গুহার মুখ থেকে সিয়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঝুলছিল। গিরিখাতে পড়ে যায়নি কারন কেউ ওকে শক্ত হাতে ধরে রেখে ছিলো। ভয়াবহ আতংকে সিয়া চোখ মুখ কুঁচকে বন্ধ করে নিলো।
ওর হাত ধরে থাকা এদুয়ার্দোর ভ্রু কুঞ্চিত হলো। চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠল। হাঁটুতে, হাতে আর পায়ে ভীষন ব্যথা পেয়েছে সিয়া। ওর ভয়ের মাত্রা এতোটাই বেশি যে হুশ হারিয়ে ফেলল। বুঝতে পারল না, ওর সাথে হচ্ছে টা কি? হঠাৎ করে এতোগুলো বাদুড় কোথা থেকে এলো? তাছাড়া গুহায় তো কেউ ছিলো না। তাহলে এই মুহূর্তে ওর হাত ধরে আছে কে?
– কোনো র’ক্তচোষা পি’শাচ নয়তো!
ভাবতেই সিয়ার পুনরায় পিলে চমকে গেলো। এদুয়ার্দোর পেছন থেকে কিচ শব্দ করে উঠল। এদুয়ার্দো মনে মনে ভাবল,
– এই মেয়েটাকে ব্যবহার করে কাস্ত্রোরুজ থর্পে পৌঁছাতে হবে।
সে এক ঝটকায় সিয়াকে উপরে তুলে নিলো। সিয়া ব্যথা পেলো। করুনস্বরে আর্তনাদ করে উঠল। ভীত-ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
– কে?
এদুয়ার্দো কোনো কথা বলল না। সিয়ার গলা কাঁপতে শুরু করল। আঁটকে আসা কন্ঠে জানতে চাইল,
– আপনি কি মানুষ? নাকি কোনো প্রেতাত্মা?
র’ক্তচোষা শব্দটা মুখে উচ্চারণ করল না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই শব্দটা বেশ কয়েকবার আওড়াল ও। এদুয়ার্দো ওর মনের কথা শুনতে পেলো। অকস্মাৎ তার নাকে রক্তের গন্ধ এসে লাগলো। চোখজোড়া ফের জ্বলজ্বল করে উঠল। ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। এদুয়ার্দো উল্টো ঘুরে অনেকটা দূরে গিয়ে দাড়াল। যাতে কিছুটা হলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। সিয়া গুহার পাথুরে মেঝেতে বুট জুতোর শব্দ শুনতে পেলো। ভীষণ অবাক হলো। মনে মনে ভাবল,
– লোকটা কি বোবা? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এভাবে চলে যাচ্ছে যে!
কথাটা যেন এদুয়ার্দোর শ্রবণেন্দ্রিয় ভেদ করে মস্তিকে বারি খেল। সে ক্রুদ্ধ হয়ে একহাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। দু’চোখ বুজে রাগটুকু গিলে নেওয়ার চেষ্টা করল। থমথমে পায়ে আরও একটু দূরে গিয়ে দাড়াল। সিয়া সারা শরীরে অসহনীয় ব্যথা অনুভব করল। মৃদু মৃদু মাথা ঘুরাচ্ছিলো। কিচ ওর পায়ের কাছে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। থেকে থেকে গলা দিয়ে অদ্ভুত রকম শব্দ করে উঠল। লম্বা লেজ দিয়ে সিয়াকে সুরসুরি দিলো। ওর হাব-ভাবে অসামান্য ভয় প্রকাশ পেলো। কিন্তু কেনো এতো ভয় পাচ্ছে ও?
সিয়া খুব কষ্টে কিচকে কোলে তুলে নিলো। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– কি হয়েছে? তুমি এতো ভয় পেয়ে আছো কেনো?
কিচ সিয়ার বুকের কাছে মুখ গুঁজে দিলো।
– অন্ধকারে ভয় পাচ্ছো?
