ফ্লোরেনসিয়া – ২৭

16 Min Read

ভয়াবহ এক হিমেল আতংকের নিষ্ঠুর আলিঙ্গনে বুক কেঁপে ওঠে আর্নির।অসীম,অফুরন্ত বিস্ময় নিয়ে স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও।ওর থেকে কিছুটা দুরে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছে এদুয়ার্দো।যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায় সিয়া।ইনায়া বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে অনিমেষ তাকিয়ে থাকে।চোখের সামনে থাকা পুরুষ দু’জন হুবহু একই রকম দেখতে।একজনকে চিনে ইনায়া,অন্যজনকে চিনে সিয়া।আব্রাহামকে দেখে সিয়া প্রথমে এদুয়ার্দো ভেবে ভুল করেছিলো।কিন্তু ইনায়ার কাছে ছেলেটার নাম আব্রাহাম স্যাভেরিন শুনে ওর মনে তীব্র সংশয় জেগেছিলো।ভেবেছিলো এটাও এদুয়ার্দো শয়তানটার কোনো মায়া।ভয়ংকর ষড়যন্ত্র।মাথার চুল আর চোখের রং বদলে ইনায়ার কাছে নিজেকে আব্রাহাম বলে পরিচয় দিয়েছিলো।কিন্তু ওর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে সহসা একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে এদুয়ার্দো চলে আসে।দাড়ায় মেয়েটার পাশে।মেয়েটা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে।তার দু’পাশে হুবহু একই চেহারার দু’জন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে।

এদুয়ার্দোর গায়ে সাদা রঙের শার্টের উপর অফ-হোয়াইট রঙের ব্লেজার জড়ানো।দু’হাতের কনুই পর্যন্ত ব্লেজারের হাতা গুটিয়ে ছাই রঙা প্যান্টের দু’পকেটে দু’হাত গুঁজে দিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে সে।সম্পূর্ণ মুখে রাজ্যের গাম্ভীর্য।তার এমারেল্ড সবুজ চোখের দৃষ্টি পাশের ছেলেটার দিকে ছিলো।চোখের পলক পড়েনি একবারও।এক ভ্রু উঁচিয়ে লাল টুকটুকে ঠোঁটজোড়া কুঁচকে ফেলে এদুয়ার্দো।

গাঢ় সবুজ রঙের গাউন পরিহিত সুন্দরী মেয়েটার ডান পাশে এদুয়ার্দো আর বামপাশে এদুয়ার্দোর মতই দেখতে অন্য ছেলেটা দাড়িয়ে ছিলো।মেয়েটা একবার ডান দিকে তাকায়।অতঃপর দৃষ্টি সরিয়ে বাম দিকে তাকায়।পরপর দু’বার এমন করে সহসা খিলখিল শব্দে হেঁসে উঠে সে।তার হাসির ঝংকারে ইনায়া সম্বিত ফিরে পায়।সিয়া তখনো স্তব্ধ।আর্নি ওদের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির রেখাটুকু বজায় রেখে বলে,,

-আজও আপনাদের পরিধেয় পোশাক মিলে গেছে।ভাগ্যিস চুল আর চোখের রং ভিন্ন।নতুবা আমি নিজেই দ্বিধায় পড়ে যেতাম।আচ্ছা বলুন তো,প্রায়ই এরকম পোশাক বা পোশাকের রঙ মিলে যাওয়ার ঘটনা কি নেহাতই কাকতালীয়?নাকি আপনাদের দু’জনের পূর্ব পরিকল্পিত?

এদুয়ার্দোর দৃষ্টি সরু হয়ে আসে।কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে।পরিধেয় ব্লেজারটা খুলে সামনের দিকে ছুঁড়ে ফেলে সে।যাতে করে দু’জনের পোশাকে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়।অ্যাভোগ্রেডো ব্লেজারটা দু’হাতে লুফে নেয়।আব্রাহাম বেশ রাগান্বিত হয়।

