ঘড়িতে রাত বাজে ঠিক ঠিক ৩ টা।বিছানায় রাত জাগা পাখির মতো সুয়ে এপাস, ওপাস করছি শুধু।ধরণির বুকে ঘুমিয়ে পড়েছে মানুষ সহ সমস্ত প্রাণ থাকা জীব।আকাশে চলছে সাদা মেঘের খেলা,মনে হচ্ছে আকাশ নেমে এসেছে খানিক টা নিচে পৃথিবীর বেশ খানিক টা কাছাকাছি।ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ তার ক্ষয় হওয়া অর্ধরূপে আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে।চাঁদের এই আলোকে পৃথিবীর বুকের টর্চের আলো মনে হয় আমার।রাতজাগা পথিকের পথ চলার সঙ্গী এই চাঁদ।পৃথিবীর সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম নেই আমার দু’চোখে।শুনেছি মেয়েরা বিয়ের আগে আনন্দে ঘুমোতে পারে না।আমার ক্ষেত্রে ব্যাপার টা সম্পূর্ণ উলটা হলো।আমার ও ঘুম হচ্ছে না তবে সেটা আনন্দে নয় অতি কষ্টে।আসলে মানুষ যখন যা চায় তখন তা পায় না।
অতীতের কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে আজ, ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে।যখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন প্রথমবার কিশোরী মনে জেগেছিলো আমার শিহরণ,শরীরে এসেছিলো কারো ছোঁয়াতে অদ্ভুত কম্পণ,যে কম্পণ শরীরের রন্ধে রন্ধে ছড়িয়েছে অন্যরকম অনুভূতি।
‘সেদিন বাচ্চাদের মতো বিহান ভাই কে বলেছিলাম আপনি আমাকে স্পর্শ করলে কেমন যেনো অদ্ভুত লাগে আমার।’
‘উনি অবাক হয়ে আমাকে বলেছিলেন, এটা কেমন কথা কেমন লাগে দিয়া।উনার চোখে মুখে ছিলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন।?’
‘আমি বাচ্চাদের মতো অসহায় নির্বিকার তাকিয়ে ছিলাম উনার দিকে।’
‘উনি আবার ও বলেছিলেন কি দেখছিস এইভাবে তাকিয়ে।কি হয়েছে তোর।তোর চোখে মুখে এমন অদ্ভুত পরিবর্তন কেনো?’
‘উনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলেছিলাম জানিনা তো বিহান ভাই।কেনো এমন হয় আমার।?তাই আপনার কাছে শুনতে এসেছি।কেনো আপনি সংস্পর্শে আসলেই আমার এমন হয়।’
‘উনি ভ্রু কুচকে বললেন,কতদিন থেকে এমন হয় তোর দিয়া।সব ছেলে দেখলেই এমন হয় নাকি শুধু আমাকে দেখলেই।’
‘আমি এক কথায় উত্তর দিয়েছিলাম, ইদানিং এমন হচ্ছে বিহান ভাই।আর কোনো ছেলে দেখলেই এমন হয় না।শুধু আপনাকে দেখলেই এমন হয়।’
‘এমন তো হয় কাউকে ভালবাসলে?তুই কি তাহলে আমায় ভালবাসিস দিয়া।’
‘এমন হওয়া কে ভালবাসা বলে বুঝি বিহান ভাই।তাহলে আমি আপনাকে ভালবাসি বিহান ভাই।’
‘উনি চোখ বড় বড় করে বললেন,সিরিয়াসলি?তোর ভয় করছে না দিয়া এতটুকু মেয়ে যে কিনা হামাগুড়ি দেয় এখনো, সে একটা দাঁড়ি- গোফ গজানো ছেলেকে ভালবাসার কথা বলছে।এখন যদি আমি তোকে পানিসমেন্ট দেই তাহলে কি হবে?’
‘আমি চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।’
‘উনি নিজেই ভ্রু নাচিয়ে বললেন, পানিসমেন্ট না চাইলে কান ধরে চোখ অফ করে দশ বার বল, আই লাভ ইউ বিহান ভাই।’
‘সেদিন বাচ্চাদের মতো কান ধরে উনাকে আই লাভ ইউ বলেছিলাম।’
‘উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন ভালবাসা বুঝিস তুই?’
