রুমাইশা চমকে তাকালো জুবায়েরের দিকে। আতঙ্কিত হয়ে বলল,
— একি ভাইয়া, আপনি আমার হাত ধরছেন কেন? ছাড়ুন এক্ষুনি!
হাত টা জুবায়েরের হাত থেকে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো ও৷ কিন্তু জুবায়ের ছাড়লোনা। উলটো বলল,
— কাল তো এমনিতেই আমার হয়ে যাবে, তখন তো শুধু হাত ধরবো না, তোমার সব কিছুই তখন আমার হবে। একটা রাতের ই তো ব্যাপার আর, তাহলে ধরলে অসুবিধা কোথায়?
রুমাইশা চরম ঘৃণার চোখে তাকিয়ে এক ঝটকায় হাত টা ছাড়িয়ে নিলো, তারপর কড়া গলায় বলল,
— দেখুন ভাইয়া, আমি আপনাকে সারাজীবন ভাইয়ার চোখেই দেখেছি, তাই আপনাকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়, আর তা ছাড়া
পুরো বাক্যটা শেষ করতে দিলো না জুবায়ের তার আগেই রুমাইশার কাছে সরে এলো ও৷ জুবায়ের এইভাবে কাছে সরে আসায় রুমাইশা ভড়কে গেলো, জুবায়ের এগিয়ে এসে রুমাইশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
— যতো পারো আজ ভাইয়া বলে নাও, কারণ আগামী কাল রাতে তোমাকে এমন আদর করবো যে আমার নাম টাও ভুলে যাবে৷
ঘেন্নায় চোখ মুখ কুচকে নিলো রুমাইশা, দ্রত পায়ে পিছিয়ে গেলো ও জুবায়েরের থেকে। তারপর চোখ মুখে কাঠিন্যতা এনে বলল,
— দেখুন ভাইয়া, আমি আপনাকে কোনোভাবেই বিয়ে করতে পারবো না। আমি একজন কে ভালোবাসি, আর তার সাথে আমি এই ঘরেই এক বিছানায় থেকেছি, তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই ভালো হয় আপনি এই বিয়েতে না করে দেন৷
কিন্তু রুমাইশার কথায় জুবায়েরের কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। ও বিশ্রি হেসে বলল,
— তাহলে তো তোমার এক্সপেরিয়েন্স আছে, আসলে এক্সপেরিয়েন্স ছাড়া না জমে না। আর তা ছাড়া কারো সাথে বিছানায় গেলেই যে তাকে বিয়ে করতে হবে এমন কোনো সিস্টেম নাই। আমিও তো কত জনের সাথে বিছানায় গেলাম, আমি কি সবাইকে বিয়ে করেছি? করিনি। আর…… সে তোমাকে আর কি প্লেজার দিয়েছে, আমি তোমাকে যে প্লেজার দেবো তাতে তুমি তার এক্সিস্টেন্স ও ভুলে যাবে!
কথা টা বলেই জুবায়ের আবার ও সরে এলো রুমাইশার কাছে আর তারপর রুমাইশা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুমাইশার চোয়ালদ্বয় ধরে ওর ঠোঁটের দিকে মুখ বাড়ালো। সেটা টের পেতেই জুবায়ের কে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো ও। আর তারপরেই দরজা খুলে দৌড়ে সোজা বাইরে চলে এলো। আয়েশা রা বাইরেই বসে ছিলেন। রুমাইশা এসেই আয়েশার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো তারপর কড়া গলায় বলল,
— মা, জুবায়ের ভাইয়া কে আমি বিয়ে করতে পারবোনা। আমি সাফওয়ান কে ভালোবাসি, আর বিয়ে করতে হলে সাফওয়ান কেই করবো, নইলে এই জীবনে আর বিয়ে করবো না। সারাজীবন অবিবাহিতই থাকবো৷
৩৬. রাতের প্রায় এগারোটা। সাফওয়ান ছাদে টি টেবিলের পাশে রাখা ছোট শীতল পাটির ওপর বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। মুখে মাস্ক নেই ওর৷ চোখ ও উন্মুক্ত। চোখ মুখ ভয়াবহ রকমের শক্ত ওর। রাগে লাল হয়ে আছে সমস্ত চেহারাটা৷ দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে ও।