-ভাম্পায়ারদের ওভারলর্ড বলে কি যা খুশি তাই করবে?এভাবে অপমান করবে?আমি কি ইচ্ছে করে মিলিয়ে পোশাক পরেছি?____আব্রাহাম মনে মনে ভাবে।ভাবতে ভাবতে সে নিজেও তার পরিধেয় ব্লেজারটা খুলে অ্যাভোগ্রেডোর দিকে নিক্ষেপ করে।বেচারা অ্যাভোগ্রেডো থতমত খায়।আব্রাহাম নত মস্তকে সম্মান জানিয়ে বিদ্রুপের স্বরে বলে,,,,

-অনারেবল ওভারলর্ড।আশা করি এবার আপনি নিজের পরিধেয় শার্টটাও খুলে ফেলবেন।একাডেমির মেয়েগুলোকে দেখিয়ে দিবেন নিজের চওড়া বুক,পেশিবহুল দু’হাত আর তুষারশুভ্রের মতো ধবধবে ফর্সা শরীর।সবাই কেমন প্রলুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে।ভাবতেই ছোট ভাই হিসাবে আমার বেশ গর্ববোধ হচ্ছে।আফসোস,এমনিতে আপনার এই তিক্ত গাম্ভীর্য মুখখানার দিকে কোনো মেয়ে ফিরেও তাকায় না।খুবই দুঃখজনক।

নিজের কথা শেষ করে শব্দ করে হতাশার দীর্ঘশ্বাস টেনে নেয় আব্রাহাম।এদুয়ার্দো তার দিকে অগ্নি ঝরা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।দুই ভাইয়ের এই খুনসুটিতে ইজাবেল ভীষণ মজা পায়।এটা নতুন কিছু নয়।এরা একসাথে হলে সবসময়ই একজন আরেকজনের পেছনে লেগে রয়।এদুয়ার্দো নিজের রাগাটুকু সংযত করে নেয়।অতি আদরের ছোট বোন ইজাবেলের সামনে নিজের ক্রোধিত ভয়ংকর সত্তাটাকে দেখাতে চায় না সে।দুষ্টু হাসে আব্রাহাম।অহংকারী মহারাজ বেশ জব্দ হয়েছে আজ।এদুয়ার্দো ইজাবেলকে পাশ কাটিয়ে আব্রাহামের পাশে গিয়ে দাড়ায়।ভীতি জাগানো শীতল কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে বলে,,,,

-মুখ বন্ধ রাখো।কেনো অযথা নিজের গর্দান হারাতে চাইছো?

আব্রাহামের ঠোঁটের ভাঁজের হাসিটুকু দীর্ঘায়িত হয়।এদুয়ার্দোকে জব্দ করতে পেরে মনে মনে ভীষণ আনন্দ পায় সে।ইজাবেল ব্যতিব্যস্ত কন্ঠস্বরে বলে,,,

-অনেক হয়েছে।চলুন এবার।প্রিন্সিপাল অপেক্ষা করছেন।

এদুয়ার্দো সোজা হয়ে দাড়ায়।থমথমে পায়ে এগিয়ে যায় একাডেমির প্রধান ভবনের দিকে।তার পেছন অ্যাভোগ্রেডো।ইজাবেল আব্রাহামকে সাথে নিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করে।এদুয়ার্দো প্রথমে আর্নিকে অতিক্রম করে যায়।সিয়া ইনায়া আর আর্নি যেন অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো।দু’চোখে গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছিলো একটা অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য।সহসা এদুয়ার্দোকে এগিয়ে আসতে দেখে ওরা নিজেদের সম্বিত ফিরে পায়।

ক্রোধের অনলে জ্বলতে শুরু করে সিয়ার দেহের সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রগুলো।রক্তবর্ণ চোখের উজ্জ্বল বাদামী রঙা মনিগুলোতে স্পষ্ট ভয়ংকর চাহনি।ভিতরে ভিতরে দুর্দমনীয় আক্রোশে ফুঁসে উঠে ও।হৃদপিণ্ডে জাগ্রত হওয়া আক্রমণাত্মক সত্তাকে দমিয়ে রাখতে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।শুধু পারেনা হিংস্র সিংহীর ন্যায় এদুয়ার্দোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে।