‘আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,হ্যাঁ বুঝি তো,আম্মু,বাবা,ভাইয়া,মামা, মামি সবাইকেই তো ভালবাসি।ভালবাসা বুঝবো না কেনো?’
‘উনি খানিক টা হেসে বললেন,ঠু মাছ পিচ্চি।এক্ষুণি গিয়ে পড়তে বস।না হলে সারাদিন কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবো।ষ্টুপিড কোথাকার।’
সেদিন প্রেম ভালবাসার সঙ্গা আমি বুঝতাম না।বয়সের সাথে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে বিহান ভাই এর এক্সট্রা কেয়ার ধীরে ধীরে উনার প্রতি আমাকে আসক্ত করতে থাকে।যতটা বয়স বেড়েছে আমি বুঝতে পেরেছি আমার পুরো মনের দখল উনি করে নিয়েছেন।ভয়ে আমি কখনো প্রকাশ করতে পারি নি।বান্ধবীরা রিলেশন করে চারদিকে আমার কেনো যেনো মন চাইতো বিহান ভাই আমাকে ভালবাসুক,অন্য নজরে দেখুক,আমাদের যেনো ম্যাজিকের মতো কখনো বিয়ে হয়।কিন্তু ধীরে ধীরে উনি যেনো কেমন চেঞ্জ হলেন।দিন দিন আমাকে বিরক্ত করা শুরু করলেন।এমন ই বিরক্ত উনি আমায় করেন উনাকে দেখলেই দোয়া দুরুদ পড়ি আমি।আমি দিনে দিনে অতিষ্ট হয়েছি উনার প্রতি।আর আজ দাঁড়িয়ে আছি জীবনের সব থেকে বাস্তব সত্যর মুখোমুখি। যে মানুষ কে বিয়ের জন্য পাগল ছিলাম মনে মনে, সেই মানুষ টার সাথে আমার বিয়ে অথচ আজ আমি সেই বিয়ে মেনে নিতে পারছি না।যখন উনাকে চেয়েছি পায় নি অথচ আজ চাইছি না জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।ওই বিরক্ত করা মানুষ টার একটা গুন আছে আমার সব সমস্যা গুলো কখনো মুখে বলা লাগে নি।ঘুরিয়ে পেচিয়ে কোন না কোন ভাবে দূরে থেকে হলেও সাহায্য আর সাপোর্ট দুটোই করেছেন উনি।খুব অবাক লাগছে আজ আমার একটা বিষয় ভেবে যে মানুষ আমার বিয়ের কথা শুনতে পারে না সে আম্মুকে বলেছে আমার বিয়ে করিয়ে দিতে।কি আশ্চর্য তাইনা? ব্যাপার টা।উনি খারাপ ব্যাবহার করলেও জীবনের সব থেকে খারাপ সময়ে উনাকেই পাশে পেয়েছি।আচ্ছা উনার করা ব্যবহার কি সত্যি খারাপ নাকি শুধু মাত্র আমাকে রাগাতেই এমন করেন।তার থেকেও অবাক লাগে আমার এটা ভেবে কতশত মেয়ে উনার সাথে কথা বলতে আগ্রহী উনি সবাইকে ইগনোর করে ঘুরে ঘুরে আমার সাথেই রাগানো কথা বলেন।উনি কি এতটায় ঘৃণা করেণ আমায়?রাত জেগে হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়।উনি আমাকে ঘৃণা করুক আর যায় করুক আই ডোন্ট কেয়ার আমি উনাকে বিয়ে করবো না এটাই ফাইনাল।
ঘুম আসছে না বলে নেটেই ঘোরাঘুরি করছি আমি।অন লাইনে কেউ নেই সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে।চ্যাট লিস্টে এক্টিভ শুধু মাত্র একজন মানুষ সেটা হলো বিহান ভাই।সবুজ বাতি জল জল করছে চোখের সামনে।উনার প্রফাইলে দীর্ঘ পাঁচ বছরে একটা গুগল থেকে ডাউনলোড করা হার্টের পিকচার।গত পাঁচ বছরে চেঞ্জ করেন নি এই প্রফাইল।আইডি তে নিজের কোনো ছবি ও নেই।কভারে একটা থার্মোমিটার এর পিকচার।কার্ডিওলজি নিয়ে লেখাপড়া করেণ উনি।রাত জেগে লেখাপড়া করেন উনি ঘুম যা দিনেই ঘুমোন।ফ্রেন্ড লিস্টে হাতে গোনা কয়েকজন আছে উনার।কোনো পাব্লিক গ্রুপে এড হন না,কোনো পেজে ফলো দেন না,কেউ ইনভাইট দিলেই ব্লক করেন।ফেসবুকে অন্য কোনো একটা আইডি দিয়ে যেনো নিউজ দেখেন।উনাকে হোয়াটস এপ এ ছাড়া পাওয়া যায় না।পরীক্ষার সময় তো কারো সাথে কথায় বলেন না।তার উপর ফ্রিল্যান্সার উনি।
উনাকে এক্টিভ দেখে নক দিবো ভেবে ভেবে কিভাবে দিবো ভেবে পাচ্ছি না।
অতঃপর উনাকে মেসেজ দিলাম,আছেন?