কিচের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। নড়াচড়াও করল না। একটুখানি দূরে সিয়া নিজের লন্ঠনটা মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখল। মনে মনে খুব খুশি হলো। সামনে এক পা বাড়াতেই হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করল। ওর হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় অনেকটা চামড়া ছিলে গেছে। পা কেটে রক্ত ঝরছে। হাঁটুর হাড়েও ব্যথা পেয়েছে। এই ব্যথাগুলো ওকে কাবু করতে পারতো না, যদিনা ওর শরীর দুর্বল হয়ে যেত। গলা শুকিয়ে গেছে। মাথাটাও ঘুরছে। সারাদিন কিছুই মুখে না দেওয়ার ফল। সাথে সুদীর্ঘ দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া এবং পড়ে গিয়ে ব্যথা পাওয়াতেই এমন করুণ অবস্থা হয়েছে ওর।
মানসিক ভাবেও অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে সিয়া। যখন কেউ মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে তখন সে নিজেকে শারীরিকভাবেও বেশ দুর্বল অনুভব করে। কিন্তু সিয়া তো এতো সহজে ভেঙ্গে পড়ার মতো মেয়ে নয়। ওর বাবা শিখিয়েছে ওকে, ভয় কে জয় করতে হয়। তাইতো এই গভীর রাতে এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে নিজের বাবাকে খুঁজতে এসেছিলো। সিয়া ধীরপায়ে হাঁটতে শুরু করল। যেন গুনে গুনে পা ফেলছিল। হেঁটে গিয়ে লন্ঠনটা হাতে তুলে নিল।
কাচের তৈরি লন্ঠনটায় এখনো আগুন জ্বলছে। কিন্তু পাথুরে মেঝেতে পড়ে যাওয়ায় একপাশের কাচ ভেঙ্গে গেছে। কিচকে কোলে নিয়ে নিচু হয়ে লন্ঠন তুলে নেওয়ায় ওর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। ঐ তো কিছুটা দূরে ঐ লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। আকাশি রঙা শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরনে ছিলো। লোকটার পেছন দিকটায় শুধু দেখা যাচ্ছে। যার চেহারাটা একবারের জন্যও দেখতে পায়নি সিয়া।
– লোকটাকে অন্তত একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।
সিয়া মনে মনে ভাবে। কেটে যাওয়া পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। সহসা কিচ শব্দ করে নড়েচড়ে উঠে। গুটিয়ে গেল সিয়ার বুকে। সিয়া লোকটার দিকে যতখানি এগোয় কিচের নড়াচড়া ততই বেড়ে যায়।
– তোমার কি অন্ধকারে ভয় লাগছে?
কিচকে কথাটা জিজ্ঞেস করে সিয়া লন্ঠনের কাচ উপরে তুলল। গুহায় প্রবেশ করার রাস্তার দু’পাশে থাকা মশালগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিল। রাস্তাটা আলোকিত হয়ে উঠল। সিয়া একপা দু’পা করে হাঁটল।
– ওখানেই দাড়াও।
সামনে থেকে লোকটার কন্ঠস্বর ভেসে আসে। সিয়া চমকায়। মনে মনে ভাবে,
– এতোটা গম্ভীর কন্ঠস্বর কি কোনো মানুষের হতে পারে?
ওর পা থেমে যায়। ধীরে ধীরে শরীর অবশ হয়ে আসে। এই অবস্থায় বাড়ি ফিরে যাবে কি করে? অন্তত একটু পানি খেলে হয়তো শরীর কিছুটা হলেও সুস্থ অনুভব করতো। সিয়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– গুহার ভিতরে কি পানি আছে? আমাকে একটু পানি দিতে পারবেন?
