অপেক্ষা – মাহা আরাত | পর্ব – ২৬

15 Min Read

40★

৭৪
ঘড়িতে যখন একটার ঘর ছুইছুই তখন আরহাম রুম থেকে বেরোলেন।দূপকেটে হাত গুজে নিচে আসলেন প্রথমে।আধো অন্ধকারে মাইমুনার কক্ষে প্রবেশ করে চেয়ে রইলেন তাঁর চাঁদের দিকে।
মাইমুনার ভেজা চোখ আর মলিন দৃষ্টি আরহামের চোখ এড়ায় না।আরহাম বুঝেন,কিন্তু বুঝতে দেন না।অজানা কোনো এক কারনে রুদ্রকে উনার পছন্দ না।কিন্তু মাইমুনা আর রুদ্রের সম্পর্ক ভালো।ঠিক আছে মামা মাহরাম,তাই বলে হাসি ঠাট্টা, অপ্রয়োজনীয় কথা বলা,পাশাপাশি থাকা এটা তো পছন্দ নয় উনার।দূজনই প্রাপ্তবয়স্ক।মাইমুনা কুমারী, তাঁর মামা ও যুবক।এসব সম্পর্কে ফেতনার আশঙ্কা থাকে।আরহামের এসব পছন্দ নয়।উনার আহলিয়াকে কেন বাইরের মানুষ দেখবে!তাঁর সৌন্দর্য শুধু তাঁর প্রিয়তমের জন্যই।

কিছুক্ষণ পরে বের হয়ে উপরে আসলেন।হাফসার রুমে দেখলেন অন্ধকার।করিডোরের লাইট দিয়ে দেখলেন, হাফসা রুমেই নেই।

আরহাম আশ্চর্য হলেন খুব।আবারো দ্রুতপায়ে আম্মুর রুমে গেলেন।রুমটা ড্রিম লাইটের আলোয় সব বুঝা যাচ্ছে।হাফসাকে দেখে হাসলেন তিনি।আম্মুকে জড়িয়ে ধরে আছে,আম্মু নিশ্চয়ই ব্যাথা পাচ্ছেন হাতে।আরহাম গিয়ে আম্মুর থেকে ওর হাত সরাতে বুঝলেন, বেশ শক্ত করেই জড়িয়ে আছেন আম্মুকে।

হাফসাকে ছাড়িয়ে সোজা কোলে তুলে পা দিয়ে ডোর লাগিয়ে উপরে উঠলেন।
রুমে এসে বিছানায় শোয়াতেই সে নড়েচড়ে উঠে।লাইটের উজ্জ্বল আলো চোখে পড়তেই চোখ কুঁচকায় সে।আধো অবয়বে আরহামকে দেখে উঠে বসে।

‘উঠতে হবে না ঘুমান।’

‘এ্ এ্ এখানে এলাম কি করে!আম্মুর সাথে ঘুমিয়েছি আমি।’

‘আমি নিয়ে এসছি।’

আরহাম খোঁচা মেরে বললেন, ‘ঘুমানোর সময়ও হুষ ঠিক থাকে তাই না?এখন আম্মু কে তো জড়িয়ে ধরেই ঘুমাচ্ছিলেন,আর আমার সাথে ঘুমোলে কীভাবে দূরে থাকা যায়!কীভাবে দূরে সরে ঘুমানো যায়!’

ঘুমের ঘোরে এসব কথা ঠিক বুঝতে পারলো না হাফসা।

জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি বুঝলেন কি করে আমি আম্মুর রুমে?কয়টা বাজে?’

‘দেড়টা।আপনাকে গিয়ে খুঁজছি রুমে পাইনি।একটুর জন্য হার্ট এ্যাটাক করিয়ে দিচ্ছিলেন আমাকে।’

‘ঘুমাই?’

‘আপনার রুমে ঘুমালেন না কেন?’

‘ভয় করছিলো।’

‘আমার রুমে আসতেন?’

