এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা – সিজন ২ | পর্ব – ৯

এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা - সিজন ২

–ঘড়িতে সময় বিকাল চার টা।শীতকালের বিকাল চারটা মানেই সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে গিয়েছে,কিছুক্ষণের মাঝেই অস্ত যাবে।সূর্যের তেজহীন কমলা কালারের আভা জানালার মেরুণ কালারের পর্দা ভেদ করে খাট থেকে সোজা গিয়ে ওয়ালে পড়েছে।ওয়ালে লাগানো রঙিন প্রজাপতি গুলো সূর্যের আলোতে ঝলমল করছে বেশ,আমি খানিক টা মুগ্ধ হয়েই সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম।মিনিট দশেক আগেই ঘুম ভেঙেছে আমার। মাত্রই ঘুম থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিন টেবিলের সামনে টুল টেনে বসে চিরুনি দিয়ে চুল ঠিক করছি অতঃপর হাতে পায়ে লোশন লাগানোর জন্য হাতে খানিক টা লোশন ঢেলে নিলাম।হঠাত বাবার কথা আমার কানে এলো।আমার কান অধীর আগ্রহে ও ঘরের দিকে খেয়াল দিয়ে আছে।

‘পাশের রুমে বাবা বলছেন,যতই এভাবে বিয়ে হোক মেয়ের জন্য গহনা তো বানাতে হবে।আমার একটা মাত্র মেয়ে গহনা ছাড়া আমি বিয়ে দিবো না।আম্মু বলছে,এখুনি তো আর তুলে দিচ্ছি না যা আছে গহনা তাতেই হবে।দিয়ার তো সিম্পল কানের৷ দুল,চেইন আর একটা আঙটি আছেই।তবে কিছু শাড়ি কিনতে হবে যতই হোক কালেমা পড়ানো হবে শাড়ি না কিনলে হয় না। বাবা বলছেন,বিহানের জন্য তো কিছু বানাতে হবে।আম্মু বললো,একটা চেইন বানিয়ে এনো যদিও জানি বিহান ওগুলো কখনোই পরবে না,তবে আমার যা দায়িত্ব সেটা আমাদের পালন করতে হবে।

‘ভাইয়া আম্মু আর বাবা কে বলছে আমার একটা কথা ছিলো জানিনা কিভাবে নিবে তোমরা।’

‘বাবা বললেন,কি কথা আবির?’

‘বাবা দিয়া এমনিতেই বিয়ে তে রাজি নয়, এখান শুধু বিয়ে দিয়ে রাখলে দূরত্ব আরো বাড়বে।আমার মনে হয় ওদের বোঝাপড়ার জন্য ওদের কাছাকাছি থাকার প্রয়োজন টা বেশী।যদিও দিয়ার বয়স কম বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয় আবার দিয়ার বয়সী মেয়েদের যে বিয়ে হয় না সেটাও না।ইন্টার লেভেলে মেয়েদের বিয়ে হয় কিন্তু বাবা।’

‘তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো আবির?’

‘বাবা দিয়া এমনিতেও দিনে দুই-একবার মামা বাড়িতে যায়।মাসের অর্ধেক সময় মামা বাড়িতেই কাটায়।তাই ওর জন্য শ্বশুরবাড়িটা খুব একটা অসুবিধার হবে না।তাছাড়া বিহান তো বেশী বাড়িতেই থাকে না।মাসে দুই -একদিন থাকে বাড়িতে।ওদের কাছাকাছি থাকাটা বেশী জরুরী।তাই দিয়াকে বিয়ের পরে বিহানের সাথেই রাখতে হবে।আমার মনে হয় এটাই ঠিক হবে।’

‘তোমার মামাদের সাথে কথা বলে দেখি কি বলে?..’

‘এখন বিহান আসবে আম্মু।আমি বিহান কে বলেছি দিয়ার সাথে একটু আলদা কথা বলে নিয়ে দিয়াকে বোঝাতে।বিয়ে যখন হবেই নিজেদের একটু বোঝাপড়া করে নেওয়ায় ভালো হবে।’

কথাটা শুনেই আবার চমকে গেলাম।কেনো আসবেন উনি? উনি আবার আসবেন।আমি তো মামিকে বলে দিয়েছি যে আমি তার ছেলেকে কোনো কিছুর মূল্য বিয়ে করতে পারবো না।মামি কি তার ছেলেকে আমার কথাটা জানায় নি।উনার তো প্রেজটিজ আর ইগো অনেক বেশী।নিশ্চয়ই আমি রিজেক্ট করেছি শুনে উনার আত্মসম্মানে লাগবে আর আমার সামনে মুখ ও দেখাবেন না।কিন্তু ভাইয়া যে বলছে একটু পরেই বিহান আসবে।উনি কি আসছেন উনাকে রিজেক্ট করেছি সেই বিষয়ে আম্মুর কাছে নালিশ দিতে।একবার আম্মুর কাছে নালিশ দিয়ে আমাকে গুষ্টিসহ মানুষের সামনে মান অপমান করেছেন।এইবার আম্মুকে কিছু বলুক আমিও আম্মুকে সাফ সাফ বলে দিবো প্রয়োজনে পাশের বাসার রিক্সাচালক রফিকের সাথে বিয়ে দাও আমার তাতেও কোনো আপত্তি নেই কিন্তু আম্মুর ওই হৃদয় হীন ভাতিজার সাথে নয়।