এদুয়ার্দো কোনো দিকে না তাকিয়ে সগর্বে বুক ফুলিয়ে হাঁটে।সিয়ার কাছাকাছি পৌঁছাতেই তার লাল টুকটুকে ঠোঁটজোড়ায় পৈশাচিক হাসি ছড়িয়ে পড়ে।অথচ তার দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির।চোখে মুখে প্রবল আত্ম অহমিকা প্রকাশ পায়।আশে পাশে থাকা ছেলে মেয়েগুলো একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।কয়েক পল চোখের পল্লব নাড়াতে ভুলে যায়।এদুয়ার্দো চলে যেতেই ছেলে মেয়েগুলো আব্রাহামের দিকে তাকায়।দু’চোখের দৃষ্টিতে ভয়ংকর ঘোর লেগে যায়।যেন এরকম অসম্ভব সুন্দর মানুষ তারা আজই প্রথম দেখছে।

ইনায়ার কাছাকাছি এসে আব্রাহাম থমকে দাড়ায়।পাতলা মসৃন সাদা কাপড়ের নিকাপ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা দু’জন মেয়েকে দেখতে পায়।লালচে-সোনালি চুলের মেয়েটার চোখের দিকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে।মেয়েটা তীব্র ঘৃনায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।ভয়াবহ রাগের বশবর্তী হয়ে তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে থাকে।বামহাতে সিয়ার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরে ক্রোধ সংবরণ করে।ইজাবেল মিষ্টি স্বরে ডাকে,,,

-ভাই।এসো।

আব্রাহাম একপা দু’পা করে এগোয়।হাঁটতে হাঁটতেও ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সে।ইনায়াকে অতিক্রম করে অনেকটা সামনে এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে দেখে।মাথায় লম্বা করে দেওয়া অবগুণ্ঠনের আড়ালে সুদীর্ঘ চুলের পুরু বিনুনি নজরে আসে।আব্রাহাম ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে।মনে মনে বলে,,,,

-তুমি এখানেও এসে গেছো।আমার শিকার তুমি।পালিয়ে যাবে কোথায়?আমাদের দেখা হবে।তোমার মিষ্টি মধুর রক্তের স্বাদ নিতে আমি আসবো।

ইজাবেল,আব্রাহাম আর এদুয়ার্দো প্রিন্সিপালের কামরায় প্রবেশ করে।নিশ্চল,নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে থাকা আর্নি সিয়ার পাশে এসে দাড়ায়।চোখের পানিতে নিকাব ভিজে গেছে ওর।ভয়,যন্ত্রণা আর ঘৃনায় মৃদুমৃদু কাঁপতে শুরু করে।কিছুক্ষণ পর ক্রিসক্রিংগল ফিরে আসেন।আর্নি নিমেষেই সবকিছু কিছু ভুলে গিয়ে উচ্চস্বরে ডাকে,,

-মাস্টার।

সিয়া চমকায়।আর্নির একহাত মুঠোবন্দি করে ধরে ইশারায় কিছু বলতে বারন করে ওকে।ক্রিসক্রিংগল প্রত্ত্যুতর দেন,,,

-হ্যাঁ।বলো।

সিয়া তখনো দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে চুপ থাকতে বলে ওকে।আর্নি কাতর কন্ঠে বলে,,,

-আমি এই একাডেমিতে ভর্তি হতে চাইনা।

বেশ আশ্চর্য হন ক্রিসক্রিংগল।কয়েক পল নিশ্চুপ থেকে রাশভারি কন্ঠে বলেন,,,,

-ভর্তির কার্যক্রম শেষ।আগামীকাল থেকে তোমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে।অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।প্রধান ফটক পর্যন্ত এসো।আমি দেখি কোনো ফিটন খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।

ক্রিসক্রিংগল চলে যান।আর্নি আর ইনায়াকে নিয়ে সিয়া ধীরপায়ে হাঁটে।কিছুক্ষণ আগের দেখা দৃশ্য কল্পনা করে।মেয়েটার নাম ইজাবেল।ওর চোখ আর চুলগুলো কালো রঙের ছিলো।ওষ্ঠদ্বয়ে হালকা গোলাপী রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছিলো।ইনায়ার মনে সংশয় হয়।ও অনুচ্চস্বরে বলে,,,,

-মেয়েটাকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মনে হলো।কিন্তু এই শ’য়তান দু’টোর সাথে ওর কি সম্পর্ক থাকতে পারে?