কোনো কথা বলল না এদুয়ার্দো। নির্বিকার ভঙ্গিতে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। এমনকি পেছন ফিরে দেখল না পর্যন্ত।
– লোকটা কি বধির?________সিয়া মনে মনে ভাবে।
এদুয়ার্দোর ক্রোধ বেড়ে গেল। চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে উঠল। রক্তলাল ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। নিজেকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না সে। বাধ্য হয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো। ছোট আকারের কাঁচের একটি গোলাকার শিশি বের করে আনল। ছিপি খুলে শিশিতে থাকা পোশন পান করে নিলো। এটা এমন একটা পোশন ছিলো যা ভ্যাম্পায়ারদের দুর্দম্য রক্তের নেশা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এমনকি সূর্যের আলোয় শরীর জ্বলে যাওয়া থেকে রক্ষা করে তাদের। কিন্তু প্রখর রোদে এই পোশনের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এমনও সময় আসে যখন রক্তচোষা পিশাচগুলোকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কফিনে মৃতের ন্যায় শুয়ে থাকতে হয়।
পোশন পান করতেই এদুয়ার্দো স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে পেছন ফিরে তাকাল। সিয়ার কেটে যাওয়া পায়ের রক্তের ঘ্রাণ এখন আর কাবু করতে পারল না তাকে। মশালের আলোয় সিয়ার চেহারা স্পষ্ট দেখা গেল। মেয়েটা বেশ লম্বা। নিটোল স্বাস্থ্যের অধিকারী। গোল গোল চোখ দু’টোতে জ্বলজ্বলে বাদামী চোখের মনি। ফর্সা গালে ঈষৎ লাল আভা ছড়িয়ে আছে। পুতুলের মতো একজোড়া চোখ আর উজ্জ্বল বাদামী রঙা চুলগুলো ব্যাংস লেয়ার কাট দেওয়ায় মেয়েটাকে বার্বি ডলের মতো লাগছে।
এদুয়ার্দো গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখল। সিয়া নিবিড় কৃষ্ণ পল্লব নাড়িয়ে চোখ মেলে তাকাল। এদুয়ার্দোর মনে হলো একটা বাচ্চা পুতুল দাঁড়িয়ে আছে তার চোখের সামনে। মনে মনে ভাবল,
– মেয়েটার কথা আর আচরণ যেমন শিশুসুলভ তেমন চেহারাতে একরকম বাচ্চা বাচ্চা ভাব। তবে দুঃসাহস আছে অনেক।
সিয়া অবাক চোখে সামনে দাড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। ওর ঠোঁট দু’টো ঈষৎ পৃথক হয়ে গেল। লম্বা সবল সুগঠিত দেহ, মাথায় ঘনকালো মসৃণ চুল, লম্বা মোটা ভ্রু, শ্বেতশুভ্র গায়ের রঙ, লাল টকটকে ঠোঁট, সূচালো নাক আর একজোড়া এমারেল্ড সবুজ চোখের আকর্ষণীয় দৃষ্টি যেন ওকে বশীভূত করে নিলো। সিয়া মনে মনে ভাবল,
– আমার সামনে দাড়িয়ে থাকা এই পুরুষটা কি সত্যিই কোনো মানুষ? নাকি স্বর্গের কোনো দেবতা?
সিয়ার কথায় এদুয়ার্দোর ঘোর কেটে গেল। প্রশস্ত বুক টানটান করে স্বাভাবিক হয়ে দাড়াল। চেহারায় কেমন একটা গাম্ভীর্যতা ফুটিয়ে তুলল। সিয়া পরপর দু’বার দু’চোখের পল্লব নাড়ালো। কিছুক্ষণের জন্য যেন সব ব্যথা-যন্ত্রটা ভুলে গিয়েছিলো। কিচ পুনরায় নড়চড় শুরু করে। সিয়া একপা দু’পা করে এগোয়। কিচ এদুয়ার্দোর দিকে তাকিয়ে থেকে অস্থির হয়ে উঠল। অকস্মাৎ লাফ দিয়ে মেঝেতে নেমে দাড়াল। সিয়া মৃদুস্বরে ডাকল,
– কিচ!
