শতাব্দী প্রাচীন পাথুরে গুহা। চারদিকে দানবীয় গাছ আর ঘন ঝোপঝাড়ে ঘেরা। গাছের সবুজ পাতার আড়ালেও যেন উৎ পেতে আছে ভয়াবহ বিপদ। অদুরে ভীতি জাগানো কন্ঠে ডেকে উঠে হুতুম পেঁচা। কি ভয়ংকর সেই ডাক। শরীরের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে যায়। কখনো স্নিগ্ধ ভোরের শিশির ভেঁজা ঘাসে, কখনো বা শৈবাল জমে যাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে পিচ্চিল পথে দু’জনে পা চালিয়ে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে একটা ঝিরির কাছে পৌঁছে যায়। পায়ের নিচে ছোট ছোট ধারালো পাথরের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। প্রবাহিত পানির কলকল শব্দ ক্রিসক্রিংগল উৎকর্ণ কানে শোনেন। মার্কস ভীত-সন্ত্রস্ত। ভীষণ গলা শুকিয়ে আসে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শঙ্কিত কন্ঠে বলে,,
– ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি। একটু পানি পাওয়া যাবে?
দু’জনের চোখের উপর পুরু কালো কাপড় বেঁধে দিয়েছে ওরা। হাতগুলোও পেছনে শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা। দু’পাশ থেকে দু’জন করে চারজন লোক মার্কস এবং ক্রিসক্রিংগলকে একপ্রকার টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো কোথাও। হাত আর চোখ বাঁধা থাকায় ক্রিসক্রিংগলের শ্রবণেন্দ্রিয় হয়ে উঠেছিলো অত্যাধিক প্রখর। এই ঝিরি পর্যন্ত পৌঁছাতে পা গুনে গুনে এসেছেন। কখন কোন দিকে মোড় নিয়েছেন সবটা খেয়াল রেখেছেন। যদিও তার অবচেতন মন বলছে এই লোকগুলোর মাস্টার মার্টিন লরেন্স। তবুও তিনি সাবধানতা অবলম্বন করেন।
– উপরের দিকে মুখ তুলে হা করো। ____মার্কসের উদ্দেশ্যে একজন কঠিন গলায় কথাটা বলে।
– মানে?______মার্কসের কন্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ে।
– তোমার হাত খোলা যাবে না। মুখ খুলো, পানি খাওয়াচ্ছি।
– অন্তত আমার চোখ দু’টো খুলে দিন। না দেখে কিছু খাবো না। বিশ্বাস নেই। পানির সাথে যদি বিষ মিশিয়ে খাওয়ান?
বিরক্ত হয় লোকটা। কোনো কথা না বলে আবারও টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে। ব্যথিত হয় মার্কস। এতোটা নিষ্ঠুর এরা! মৃ’ত্যু পথযাত্রীকে একটু পানি পর্যন্ত খাওয়ায় না। গলার সাথে সাথে যেন কলিজাটাও শুকিয়ে যায়। শরীর অবশ হয়ে আসে ভয়ে।
– আর কতদুর পর্যন্ত হাঁটতে হবে?___মার্কস অকপটে জিজ্ঞেস করে।
কেউ তার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর দেয় না। অধৈর্য হয়ে উঠে মার্কস। বিরক্তবোধ করে। কপট রাগ মেশানো কন্ঠে উচ্চস্বরে বলে,,,
– কেউ আমাকে বলছে না কেনো, আর কতটুকু রাস্তা অতিক্রম করতে হবে?
