যে বাড়িটা এতদিন মামাবাড়ি ছিলো সেই বাড়িটা আজ আমার শ্বশুরবাড়ি।যে বাড়িতে প্রবেশ করতে সকাল সন্ধ্যা দুপুর লাগতো না সেই বাড়ির গেটে আমাকে ঘন্টাখানিক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে বাড়িতে প্রবেশের জন্য।আজ আমাকে বরণ করার সময় চাইলেই হুট করে পারিনি সবাইকে উপেক্ষা করে বাড়ির ভেতরে গান গাইতে গাইতে প্রবেশ করতে।আজ এই বাড়িতে পা রেখে কেমন যেনো অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।আগের মতো ইজি হতে পারছি না।আগে যেমন বড়িতে প্রবেশ করেই লাফাতে লাফাতে বিভোর ভাই বিভা আপুর ঘরে প্রবেশ করতাম সেটা আর পারছি না।অন্য দিন গাউন পরে প্রবেশ করেছি আর আজ লাল বেনারসি পরেছি।এই বেনারসি গায়ে জড়ালে বড্ড ভারী লাগে,এই বেনারসির সাথে নিজের পরিচয় পালটে যায়, নিজের ভিতরে জড়তা,লজ্জা,ভয় সংকোচ কাজ করে আগে জানতাম না।আগে ভাবতাম বউ সাজার মতো আনন্দ বোধহয় পৃথিবীতে নেই।বউ সাজা শুধু আনন্দের বিষয় ই নয় নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন জীবন নতুন পরিবেশের জন্য তৈরি ও করা।কবুল বলার সাথে সাথেও পাল্টে যায় একটা মেয়ের জীবন।কবুল বলার সাথে সাথে নিজের ভেতর থেকেই যেনো অনেক কিছু বদলে গিয়েছে আমার।তিন অক্ষরের কবুলের সাথে বদলে গিয়েছে আমার পরিচয়।আজ থেকেই সবাই কেউ আর বাবার নাম ধরে বলছে না আরমান খাঁনের মেয়ে সবাই বলছে বিহানের বউ।বিহানের বউ কথাটা যত শুনছি ভেতরে কেঁপে উঠছে।এই নামের সাথেই কি তাহলে জড়িয়ে গেলো আমার জীবন।
আম্মু কাকিমনিরা আমাকে বিয়ের আগে বার বার বুঝিয়েছেন বিহানের বাম পাজরের হাড় দিয়ে উপরওয়ালা আমাকে সৃষ্টি করেছেন।বিয়ে এমন এক বন্ধন যে বন্ধনের সেতু উপর থেকেই সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টিকর্তা।বাবার পরে স্বামি একমাত্র অবিভাবক হয়ে যায় মেয়েদের।তার জীবনের সাথে জীবন জড়িয়ে যায়।স্বামির পরিচয়েই পরিচিত হতে হয়।আম্মু এমন কি এইভাবেই বুঝালো একটা মেয়ে বাবার এতটা আদরের হয়েও প্রাপ্তবয়স্ক হলে বাবার পাশে আর ঘুমোতে পারে না কিন্তু স্বামি একমাত্র পুরুষ যার কাছে বাকি জীবন এক রুম,এক বেড,এক সংসার,শেয়ার করে জীবন পাড়ি দিতে হয়।
এই কবুলের সাথে জড়িয়ে আছে এমন এক সম্পর্ক যে সম্পর্ক দিনে দিনে প্রবল হতে থাকে।স্বামিকে অসম্মান করলে মহা পাপ হবে।মেয়েদের আরেক টা আশ্রয়স্হল তার স্বামি।এ বড় অমূল্য সম্পদ।স্বামি নামক মানুষ টা এমন ই ভালবাসার মানুষ যাকে ঘিরে শুরু হয় নতুন জীবন,যার ভালবাসার জোরে মেয়েরা নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যর বাড়ি আপন করে নেয়।
উনার গুরুত্বটা আমার জীবনে অনেক বেশী সেটাই সবাই আমাকে বার বার বুঝিয়েছে।কিন্তু আমার মন সেটা মানতে পারছে না।ঢুকরে ঢুকরে কাঁন্না পাচ্ছে আমার।যে মানুষ টা আমাকে বিয়ে করে ভালবাসবে অন্য কাউকে তাকে নিজের জীবনের সব আমি কিভাবে মনে করবো।আমার বয়স কম,বুদ্ধি কম, ছেলে মানুষ এগুলো হতেই পারে তাই বলে আমি এতটা ছেলেমানুষ নই যে নিজের স্বামি অন্যর হয়ে থাকবে আর আমি সেটা মেনে নিয়ে তার সাথে জীবন কাটাবো।তাছাড়া ওই মানুষ টাকে আমি এই ভাবে মেনে নিতেও পারবো না।ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছে উনার জন্যই পরিবাত আমাকে ভুল বুঝলো,বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো,উনি আমাকে ঘৃণা করে অপছন্দ করে জেনেও বিয়ে দিলো।উনার জন্যই মা বাবা তাদের থেকে দূরে করে দিলো আমায়।ঘৃণা করি উনাকে আমি,এসব যতই ভাবছি ততই কাঁন্না পাচ্ছে আমার।