-মেয়েটা ওদের বোন।সোনালী চুলের পি’শাচটাকে ও ভাই বলে ডেকেছিলো।___সিয়া শান্ত কন্ঠে বলে।

-তুমি কি করতে চাইছো?বাবাকে জানাতে বারণ করছো কেনো?__ইনায়া কৌতুহলী কন্ঠে জানতে চায়।

-এদুয়ার্দো,আব্রাহাম,পিদর্কা স্যাভেরিন,ভিক্টোরিয়া,ক্যারলোয়েন,উড্রো উইলসন,জ্যাসন মিকারলি,অ্যালিশ,ব্রাংকো,স্যান্ড্রি।ওরা দশজন ছিলো।এদের মধ্যে আমি শুধু এদুয়ার্দোকে চিনতাম।তুমি চিনতে আব্রাহামকে।আজ আমরা একসাথে দু’জন শয়তানকে চিনলাম।জানতে পারলাম এরা জমজ শ’য়তান।ঈশ্বর আমাদের এই খারকিভ শহরে কেনো এনেছেন জানো?___সিয়ার সহজ সাবলীল প্রশ্ন।

-এই নিকৃষ্ট রক্তপিপাসুগুলোকে ধ্বংস করতে।___ইনায়ার দৃঢ় কন্ঠ।

-হ্যাঁ।বাবা আমাদের জীবন বাঁচাতে,আমাদের সম্পূর্ন সুরক্ষিত রাখতে কাস্ত্রোরুজ ছেড়ে ইম্যুভিলে পালিয়ে এসেছিলেন।কিন্তু এখানে এসেও আমরা পুনরায় ওদের মুখোমুখি হলাম।ঈশ্বরের এটাই ইচ্ছে।নিয়তির থেকে পালিয়ে বাঁচা অসম্ভব।বাবাকে যদি বলো,তিনি ইম্যুভিল ছেড়ে আমাদের নিয়ে অন্য কোথায় চলে যাবেন।এভাবে কতদিন পালিয়ে বাঁচবো?তুমি কি মৃত্যুকে ভয় পাও?

-না।মৃ’ত্যু স্বল্প সময়ের যন্ত্রণা।বুকের মধ্যে যে অসামান্য যন্ত্রণা বহন করছি তার কাছে মৃ’ত্যু যন্ত্রণা নেহাতই তুচ্ছ।

-হুম।তুমি আর আমি শুধু দুই জনকে চিনি।বাকিদের সম্পর্কে জানার জন্য,তাদেরকে চেনার জন্য আমাদের এই মেয়েটাকে প্রয়োজন।হয়তো ও আমাদের সাহায্য করতে পারে।

-কিন্তু ঝোঁকের বশে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।পরিবারের বাকি সদস্যগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।সেটা এই খারকিভ শহরে থেকে কিভাবে সম্ভব?

– সময় দাও।আমাকে ভাবতে হবে।

আতংকে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় আর্নি।ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দু’জনের দিকে।সিয়ার দুশ্চিন্তা হয় ওকে নিয়ে।ভয়ের আধ্যিক্যে যেকোন সময় ক্রিসক্রিংগলকে সবটা জানিয়ে দিতে পারে।

_________

কিয়েভ,স্যাভেরিন ক্যাসল।

দুর্গের বিশাল হলরুমে কয়েকজন শক্তিশালী ভাম্পায়ারের মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সভা ডাকা হয়।সভা ডেকেছেন পিদর্কা স্যাভরিন।মাঝখানের সোফায় বসে থেকে কারো অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিলেন তিনি।দু’পাশের সোফাগুলোতে বাকিরা বসে ছিলো।বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠে ক্যারলোয়েন।বেশ বিরক্ত হয় সে।ভিক্টোরিয়ার কানের কাছে অনুচ্চস্বরে বলে,,,,