– মুখ বন্ধ রাখো। নতুবা কথা বলার জন্য জিব থাকবে না।
শুকনো ঢোক গিলে মার্কস। কি ভয়ানক কন্ঠ! হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠে। এরা এতো নিষ্ঠুর, না জানি এদের মাস্টার কতটা নির্দয় হবে।
ক্রিসক্রিংগল সম্পূর্ণ রাস্তা নিশ্চুপ নির্বাক হয়ে ছিলেন। কান পেতে সব শোনেন। এরা আর যাই করুক, প্রাণনাশ করবে না। নিজেদের মাস্টারের আদেশ অমান্য করবে না। ক্রিসক্রিংগল মনে মনে ভাবেন। কলকল শব্দে পানি প্রবাহিত হওয়া ঝিরিটা বেশ অনেকক্ষণ আগেই পেরিয়ে গেছেন। পুনরায় হাঁটতে শুরু করেন।
—-
দীর্ঘ পথযাত্রা শেষ করে বিশালাকৃতির একটি পাথুরে গুহার সামনে এসে দাড়ায় ওরা। প্রাসকোভিয়ার উত্তরে অবস্থিত সবগুলো গুহার মধ্যে যেটা ছিলো সবচেয়ে বৃহত্তম। সুউচ্চ গুহাটার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের শেষ ছিলো না যেন। মনে হয় এর আয়তন হারিয়ে গেছে জঙ্গলের গহীন থেকে আরও গহীনে। বীভৎস, বিশাল কোনো এক দৈত্যের মুখ হা করে রাখার মতো দরজার সামনে কালো কুচকুচে পোশাকধারী কিছু লোক দাঁড়িয়ে ছিলো। সবাই কেমন প্রস্তর মূর্তির মতো দেখতে। শক্ত পাথুরে বিবর্ণ দেয়ালগুলো শৈবাল জমে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেছে। গুহাটা যেন পাহাড়ের অভ্যন্তরে। চারদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কেমন গা ছমছমে ভাব। এতোক্ষণ নিশ্চুপ থাকা মার্কস কথা বলার জন্য উসখুস করতে শুরু করে। পেটে জমিয়ে রাখা শব্দগুলো বাক্য রুপে বাইরে না বের করে দিতে পারলে বদ হজম হয়ে মারা যাবে। নাহ। কথা না বলে আর কতক্ষণ নিশ্চুপ থাকা যায়? মার্কসের পেট গুড়গুড় করে। ম’রার আগে, অন্তত শান্তিতে কিছু কথা বলে যেতে চায়। কিন্তু আফসোস!! শেষ বারের মতো পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য হবে না আর।
– আমরা কি পৌঁছে গেছি যমালয়ে?___ জিজ্ঞেস করে মার্কস।
মৃ’ত্যুদন্ড প্রাপ্ত অপরাধীর মতো দু’জনকে আবারও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দু’দিক থেকে দু’জন ব্যক্তি দু’হাত ধরতেই মার্কসের দুরুদুরু বুক কাঁপতে শুরু করে। ক্রিসক্রিংগল কিঞ্চিত বিরক্ত বোধ করেন। সাবধানে পা ফেলে হাঁটেন। মার্কস ঘনঘন নিঃশ্বাস নেয়। কাতর কন্ঠে বলে,,
– এতক্ষণ যাবৎ চোখ বেঁধে রাখলে আমি নির্ঘাত অন্ধ হয়ে যাবো। আমার চোখ দু’টো খুলে দাও ভাই। যেতে দাও আমাদের। আমার সাথে খারাপ কিছু হয়ে গেলে, আমার বউ বাচ্চাগুলো অনাহারে মা’রা যাবে। শশুরমশাই আপনি কিছু বলুন। কেনো নিশ্চুপ হয়ে আছেন?