মামির ঘরে নিয়ে আমাকে বসানো হয়েছে,চোখ দিয়ে পানি ঝরছে অঝরে।আশে পাশে পাড়ার মানুষ সবাই আমাকে চিনে তবুও তারা দেখতে এসছে কেননা নতুন বউ আজ আমি।বউ এর সাজে কেমন লাগছে সেটা দেখতেই মানুষের ভীড়।পাড়ার কেউ কেউ আমাকে প্রচন্ড ভালবাসে এই ভালবাসার পরেও কেউ কেউ বলছে বিহানের মা বাবা কি পাগল নাকি। এমন সুন্দর ছেলেটার সাথে কিনা বোনের মেয়ের বিয়ে দিয়ে আনলো।সানজিদার মেয়েও দেখতে ভালোই তবে বিহানের সাথে মানায় নি খুব একটা।ছেলেটা এবার ডাক্তার হবে বিহানের সাথে চাইলেই তো অনেক বড় ডাক্তার এর বিয়ে দিতে পারতো।কি ভেবে এমন বিয়ে দিলো বুঝলাম না।বিহানের হাঁটু অবধি ও তো হবে না দিয়ার হাইট,তালগাছ আর বেলগাছ হয়ে গিয়েছে।
“পাশের বাসার মামির এমন কথা শুনে আরেক জন পাড়াপ্রতিবেশী মামি বললেন,এটা কোনো ব্যাপার না আপা,দিয়া তো একেবারেও খাটো না।আমার কাছে তো মনে হচ্ছে মানিয়েছে সুন্দর। সব সময় ডাক্তার ই বিয়ে করতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি।বিহানের কানে গেলে এ বাড়ির ত্রিসীমানায় আর পা রাখতে দিবে না।এ বাড়ির কারো কানে গেলেই রেহায় হবে না, বিভোর শুনলেও পাড়ার মানুষ ডেকে শালিস ডাকবে।এ বাড়িতে সানজিদা আর ওর ছেলে মেয়ে অনেক আদরের।বুঝছো না অনেক আদরের না হলে যোগ্যতা চেহারা এসব না ভেবেই একমাত্র ভাগনি কে ঘরের বৌ করে নিয়ে এসছে।”
“কিন্তু বিহান মেনে নিলো এই বিয়ে।”
“মেনে না নেওয়ার কি আছে?বিহান কি আমাদের ছেলেদের মতো বাবা মায়ের মুখের উপর কথা বলবে।কখনো দেখেছো রাস্তায় মেয়ে নিয়ে ঘুরতে।আমাদের ছেলে পেলে আয়ে পাশ করতে পারে নি একেক টা ঘরে এনে উঠেছে।”
“আমার মনে হচ্ছে বিহান রাজি না দেখছো না বিহান কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।ফোন কানে নিয়ে রাস্তায় দেখলাম।”
“তো কি করবে নির্লজ্জের মতো বউ নিয়ে বসে থাকবে।বিহান এমন ই ছেলে ফুফুর মেয়েকে এমন যোগ্য ভাবে গড়ে তুলবে দেইখো।বিহানের পাশে যে মেয়ে থাকবে সেই বিহানের আদর্শে নিজেকে পালটে ফেলবে।”
“মানুষের এমন কথাও আজ সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে।কি এমন পাপ করেছিলাম আমি।জীবন টা এমন উপহাসের পাত্র হয়ে গেলো।”
“ক্রমশ রাত হতে শুরু করলো আর মানুষের ভীড় কমতে শুরু করলো।আমাদের বাড়ি আর মামাদের বাড়ি খুব একটা দূরে নয় তাই তিয়াস ভাইয়া,রিয়া,মেহু আপু,তোহা আপু সবাই এসছে।খানিক পরে ওরা আবার চলে যাবে।বাইরে দাঁড়িয়ে উঠানে বিভোর ভাই বলছেন বিহান ঘরের চাবি আমার কাছে টাকা দে দশ হাজার না হলে ফুলসজ্জা আর তোর হবে না।বিহান ভাই কপাল কুচকে বললেন কিসের ফুলসজ্জা।”
“এতদিন যার স্বপ্ন দেখেছিস।ফুলসজ্জার চিন্তায় তো এতদিন ঘুমোস নি ঠিকভাবে।”
“মানে কি আমার ঘরে তালা কেনো?ঘর আমার বিয়ে করেছি বলে ট্যাক্স দিতে হবে।”
“আমরা যে ফুল কিনে সাজিয়েছি তার টাকা দে।”
“হোয়াট দ্যা হেল আমার রুমে ফুল দিয়ে বিদিগিস্হা করে রেখেছিস।”
“তুই এত আনরোমান্টিক কেনো বিহান?তোর এই আদি কালের ভাব কমা বলে দিচ্ছি।নইলে দিয়া কার সাথে পালাবে সিরিয়াসলি?”
