–এই অবেলায় মেঘ কেনো,বৃষ্টি কেনো,এখন তো বৃষ্টির কোনো সিজন ই নয়।প্রকৃতি ও তো বৃষ্টির অভাবে খা খা করছে না তারাও তো উত্তপ্ত নয় তাহলে কেনো এই বৃষ্টি। শুনেছি মানুষ আর প্রকৃতি হাঁপিয়ে উঠলে তাদের প্রার্থনায় তাদের তৃষ্ণা মেটাতে মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে প্রকৃতির বুকে।হুমায়ুন আহমেদ এর বৃষ্টিবিলাস বই টা হাতে নিয়ে কম্বলের ভেতরে পা দিয়ে বসলাম আমি।সেদিন রিয়া দিয়েছিলো আমার জন্মদিনে।আমি যে ভীষণ বৃষ্টিবিলাসী রিয়া সেটা জানে।আমার সাথে বৃষ্টির ভীষণ ভাব।এই কিশোরী মনে বৃষ্টি ভীষণ দোলা দেয়,তাদের সাথে ভিজে নিজেকে প্রাণবন্ত করে তুলেছি অসংখ্যবার।বাইরের ঝড়ো বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে এলোমেলো ভাবে,বই হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছি পর্দার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টার দিকে।বেলকনিতে দুই হাত ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন বিহান ভাই।উনি তো আমি ভিজলে বকা দেন, এখন নিজেই ভিজছেন কেনো?পানির ছেচ লাগছে না উনার গায়ে। নাকি কি বুঝতেই তো পারছি না।আমি জোরে ডাকলাম বিহান ভাই ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?ভিজে যাবেন তো।আমার কোনো কথার ই উত্তর দিলেন না উনি।
–আমি বই টা রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।রাস্তায় রোড লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে।মানুষ জন ছাতা হাতে রাস্তার এপাস ওপাস করছে।দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করছে নিজেকে মানুষ জন।এও অসময়ে এমন বৃষ্টি কেউ আশা করে নি।বৃষ্টির জন্য ঠান্ডা কমে গিয়েছে অনেক টা।বোঝায় যাচ্ছে না এটা শীতকাল।উনার নিশ্চয়ই কফি লাগবে কিন্তু বলতে পারছেন না।উনি কি চিন্তিত উনার সেউ গেস্টদের জন্য তারা আসতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে।আমি পানি গরম করতে দিয়ে চিনির কৌটা খুজে চলেছি।পানি ফুটে গেলে কফি দিয়ে দিলাম মনে হচ্ছে কফির পরিমান অনেক বেশী দেওয়া হয়ে গিয়েছে।এটা তো অনেক বেশী তিতো হয়ে যাবে।এইজন্য চিনি একটু বেশী ই দিলাম।এই প্রথমবার উনি না চাইলেও নিজে থেকে উনাকে ভেবে কিছু একটা করছি।উনি কি খাবেন নাকি বকে ঝকে বলবেন আমি কি কফি চেয়েছি তোর কাছে দিয়া।আর এটা কি কফি বানিয়েছিস তুই,এটা তো মুখেও দেওয়া যাচ্ছে না।দেখা গেলো কফির মগ টাও ভেঙে ফেললো।মানুষ টা অনেক অদ্ভুত, উনাকে বোঝা অতটাও সহজ নয়।জীবনে প্রথম এত যত্ন আর ভাল করে কফি বানাচ্ছি শুধু একটু উনার প্রাংসা পাওয়ার জন্য।কবে যে উনি সম্পূর্ণভাবে আমায় বুঝবেন বুঝাবেন উনার মনের কথা।সেই জন্মদিনের রাতের রাত টা ই কি স্মৃতি হয়ে আজীবন থাকবে আমার জীবনে।আমার উপর কি শুধুই করুণা করেছিলেন উনি।কি ভেবে নিবো আমি।তারপর আর একটা দিন ও উনি আমার কাছে উনার কোনো অনুভূতি প্রকাশ করেন নি।উনি কি মজা পান এমন করে।উনি কি এটা বোঝার চেষ্টা করেন যে দেখি দিয়া কি করে।
–কফির মগ টা নিয়ে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কফির মগ টা উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম এটা মিস করছিলেন তাইনা?