– তোমরা দু’জন শশুর জামাতা?______একজন বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে তাকে। ক্রিসক্রিংগল হতবাক। জীবনে এতটা আশ্চর্য আজকের আগে কোনোদিনও হয়েছিলেন কিনা, মনে পড়ে না তার।
– হ্যাঁ, উনার একমাত্র মেয়ের একমাত্র অর্ধাঙ্গ আমি। আমাদের চারটে বাচ্চা। ওরা সবাই আমার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় আছে।
– শশুর জামাতা? অসম্ভব, এই বোকার হদ্দ আমার জামাতা হতে পারে না। ___ক্রিসক্রিংগল মনে মনে ভাবেন। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
গুহার দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকা কালো পোশাকধারী লোকগুলোকে পেরিয়ে ওরা ভিতরে প্রবেশ করে। গুহাটা তৈরী হয়েছে পাথর আর স্ট্যালাগমাইট প্রাকৃতিক স্থাপত্যে। বেশ কয়েকটা সুরঙ্গ এই গুহাটাকে যুক্ত করেছে আরও কয়েকটি গুহার সঙ্গে। যেন একটা গোলক ধাঁধার মতো। প্যারানরমাল গুহা মনে হয়। সুরঙ্গ একের পর এক বাঁক নেয়। যদিও চোখ দু’টো বেঁধে রাখা ছিলো, তবুও টানা হ্যাঁচড়ায় মার্কসের মাথা ঘুরতে শুরু করে। এ কোথায় এসে পড়লো? কেনো যে প্রাসকোভিয়ায় ঘুরতে এসেছিলো। ভীষণ আফসোস হয়। এতো আফসোস রাখার জায়গা কোথায়?
হাঁটতে হাঁটতে লোকগুলো সবাই একটা কামরার সামনে এসে দাড়ায়। ক্রিসক্রিংগল এবং মার্কসের হাত ছেড়ে দেয়। একজন লোক কামরায় প্রবেশ করে। দু’হাটু মুড়ে ত্বরিত বসে পড়ে। মেঝেতে মাথা ঠেকায়। অতঃপর মাথা তুলে মুষ্টিবদ্ধ বামহাতের উপর ডান হাত রেখে দৃঢ় গলায় বলে,,,
– মহামান্য মাস্টার। উনাকে নিয়ে এসেছি। সাথে আরও একজন ছেলে।
– ভিতরে নিয়ে এসো।
আদেশ পেয়ে লোকটা বাইরে বেরিয়ে যায়। দু’জনকে সাথে নিয়ে পুনরায় কামরায় ফিরে আসে। শ্রদ্ধাভরে সম্মান জানিয়ে ডাকে,,,
– মাস্টার।
– ওদের চোখের বাঁধন খুলে দাও।___ ভারী ও নিম্ন স্বরযুক্ত গলায় লোকটা বলে।
ক্রিসক্রিংগলের চিত্ত পুলকিত হয়। এই কন্ঠস্বর তিনি চিনেন। ভীষণ পরিচিত। দু’জনের চোখের উপর থেকে কালো কাপড়ের বাঁধন খুলে দেয়। প্রথমেই চোখ মেলে তাকায় মার্কস। কিন্তু দৃষ্টির সম্মুখে সবকিছু অস্পষ্ট দেখতে পায়। কয়েকপল সময় গড়ায়। স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ক্রিসক্রিংগল আর মার্কস।
নিখুঁত শরীরী সৌন্দর্য্যের অধিকারী ছ’ফুট উচ্চতার একজন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সাদা রঙের কিমোনো পরিধেয় বলশালী দেহে রাজকীয় আভিজাত্য নজরে আসে। যেন কোনো রাজা দাঁড়িয়ে আছে দু’চোখের সামনে। কি সুন্দর দেখতে! কোনো পুরুষের চোখে অন্য এক পুরুষ মানুষ এতোটা সুন্দর দেখাতে পারে? মার্কস ভাবে। যেন ওর চোখ ঝলসে যাবে। ক্রিসক্রিংগলের কন্ঠস্বর অবরোধ হয়ে আসে। কন্ঠনালী থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না। কথা বলতে ভুলে যান। লোকটা নির্জীব চোখে দেখেন। তার থমথমে মুখখানা বেশ আকর্ষণীয় লাগে।
– রবার্ট ক্রিসক্রিংগল।___ লোকটা শান্ত গলায় ডাকেন। ক্রিসক্রিংগল সম্বিত ফিরে পান। অনুচ্চস্বরে বলেন,,,
– মার্টিন লরেন্স!!
মার্টিনের মাঝে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া নেই। তিনি অকপটে জিজ্ঞেস করেন,,,,
– এখানে কেনো এসেছ? তুমি কি জানতে না, আমার খোঁজে যারা আসে তারা জীবিত ফিরে যেতে পারে না?