শাফিন ধীর পায়ে সিড়ি ভেঙে ছাদে আসলো। ছাদে পা রেখে ডান দিকে তাকিয়ে ভাইকে তার দানবাকার শরীর নিয়ে বসে থাকতে দেখলো টি টেবিলের পাশে। সাফওয়ানের মুখ টা তেমন বোঝা যাচ্ছে না। এগিয়ে গেলো শাফিন সেদিকে।
কারো পায়ের শব্দ শুনে বামে তাকালো সাফওয়ান। ওর জ্বলজ্বলে চোখ দেখে সাফওয়ান ভড়কে গেলো হঠাৎ করে৷ পা থেমে গেলো ওর৷ অপলকে তাকিয়ে রইলো ও ভাইয়ের দিকে৷ ঢোক গিলল একবার৷ কিন্তু শাফিন যে সাফওয়ান কে দেখে ফেলেছে তা নিয়ে সাফওয়ানের মুখে কোনো ভাবান্তর হলো না। চোখ মুখ আগের মতোই শক্ত করে রইলো। মুখে কোনো কথা বলল না ও। ইশারায় শাফিন কে ওর কাছে আসতে বলল।
শাফিন ঢোক গিলে এগোলো সাফওয়ানের দিকে। ধীর পায়ে সাফওয়ানের সামনে গিয়ে দাড়ালো ও। সাফওয়ান হাতের ইশারায় বসতে বলল ওকে। শাফিন বসলো ভাইয়ের বিপরীতে। ভাইয়ের ওই অদ্ভুত সুদর্শন মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। প্রচন্ডরকম সুন্দর, আবার ভয়ঙ্কর একটা চেহারা যেন, অনুভুতি টা ঠিক যে কিরকম তা শাফিন নিজেও বুঝতে পারছে না৷
কিছুক্ষণ পর কাজ শেষ করে সাফওয়ান ল্যাপটপ টা স্লিপিং মোডে রেখে, রেখে দিলো পাশে। তারপর সোজাসুজি তাকালো শাফিনের চোখে৷ শাফিন সাফওয়ানের এমন দৃষ্টিতে কেপে উঠলো। সাফওয়ান শাফিনের একটু কাছে সরে গিয়ে হাত রাখলো ওর কাধে। তারপর শক্ত গলায় বলল,
— আমাকে ভয় পাস না, আমি তোর ভাই। কোনো ক্ষতি করবো না আমি তোর৷
শাফিন স্মিত হেসে বলল,
— ভয় পাচ্ছিনা ভাইয়া, কখনো তোমার চেহারা দেখিনি তো, তাই চমকে গেছি। এ ছাড়া ভয়ের কিছু নেই, কারণ আমি জানি তোমার ব্যাপারে, সব কিছু। অনেক আগে থেকেই, রুমি আপুর ও আগে৷
সাফওয়ানের মুখে অদ্ভুত রকমের হাসি ফুটে উঠলো। দুবার শাফিনের কাধ চাপড়ে বলল,
— বল, কি বলতে এসেছিস।
শাফিন সোজা হয়ে বসলো, তারপর চোখ মুখ গম্ভীর করে বলল,
— বিকেল বেলা আমি গেছিলাম রুমি আপুদের বাসায়, তোমার কথা মতো। তুমি যা ধারণা করেছিলে তাই হয়েছে৷ রুমি আপু বলছিলো জুবায়েরের নাকি দৃষ্টি ভালো না। আপুর দিকে কেমন বাজে চোখে দেখছিলো। আর ফেরার সময়ে আমি স্বর্ণপট্টি দিয়ে আসছিলাম তখন আমি আয়েশা মামি, আর তার সাথে মামির বোন আর জুবায়ের কে দেখেছি। ওরা শপিং করছিলো, অনেক গুলো শপিং ব্যাগ ও দেখলাম, মামি যদিও আমাকে খেয়াল করেনি। জুবায়েরের চেহারা টা আসলেই মোটেও সুবিধার না। কেমন জানি একটা অসভ্য চাহনি সবসময়৷
শাফিনের কথার মাঝখানে সাফওয়ানের চেহারা আবার ও আগের মতো শক্ত হয়ে গেলো। চোখ দুইটা তীর্যক হয়ে গেলো আবার৷ শাফিন খেয়াল করলো সেটা। শাফিনের কথা শেষ হলে সাফওয়ান কঠিন স্বরে বলল,
— জানি আমি সব। তোর সাথে কি কথা হয়েছে, কার সাথে কি কথা হয়েছে বা হচ্ছে সব জানি আমি। এভরিথিং।
শাফিন অবাক হয়ে বলল,
— তুমি কিভানে জানো? আপু বলেছে?