–উনি আমার দিকে খুব আশ্চর্যজনক ভাবে ফিরে তাকালেন।যেনো কোনো ভাবনায় বিভোর ছিলেন।ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি এনে বললেন,থ্যাংক ইউ সো মাস পিচ্চি।
আবার এই পিচ্চি ডাক।কি আছে এই পিচ্চি ডাকে।উনি অনেক কিছু বলেই ডাকেন আমায়।কিন্তু বিশেষ কিছু আছে এই পিচ্চির মাঝে।যে ডাক শুনলেই বুকের মাঝে শুরু হয় ধুকপুকনি আর প্রেমবর্ষন।
— উনার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,এই অবেলায় বৃষ্টি কেনো বলুন তো?
–কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বললেন,কারণ বৃষ্টি কারো ভীষণ প্রিয় তাই।প্রার্থনা করেছিলাম মেঘের কাছে তার আঙিনায় বৃষ্টি আসুক,ঝুম বৃষ্টি সে বৃষ্টি দেখে হাসুক,হাতের তালুতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি নিয়ে আমায় ভাবুক।
–তখন আমি বেলকনিতে হাত বাড়িয়ে হাতের তালুতে বৃষ্টির ফোঁটা নিয়ে তাকেই ভাবছিলাম।কি আশ্চর্য আর অদ্ভুত তাইনা?আমি যা ভাবছি উনিও তাই বলছেন।
একজনের জন্য বৃষ্টিকে আসতে হলো কেনো বলুন তো।এখন তো আর প্রকৃতি তৃষ্ণার্ত নয়।তারা কি হাঁপিয়ে উঠেছে যে বৃষ্টি লাগবে।
–উনি আবার আমার দিকে তাকালেন,কফিতে চুমুক লাগিয়ে বললেন,প্রেমিক হৃদয় যে তৃষ্ণার্ত।প্রকৃতির তৃষ্ণার থেকে প্রেমিক হৃদয়ের তৃষ্ণা বড় ভয়াবহ তৃষ্ণা পিচ্চি।এ তৃষ্ণায় বুক ফাটে প্রতিনিয়ত কিন্তু প্রকাশ করা যায় না।কেবল মাত্র তার প্রেয়সীর ভালবাসা পারে এই তৃষ্ণা থেকে অব্যহতি দিতে।
আমি মৌন রইলাম উনার কথা শুনে।
–উনি আবার বললেন,তুমি বৃষ্টিবিলাসী তাইনা?বৃষ্টি অনেক প্রিয় তোমার।
–অনেক প্রিয়।
উনি আমায় তুমি ডাকলেন কেনো?কেঁপে উঠলো শরীর আমার,বুকের মাঝে দুরুম করে আওয়াজ হলো।উনি এতটা কোমল তার সাথেও কথা বলতে পারেন।উনার তুমি সম্মোধন এ এত নমনীয়তা।এই ভীষণ বৃষ্টি,হুডির হাতা গোটানো,হাতের কফির মগ নিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করছে বৃষ্টিবিলাসী তুমি।আমার বৃষ্টিবিলাসী মনে শুরু হলো ভীষণ তুফান।
–তাহলে ধরে নাও এই বৃষ্টি তোমার জন্য।
–ভিজছেন কেনো এইভাবে বিহান ভাই?
–তুমিও তো ভিজছো?
–কারণ আমি বৃষ্টিবিলাসী।
–সে বৃষ্টিবিলাসী তাই বৃষ্টি আমার ও ভীষণ প্রিয়।
–আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে,আর কয়েক দিন পরে আপনার এক্সাম কিন্তু।
–তার ও ঠান্ডা লাগবে,?
–এই যে তার তার করছেন কে সে?
–শ্বশুরের মেয়ে।
–সে কে?
–যার মেয়েকে বিয়ে করেছি।
–কি অদ্ভুত উত্তর তার।হাত ধরে টেনে এনে উনার গায়ের পানি ঝেড়ে দিতে শুরু করলাম।উনি অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে।
–আমি ভ্রু নাচিয়ে বললাম কি?