– আমার জীবনের চেয়েও তোমার সাথে দেখা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।___ক্রিসক্রিংগল দৃঢ় গলায় বলেন।
মার্টিন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। তার এই নিষ্প্রাণ চোখের চাহনি হুবহু মিলে যায় ক্রিসক্রিংগলের খুব কাছের একজনের সাথে। হৃদয় মুষড়ে পড়ে। যেন পায়ের নিচের মাটি নড়েচড়ে উঠে। তিনি নিজের মনকে পাথরের মতো শক্ত করেন। ভারী দীর্ঘশ্বাস টেনে নেন। শান্ত গলায় বলেন,,,,
– আমি কখনো ভাবিনি, এতো সহজে তোমার কাছে পৌঁছাতে পারবো। কিন্তু তুমি কিভাবে জানো, আমি এখানে আসবো?
– প্রাসকোভিয়ায় প্রথম যে দলটার সম্মুখীন হয়েছিলে, মনে পড়ে? ওদের কাউকে হ’ত্যা করোনি তুমি। ওদের মধ্যে একজন খুব ভালো স্কেচ আঁকতে পারে। তোমার স্কেচসহ ওরা আমাকে চিঠি পাঠিয়েছিলো। আমি চেয়েছি বলে তুমি এখানে পৌঁছতে পেরেছ। পুরনো বন্ধুর অপমৃত্যু দেখতে চাইনি। জানতে চেয়েছিলাম, দেড় যুগ পর মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কেনো আমাকে খুঁজতে এসেছ?_____মার্টিন রাশভারী কন্ঠে বলেন।
– তোমাকে আমাদের প্রয়োজন। ফিরে চলো। আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।____ক্রিসক্রিংগলের কাতর কন্ঠ।
– ফিরে যাবে। আমি তোমাকে তোমার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আর কখনো আমার কাছে আসার দুঃসাহস দেখাবে না। যদি দেখাও, দ্বিতীয়বার আমি তোমাকে কোনো সুযোগ দিবো না।
শান্ত গম্ভীর কন্ঠে কথাটুকু বলে অন্য কামরার দিকে পা বাড়ান মার্টিন লরেন্স। কিন্তু পেছন থেকে ক্রিসক্রিংগলের দৃঢ় কন্ঠস্বর শুনতে পান।
– আমি তোমাকে না নিয়ে এখান থেকে কোথাও যাবো না।
গোলগোল চোখে তাকিয়ে এতক্ষণ সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো মার্কস। ভীষণ খুশি হয়েছিলো, মার্টিন তাদের পৌঁছে দেওয়ার কথা বলায়। কিন্তু ক্রিসক্রিংগলের কথা শুনে সে বেশ হতবাক হয়। বিস্ময়ে দু’চোখের পল্লব নাড়ায়। ক্রিসক্রিংগল কেনো বোকার মতো আচরণ করছেন? নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাওয়ার এই সুবর্ণ সুযোগ কেন হাত ছাড়া করতে চাইছেন? মার্কস বুঝতে পারে না, এই লোকটাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কি প্রয়োজন?
________
ইম্যুভিল।
শান্ত স্নিগ্ধ অপরাহ্ন। সৌর দুপুরের পরের সময়। অন্যান্য দিনের তুলনায় ঠান্ডা কম লাগছে আজ। ইনায়ার পরনে লম্বা স্কার্ট আর পাতলা পশমী সুয়েটার। একাডেমিতে ছুটির দিন বিধায় পশ্চাদ্ভাগের উঠানে আর্নির সাথে অনুশীলন করে ও। আগামী ক্লাস থেকে প্রতিযোগীতা শুরু হবে। প্রস্তুতি নেয়। পাশাপাশি আর্নিকে কিছু শৈলী শিখিয়ে দেয়। কিচকে কোলে নিয়ে বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে ছিলো সিয়া। ক্রিসক্রিংগলের জন্য ওর ভীষণ দুশ্চিন্তা হয়। কতদিন হয়ে গেল, বাবাকে দেখেনি। আর কত অপেক্ষা করা যায়? বিপদ কি বলে কয়ে আসে? অন্য সব মানুষের মতো ওদের জীবন এতোটা সহজ নয়। কিসব তুচ্ছ জিনিসপত্রের জন্য র’ক্তচোষাগুলো ওদের পেছনে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে সিয়ার মন চায়, বাক্স ভর্তি জিনিসপত্রগুলো আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে। কিন্তু পারে না বাবার কথা ভেবে।
কারো গলা ঝাড়ার শব্দে দুশ্চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে সিয়া। একপা ভাঁজ করে অন্য পা সোজা রেখে ওর পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ক্রিস্তিয়ান দাড়িয়ে আছে। ছেলেটা মিষ্টি মধুর হাসে। সিয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,
– সিয়া কি ভাবছে?