হাফসা কিছুক্ষণ তাকালো।তারপর গায়ে কাঁথা জড়াতে জড়াতে বলল, ‘লাইটটা বন্ধ করুন।চোখে লাগছে।’

আরহাম এসে শুয়ে হাফসাকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে।
লজ্জায় নেতিয়ে পড়া হাফসা কোনোভাবে বলল, ‘দম বন্ধ হয়ে যাবে এভাবে ধরবেন না।’

‘এখন থেকে এরকম দমবন্ধ অনুভূতি সহ্য করতে হবে।ইটস ইউর পানিশমেন্ট।’

****
পড়ার টেবিলে বসে দ্রুতগতিতে কারো প্রোফাইল স্ক্রল করছে আদওয়া।রাগ লাগছে তাঁর।আরহামের এফবি আইডিতে একটাও ছবি নেই উনার।এই মানুষটার প্রতি দিনকে দিন ঝুঁকে যাচ্ছে সে।হতাশ হওয়ার পরও আচানক হেসে উঠলো সে।গ্যালারির হিডেন ফাইলে লুকিয়ে থাকা আরহামের ছবিটা জুম করে দেখলো।আজ উনার মায়ের অজ্ঞাতে ছবিটা তুলেছে সে।তাঁর নিজের ছবিও এতটা নিঁখুত ভাবে দেখেনি,যেমনটা আরহামের দেখছে।

মনে মনে কিছু ভেবে একাই ভেংচি কাটে সে।লোকটা অতীব সুন্দর বলে এত ভাব?তাকায় না পর্যন্ত।অদ্ভুত!

হঠাৎ পরিচিত একটা ফোন আসতেই তাঁর কপাল কুঁচকে যায়।এক আকাশ বিরক্তি নিয়ে কলটা কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকলো।একমিনিট পর আবারো যখন আরহামের ছবিটা দেখবে তখন আবার কল আসলে কল পিকাপ করেই বলে, ‘সমস্যা কি?অশান্তি লাগছে? কল দিচ্ছো কেন বারবার?’

অপাশ থেকে একটা শান্ত কন্ঠে ভেসে উঠে, ‘বারবার কোথায় দিলাম একবারই তো দিয়েছি।’

আদওয়া দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলে, ‘কেন ফোন দিয়েছো?’

‘কেন আমি ফোন দিতে পারি না?’

‘এখন আমি পড়ছি।’

‘আগেও পড়তে।’

‘তো?’

‘কিন্তু ইগনোর করতে না আমাকে।কিন্তু এখন করো।কল দিলে ধরো না,ঝাড়ি দেও আমাকে। ম্যাসেজ সিন করো না।কিন্তু অনলাইন থাকো।’

‘আমার সময় নেই ইমান।পরে কল দিও।এখন রাখছি।ওপাশের উত্তর না শুনেই সে ফোন কেটে দিল।

আবারো ফোন হাতে নিতে টাইমে চোখ পড়তে দেখলো,রাত দূইটা বাজে।আনমনে হেসে উঠলো আদওয়া।পড়া শেষে ঠিক বারোটায় ফোনটা হাতে নিয়েছিলো সে।এই মানুষটাকে কল্পনা করতে করতে কবে যে দূইটা বেজেছে তা বুঝতেই পারলো না।

41★

৭৫
আজকে মাইমুনার মা আর মেঝো বোন আসছেন।সাথে বোনের ঘরের ভাগনে।
আসছেন মধ্যাহ্নের পরে।আজকে ইফতারের তোড়জোড় বেশী।আসরের নামাজ আদায় করে হাফসা যখন আবারো নিচে নামছিলো তখন টাইম দেখতে ফোন হাতে নিলে দেখলো আরহামের ৬ টা কল।দ্রুত ফোন ব্যাক করতেই ওপাশ থেকে সালাম দিয়েই উনি বললেন,

‘কোথায় ছিলেন আপনি?এত কল দিলাম?’

‘সরি।আমি নিচে ছিলাম রান্নাআআআ ন না মানে নিচে…’

‘আপনার আর আমার বার্থ সার্টিফিকেট এর একটা পিক তুলে দেন তো এখুনি।নীল ফাইলে আছে আমারটা।কুইকলি দেন,আমি ওয়েট করছি।’

‘আচ্ছা।’

হাফসা কাবার্ড খুলে ফাইল খুলতে যাবে অমন সময় কাজল হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করে বলে, ‘ছোডু আফা,খালাম্মায় কেমন জানি করতাছেন।আপনে তাড়াত্তি নিচে আয়েন।’

কাজল একথা বলেই দৌড়।এদিকে আরহামের কল আসছে।হাফসা দিশেহারা হয়ে দ্রুতপায়ে নিচে নেমে দেখলো, আম্মুকে ‘খালামণি(মাইমুনার আম্মু) আর সাইদা ধরে পিঠ মাসাজ করে দিচ্ছেন।আম্মুর বমিটিং হয়েছে। হাফসা তাড়াতাড়ি গিয়ে উনাকে একপাশ থেকে ধরে বলে, ‘আম্মু বেশী খারাপ লাগছে আপনার?’