সাফওয়ান অন্য দিকে ফিরে বলল,
— কিভাবে জানি সেটা তোর জানার প্রয়োজন নেই৷ এখন আমি যা বলছি তাই শোন৷ কাল সকালে আমার সাথে যাবি। শপিং এ যাবো আমরা।
শাফিন চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
— হঠাৎ শপিং এ যাবা, তাও আবার আমাকে নিয়ে! কি উপলক্ষে?
সাফওয়ান শাফিনের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বলল,
— যেতে বলেছি ব্যাস যাবি। উপলক্ষ টা শপিং এর সময় বুঝতে পারবি৷ এখন রুমে যা, গিয়ে একটা ঘুম দে৷ কাল অনেক কাজ করতে হবে।
শাফিন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তারপর পাটি থেকে উঠে নিজের রুমের উদ্দ্যেশ্যে পা বাড়ালো।
“””
চারদিক সুনসান নীরবতা। ডাইনিং এ সোফার পাশে মেঝেতে বসে আছে রুমাইশা। চোখ দুইটা ওর ফোলা। নাক লাল হয়ে আছে। থেকে থেকে নাক টানছে। চোয়ালে দুইটা আঙুলের দাগ লাল হয়ে ফুটে পড়েছে। নিতম্ব ছাড়ানো চুল গুলো খোপা খুলে পিঠময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ ওড়না টা ডান কাধ আর বুক ঢেকে আছে। মাঝে মাঝেই কেপে উঠছে ও।
আয়েশা অগ্নি চক্ষু দিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। শামসুল মেঝেতে তাকিয়ে আছে। জুলেখার মুখ ভার। জুবায়ের মায়ের পাশে সোফায় বসে তাকিয়ে আছে রুমাইশার বাম কাধ আর গলার উন্মুক্ত অংশে৷ বাম পাশের বিউটি বোনের থেকে একটু নিচে বক্ষ আরম্ভিকার সামান্য ওপরে থাকা কুচকুচে কালো তিল টা ওকে চুম্বকের মতো টানছে সেদিকে।
নিরবতা ভেঙে জুলেখা কথা বলে উঠলেন। আয়েশা কে উদ্দ্যেশ্য করে তিনি বললেন,
— তোর মেয়ে একটা ছেলের সাথে এই বাড়িতে এক বিছানায় থেকেছে আর সেটা তুই আমাকে এখন বলছিস? তোর নষ্টা মেয়েকে তুই আমার ছেলের ঘাড়ে চাপাতে চাস?
আয়েশা রুমাইশার দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলেন, তারপর জুলেখার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
— আমার মেয়ের সাথে ওই ছেলের ফিজ্যিকালি কিছু হয়নি সেটা তোমাকে আমি বলেছি। আর তুমি আমার মেয়েকে নষ্টা বলছো, আর তোমার ছেলে কি? তোমার ছেলে পীর? তোমার ছেলে তো নিজের মুখে স্বীকার করেছে যে সে কত মেয়ের সাথে…… আর তুমি নিজের ছেলের চরিত্র না দেখে আমার মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলছো!