– ভাবছি, কতদিন হয়ে গেল। বাবা এখনো বাড়ি ফিরে এলেন না কেনো?
সিয়ার কথা শুনে ক্রিস্তিয়ানের মুখ শুকিয়ে যায়। এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারো। ফ্রাঙ্কলিং হয়তো জানেন। কিন্তু বলতে চান না। মাদাম ল্যারি কি কিছু জানেন? মাস্টার বাড়িতে ফিরে এলে সিয়া হয়তো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ওর মুখের দিকে তাকানো যায় না। প্রাণহীন পুতুল যেন। কখনো সিয়াকে হাসতে দেখেছে কিনা, ক্রিস্তিয়ানের মনে পড়ে না।
সিয়ার সুদীর্ঘ ঘন বাদামী চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ক্রিস্তিয়ান প্রশান্তিময় হাসে। দেড়মাস আগেও ওর চুলগুলো কাঁধের উপর লাফালাফি করতো। এখন সেগুলো হাঁটুর নিচে নেমে গেছে। অবাক করার বিষয় হলো এই চুলগুলো সামলাতে ওর বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না। ইনায়া তবুও নিজের চুল নিয়ে মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ করে, কিন্তু সিয়া কখনো বিরক্ত বোধ করে না। ক্রিস্তিয়ানের মনে হয়, সিয়ার এই চুলের মাঝে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। নতুবা ওর চুল এতো দ্রুত বড় হয় কিভাবে?
সিয়া সুন্দর। অত্যাধিক সুন্দর। দিনে দিনে যেন ওর সৌন্দর্য আরও বাড়ছে। উজ্জ্বল বাদামী আঁখিদুটি থেকে প্রায়ই জ্বলজ্বলে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। গোলাপী অধর জোড়া আরক্তিম হয়ে গেছে। মেয়েটা কেনো এভাবে লাবন্যময়ী হয়ে উঠছে? ক্রিস্তিয়ানের ভয় করে। সিয়ার মাঝে এমন অভাবনীয় সৌন্দর্যের পরিবর্তন শুরু হয় ইম্যুভিলে আসার পর থেকে। ক্রিস্তিয়ান বেশ লক্ষ্য করেছে ওকে। সে প্রতিনিয়ত দেখে, একাডেমির ছেলেগুলো কিভাবে সিয়ার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। এসব কোনো কিছুই খেয়াল করে না অনুভূতিশূন্য ভাবুক মেয়েটা। ও অন্য সব মেয়েদের থেকে কেনো এতো ভিন্ন? এই যে একটা সুদর্শন ছেলে দাড়িয়ে আছে পাশে, ওর কি একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করে না? কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করলে ওর মুখ থেকে উচ্চারিত একটা শব্দ শোনা যায় না। ক্রিস্তিয়ানের বুক চিরে হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
মৃদু মন্দ বাতাসে সিয়ার মুখের উপর চুল উড়োউড়ি করে। ছেলেটার ইচ্ছে করে পরম যত্নে আদুরে হাতে সিয়ার কানের পাশে চুল গুঁজে দিতে। কিন্তু সাহস হয়না। মেয়েটা যে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। স্পর্শ করলে হারিয়ে যেতে পারে। ক্রিস্তিয়ান দুর থেকেই ওর মায়াভরা মুখখানা দেখে হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটায়। যেন চোখের সামনে কোনো স্বর্গীয় দেবী দাঁড়িয়ে আছে।
সহসা কিচ নড়েচড়ে উঠে। সিয়া ওকে আলতো স্পর্শে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ক্রিস্তিয়ানের উদ্দেশ্যে নিষ্প্রভ কন্ঠে জানতে চায়,,,,
– বাজারে যাবে না?