-মনে হয় না সে আসবে।মা অহেতুক আমাদের বসিয়ে রেখেছেন।

-চুপ করো।মা শুনতে পাবেন।এমনিতেই তিনি ভীষণ রেগে আছেন।

অকস্মাৎ সশব্দে দরজা খুলে যায়।ঝড়ের বেগে কামরার ভিতর একটা কালো ধোয়ার কুন্ডলী প্রবেশ করে।ধীরে ধীরে ধোঁয়ার কুন্ডলীটা মানুষের অবয়বে ফিরে।কালো কুচকুচে পোশাক পরিধেয় একজন যুবক পিদর্কা স্যাভেরিনের সামনে গিয়ে দাড়ায়।তার দু’চোখের হালকা নীলাভ মনিগুলো থেকে অসাধারণ দ্যুতি ছড়ায়।মুখের উপর বেঁধে রাখা কালো রঙের ত্রিকোণ কাপড়টা খুলে ফেলে উচ্ছ্বসিত স্বরে ডাকে,,,,

-মা।

-আমার সাহসী ছেলে।

পিদর্কা স্যাভেরিন ত্বরিত দাঁড়িয়ে পড়েন।দু’হাতে নিজের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেন।ছেলেটা কামরায় উপস্থিত থাকা ভাম্পায়ারগুলোকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে।পিদর্কা স্যাভেরিন তাকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসতে বলেন।ছেলেটা বসে।ক্যারলোয়েন আর ভিক্টোরিয়ার চোখে বিস্ময় দেখা যায়।অথচ ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠে।

-খুঁজে পেয়েছো ওদের?____উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন পিদর্কা স্যাভেরিন।

-এখনো না।তবে খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি।খুব শীঘ্রই তোমার কাছে সবাইকে উপস্থিত করবো মা।

-দ্রুত খুঁজে বের করো।

-আমি তখন ছোট ছিলাম।কিছুই মনে নেই।কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে,ক্লারেসিয়াকে আঠারো বছর আগে হত্যা করে তার রক্ত খেয়েছো।তাহলে অহেতুক দুশ্চিন্তা করছো কেনো?

-আমার দুশ্চিন্তা শুধু জাদুর তলোয়ার নিয়ে না।পাথর আর বই নিয়েও।তুমি বুঝবে না।

-আমি সব বুঝি।সব জানি মা।তোমার প্রতিটা পাপের সঙ্গী হয়েছি আমি।আমাকে ছাড়া তুমি শূন্য।কোনো ক্ষমতা নেই তোমার।যদি এদুয়ার্দো তোমার সব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পেরে তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়,তাহলে একমাত্র আমিই তোমার শেষ ভরসা।

ছেলেটার কন্ঠে প্রগাঢ় দম্ভ প্রকাশ পায়।পিদর্কা স্যাভেরিন ধৈর্য ধরে কথাগুলো হজম করে নেন।উড্রো উইলসন হতভম্ব হয়ে দেখে।ভিক্টোরিয়া রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে,,,

-মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?তাছাড়া তুমি কি ভুলে গেছো,তিনি ভাম্পায়ার সাম্রাজ্যের একমাত্র সম্রাজ্ঞী?

-আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না।আমি জানি আমি কার সাথে কথা বলছি।পিদর্কা স্যাভেরিন শুধু আমার মা না।তার আরও দু’জন সন্তান আছে।তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলে আমার সাথে কেনো করবে না?___ছেলেটার কন্ঠে বিদ্রুপের রেশ।

-থামো তোমরা।____বিরক্ত কন্ঠে ধমকে উঠেন পিদর্কা স্যাভেরিন।

-তোমার মেয়েকে থামাও।যখন আমি আর তুমি কথা বলবো,তখন আমাদের মাঝখানে আর কেউ যেন কথা না বলে।তাছাড়া আমি ভুলে যায়নি,তোমরা আমাকে কতগুলো বছর কফিনে বন্দি করে রেখেছিলে।

-যা করেছি,সবকিছু তোমার ভালোর জন্য।নতুবা কবেই তোমার দ্বিখন্ডিত দেহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যেতো।শুধুমাত্র তোমার জন্য প্রতিনিয়ত শতশত সুন্দরী যুবতী নিয়ে এসেছি এই স্যাভেরিন ক্যাসলে।তুমি বেসমেন্টের গুপ্ত কামরায় বসে রক্তের হলি খেলেছো।এতো ঝুঁকি নিয়ে আমি এসব তোমার জন্য করেছি।তবুও আমাকে অবিশ্বাস করছো?