উনি সিন করলেন না।মেসেজ টা আনসেন্ড করে আবার মেসেজ দিলাম,আপনার সাথে কথা আছে দ্রুত রিপ্লাই দিন।
তবুও সিন করলেন না।আবার আনসেন্ড করে দিলাম।ইগো তে লাগছে আমার।আবার মেসেজ দিলাম,গফ নিয়ে বিজি আছেন নাকি?
তবুও সিন করলেন না।আবার আনসেন্ড করে দিলাম।এবার মেসেঞ্জারে কল দিয়ে দেখলাম এনাদার কল।এত রাতে নিশ্চয়ই উনি গফ নিয়ে বিজি আছেন।সব মেসেজ আনসেন্ড করে দিলাম।আমার মেসেজের উত্তর নেই অথচ গফ নিয়ে বিজি।আমি কি এতই সস্তা হয়েছি।
–এতক্ষণে উনার আইডি থেকে মেসেজ এসছে তবুও লাল লাল টমেটো মানে এংরি রিয়্যাক্ট। এংরি রিয়্যাক্ট এর পর মেসেজ দিয়েছেন এত রাতে কল দিচ্ছিস কেনো?মেসেজ দিয়ে আনসেন্ড করে লাভ কি? আমি যদি সব দেখতেই পেয়ে যায় তাহলে আনসেন্ড করে ফয়দা আছে কোনো।কি কথা আছে দ্রুত বল আমি বিজি আছি।
–শ্বশুরের মেয়ে নিয়ে বিজি আছেন তাইনা?এত রাতে এনাদার কল।
–মধ্য রাতে ফাউল কথা বলতে মেসেজ দিয়েছিস।আমার এত সময় নেই তোর আজাইরা কথা শোনার মতো।কি কথা আছে বল। অল রেডি চার মিনিট সময় নষ্ট হয়েছে।
–আমার সাথে দেখা করেন?যা বলার সরাসরি বলতে চাই।
–.কাল সকাল সাড়ে পাঁচ টায় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াবি,আমি হাঁটতে বেরোবো তখন দেখা হবে।
আনসেন্ড করা মেসেজ কি লিখছিলি গফ নিয়ে বিজি।হ্যাঁ মহারাণী মাত্র ই আমাকে নক দিয়েছেন রণচন্ডী মুডে।কপাল ভালো আমার কাছে নেই সে এখন,থাকলে ওর খবর ছিলো আজ।বলেই ফোন টা কেটে দিয়ে একটা স্ক্রিনশট দিলেন।টাইমের জায়গা কালার করে দিয়েছেন।প্রুভ হিসাবে দিয়েছেন একজন বিদেশী ক্লাইন্ট এর সাথে কলে আছেন।
আমাকে প্রুভ দেওয়ার কি আছে অদ্ভুত। কাল দেখা করে সাফ সাফ বলে দিবো আপনার মতো অসভ্য মানুষ কে দিয়া কখনোই বিয়ে করবে না।বিয়ে টা ভেঙে দিয়ে ঢাকায় ফিরে যান।
আবার ও মেসেজ এসছে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি
স্ক্রিনশট এর নিচে লিখে দিয়েছেন,”মধ্যরাতে সে আমাকে ভুল না বুঝলেও পারতো।”
অদ্ভুত উনি কি উনার গফের মেসেজ ভুলে আমাকে দিয়ে দিলেন।কি ঢং এর প্রেম ভাবা যায়।