার কাজ হয়েছে। আশমিন স্টেয়ারিং এ আঘাত করলো। রাগে দুঃখে তার ভিতরে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। ফাকা রাস্তা হওয়ায় গাড়ি হাই স্পিডে চালিয়ে যেতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। কয়েক মিনিট পরেই বাহাদুরের গাড়ি আশমিন কে ধরে ফেললো। আশমিনের সেদিকে হুস নেই। আজ রাস্তা টাও অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে। নূরের এই অতিরিক্ত বোঝার ফল যদি তাকে আবারও নিঃস্ব করে দেয় তাহলে নূর কে শাস্তি পেতে হবে। ক্ষমা পাবে না নূর।
আশিয়ান বাড়িতে ঢুকে স্থির হয়ে গেলো।মনে হচ্ছে এখানে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে।সব কিছু এদিক সেদিক পরে আছে। ভাঙা কাচ মাড়িয়ে একটু সামনে এগুতেই মায়া বেগমের রক্তাক্ত দেহ পরে থাকতে দেখলো আশিয়ান। কাপা কাপা পায়ে সামনে এগিয়ে বুঝতে পারলো মায়া বেগম আর বেচে নেই।তাকে মারাত্মক ভাবে আঘাত করা হয়েছে।কপালের দিকটা থেতলে গেছে।পেটে ছু*রি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।চারিদিকে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আশিয়ান কাপছে। এই হাতে কত মানুষ মে*রেছে। অথচ আজ মায়া বেগমের নাকের সামনে হাত নিতে তার হাত কাপছে। ঝাপসা চোখে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বায়া বেগমের নিঃশ্বাস পরছে কিনা চেক করল আশিয়ান। তার ধারণা সত্যি হয়ে গেলো। মায়া বেগম আর বেচে নেই। ড্রয়িং রুমে কয়েকজনের লা*শ পরে আছে। তাদের কে গু*লি করা হয়েছে। আশিয়ান দ্রুত পায়ে সিরি দিয়ে উপরে উঠলো। নূর ঠিক আছে তো! তার প্রিন্সেস রা কোথায়!
আশমিনের রুমের সামনে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে কলিজা কেপে উঠলো আশিয়ানের। কোমড় থেকে নিজের রিভা*লবার টা বের করে দরজা হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। ঠিক সে সময় আশমিন প্রবেশ করলো বাড়িতে। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে এসেছে সে। দ্রুত নিঃশ্বাস উঠা নামা করছে। সিরির কাছে এসে থমকে গেলো আশমিন। মায়া বেগমের নিথর শরীরটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো। ধীর পায়ে তার কাছে গিয়ে আলতো হাতে জরিয়ে ধরলো তাকে। চোখ থকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো মায়া বেগমের কপালে। বাহাদুর তার দল নিয়ে উপরে চলে গেছে। সবাইকে চারিদিকে ছড়িয়ে পরতে বলা হয়েছে। একজন কে সিকিউরিটি রুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সিসিটিভি চেক করার জন্য। আশমিন মায়া বেগম কে রেখে টলমল পায়ে উপরে উঠছে। বার বার পা ভেঙে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো সে। বাহাদুর অস্রুসিক্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে আশমিনের রুমের দরজার সামনে। আশমিনের বুকের ব্যথা বেগতিক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
আশমিন কাছে আসতেই বাহাদুর দরজা থেকে সরে দাড়ালো। আশিয়ান পাখি কে বুকে নিয়ে বসে আছে। পাখির ছোট্ট দেহটা নিস্তেজ হয়ে আছে আশিয়ানের কোলে। মাথা থেকে চুয়িয়ে চুয়িয়ে র*ক্ত পরছে। আশমিন ঝাপসা চোখে একবার চোখ বুলালো। আশিয়ান নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। আশমিন পাখিকে আশিয়ানের কাছ থেকে নিজের কোলে নিলো। বুকে চেপে ধরে চিৎকার করে কেদে উঠলো আশমিন।সকালে এই হাতে নিজের পুতুল গুলো ক্র কোলে নিয়ে আদর করেছে সে। তখন তারা খিলখিল করে হাসছিল। এখন সেই আদরের মেয়েকে নিস্তেজ দেখে কলিজা ফেটে যাচ্ছে আশমিনের। হুট করেই আশমিনের কান্না থেমে গেলো। চিৎকার করে আশিয়ান কে ডেকে বললো,,
— আশিয়ান আমার মেয়ে বেচে আছে।ওরে আমার মেয়ে বেচে আছে। বাহাদুর গাড়ি বের করো। আমার মেয়েকে হসপিটাল নিয়ে যাও ভাই।
আশিয়ান এসে পাখিকে নিজের কোলে নিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল। বাহাদুর দৌড়ে বেরিয়ে গেল আশিয়ানের সঙে।
আশমিন কয়েক সেকেন্ড নিজের রক্তাক্ত হাত আর পাঞ্জাবির দিকে তাকিয়ে গা ঝারা দিয়ে উঠে দাড়ালো। তার সুখ আর নূর কে ও যে খুজতে হবে।
কয়েকজন গার্ড এসে জানালো নূর আর সখ কে বাড়ির পিছনের বাগানে পাওয়া গেছে। আশমিনের আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। সে সেদিকে ছুটলো।
একটা ঝোপের আড়ালে থেকে হালকা কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে সুখ কে দেখে আশমিনের জানে পানি এলো। সুখ হাত পা নাড়িয়ে কান্না করছে। অনেক ক্ষন কান্না করার দরুন গলা ভেঙে গেছে। সুখ কে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে আশমিন চারিদিকে পাগলের মতো নূর কে খুজতে লাগলো।
বাবার বুকে এসে সুখের কান্না থেমে গেছে। একজন গার্ড এসে নূর কে দেখিয়ে দিলো। রক্তাক্ত হয়ে একপাশে পরে আছে নূর। মেয়েকে বাচাতেই ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল হয়তো।
আশমিন নূরের রক্তাক্ত দেহটাকে এক হাতে বুকে আগলে নিলো। রক্তাক্ত চোখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
— আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না নূর। এর শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।
একজন গার্ড এসে ভয়ে ভয়ে আশমিন কে বললো,,
— স্যার, আমজাদ স্যারের গুলি লেগেছে। ম্যামের অবস্থা ও ভালো নয়। প্লিজ স্যার, তারাতাড়ি হসপিটাল নিয়ে চলুন।
( আমি আবার ও ক্ষমা চাইছি। আজ থেকে প্রতিদিন গল্প পাবেন। আপনাদের সাপোর্ট পেলে আশমিন আর নূর বইয়ের পাতায় আসবে। যাদের গল্প অনিয়মিত দেয়ার জন্য আমার উপর রাগ তাদের বলছি,, আমার ছেলে হাফিজিয়ার প্রস্তুতি চলছে। তাই আমার ব্যস্ততা টা একটু বুঝবেন আশা করি। )

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।