ছেলেটা উচ্চশব্দে হাসতে শুরু করে।ঠোঁটের ফাঁকে হাসিটুকু বজায় রেখে বলে,,,

-শুধুমাত্র আমার জন্য?

-এ ব্যাপারে তোমার কোনো সন্দেহ আছে?____ভ্রু-কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করেন পিদর্কা স্যাভেরিন।

-শোনো।এদুয়ার্দো তোমাকে ঠিক যতটা বিশ্বাস করে।আমি তোমাকে ঠিক ততটাই অবিশ্বাস করি।ও তোমার বলা প্রতিটা শব্দকে ধ্রুব সত্য বলে মানে।অথচ আমি জানি তোমার আদি-অন্ত সবটাই মিথ্যে।আমাকে সাত পাঁচ বোঝানোর চেষ্টা করো না।ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সব সুন্দরী যুবতী মেয়েদের অপহরণ করে এনে তুমি নিজের প্রয়োজন মিটিয়েছ।একদিকে এদুয়ার্দোর কাছে সৎ হওয়ার নাটক করে ওকে সততার উক্তি শুনিয়েছো,অন্যদিকে আমাকে ভয়ংকর পি’শাচ বানিয়েছো।আমি যদি বলতে শুরু করি,তোমার সব রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে।

তাছাড়া তোমার আরেকজন সন্তানের কথা না হয় না-ই বললাম।ওকেও ব্যবহার করছো নিজের স্বার্থে।ভীষণ সরল ও।ওকেও ছাড় দিলে না!আচ্ছা তুমি কি সত্যিই আমাদের মা?

-ব্যস।থামো।অনেক বলেছো।আর কিছু শুনতে চাইনা।কামরা খালি করো এখুনি।বেরিয়ে যাও সবাই।

ছেলেটা পুনরায় শব্দ করে হাসে।পিদর্কা স্যাভেরিনকে রাগাতে পেরে বেশ আনন্দ বোধ করে সে।আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে মনে।

একে একে কামরা খালি করে বাইরে বেরিয়ে যায় সবাই।ছেলেটা বসে থাকে।অনুচ্চ স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে,,,,

-আমি সত্যিই একজন ভয়ংকর পি’শাচ।যে কিনা ক্ষমতার জন্য ভাইকেও হত্যা করতে পারে।আমার হৃদয়ে বিন্দুমাত্র মায়া দয়া নেই।পুরোপুরি তোমার স্বভাবের।একারণেই আমাকে ভীষণ ভয় পাও তুমি।তোমার থেকেও বেশি ভয় পায় তোমার মেয়েগুলো।

-তোমাকেও বের হয়ে যেতে বলেছি।ভয় পাইনা আমি।যার মৃ’ত্যু ভয় নেই,তার অন্য কিসের ভয় থাকতে পারে?আমি অমর।আমাকে বিনাশ করার জন্য যে দু’জন জন্মগ্রহন করেছিলো,তাদের একজনকে পি’শাচ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছি।অন্যজনকে খাদ্য হিসাবে গ্রহন করেছি।স্বর্গে চলে গেছে ও।

ছেলেটা হাসে।অট্টহাসিতে মেতে উঠে সে।হাসতে হাসতেই ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়।পিদর্কা স্যাভেরিনের গলা শুকিয়ে আসে।টেবিল থেকে রক্তের গ্লাস তুলে নিয়ে ঢকঢক করে রক্ত পান করে শুকিয়ে যাওয়া গলা ভিজিয়ে নেয়।

_____

ইম্যুভিল।

গভীর রাত।চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার।কামরার এক কোনায় একটি ছোট মোমবাতি জ্বলছিলো।সিয়ার চোখে ঘুম নেই।উৎকর্ণ কানে সজাগ থাকে ও।হঠাৎ বাইরে থেকে অদ্ভুত কিছু শব্দ শুনতে পায়।মৃদু আওয়াজে কেউ ফিসফিসিয়ে ডাকে,,,