জুলেখা মুখ বেকিয়ে বললেন,
— ছেলে মানুষের ওরকম একটু আধটু থাকে। তাছাড়া ও বাইরে থেকেছে, ওখানের যেরকম কালচার সেভাবেই ও নিজেকে মানিয়ে বিয়েছে, দেশে এসে তো কিছু করেনি? দেশে কিছু করলে না হয় তুই বলতি। আর তোর মেয়ে তো তোর সামনে দিয়েই সবকিছু করে গেছে আর তোরা কিছুই করতে পারিসনি।
আয়েশা বোন কে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
— ফাউ লজিক দিও না আপা, চরিত্রহীনের আবার দেশ কি বিদেশ কি? যে চরিত্রহীন সে সবখানেই চরিত্রহীন। তুমি আর নিজের ছেলের হয়ে ওকালতি করো না। আর আমার মেয়েকে আমি যথেষ্ট শাসন করেছি। তোমার মতো লাই দেইনি।
এমন সময় জুবায়ের মা আর খালা কে থামিয়ে দিয়ে বলল,
— মা, খালা তোমরা থামবে প্লিজ! তোমরা চুপ করো এখন, বিয়েটা যেহেতু আমাদের তাই কথা আমরা বলবো, তোমরা থামো। আমার রুমি কে বিয়ে করতে কোনো অসুবিধা নেই। বিন্দু মাত্র ও অসুবিধা নেই। ও কার সাথে কি করলো সেটা আমার দেখার বিষয় না। ও আমার বউ হয়ে গেলে এসব আর ম্যাটার করবে না। ওকে আমার খুব ভালো লেগেছে, তাই বিয়ে আমি ওকেই করবো। পাস্ট আমার ও আছে, ওর ও আছে, দুইটা মিলে সমান সমান। এখন তোমরা থামো।
মেঝে থেকে গর্জে উঠলো রুমাইশা,
— আমি কখনোই আপনাকে বিয়ে করবো না। আমি মরে যাবো তবুও আপনাকে বিয়ে করবো না৷ আমি সাফওয়ান কে ভালোবাসি, আর ওকেই বিয়ে করবো।
এ কথা বলার সাথে সাথেই আয়শা ঠাস করে চড় মারলেন রুমাইশার মুখে আবার। তারপর রুমাইশার চুল মুঠি করে ধরে বললেন,
— তুই এত কিছু করার পর ও ছেলে টা যে তোকে বিয়ে করতে চাইছে তাতে তুই শুকরিয়া আদায় কর, বেয়াদব কোথাকার! সামান্য অপরাধবোধ নেই ওর ভেতরে, উলটো গলা উচু করে কথা বলছে। তোর জন্য আজ আমাকে অন্য মানুষের সামনে ছোট হতে হচ্ছে, শুধুমাত্র তোর জন্য।
শামসুল আর থাকতে পারলেন না। আয়েশার উদ্দ্যেশ্যে কড়া গলায় বললেন,
— আয়েশা ওকে ছেড়ে দাও, ওকে আর একটা আঘাত ও করবা না তুমি। ও বিয়ে করতে না চাইলে ওকে মোটেই জোর করতে পারোনা তুমি। ও সাফওয়ান কে বিয়ে করতে চাইলে তাই করবে৷ সাফওয়ান জুবায়েরের থেকে হাজার গুণ ভালো ছেলে। কোনো লুচ্চা বদমাসের হাতে মেয়ে তুলে দেওয়ার থেকে কোনো জংলির হাতে মেয়ে দিয়ে আমি বেশি নিশ্চিত থাকবো। সাফওয়ান আর যাই করুক, কখনো রুমি কে ঠকাবে না। আর না কখনো অন্য কারো কথা মাথায় আনবে। আমার মেয়ের বিয়ে আমি জোর করে দিতে চাইনা মোটেই।
আয়েশা ফুসে উঠলেন,
— মোটেও সাফওয়ানের সাথে আমি ওর বিয়ে দেবো না। যাকে একবার মেয়ে দেবো না বলেছি তাকে আমি আবার ডেকে ডেকে মেয়ে দেবো? কখনোই না।
— তুমি তোমার মেয়ের সুখের থেকে তোমার আত্মসম্মান টাকে বড়ো করে দেখছো আয়েশা! তুমি তো এরকম ছিলেনা আয়েশা, কবে থেকে হলে তুমি এরকম? কবে থেকে তুমি মেয়ের চিন্তা ছেড়ে নিজের চিন্তা শুরু করেছো! আমার মেয়েকে আমি কোনোমতেই জোর করে বিয়ে দেবো না৷ এতে না আমার মেয়ে সুখে থাকবে আর না আমরা!