মিসেস আফসানাকে বিছানায় শুইয়ে উনার হাতের তালুতে মাসাজ করছে হাফসা।ওদিকে কাবার্ডে আম্মুর ফোনে আরহামের কল আসছে।
আম্মু অস্থিরতায় জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন।মুখে ধরধর করে ঘাম ছুটছে।হাফসা বিছানায় পলিথিন রেখে উনার মাথায় পানি দিলো।বেশ কিছুক্ষণ পর শান্ত হলেন তিনি।

ইফতারের টাইম ছুইছুই।একজন সার্ভেন্টকে আম্মুর পাশে রেখে কিচেনে গেলো হাফসা।এত কিছুর আয়োজন করা হয়েছে, একহাতে সামলানো মুশকিল।তাও পারা যেতো,যদি একঘন্টা সময় হাতে থাকতো।একসাথে চারটা গ্যাস অন করে দূটোতে সিদ্ধ, আর দূটোতে আইটেম বানানো শুরু করলো সে।

বিনু,আর কাজল সবজি কেটে মসলা রেডি করে দিচ্ছে।দিনের শেষ সময়ের ক্লান্তি ফুটে উঠেছে হাফসার পুরো চেহারায়।শুষ্ক চেহারা জুড়ে চিকচিক করা ঘামের ছড়াছড়ি।তেলে পাকোড়া ছাড়তে গিয়ে হালকা চিৎকার করে উঠলো।বিনু আর কাজল দৌড়ে গেলো।সে নিজের হাত আড়াল করে বললো, ‘কিছু হয়নি।’

এমন সময়েও কিচেনে এসে এটা ওটা নিয়ে খেলতে শুরু করেছে কিরান।বয়সের তুলনায় বেশী চঞ্চল সে।কারো কোনো কথা মান্য না করেই চুলার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে।তাকে মানা করতে করতে এ পর্যায়ে মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে হাফসার।বিনু, আর কাজল অসহায় চোখে তাকালো হাফসার দিকে।

এই ছেলেটাকে বাধা দিতে দিতে গলার শেষ রসটুকু শেষ।এর মধ্যে হাফসার টেনশন আইটেম বানানো শেষ করার।বাবার জন্য আলাদা করে নরম খিচুড়ি করতে হয় প্রতিদিন।আর মায়ের জন্য তো লিকুইড বানাতে হবে।এসব কিছুর টেনশনে তাঁর মনেই ছিলো না আরহামের ফোনের কথা।

ইফতারি টেবিলে সার্ভ করতে করতেই আযান পড়ে।আরহাম এখনো আসলেন না তা নিয়ে হাফসার টেনশনের শেষ নেই।পানি খেয়ে অযু পড়ার নাম করে রুমে গিয়ে আরহামকে ফোন দেওয়ার জন্য ফোন হাতে তুলতেই মনে পড়ে বিকালের কথা।হন্তদন্ত হয়ে আরহামের কল লিস্ট চেক করে দেখলো ১৮ টা কল,৯টা ম্যাসেজ।হাফসা একসেকেন্ড চোখ বুজে একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিলো,যেটাতে মিশে আছে অপরাধবোধ,আর একরাশ ক্লান্তির তিক্ততা।

অযু পড়তে গিয়ে অনুভব করলো,ওর হাত ভীষণ ভাবে জ্বলছে।হাতের সোজা পিঠে বেশ অংশ জ্বলেছে।জ্বলা উঠতেই একপ্রকার কেঁদেই দিলো সে।শেষক্ষনেও নিজেকে সামলে দ্রুত টাওয়াল দিয়ে হাত মুখ মুছে নিলো।