ক্রিস্তিয়ান সম্বিত ফিরে পায়। মলিন কন্ঠে বলে,,,
– যাবো। সন্ধ্যার পরে।
কিচ লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে দাড়ায়। হঠাৎই ছুটতে শুরু করে। ছুটছে তো ছুটছেই। সিয়া পেছন থেকে ডাকে,,,,
– কিচ দাড়াও। যেও না।
কিচ বারণ শোনে না। ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ির সীমানা পেরিয়ে যায়। পেছনে সিয়া। সিয়ার পেছনে ক্রিস্তিয়ান ছুটে আসে। বরফ ঢাকা বিস্তর প্রান্তরে কিচ লাফালাফি করে। সিয়া মৃদু হাসে। হয়তো ওকে হাসানোর জন্যই কিচের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ছিলো। ক্রিস্তিয়ান বিমুগ্ধ চোখে দেখে। সিয়ার অধর কোণের হাসি তার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। সিয়া কিচকে কোলে তুলে নেয়। মুখের কাছে নিয়ে কপালে চুমু খায়। ক্রিস্তিয়ান ওর পাশে এসে দাড়ায়। দু’হাত বাড়িয়ে বলে,,,
– আমাকে দাও।
সিয়ার কাঁধের উপর থাকা ক্রুশ চিহ্নটা আচমকাই জ্বলতে শুরু করে। সিয়া অন্যমনস্ক হয়ে কিচকে ক্রিস্তিয়ানের হাতে তুলে দেয়। থমথমে গলায় বলে,,,
– ওকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যাও।
– আর তুমি?____ ক্রিস্তিয়ান বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওকে।
– পরে।
– আমিও থাকি। একসাথে ফিরে যাবো।
– কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।
ক্রিস্তিয়ানের মুখখানা মলিন হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে কিচকে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। সিয়া স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। ক্রিস্তিয়ান চোখের আড়াল হতেই দৃঢ় গলায় বলে,,,
– তুমি যেই হও, সাহস থাকলে সামনে এসো।
ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে সিয়ার সামনে দাড়ায় এদুয়ার্দো। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়। লাল টুকটুকে দু’ঠোটের ফাঁক গলিয়ে শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে। সিয়া নির্ভীক চিত্তে বুক টানটান করে সগর্বে দাড়িয়ে থাকে। বিস্মিত হওয়ার ভান করে তাচ্ছিল্য কন্ঠে বলে,,,
– রক্তচোষাদের ওভারলর্ডের এতটা অধঃপতন! চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখছিলো?
এদুয়ার্দো শক্ত হাতে সিয়ার গাল চেপে ধরে। নিমেষেই হিংস্রাত্মক হয়ে উঠে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে গর্জন ছেড়ে বলে,,,
– এখানে এসব কি চলছিলো?