আয়েশার মাথায় জেদ চাপলো, ভয়ানক রকমের জেদ৷ আয়েশা রুমাইশার চুল ছেড়ে দিলেন। মায়ের থেকে ছাড়া পেয়ে রুমাইশা ফুপিয়ে উঠলো, মাথার পেছনে প্রচন্ড ব্যাথা করছে ওর৷ ব্যাথা পাওয়া জায়গায় নিজের হাত টা রেখে ফোপাতে লাগলো ও।
আয়েশা জুবায়েরের দিকে চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে বললেন,
— জুবায়ের বাবা, তুই বিয়ে করতে রাজি? তুই রাজি থাকলে বিয়ে আজকে রাতেই পড়ানো হবে৷
“””
সাফওয়ান এতক্ষণ পাটির ওপর ওভাবেই বসে ছিলো ল্যাপটপ নিয়ে। হঠাৎ ধাম করেই ল্যাপটপ টা বন্ধ করে দিলো ও৷ তারপর ফোন টা নিয়ে কল করলো শাফিনের কাছে।
শাফিন তখন কেবল ঘুমিয়েছে। রিংটোন বেজে উঠতেই শাফিন ঘুম থেকে থড়বড় করে উঠে গেলো। ভাইয়ের কল দেখে রিসিভ করলো তাড়াতাড়ি। ধাফিন রিসিব করতেই সাফওয়ান ফোনের ওপাশ থেকে গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলো,
— রেডি হ, আমরা বেরোবো।
ভাইয়ের কথা শুনে শাফিন বেক্কলের মতো বসে রইলো বিছানায়,
কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
— বেরোবো মানে? এত রাতে কোথায় যাবো?
সাফওয়ান নিজের রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
— রেডি হতে বলছি রেডি হ, কোথায় যাবো সেটা গেলে বুঝতে পারবি। ফাস্ট ফাস্ট, ১০ মিনিট সময়, এর ভেতরে রেডি হয়ে গ্যারাজের সামনে আয়৷
বলে ফোন কেটে দিলো সাফওয়ান। শাফিন ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দ্রুত পায়ে বিছানা ছেড়ে উঠলো, ওয়াশরুমে গিয়ে দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে রুমে এসে তাড়াতাড়ি করে একটা প্যান্ট আর শার্ট পরে নিলো। তারপর ফোন টা হাতে নিয়ে রুমের বাইরে এসে দেখে সাফওয়ান ও নামছে সিড়ি দিয়ে৷ দুই ভাই একসাথে নামলো।
হলরুম দিয়ে যাওয়ার সময় রুনিয়া আর ইশতিয়াকের রুমের সামনে হঠাৎ করেই থেমে গেলো সাফওয়ান। ভাইয়ের দেখা দেখি শাফিন ও থেমে গেলো। সাফওয়ান নক করলো দরজায়। তিন বার নক করার পর ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দিলেন রুনিয়া৷
এত রাতে দুই ছেলে কে একসাথে এমন ফিট ফাট হয়ে সামনে দেখে চমকালেন রুনিয়া৷ পেছন ফিরে ইশতিয়াকের দিকে একবার দেখে নিলেন। ভদ্রলোক গভীর ঘুমে আছেন। নকের শব্দে ঘুম ভাঙেনি তার৷ আবার সামনে তাকিয়ে দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলেন রুনিয়া৷ তারপর দরজা টা বাইরে থাকে টেনে দিলেন।
সাফওয়ানের সামনে এসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— তোরা দুজন, এত রাতে, এক সাথে! এমন সেজে গুজে আছিস কেন? কোথাও যাচ্ছিস নাকি?
সাফওয়ান মায়ের হাত টা নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে বলল,
— নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি মা, দুয়া কইরো।
— নতুন জীবন মানে?
একবার সাফওয়ানের দিকে আর একবার শাফিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
শাফিন হাত নাড়িয়ে বোঝালো, যে সে নিজেও জানেনা তার ভাইয়ের কথার আগা মাথা।
সাফওয়ান রুনিয়া কে বললেন,
— বাড়ি ফিরে আসি, তারপর বুঝতে পারবা৷ এখন বেশি বেশি দুয়া করো। আসি মা।
বলে রুনিয়ার হাত টা ছেড়ে দিয়ে শাফিন কে ইশারা দিয়ে মেইন ডোর খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো সাফওয়ান। শাফিন একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে চলল ভাই এর পেছন পেছন।
রুমাইশার রুমে রুমাইশা কে জোর করে শাড়ি পরাচ্ছেন আয়েশা আর জুলেখা। রুমাইশা বার বার শাড়ি টা টান দিয়ে খুলে ফেলছে। আর প্রতিবার ই আয়েশা ওকে থাপ্পড় মারছেন। মায়ের থাপ্পড় খেয়েও রুমাইশা নমনীয় হচ্ছে না। উলটো ওর জেদ উত্তোরত্তোর বেড়েই চলেছে৷ চোখ মুখ শক্ত করে আছে ও।
পরের বার শাড়ি টান দিয়ে খুলতেই আয়েশা রুমাইশার মুখ টিপে ধরে তীর্যক কণ্ঠে বললেন,
— ভালোয় ভালোয় শাড়ি পরে নে কিন্তু! নইলে তোকে আমি শেষ করে ফেলবো। তোর বিয়ে করাই লাগবে৷ তুই বিয়ে না করে কোথায় যাস আমিও দেখবো।
রুমাইশা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— আমার প্রাণ থাকতে আমি সাফিওয়ান ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। তুমি আমাকে শেষই করে ফেলো। এ ছাড়া আমাকে বিয়ে দিতে পারবে না তুমি। আমিও দেখবো তুমি আমার বিয়ে কিভাবে দাও।
পাশ থেকে জুলেখা রুমাইশার উদ্দ্যেশ্যে নরম গলায় বলে উঠলেন,
— দেখ রুমি মা, সেই সেই তো বিয়ে টা করতেই হবে, তা এত ঝামেলা না করে মেনে নে, তোর বাবা কে বুঝিয়েছি আমরা, তোর বাবা তো বুঝেছে। আর তাছাড়া তুই তোর বাবা মার মত ছাড়া বিয়ে করবি এটা তো হয় না! তারা পছন্দ করে যেখানে বিয়ে দিতে চাইছে সেখানেই বিয়ে টা করে নে৷ তারা তো আর তোর খারাপ চাইবে না!