কিচ ওদের থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে দাড়াল। কেমন ভয় পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে রইল। ওর দিকে একপলক তাকাল সিয়া। অতঃপর এদুয়ার্দোর দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মলিন হেঁসে বলল,
– আপনি ওর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাই ভয় পাচ্ছে। আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আসছি।
সিয়া উল্টো ঘুরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। মাথাটা এখনো ঘুরছে। কিচের কাছে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। হাতের লন্ঠন টা মেঝেতে রেখে কিচকে কোলে তুলে নিলো। এদুয়ার্দো তাকিয়ে থেকে দেখল। সিয়া একহাতে কিচকে আগলে রেখে অন্য হাতে লন্ঠন তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল। কিন্তু হঠাৎ’ই যেন পায়ের নিচে অথৈয় শূন্যতা অনুভব করল। পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিল। তারপর গুহার দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।
– গন্তব্যে পৌঁছানোর সামর্থ্য আছে শরীরে?
পেছন থেকে দ্বিতীয় বারের মতো সেই গম্ভীর কন্ঠস্বর শোনা গেল। সিয়া থমকাল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
– আছে। আমি নিজেকে সামলে নিতে জানি।
এদুয়ার্দো তৃতীয়বারের মতো কোনো কথা বলল না। সিয়া হাঁটতে শুরু করল। জোর গলায় কথাটা বললেও ওর মনে সংশয় ছিল। এখানে আসার সময় এমন আহত ছিলো না। কিন্তু এখন আহত হওয়ার পাশাপাশি মাথা ঘুরছে। পাহাড় থেকে নামতে পারবে কিনা সন্দেহ। সেখানে প্রায় তিন মাইল রাস্তা সে কিভাবে হেঁটে যাবে? পথিমধ্যে একটা সাঁকো পেরিয়ে যেতে হবে। ভাবতেই সিয়ার গলা শুকিয়ে এলো আরো। এক ঢোক পানির জন্য কেমন মরিয়া হয়ে উঠল। তবুও সিয়া হাঁটল। হাঁটতে হাঁটতেই আচমকা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
লন্ঠনটা মেঝেতে পড়ে কাচগুলো ফেঁটে চৌচির হয়ে গেল। কিচ শব্দ করে খানিকটা দূরে ছুটে পালাল। কিন্তু গুহার ভিতরেই ছিল। এদুয়ার্দো একপলক তাকিয়ে থেকে থমথমে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। একজোড়া পেশিবহুল হাতে সিয়াকে কোলে তুলে নিলো। ধীরপায়ে হেঁটে গুহার আরও ভেতরে ঢুকে গেলো। কিচ ওদের অনুসরণ করল।এদুয়ার্দোর কাছাকাছি গেল না। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে রইলো।
অচেতন হয়ে যাওয়া সিয়াকে এদুয়ার্দো একটা চৌকিতে শুইয়ে দিলো। মশালের আলোয় একপলক তাকাল সিয়ার দিকে। ওর লম্বা ঘনকালো ভ্রু, সরু নাক, পাতলা কোমল গোলাপী রঙা ঠোঁটের দিকে এদুয়ার্দো সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কি মিষ্টি মুখের আদল মেয়েটার। এদুয়ার্দোর কাছে চরম বিরক্তিকর মনে হলো। কারন তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী তার মা। এই মেয়েটাকে যেন তার মায়ের থেকেও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছিল।
হঠাৎ’ই সিয়ার ঠোঁট দু’টো মৃদুমন্দ কাঁপতে শুরু করে। ও ঠোঁট নেড়ে কিছু বলছে। এদুয়ার্দো শুনল। মেয়েটা পানি চাইছে।
– এখন পানি পাবো কোথায়?