সিয়া এদুয়ার্দোর বুকের উপর দু’হাত রাখে। সজোরে ধাক্কা মা’রে। দু’কদম পিছিয়ে যায় এদুয়ার্দো।
– মহামান্য মাস্টার কি ঈর্ষান্বিত? হিংসে হচ্ছে? কেনো হিংসে হচ্ছে শুনি?____ বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে সিয়া।
এদুয়ার্দো ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। মুখ ঘুরিয়ে নেয় ডানপাশে। চোখের পলকে ছুটে গিয়ে দু’হাতে শক্ত করে সিয়ার কোমর চেপে ধরে। শীতল কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে বলে,,,,
– ফ্লোরেনসিয়া, বোকা বাঘিনী। এদুয়ার্দোর শিকার তুমি। তোমাকে ছোঁয়ার দুঃসাহস দেখানো তো দুর, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার অধিকার কারো নেই। সাবধান করছি। যদি আবারও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, তোমার দিকে তাকানো পুরুষের চোখ দু’টো উপড়ে ফেলবো আমি।
– অ’সভ্য তুমি। অপবিত্র। তোমাকে প্রচন্ড ঘৃণা করি আমি। প্রতিনিয়ত তোমাকে বিনাশ করার পূন্যময় স্বপ্ন দেখি। _____সিয়া শান্ত গলায় বলে। এদুয়ার্দোকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়।
এদুয়ার্দো কপাল কুঁচকায়। প্রাণবন্ত চমৎকার ভঙ্গিমায় হাসে। ভ্রু নাচিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে বলে,,,
– তাই!!
সিয়া স্পেল আওড়াতে পারে না। শুনতে পাবে শ’য়তানটা। সাবধান হয়ে যাবে। ওকে চরম শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে?
সিয়া ধীরে ধীরে নিজের হাত দু’টো মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। মোক্ষম একটা আঘাত হানবে। এমন সময়, এদুয়ার্দো সিয়ার কোমর ছেড়ে দিয়ে শক্ত হাতে ওর দু’হাত পেঁচিয়ে ধরে। রক্ত হিম হয়ে যাওয়া ঠান্ডা গলায় ফিসফিসিয়ে বলে,,,
– তোমার রক্তও তীব্র বিষাক্ত। ভাবতেই জিহ্বা তিক্ত হয়ে আসে। বেশি করে মিষ্টিজাতীয় খাবার খাবে, এতে যদি তোমার রক্ত সামান্য মিষ্ট হয়। দ্বিতীয়বার আমাকে আক্রমণ করার স্পর্ধা দেখাবে না, হাত ভেঙ্গে গলায় ঝুলিয়ে দিব।
এদুয়ার্দোর পায়ে নিজের পা দিয়ে শক্তপোক্ত আঘাত করে সিয়া। এদুয়ার্দোর ঠোঁট কুঁচকে যায়। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সিয়াকে।
– প্লিজ মহামান্য মাস্টার, এবার আমার পা দু’টো ভেঙ্গে গলায় ঝুলিয়ে দিন। আমি ধন্য হই।
এদুয়ার্দো সিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। এই মেয়েটার মাঝে ভদ্রতার লেশ মাত্র নেই। দিন দিন সাহস বেড়ে যাচ্ছে। এই অভদ্র, বেয়াদব মেয়েটাকে সময় নিয়ে পরে দেখবে। প্রথমে স্ট্রিকল্যান্ডের কাছে যেতে হবে। এদুয়ার্দো সিয়ার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসে। সিয়ার পিত্তি জ্বলে যায়। শয়তানটাকে খু’ন করে তার রক্ত দিয়ে দু’হাত রঞ্জিত করতে ইচ্ছে করে। বুকের ভেতরে ভয়ংকর দাবানল জ্বলে উঠে। মায়ের রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখখানা চোখের সামনে ভাসতেই নেত্রচ্ছদ বুজে ফেলে। মাত্রারিক্ত ঘৃণায় সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করে। যন্ত্রণা হয়, প্রচন্ড যন্ত্রণা হয়। হেরে যাওয়ার যন্ত্রণা। মায়ের হ’ত্যাকারীকে চোখের সামনে দেখেও কিছু করতে না পারায় ভীষণ অসহায় বোধ করে। ওর এই অসহায়ত্বের শেষ কোথায়?
ক্ষণকাল সময় গড়ায়। সিয়া চোখ মেলে তাকায়। ওর দু’চোখের সাদা অংশটুকু বেশ লাল হয়ে গেছে। এই বুঝি চোখ ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়বে। সামনে এদুয়ার্দো নেই। ও দৃষ্টি ঘুরিয়ে চারপাশে তাকায়। নেই, শ’য়তান রক্তপিপাসুটাকে দেখা যায় না কোথাও।