হাফসা যখন নিচে নামলো,দেখলো টেবিলে খালামণি,মাইমুনা,ইমরানা আপু আর কিরান।আম্মুর রুমে গিয়ে দেখলো,আম্মুর কাছে আরহাম বসা।পাশে আব্বু। হাফসাকে ডুকতে দেখে আরহাম চোখ তুলে তাকালেন,হাফসা দৃষ্টি নামিয়ে নেওয়ার আগেই তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন।উনার দৃষ্টি ছিলো কঠিন।

আরহাম আম্মুকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন।হাফসা পাশে গিয়ে বলল,’ব্ বাবা আর আপনার ইফতারি বাবার রুমে টেবিলে।আপনারা ইফতার করে নিন,আমি আম্মুকে খাইয়ে দিচ্ছি।’

আব্বুকে জোর করে রুমে পাঠিয়ে আরহাম হাফসাকে বললেন, ‘আপনি গিয়ে করুন ইফতার। আম্মুকে আমি খাইয়ে দিতে পারবো ‘

হাফসার করুণ দৃষ্টি আরহামের দৃষ্টিতে আটকালো না।বলা বাহুল্য তিনি তাকালেন না পর্যন্ত।আরহাম বা আব্বুকে কে বলা হয়নি,বিকেলে আম্মুর অসুস্থার কথা।শুধু শুনেছেন,দূর্বল লেগেছে তাই আম্মু রেস্ট নিচ্ছিলেন।’

হাফসাকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,আরহাম কিছুটা ধমকের সুরে বললেন, ‘যান না কেন?ইফতার করুন।ড্রয়িং এ মেহমান আছে।এখানে দাঁড়িয়ে কিছু করতে হবে না।’

উনার ধমকে কোনোরকম কান্না আটকে ড্রয়িং এ আসার সময় শুনতে পেলো,খালামনির কথা।মাইমুনাকে বিদ্রুপের স্বরে বলছিলেন, ‘তর সতীন কি রান্না জানে না।পোলাও টা একদম পুড়িয়ে ফেলেছে দেখছি।’

মাইমুনা কিছু প্রত্যুত্তর করার আগেই ইমরানা বলে উঠলেন, ‘দুলাভাই ওর রুপে দিওয়ানা।নাহলে এমন অকর্মা নির্বংশী মেয়েকে কে বিয়ে করতো।’

আর এক চামচ পানিও মুখে উঠবে না হাফসার।আল্লাহ সুইয়ার!মাইমুনা যেদিন প্রথম হাফসার মা-বাবা তুলে কটু কথা বলেছিলেন,সেদিনও তেমন কষ্ট লাগেনি,যতটুকু আজ লেগেছে!জীবনের এ পর্যায়ে দ্বিতীয়বার হাফসা রবের দরবারে অভিযোগ জানালো, ‘কেন আমাকে এতিম করলে আল্লাহ?মা-বাবার সাথে আমাকেও নিয়ে নিতে!’

কান্না মাখা মুখটি ওরনায় আড়াল করে হাফসা দূর্বলপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে রুমে চলে গেল।অথচ ড্রয়িং এ থাকা একটা মানুষও তাকে ডাকলো না।জিজ্ঞেস করলো না,’সে ইফতার করেছে কী না!’

দশ মিনিট ধরে,সে কাঁদতে কাঁদতে এবার কাশি উঠে গেছে নাকেমুখে।মুখ চোখ লাল হয়ে মাথার তালু পর্যন্ত জ্বলতে শুরু করেছে।নিজের ভেতরের আর্তচিৎকার,আর কান্নার আওয়াজ যখন ওরনায় চেপে নিবারণ করতে চাচ্ছিলো,তখন দরজায় নক পড়ে।

42★

৭৬
অনবরত দরজায় নক হচ্ছে,হাফসা চোখ মুখ ভালো করে মুছলো তবু এবার আর উপায় নেই,যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে,সে এতক্ষণ কাঁদছিলো।কান্না পুরো থামে নি তাঁর।এখনও হেঁচকি তুলছে।দরজা খুলতেই সামনে আসেন আরহাম।টেবিলে প্লেট রেখে হাফসার কাছে যেতে চাইলেই হাফসা মুখ ফিরিয়ে নেয়।