বলতেই বলতেই বাড়িতে প্রবেশ করলেন বিহান ভাই।উনি প্রবেশ করতেই আয়রা উনার কোলে দৌড়ে গিয়ে উঠলো।উনি আয়রা কে কোলে নিয়ে আয়রার হাতে পকেট থেকে চকলেট বের করে দিলেন।আয়রা চকলেট পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে বললো,ভাইয়া শুনলাম তোমার আর দিয়াপুর বিয়ে।উনি আয়রার নাক টেনে বললেন,কে বলেছে তোমাকে আয়রা।আমাকে রিয়াপু বলেছে।বিহান ভাই আয়রার কথায় আর কোনো উত্তর করলেন না।এমন সময় মেজ কাকি আর ছোট কাকি বিহান ভাই এর কাছে এগিয়ে গেলেন।উনি মিষ্টি হেসে সবার সাথে কথা বললেন।এমন ভাবে কথা বলছেন যেনো উনার মতো মারাত্মক মিষ্টভাষী ছেলে এ দুনিয়াতে আর একটি ও নেই।শাকিব খানের মতো নিঁখুত অভিনেতা উনি।মানুষ ভাবে এমন লক্ষি ছেলে যেনো ঘরে ঘরে সবার হয়।আসলে উনার আসল চরিত্র তো আর জানে না,জানলে নিশ্চয়ই বলতো না।এরই মাঝে আম্মু ও এগিয়ে গেলো।আম্মুর মুখ রাশভারী দেখে বিহান ভাই বললেন ফুপ্পি আমাকে আবির ডেকেছিলো কোনো সমস্যা হয়েছে?আর তোমার মন খারাপ ফুপ্পি।আম্মু মুখ ভার করেই বললেন,বাবা তুই তো ঢাকায় লেখাপড়া করিস তোর ওখানে কোনো পছন্দ আছে কিনা না জেনেই হুট করেই এমন একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলো ভাই আর ভাবি।তুই মন থেকে দিয়া কে মেনে নিতে পারবি তো।তোর মনের উপর জোর করে হলে দরকার নেই।বিহান ভাই একটু হেসে বললেন,ফুপ্পি কাউকে পছন্দ করবো এমন সময় কি আমার আছে।ঢাকায় যেটুকু সময় থাকি লেখাপড়ার বাইরে তোমাদের মিস করি।তুমি চিন্তা করো না ফুপ্পি আমি জানি আমার কি করা উচিত কোনো দায়িত্বর অবহেলা আমি করবো না।অন্তত আমার জন্য তোমাকে কখনো কষ্ট পেতে হবে না।আম্মু অনেক নিশ্চিন্ত হলো বিহান ভাই এর কথা শুনে।

সবার সাথে কুশল বিনিময় করে আমার রুমে প্রবেশ করলেন গম্ভীর মুডে।আমাকে দেখলেই উনার কি হয়।উনার মুখের হাসি কি আমাকে দেখেই পালিয়ে যায়।আমি হাতে পায়ে লোশন লাগাচ্ছিলাম উনাকে দেখে ওড়না টা ঠিক ঠাক ভাবে গায়ে দিলাম।উনি গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।মাত্রই না দেখলাম হাসি খুশি মিষ্টভাষী ছেলে।এক্ষুণি মুডের কি হলো উনার।বেগুনে লস হয়েছে নাকি উনার।উনার পরণে ব্লু জিন্স,গায়ে সাদা টি-শার্ট, প্যান্টের পকেটে হাত গুজে উগ্র মেজাজে আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন।দরজা থেকে এক দু’পা করে এগোতে লাগলেন আমার দিকে মুখে কোনো কথা নেই।অতি সত্য কথা মাঝে মধ্য উনি রেগে গিয়ে যখন নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে অগ্নি চোখে তাকিয়ে থাকেন উনার ফর্সা গালে এক রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে।

উনাকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম উনাকে পাত্তা না দিয়ে।উনাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতেই,উনি সাথে সাথেই আমার হাত হেচকা টানে নিয়ে ওয়ালের সাথে চেপে ধরে ঝুঁকে দাঁড়ালেন আমার দিকে।ওনার এক হাতে আমার হাত চেপে ধরা অন্য হাত ওয়ালে ঠেকানো।

আমার কাছে বেশ অবাক লাগলো ব্যাপার টা।উনার উপর প্রচন্ড রেগে আছি আমি অথচ উনি নিজেই রাগ দেখাচ্ছেন।আমি একটু ফুঁশে উঠে বললাম ছাড়ুন আগে।ছাড়ুন আমার হাত।

উনি অগ্নি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘তুই নাকি আম্মুকে বলেছিস আমাকে বিয়ে করবি না?’

