এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা – সিজন ২ | পর্ব – ১৮

এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা - সিজন ২

–এক আকাশ রাগ,অভিমান নিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়িতে প্রবেশ করলাম।কিন্তু বাড়িতে প্রবেশ করেই বাড়ির প্রবেশ অন্যরকম মনে হলো।উঠানে আম্মু কাকিমনিদের সাথে পাড়ার কয়েকজন মহিলা দাঁড়িয়ে কথা বলছে।আমাকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে গেলো যেনো সবাই।আম্মু আর কাকিমনিরা এগিয়ে এসে বললো দিয়া তুই এখন এই অসময়ে।আম্মু চোখে মুখে চিন্তার বলি রেখা ফুটে উঠেছে। আমার মন চাইছে এক্ষুনি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেই।

–পাশের বাসার আন্টি বলছেন,দিয়া বিয়ের একদিন হতে না হতেই বাপের বাড়ি রাগারাগি করে চলে এসেছো।তোমার আম্মুকে এইজন্য বলেছিলাম তোমার ভাতিজা এত বড় ডাক্তার তোমার মেয়ের সাথে মানিয়ে চলতে পারবে না।আম্মু একটু রেগেই বললো,দিয়া কি বলেছে ও রাগ করে এসছে বা মানিয়ে চলতে অসুবিধা হচ্ছে।আপনারা এসব বলছেন কেনো আগেই।পাশের বাসার আরেক আন্টি বললেন,আমাদের বাসার ভাড়াটিয়ার মেয়ে ও বিয়ের পরের দিন কি নিয়ে রাগারাগি করে চলে এসছিলো তারপর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।কতগুলো টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছিলো,টাকা গেলো,সম্মান গেলো সব ই গেলো।পরে ওই ভাই স্ট্রোক করেই মারা গেলেন।আজকাল যুগে বিয়েই টিকে না।তোহা আপুর আম্মু বললেন দেখুন ভাবি সবাই তো আর এক নয়,আর বিহান কে তো চিনেন ওর মতো ছেলে লাখে কয়টা মিলে।আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,দিয়া তুমি কি রাগ করে এসছো?আম্মুর চোখে পানি ছলছল করছে সাথে আমার চোখেও।আমি বা কিভেবে এসছিলাম আর এখানে বা কি হচ্ছে।আম্মুর এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে ঠোঁট কাঁপছে আমার।

–এমন সময় পেছন থেকে বিহান ভাই বললেন,কেনো ও রাগ করে আসবে কি নিয়ে ফুপ্পি।

–উনার ভয়েজ শুনে আশ্চর্য হয়ে পেছনে তাকালাম আমি।উনি কখন আসলেন,তাহলে কি আমায় ফলো করতে করতে চলে এসছেন।

–গায়ে হোয়াইট কালারের জ্যাকেট,পরণে সাদা জিন্স,জিন্সের পকেটে হাত গুজে কপালের চামড়ায় কয়েক ভাজ ফেলে দাঁড়িয়ে আছেন।উনার চোখে মুখে বিরক্তি দেখা যাচ্ছে।

–বিহান ভাই কে দেখে আম্মু একটু স্বস্তি নিয়ে বললো,বিহান তোরা আগে পিছে এসছিস তাই ভাবলাম রাগ করে এসছে দিয়া।

–দিয়া কার সাথে রাগ করবে ফুপ্পি,ও বাড়িতে কে আছে সে দিয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে আর সেজন্য দিয়া রাগ করে চলে আসবে।বিহান ভাই কপালে কিঞ্চিত ভাজ ফেলে পাশের বাসার আন্টিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,ফুপ্পি এমন কোনদিন হবে না দিয়া রাগ করে চলে আসবে আর সেই আসায় শেষ আসা হবে।উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন রাগ করে এসছিস দিয়া তুই।

–আমি কি একবার ও বলেছি যে আমি রাগ করে এসছি।

–আমরা এক সাথেই এসছি,রাস্তায় একজনের সাথে দেখা তাই আমি তার সাথেই কথা বলছিলাম আর দিয়া এগিয়ে এসছে জাস্ট এটুকুই।আমার আর একটু লেট হলে দেখছি এটা নিউজ পেপারের হেড লাইনে ছাপা হয়ে যেতো।