–এত বৃষ্টির মাঝেও আমার মন মেঘলা গুমট কেনো বলতে পারো দিয়া।
–কেনো গুমট বিহান ভাই।কফিটা কি ভালো হয় নি?আমি অনেক যত্ন করেই বানিয়েছি আপনার জন্য।
–এই কফি ছিলো আমার লাইফে খাওয়া বেষ্ট কফি।উনি আমার হাত ধরে বললেন এই হাতের ছোয়া যে কফিতে সে কফি কি কখনো খারাপ হতে পারে?এটার টেস্ট বেষ্ট ছিলো।অতি আনন্দ আর লাজুকতায় মৌন রইলাম আমি।
–উনি আমার দিকে তাকিয়ে আবার ও বললেন,মিনারের একটা গান মনে পড়লো শুনবে?আমি কখনো গান গাইতে পারিনা।তবে তুমি শুনলে এক কলি শুনাতে পারি।
আমি বেশ অবাক হলাম এই মানুষ টা গান ও গাইতে পারেন।আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উনি বুঝে গেলেন উনার গান শুনতে আমি কত বেশী আগ্রহী।
হাতের মুঠোয় পানি নিয়ে আমার মুখে ছিটিয়ে দিয়ে গান শুরু করলেন,
“তোর কাছে যেতে চাই হৃদয় মানে না বারণ
বৃষ্টির শহরে মেঘলা আমার এ মন
তুই কি আমার মতো ভাবিস আমায়
ভালবাসা খুজে নিস জলের ছোয়ায়।
তোকে ছাড়া হয়নাতো কোনো উৎসব
তুইতো আমার সব।”
গান শেষ করে বললেন,’এই গানের মানে যদি তুমি খুজতে চাও তাহলে অনেক কিছু পেয়ে যাবে।বলেই উনি রুমের ভেতরে চলে এলেন আমার গালে আদরের সাথে হাত ছুইয়ে।’
যদি বলি খুব অবাক হয়েছি তাহলে বিরাট বড় ভুল হবে।আমি ভীষণ অবাক হয়েছি।মানুষ টা নতুন নতুন ভাবে আমাকে উনার প্রতি মুগ্ধ করতে পারেন কিভাবে।এই ট্যালেন্ট টা এই পৃথিবীতে উনি ছাড়া আর কারোর ই নেই।
–যাওয়ার সময় কফির মগ আমার হাতে দিয়ে গেলেন উনি।উনার কফির মগ আমার হাতে।এতটা তৃপ্তি করে উনি কফি খেয়েছেন কফি কি সত্যি এতটা সুন্দর হয়েছিলো।এক চুমুক কফি অবশিষ্ট ছিলো।আমি উনার ওষ্ট স্পর্শ করা জায়গা মুখ দিয়ে কফি অবশিষ্ট কফিটুকু নিজের মুখে নিতেই মুখ থেকে কফি ছুড়ে ফেলি।এতটা লবন,এত বাজে ভাবে লবন হয়েছে এই কফিতে।এই লবনাক্ত কফি উনি কিভাবে খেলেন।এটা তো মুখেও দেওয়া যাচ্ছে না।উনি এতটা বাজে খাবার তো সহ্য করার মতো মানুষ উনি নন।উনি এই অতিরিক্ত লবনযুক্ত কফি কিভাবে খেলেন।তাও আবার বললেন,এটা বেষ্ট ছিলো।
আমি দ্রুত রান্না ঘরে গিয়ে দেখি লবনের কৌটায় চিনির মুখ লাগানো।নিশ্চয়ই বিভোর ভাই উল্টা পালটা করেছেন।
–রুমের ভেতরে গিয়ে দেখি বিহান ভাই গায়ের আধভেজা কাপড় চেঞ্জ করে নিয়ে ফোন স্ক্রল করছেন।আমি উনার কাছে গিয়ে বললাম আত্মীয় আসবে কিভাবে এই বৃষ্টিতে।
–ওরা আসবে না,বলে দিয়েছে।এই বৃষ্টিতে ওরা আসতে পারবে না।
–তাহলে এই খাবার এর কি হবে?
–কি আর হবে নিজেরা খেতে হবে।
–কফি কি সত্যি ভাল ছিলো।
–হুম অনেক সুন্দর ছিলো।
–এত চিনি ছিলো কিভাবে খেলেন।
–ইচ্ছা করে চিনি দিয়েছিলে বুঝি।
–এম্মা না না,বুঝি নি চিনি নাকি লবন ছিলো।
–আমি জানি তুমি বুঝতে পারো নি,তাইতো কিছু বলিনি।তবে তোমার এত যত্নে বানানো কফি সত্যি অসাধারণ ছিলো দিয়া।যদি বলতাম লবন ছিলো মন খারাপ করতে।তাই খেয়ে নিয়েছি।
–আমি খুব অবাকের সাথেই উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।উনি ফোন স্ক্রল করেই যাচ্ছেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, খেয়ে সুয়ে পড়ো, হ্যাঁ কাপর চেঞ্জ করে নাও।আমার এসাইনমেন্ট করতে হবে।