‘হ্যাঁ বলেছি।’

‘তোর সাহস হলো কিভাবে আম্মুকে একথা বলার।’

‘সব কিছুতে সাহসের কি আছে বিহান ভাই।আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না ব্যাস।আই হোপ বিয়ে টা ভেঙে দিবেন আপনি।’

‘বিয়ে না করার কারণ কি? তোর ক্লাস ফ্রেন্ড সাইমন নাকি দিয়া।’

‘এখনো কারণ জানেন না।আপনি আমাকে পুরো বিয়ের বাড়ির সামনে অসম্মান করেছেন।আপনি আম্মুকে উল্টা পাল্টা বুঝিয়েছেন।এখন কি আমার বিয়ের বয়স।আপনার করা এই অপমান আমি কোনদিন ভুলবো না।তাই আপনাকে বিয়ে করার ও বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার।সাইমন হলেও আপনার কি যায় আসে তাতে।আপনার যে প্রেমিকা আছে তা নিয়ে কি আমি কিছু বলতে গিয়েছি কখনো।’

‘আমার প্রেমিকা নিয়ে তেমন অসুবিধা থাকলে নিশ্চয়ই বলতি।এখানে তো তোর কোনো অসুবিধা নেই।ওনি ওয়ে
আমার ও ইচ্ছা নেই তোকে বিয়ে করার কিন্তু সিসুয়েশন বাধ্য করেছে।কে চায় পেত্নী নিয়ে জীবন কাটাতে।?’

‘চান না যখন বিয়ে ভেঙে দিন।’

‘আমি কি নিজের ইচ্ছায় নিজের উইকেট পতন ঘটাচ্ছি।আম্মুর কথা আমি ফেলতে পারবো না।’

‘আপনি তাহলে বিয়েটা করছেন?’

‘হ্যাঁ করছি।’

‘আপনার না জিএফ আছে?’

‘কে?’

‘আপনার শ্বশুরের মেয়ে।’

‘জিএফ নয় হবু বউ।’

‘আপনার না রিলেশন তার সাথে।’

‘হুম তো।’

‘তাকে রেখে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন।’

‘হুম করবো।’

‘একটা মেয়ে আপনাকে ভালবাসে বিহান ভাই।আপনার কি কোনো দায়িত্ব নেই।’

‘দায়িত্ব আছে, নেই বলেছি কখনো।’

‘তাহলে বিয়ে কেনো?’

‘এত কথা না বলে চুপচাপ বিয়ের জন্য রেডি হয়ে নে দিয়া।আফটার অল বিয়েটা তোর আমাকেই করতে হবে।হবে মানে হবেই।’

‘কারো মন নিয়ে খেলার কোনো অধিকার নেই আপনার।?’

‘মন নিয়ে কখন খেললাম।’

‘একটা মেয়ে আপনাকে ভালবাসে আর আপনি তাকে রেখে পরিবারের জন্য অন্যাত্র বিয়ে করছেন।এটা কি মন নিয়ে খেলা নয়।’

‘ওকে ফাইন দুইটা বিয়ে করবো।হ্যাপি তুই।সতিন নিয়ে ঘর সংসার করার খুব শখ তাইনা মিসেস সরি মিস দিয়া।’

‘যে কয়টা ইচ্ছা করুণ বিয়ে সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই।যাকে ভালবাসেন তাকে কি বলবেন আপনি?’

উনি আমার দিকে ঝুঁকে তো আছেন ক্রমশ উনি আরো খানিক টা এগিয়ে এলেন খুব সাবধনতার সাথে।আমার সাথে স্পর্শ না লাগলেও উনি আমার মুখের এতটা কাছাকাছি চলে এলেন আমার বুকের মাঝে হৃদপিন্ডতা দুরুম দুরুম করছে।ওয়ালে ঠেকানো হাত টা দিয়ে আমার বাম গালে আলতো স্পর্শ করতেই আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো।উনি উনার মুখ নিয়ে আমার কাছে বললেন ফিস ফিস করে,,

‘আই লাভ ইউ’ আই স্টিল লাভ ইউ,আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ,উইল ইউ ম্যারি মি।প্লিজ এক্সেপ্ট মি!’

উনার এমন কথা শুনে চট করেই চোখ খুলে তাকালাম আমি।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।