“কে পালাবে দিয়া?ওর সেই সাহস আছে।”
“সাহস দেওয়ার জন্য আমরা আছি।দিয়ার পালানো ই উচিত।দিয়া কেনো যে কোনো মেয়ের ই থাকা উচিত নয়।শোন সময় আছে নিজের মুড পালটে ফেল।”
“সময়ের কাজ সময়ে করতে বিহান ঠিক ই পারে।”
“রিয়া বললো,বিহান ভাই দিন না।এই দিনে অধিকার আছে আমাদের।”
“মানে রিয়া ওই বাড়িতে,গেট, হাত ধোয়ানো,বউ সাজানো,ইটিছি আরো কি কি যেনো বলে আমার পকেট খালি করেছো।এখন আবার এখানে এসে আমার ঘর আটকে চাঁদা চাইছো।আচ্ছা বর পক্ষ বা কারা কনে পক্ষ বা কারা কিছুই বুঝলাম না।সব কটাতে মিলে ই তো টাকা আদায় করে বেড়াচ্ছো।এ কেমন অদ্ভুত বিয়ে বুঝলাম না।”
“বিভোর ভাই বললেন,এক মাসের পেমেন্ট ও দিস নি এখনো।এত কিপ্টামি করিস না বিহান।”
“আমি সারারাত বাইরে থাকবো তবুও টাকা দিবো না।তোর বিয়ের সময় আসলে দেখিস বিভোর কি করি।”
“হাহহা আমার ওসব নিয়ে চিন্তা নেই।রাত দশ টার আগে আমার ঘর ক্লিয়ার করবি সবাই।আমি রিয়াকে নিয়ে ফুলসজ্জা করবো।আর যদি কেউ না বেরোয় আমি সবার সামনেই রোমান্স শুরু করবো।”
“রিয়া বললো নির্লজ্জ যাকে বলে। ”
এমন সময় বড় মামি গিয়ে বললেন,এই বিভোর দরজা খুলে দে।দিয়ার খুব মাথায় যন্ত্রণা করছে।ওর ঘুমের প্রয়োজন।অনেকক্ষণ হয়েছে মেয়েটা মাথায় পেইনে ছটফট করছে।
বিভোর ভাই বললেন,সেটা বিহান বুঝছে না আম্মু।
বিহান ভাই তখন আর কথা না বাড়িয়ে দশ হাজার টাকা দিয়ে দিলেন।
বিভা আপু,রিয়া, তোহা আপু সবাই মিলে আমাকে বিহান ভাই এর ঘরে দিয়ে আসলেন।চুপ করে খাটের উপর বসে আছি আমি।সবাই চলে গিয়েছে এতক্ষণে বাড়িতে।ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজে বিহান ভাই এর এখনো খোজ নেই,যাক না আসলেই শান্তি।এবার উনি এক মাসের জন্য নড়াইল এসেছেন,উনার কলেজ অফ আছে।মাত্র সাত দিন হয়েছে এখনো তেইশ দিন বাকি আছে।বিহান ভাই এর ঘর টা আজ চেনায় যাচ্ছে না।দেখে মনে হচ্ছে কোনো ফুলের রাজ্য এটা।উনি আর আসবেন না ভেবে বিছানায় কাত হলাম মাত্র।মনে মনে অনেক খুশি ও হলাম যাক অন্তত আমাকে বিরক্ত তো আর করবেন না।উনি নিশ্চয়ই বাইরে কোথাও আছেন।কিন্তু আরাম কে হারাম করে উনার আগমন ঘটলো।