-ফ্লোরেনসিয়া।এসো,,,এসো আমার কাছে।

সিয়া ভয় পায়।সেই লম্বা চুলের অদ্ভুত মেয়েটা নয়তো!সিয়া মনে মনে ভাবে।বিশালাকৃতির সবুজ অ্যানাকন্ডাটার কথা মনে পড়তেই ওর গাঁ শিউরে উঠে।ভয়াবহ গলা শুকিয়ে যায়।শোয়া থেকে উঠে বসে।বিছানার কাছে থাকা টি-টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নেয়।এক নিশ্বাসে গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে ও।বাইরে থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বরটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে।গত দু’রাতে এই কন্ঠস্বর যতবার শুনতে পেয়েছিলো,ইনায়াকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিলো ও।কিন্তু অদ্ভুতভাবে কন্ঠস্বরটা সিয়া শুনতে পেলেও ইনায়া শুনতে পায়নি একবারও।এই অদ্ভুত শব্দগুলো আর মেয়েটার কন্ঠস্বর সিয়া ব্যতীত অন্যকেউ শুনতে পায়না।সিয়া বুঝতে পারে না,ওর সাথে কি হচ্ছে এগুলো?

-ফ্লোরেনসিয়া।আমি তোমাকে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছে দিবো।আমাকে ভয় পেয়ো না।

-ভাম্পায়ারদের তবুও শরীর থাকে।কিন্তু এই মেয়েটা যদি অশরীরী হয়।আমি তার সাথে কিভাবে লড়বো?___সিয়া অস্ফুট স্বরে বলে।

দরজার বাইরে থেকে খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যায়।মেয়েটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,,,,

-তুমি ভীতু।ভীষণ ভিতু একটা মেয়ে।তোমার দ্বারা কিছুই হবে না।
পারবে না তুমি রক্তপিপাসুগুলোকে বিনাশ করতে।

মেয়েটা সিয়াকে রাগাতে চায়।একসময় সফল হয় সে।প্রচন্ড রাগের বশবর্তী হয়ে বিছানা থেকে নেমে দাড়ায় সিয়া।আলমারি খুলে হাতে তলোয়ার তুলে নেয়।দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজা খুলে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়।ভয়াল অন্ধকার চারপাশে।হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে ধবধবে সাদা আলো ছড়িয়ে পড়ে।বেশ খানিকটা দুরে সাদা রঙের বড় ঘোড়ার মতো একটা জন্তু দেখতে পায় ও।ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সিয়া।জন্তুটা আলোর গতিতে ওর সামনে এসে দাড়ায়।নিমেষেই চারপাশটা দিনের মতো ঝলমল করে উঠে।সিয়া ঘোড়াটার কপালের মাঝখানে লম্বা প্যাঁচানো একটা শিং দেখতে পায়।ও বিস্মিত কন্ঠে ডাকে,,

-ইউনিকর্ন।

ইউনিকর্নটা ওকে চুম্বকের মতো টানে।নিজের অজ্ঞাতেই সিয়া এক পা দু’পা করে এগোয়।হাত রাখে ইউনিকর্নের পিঠে।ওর হাতের স্পর্শ পেয়ে অকস্মাৎ উধাও হয়ে যায় ওটা।চারপাশ আবারও নিকষকালো অন্ধকার হয়ে উঠে।সিয়ার পিলে চমকে যায়।অদুরে ইউনিকর্নটাকে পুনরায় দেখতে পায়।ও কেমন অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়।ক্ষনকাল সময় গড়ায়।হঠাৎই নিজের সম্বিত ফিরে পায় সিয়া।এখনো একহাতে শক্ত করে তলোয়ার ধরে আছে।কিন্তু চারদিকে ভয়াবহ অন্ধকার।কোথায় আছে বুঝতে পারে না ও।তীব্র শীত আর অজানা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করে।

আচম্বিতে চোখের সামনে দপ করে আগুন জ্বলে উঠে।সিয়ার থেকে বেশ কিছুটা দুরে উল্টো ঘুরে দাড়িয়ে আছে কেউ।সিয়া শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে তাকে,,,

-কে?কে ওখানে?

পেছন ঘুরে দাড়ায় একজন সবল সুগঠিত দেহের যুবক।অন্ধকারে তার চোখ দু’টো জ্বলন্ত অগ্নিবিন্দুর ন্যায় জ্বলজ্বল করে উঠে।সে থমথমে ভরাট কন্ঠে বলে,,,,,

-“ফ্লোরেনসিয়া” আমার শহরে তোমাকে স্বাগতম।

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।