সে যে মুখ নিচু করে কাঁদছে, সেটা ওর কাঁপুনি তেই স্পষ্ট। আরহামের ওর হাত ধরতে চাই সে হাত সরিয়ে নেয়।ওকে ধরতে চাইলে সে নিজেই সরে যায়।এবার আরহাম হাফসার হাত নিজের হাতে নিয়ে মিনতিসুরে বললেন, ‘আপনি যা শাস্তি দিবেন, সব মেনে নিব।একটাবার কান্না বন্ধ করুন উমায়ের সহ্য করতে পারছি না।’

হাফসা নড়লো না পর্যন্ত।কান্না বেগ সাথে হেঁচকি বাড়লো।হেঁচকির সাথে বারেবারে তার সারা শরীর কেঁপে উঠছে। আরহাম ওর মুখ তুলে চোখ মুছে দিয়ে বললেন, ‘প্লিজ কাঁদবেন না আর।হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে আমার।যদি আপনাকে দেখাতে পারতাম।প্লিজ উমায়ের,আর কাঁদবেন না,বলে হাফসার মুখটা দূহাতে মুছে দিয়ে তাকে বসালেন।

ইফতারি সাজানো প্লেট টা সামনে দিয়ে বললেন, ‘খেয়ে নিন।’

হাফসা প্রত্যুত্তর করলো না।

আরহাম আরও কয়েক বার জোর করলেও হাফসা কোনোরুপ উত্তরই দিলো না।

আরহাম বললেন, ‘খাবেন না আপনি?আমিও খাবো না’
হাফসা নিরুত্তর।

‘আমার খুব খিদে লেগেছে।’

হাফসা হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে, ‘খান।’

‘আপনি না খেলে খাবো না আমি।’

হাফসার মৌণতায় আরহাম এক লোকমা তাঁর মুখে তুলে দিলে সে মুখ ফিরিয়ে নিলে আরহাম বললেন, ‘দোষটা তো আমার, খাবারের না।আল্লাহ নাখোশ হবেন উমায়ের।’

এবার আর মুখ ফিরালো না।দ্বিতীয় লোকমা তাঁর মুখে দিতে চাইলে সে আরহামকে রিপিট করে।
হটাৎ ইমরানার সেই কথাটা মনে হতেই হাফসা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে দেয়।আরহাম ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাকে নিয়ে।

আরহামের বুকে সে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে। আরহামের জুব্বা ভিজে তাঁর চোখের পানিতে।আরহাম এখন আর বাঁধা দিলেন না।উনার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট।সারা শরীর রাগে রি রি করছে।হাফসা যখন ড্রয়িং রুমে আসছিল তখন হাফসাকে ডাকতে গিয়ে উনি ওর পিছুপিছু এসেছিলেন আরহাম।ইমরানা আর মাইমুনার আম্মুর বলা কথাগুলো শুনতেই আরহামের মাথা গরম হয়ে যায়।হাফসাকে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে রুমে যেতে দেখছিলেন।এরপর..

ফ্ল্যাশব্যাক___
‘সামান্যতম মেনারস টুকু ওর মধ্যে নেই?আমরা তো এ বাসার মেহমান তাই নয় কি?ওর কি উচিত না আমাদের কে এটা সেটা সার্ভ করে দেওয়ার?’

মায়ের এমন মন্তব্যে মাইমুনা বললেন,

‘মা ও এমনি।বাদ দাও।মেনারস শিখবে কথথেকে?ও কি পরিবার পেয়েছে?আমি এখনও বুঝি না আরহাম কেনো ওকে বিয়ে করলেন?উনি তো ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে জানতেনই।কি জানি আদৌ ওর ফ্যামিলি আছে কী না?কত লোকই তো ব্যাস্টার্ড…..

কথাটা শেষ করবার আগেই মাইমুনার হাত খপ করে ধরলেন তিনি।আরহামের চোখে আগুনের লাভা ছোটাছুটি করতে দেখে মাইমুনার গলা শুকিয়ে কাঠ।মাইমুনাকে ধরে রুমে নিয়ে জোরেই দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেন।

অতপর কিছুসময় নীরবতা।তারপর ‘ঠাস’ একটা শব্দ।ফুলের গায়ে প্রথমবার আঘাত!