এদুয়ার্দো গুহার মধ্যে পানি খুঁজতে শুরু করে। খুঁজতে খুঁজতে চৌকির নিচে দেখে। যেখানে বলশালী দেহের কোনো এক ব্যক্তির মৃ’তদেহ পড়ে আছে। ঘন্টা দুয়েক আগে এদুয়ার্দো যার রক্ত চুষে খেয়েছিল। চৌকির নিচে থাকা মাটির তৈরী ছোট কলসি’টাতে একটুও পানি খুঁজে পেল না সে।
সহসা তার দৃষ্টি চলে যায় অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা কিচের দিকে। কিচের দিকে তাকাতেই কিচ দৌড়াতে শুরু করে। এদুয়ার্দো বিদ্রুপের স্বরে বলে,
– ওভারলর্ড এদুয়ার্দোর এতোটাও খারাপ সময় আসেনি যে, তোর মতো সামান্য একটা কাঠবিড়ালির রক্ত শুষে খেতে হবে। বরং তোর মালকিনের রক্ত শুষে খেতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। কিন্তু ওকে আমার প্রয়োজন, তাই আজকের মতো বাঁচিয়ে রাখছি।
সিয়া পুনরায় পানি পানি বলে মৃদুস্বরে গোঙ্গানি দিয়ে উঠে। এদুয়ার্দো মাটির কলসিটা হাতে তুলে নিয়ে ঝড়ের বেগে গুহার বাইরে বেরিয়ে যায়। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পানি নিয়ে ফিরে আসে সে। হাতের তালুতে করে শুয়ে থাকা সিয়াকে পানি পান করায়। কপট রাগমিশ্রিত কন্ঠস্বরে বলে,
– রক্তচোষা’দের ওভারলর্ডকে দিয়ে নিজের সেবা যত্ন করানোর ফল ভুগবে তুমি। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া মাত্রই তোমার শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে খাবো আমি।
________★★________
কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।
ঘড়ির কাটা জানান দেয় রাত তিনটে বেজে গেছে। দুর্গের একটি গুপ্ত কামরার দ্বার খুলে যায়। ক্যারলোয়েন আর ভিক্টোরিয়াকে সাথে নিয়ে কামরায় প্রবেশ করেন পিদর্কা স্যাভেরিন। বিশালাকৃতির কামরার মেঝেতে বানানো ছোট গোলাকার পুল। যার চারপাশটা ঝকঝকে সাদা ছিলো। পুলের দিকে তাকাতেই ক্যারলোয়েনের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো। ভিক্টোরিয়ার চোখ দু’টো খুশিতে চকচক করে উঠল। পিদর্কা স্যাভেরিন সগর্বের হাসি হাসেন। ক্যারলোয়েনের দিকে দৃষ্টি রেখে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলেন,
– নেমে যাও পুলে।
– মা! আমি যা দেখছি তা কি সত্যি? ___ক্যারলোয়েন অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে।
পিদর্কা স্যাভেরিন এক গাল হেসে সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন।
– এই তাহলে আপনার আর ভিক্টোরিয়ার রুপের রহস্য?
ক্যারলোয়েনের প্রশ্নটা শুনে ভিক্টোরিয়া ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। হাসলে তাকে আরও বেশি সুন্দর লাগে দেখতে। ক্যারলোয়েন মুগ্ধ চোখে দেখে। অতঃপর বাথরোব গায়ে জড়িয়ে নেমে যায় পুলে। পিদর্কা স্যাভেরিন আর ভিক্টোরিয়া পা ভিজিয়ে পুলের পাড়ে আরাম করে বসে।
★★
সোফার উপর সটান হয়ে শুয়ে ছিলো অ্যাভোগ্রেডো। হঠাৎ’ই দরজার ওপাশে কারো হাঁটা চলার শব্দ শুনতে পেল। শোয়া থেকে উঠে বসল। চোখের পলকে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওপাশ থেকে ভয়ংকর এক নারী কন্ঠ ভেসে এলো,
– অ্যাভোগ্রেডো! প্রেতাত্মা দেখেছো কখনো?