–রিয়ার আম্মু বললো,বিহান আমরা তো তোমাকে চিনি বাবা।আসলে আজকাল যুগে এমন হচ্ছে চারদিকে তাই উনারা বলে ফেলছেন।যাও ভেতরে যাও।আম্মু কিছু না বলেই আমাদের ভেতরে আসতে বলে ভেতরে চলে গেলো কাকি মনিরা ও ভেতরে চলে গেলো।পাশের বাসার আন্টিরা খুব লজ্জিত হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।উনাদের সন্দেহ কি পুরোটা ক্লিয়ার হয়েছে।বিহান ভাই উনাদের দিকে উনার হাত এগিয়ে দিলেন আমার দিকে উনার হাতটা ধরার জন্য।আমি শান্ত নয়নে উনার দিকে তাকালাম, উনার চোখ এক দৃষ্টিতে নির্বিকার তাকিয়ে আছে আমার দিকে।পরিস্হিতি সামলাতে উনার হাতের উপর আমার হাত টা রাখলাম।আমার হাত উনার হাতের উপরে রাখার সময় আমার হাত খুব কাঁপছিলো।উনি আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন।আমার হাত ধরেই উনি বাড়ির ভেতরে রওনা হলেন।খুব অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে,এই হাত ধরাটা কেনো সত্য হলো না।কেনো উনার বলা কথাগুলো আমার জন্য সত্য হলো না।কেনো উনার সেই শ্বশুরের মেয়ে আমি হলাম না।এইভাবে উনার হাত ধরে সাত জনম কাটিয়ে দিতে চাই আমি।কেনো ভালবাসলেন না আমায় বিহান ভাই।আমি আপনার মতো সুন্দর না,আপনার মতো হাইট নেই,ভাল স্টুডেন্ট না এইজন্য।ভালবাসলে কেউ সামান্য তার ফোনের কথা শোনার অপরাধে এত বকতো না।কেনো বার বার এত অভিনয় করে দূর্বল করেন আমাকে।আপনার আমার সাথে করা সব অভিনয় আমার কাছে সত্য মনে হয়।আপনার অভিনয় কে সত্য ভেবে দিনে দিনে ভীষণ দূর্বল হয়েছি আমি।কেনো ওই শিউলি ফুলের মালা,কেনোই বা ভুল করে আমাকে ঘুমের মাঝে স্পর্শ করা আর কেনোই বা পরম আবেশে আমার হাত ধরেছেন।আমাকে তো ভালবাসেন না তাহলে রাগ করে চলে এসেছি আপনি আবার মিথ্যা বলে কেনো আমার সম্মান বাঁচাতে এসছেন।কেনো ধরেছেন আমার হাত আবার তো ছেড়েই দিবেন।আমি বহুবার রাগ করেছি অনেক বিরক্ত হয়েছি,অতিষ্ট হয়েছি তবুও আপনার জন্য আলাদা জায়গা রেখেছি মনের মাঝে।আমার জীবনে আপনার মতো চমৎকার মানুষ আর দ্বীতীয় টা দেখি নি,যতই আপনি বিরক্ত করেন আপনার মতো একজন লয়াল আর কেয়ারিং মানুষ কে স্বামি হিসাবে পাওয়া ভাগ্যর ব্যাপার।কেনো মিথ্যা সম্পর্কের জালে জড়ালেন।সেই তো ছেড়েই যাবেন।তখন কিভাবে থাকবো আমি।ভেবেই চোখে পানি ছলছল করছে করছে আমার।আমি উনার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছি আর উনি আমার হাত শক্ত ভাবে ধরে হাতে আঙুল উনার হাতের আঙুল দিয়ে স্লাইড করছেন।যা আমার মাঝে লজ্জার ও সৃষ্টি করছে।

–ঘরে ঢোকার আগেই উনি হাত ছেড়ে দিলেন আর আমার দিকে তাকিয়ে একটা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বললেন,এই যে বালিকা দয়া করিয়া আপনার চোখের পানি মুছুন।না হলে এ জেলায় বন্যা প্রবাহিত হবে।আমি উনার টিস্যু না নিয়ে নিজের ওড়না দিয়েই মুছলাম।

–আম্মু আর কাকিমনি দ্রুত নাস্তা রেডি করছে।বিহান ভাই বললেন প্লিজ ফুপ্পি এখন কিছুই দিও না।এখন কিছুই খাবো না দিয়ার কি বই বাকি আছে সেটা নিতে হবে।রিয়া এগিয়ে এসে বললো আমি তো বই দিয়েই এসছিলাম।বিহান ভাই বললেন আর একটা বাকি আছে বই।

–আম্মু বিহান ভাই কে নাস্তা খেতে দিয়ে আমাকে আম্মুর রুমে নিয়ে ডেকে নিয়ে বললো,কি হয়েছে দিয়া সত্যি করে বল তো।
আম্মুকে আর টেনশন দিতে ইচ্ছা করছে না।তাই বললাম না আম্মু কিছুই হয় নি,কি হবে।

আমি জানি দিয়া তোর বিয়েটা হয়তো এভাবে দেওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু দিয়া একটা কথা মাথায় রাখিস মা বিয়ের পর স্বামি ই কিন্তু সব।হুট হাট করে এইভাবে চলে আসলে মানুষ কত বাজে কথা বলে দেখেছো তো।বিহানের জীবনের সুখ শান্তি তোমার উপর নির্ভর করছে।