আরহাম রাগে কাঁপতে কাঁপতে রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন।টেবিল থেকে হাফসার ইফতারি নিয়ে রুমের দিকে এগোলেন।

বর্তমান___

কিছুক্ষণ পর
আরহাম হাফসার পোড়াজায়গায় মেডিসিন লাগিয়ে যত্ন করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন।অতঃপর তাকে নামাজ পড়তে দিয়ে উনি নিচে গেলেন।

নিচের পরিবেশ চুপচাপ। মায়ের বুকে পড়ে কাঁদছে মাইমুনা।আরহাম আজ প্রথমবার ওর গায়ে হাত তুলেছেন,আঘাত করেছেন।এটা যে ঠিক কতটা কষ্টের!সেটা প্রকাশ অসম্ভব।

***
মায়ের রুমে গিয়ে আরহাম মায়ের কোলে মাথা লাগিয়ে জড়িয়ে ধরে রইলেন।

আরহামের যখন খুব মন খারাপ হয়,তখনি চুপচাপ মাকে জড়িয়ে ধরে রাখেন।

আম্মু আরহামের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?মন খারাপ কেন?’

‘মাইমুনা কে মেরেছি আমি।’

‘কিহহহ?’

‘হ্যাঁ।’

আম্মু আরহামের মাথা কোল থেকে তুলে বললেন, ‘আরহাম।তুমার মাথা ঠিক আছে? ‘

‘ঠিক।’

অতপর আম্মুকে সব খুলে বললে তিনি মাইমুনার প্রতি প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।আরহাম বললেন, ‘মাইমুনা এর আগেও অনেক কিছু করেছেন।কোনোদিন আমি আপনাকে উনাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ করিনি।বাট এখন বেশী হয়ে যাচ্ছে।’

‘হাফসা কীভাবে সহ্য করলো এগুলো?’

‘উনার সাথেও কঠিন আচরণ করেছি।’

‘এবার কিন্তু মারবো তোমাকে।এর আগে তুমি হাফসার গায়ে হাত তুলেছো বিনা দোষে।’

‘আমার মাথা গরম ছিলো।রেগে ছিলাম।’

‘তুমি অন্যায় করছো ওর সাথে।’

‘তাও তো উনি সব সহ্য করে নেন।

‘তুমি লাকি।হাফসা তোমার ভাগ্যে ছিল।কখনো কষ্ট দিও না তাকে।’

আরহাম আশ্চর্যান্বিত হলেন।মাইমুনা কে নিয়ে বিগত তিন বছরেও আম্মু যা বলেননি হাফসাকে দেড় মাসের মাথায় এ কথাটা বলে দিলেন!

*******
মসজিদ থেকে তারাবীহের নামাজ থেকে আসার পর আরহাম মায়ের রুমে বেশ কিছুক্ষণ থেকে রুমে আসলেন।
উপরে এসেই শেষ সিঁড়িতে হাফসার সাথে হঠাৎ ধাক্কা।নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘নিচে কেন যাচ্ছেন? ‘

‘কিচেনে।’

‘এখনও কি রাগ?তাকাচ্ছেন কেন আমার দিকে? ‘

হাফসা কোনো উত্তর ও দিলো না,তাকালোও না।
আরহাম আচমকা হাফসাকে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে এসেই দরজা বাইরে থেকে লক করে দিলেন।হাফসা এসে দরজায় নক করতে করতে বলে, ‘দরজা লক করলেন কেন?খুলুন প্লিজ।’

আরহাম মুচকি হেসে বললেন, ‘ভয় লাগছে হোমাপাখি?’

‘খুলুন না।নিচে যেতে হবে।’

‘গিয়ে রান্না করবেন তাই না?নো নিড।আজকে আমি রান্না করব।’

কথা শেষ হতেই উনার ধুপাধুপ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।মানে আরহাম চলে যাচ্ছেন।হাফসা আরো জোরে দরজায় থাবা দিতে দিতে বলে, ‘খুলে যান প্লিজ।আমাকে নিয়ে যান।’

হাফসার আর্তনাদ আরহামের কান পর্যন্ত পৌঁছলো না।হতাশ হয়ে দরজায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে সে ভাবলো, ‘এমন মানুষ নিয়ে সংসার করা যায়?রাঁধতে দেবেন না বলে না খেয়েও থাকবেন।তবু কিচেনের কাজ করতে দেন না।অদ্ভুত!

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।