অ্যাভোগ্রেডো সশব্দে দরজা খুলে ফেলল। সহাস্যে বলল,
– জ্বি না প্রিন্সেস। আপনি দেখেছিলেন কোনোদিনও?
থতমত খেলো ইজাবেল। এতো কষ্ট করে প্রেতাত্মাদের মতো সেজেগুজে এলো অ্যাভোগ্রেডোকে ভয় দেখানোর জন্য। কিন্তু ছেলেটা তার সব পরিকল্পনা ধূলিসাৎ করে দিলো। সহজেই চিনে ফেললে তাকে। ইজাবেল এক মূহুর্তও আর দাঁড়াল না। ঝড়ের বেগে ছুটতে শুরু করে। অ্যাভোগ্রেডো শব্দ করে হাসে। দূর থেকে ক্যারলোয়েন তা দেখে। গোসল সেরে মাত্রই কামরার দিকে যাচ্ছিলো সে। এদের দু’জনকে একসাথে দেখলে তার হৃদপিণ্ড জ্বলে যায়। বোন হয়েও বোনের প্রতি ভীষণ হিংসে বোধ করে। শুধুমাত্র ইজাবেল অ্যাভোগ্রেডোর আশেপাশে ঘুরঘুর করে বলে।
ক্যারলোয়েন ক্ষিপ্র গতিতে অ্যাভোগ্রেডোর দিকে এগিয়ে যায়। অকস্মাৎ তাকে চোখের সামনে দেখে অ্যাভোগ্রেডো অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ক্যারলোয়েন রাগান্বিত কন্ঠস্বরে তাকে জিজ্ঞেস করে,
– এই মাঝরাতে ইজাবেলের সাথে কি নিয়ে হাসাহাসি করছিলে?
অ্যাভোগ্রেডো কোনো উত্তর দিতে পারেনা। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। ক্যারলোয়েন শাসানোর স্বরে আঙ্গুল তুলে বলে,
– ইজাবেলের থেকে দূরে থাকবে। ওর আশে পাশেও যেন তোমাকে না দেখি।
– জ্বি প্রিন্সেস। ____অ্যাভোগ্রেডো নতমুখে বলে।
ক্যারলোয়েন মনের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করে। অ্যাভোগ্রেডোকে দরজা লাগিয়ে দিতে বলে নিজের কামরার দিকে চলে যায়।
________★★________
ওডেসা, দুভিল কোট।
ক্রমে ক্রমে সময় গড়ায়। রাত পেরিয়ে ভোর হয়। অদূরে গীর্জা ধ্বনি বেজে উঠে। চোখ মেলে তাকায় পামেলা। রাতে বিছানায় শুয়ে থেকে অনেক কেঁদেছিল মেয়েটা। ভোর হতেই সব ভুলে গেছে। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল সে। পোশাক নিয়ে গোসল খানায় প্রবেশ করে। অনেকক্ষণ সময় লাগিয়ে গোসল শেষ করে। ঠান্ডা পানি গায়ে পড়তেই সতেজতা অনুভব করে। গোসল শেষে লাল রঙা একটা গাউন পরিধান করে। চুল শুকিয়ে আয়নার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বেশ সুন্দর করে সেজেগুজে কামরা থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে আব্রাহামের কামরার সামনে এসে দাঁড়ায়। পামেলাকে ভীষণ আনন্দিত দেখাচ্ছিলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বাররক্ষী দু’জনকে জিজ্ঞেস করল,
– রুলার আছেন?
– জ্বি না। ________ দ্বাররক্ষীদের একজন প্রত্যুত্তর দিলো।
পামেলার মুখ শুকিয়ে গেল। দু’চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– কোথায় গেছেন তিনি?
– মাঝ রাতে বেরিয়ে গেছেন, এখনো ফিরে আসেননি।