একটু হেসে বললাম মানুষ যা ভাবে তা সব সময় সত্য হয় না আম্মু।ভেবো না আম্মু আমি চেষ্টা করবো সংসার করার।

বিয়ের পরে একটা মেয়ের অনেক কিছুই বদলে যায় সেটা আজ বুঝলাম।বাবার বাড়ি ও ইচ্ছা মতো আর আসা যায় না।

সেদিন বিহান ভাই এর সাথে আবার ও ফিরে এলাম উনার বাড়িতে।উনার সাথে আর একটা কথা ও বলি নি আমি।চুপচাপ সুয়ে আছি বিছানায়।উনি মন দিয়ে পড়াশুনা করছেন।কয়েক ঘন্টা হয়ে গিয়েছে দুজনে আর কোনো কথা বলি নি।সন্ধ্যায় একবার বিহান ভাই এসছিলেন আমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গিয়েছে কারণ বিহান ভাই লেখাপড়া করছেন।একটা মানুষ এত দীর্ঘ টাইম কিভাবে বই পড়তে পারে।

মামি অনেক বার খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করেছে,শরীর খারাপ বলে আর যায় নি।মামা মামিকে বলেছে তোমার মাথায় কি কিছুই নেই মারুফা কে দিয়ে দুজনের খাবার ঘরে দিয়ে এসো দুজনে ঠিক ই খেয়ে নিবে। মারুফা খালা খাবার দিয়ে গিয়েছে সেই সন্ধ্যার পরেই।আর এখন রাত বারোটা বাজে।উনি বই পড়েই যাচ্ছেন।উনার মুড অফ হলে বই ছেড়ে আর ওঠেন না।

কেউ একজন উনার ফোনে ফোন দিয়েছেন,উনি প্রচন্ড রাগে বকাঝকা করে কথা বলে ফোন সোফার উপর ফেলে দিলেন।গায়ের উইন্টার ড্রেস খুলে ওয়াশ রুমে গেলেন।এই প্রচন্ড ঠান্ডায় উনি সাওয়ার নিচ্ছেন কেনো?অদ্ভুত মানুষ তো উনি।সোফার উপর ফোন অনেক বার বাজছে তো বেজেই যাচ্ছে।আমি অতিষ্ট হয়ে উঠে এলাম ফোনের উপর ভাষছে প্রেয়সী নাম।সেই নামের কল প্রায় ত্রিশ বার।কত গুলো মেসেজ ও পাঠিয়েছে উনার ফোন লক থাকায় মেসেজের সব টা পড়া যাচ্ছে না।শুধু দেখলাম প্লিজ সরি আর এমন হবে না।একবার ফোন তোলো।মেসেজ দেখে বুঝতে আর বাকি রইলো না এই সেই প্রেমিকা যার সাথে মনোমালিন্য হওয়াতে উনার মুড অফ।এইজন্য রেগে আছেন আর এই শীতে সাওয়ার নিচ্ছেন।উনি সাওয়ার থেকে বেরিয়ে দেখেন আমার হাতে উনার ফোন।চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বাইরে বেরিয়ে এলেন।অবাক করা নয়নে আমার দিকে তাকালেন।উনাকে বেরিয়ে আসতে দেখে আমি ফোনটা রেখে একটা চাঁদর নিয়ে আর একটা বালিশ নিয়ে ফ্লোরে গিয়ে সুয়ে পড়লাম।উনি শিতল নয়নে দেখলেন আমি কি করছি।বেশ অবাক ও হলেন আমার কাজ দেখে।

উনার পরনে সাদা টাওয়াল এই প্রথম বার উনার নাভি দেখলাম আমি।ছেলেদের নাভি ও এত সুন্দর হয়।ছেলে মানুষ তবুও সব সময় নিজেকে আগলে রাখেন উনি সব সময়।কারো সামনে খালি গায়ে থাকেন না।নাভির একটু নিচেই টাওয়াল এর গিট,ভেজা চুল গুলো কপালে দলা পাকিয়ে পড়ে আছে গায়ে পানি চিকচিক করছে।কৃত্রিম আলোতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে সদ্য সাওয়ার নেওয়া বিহান ভাই কে।খালি গায়ে ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে লোসন লাগালেন গায়ে।এক’পা,দু’পা করে এগিয়ে এলেন আমার দিকে।উনি আমার কাছে হাঁটু ভাজ করে বসে বললেন,এখানে কেনো?ঠান্ডা লাগবে তো!
আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
উনি উনার চুল ঝাঁকি দিয়ে আমার মুখে পানি ছিটিয়ে বললেন, আমি কিছু বলেছি দিয়া উত্তর দিচ্ছিস না কেনো?ঠান্ডা লেগে জ্বর হলে খুব ভাল লাগবে?
আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে সুয়ে রইলাম।
উনি আমাকে বললেন ভাল কথায় না গেলে অন্য ভাবে নিতে হবে।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।