রুমাইশা ফুসে উঠে বলল,
— কে আমার কেমন ভালো চায় তা আমার জানা হয়ে গেছে! ভালোই যদি চাইতো তবে তোমার ওই লুইচ্চা ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইতো না৷ জোর করতো না আমাকে বিয়ের জন্য। আমি যাকে চাই তার সাথেই বিয়ে টা দিতো! নিজের জেদ বজায় রাখার জন্য আমাকে তোমার ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে! বলির পাঠা মনে করেছে আমাকে, না? আমি কোনোভাবেই এই বিয়ে করবো না! আমাকে মেরে ফেললেও না৷
শামসুল খুব দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছেন। একদিকে মেয়ে চাইছে একজন কে, তার ভালো খারাপ উভয় দিক আছে; অন্যদিকে স্ত্রি, ছেলে, স্ত্রীর বোন সবাই অন্য একজন কে চাইছে, সেই অন্য জন ও মেয়ে কে চাইছে। তার ও ভালো খারাপ উভয় দিক বিদ্যমান। কোনদিকে যাবেন উনি ভাবতে পারছেন না।
তার স্ত্রী ও জেদের বসে যে কি শুরু করেছে তিনি বুঝতে পারছেন না৷ আর মেয়েটা মায়ের চাইতেও বেশি জেদি। জেদে জেদে ভর পুর তার চারপাশ। কোনদিকে যাবেন তা তিনি ভেবে উঠতে পারছেন না৷ মেয়ের চিৎকার চেচামেচি কানে আসছে তার থেকে থেকে। আর কানে আসছে স্ত্রীর দেওয়া থাপ্পড়ের শব্দ৷ নিজের ঘরে দম মেরে বসে আছেন তিনি। যা হচ্ছে তাই হতে দিচ্ছেন। স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই তার জন্য ভালো হবে হয়তো।
বিয়ে পড়ানোর জন্য এলাকার মসজিদের ইমাম কে খবর দেওয়া হয়েছে। আর বিয়ের খবর টা চেপে যেতেও বলা হয়েছে। গ্রামের অন্য প্রান্তে ইমামের বাড়ি হওয়ায় আসতে একটু সময় লাগবে৷ রাত প্রায় বারোটার বেশি, এই সময়ে তো কেউ আসতেই চাইবে না হুট করে। তবুও সে যে আসতে চাইছে এতেই আয়েশা খুশি। দেরি হলেও সমস্যা নেই। বিয়ে তো হবেই আজ। যেভাবেই হোক। শেষ রাতে হলেও।
রুমাইশা কে শাড়ি পরানো যাচ্ছে না৷ জুলেখা কয়েকটা গয়না পরিয়েছিলেন সেগুলোও সব টেনে ছিড়ে খুলে ফেলেছে ও৷ কাদছে না ও এখন আর। উলটো ওর চোখে মুখে দেখা যাচ্ছে হিংস্রতা। হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুড়ে ছুড়ে ভাংছে। আয়েশা জুলেখা কেউই থামাতে পারছে না ওকে৷ সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে ও৷
শামসুল আর বসে থাকতে পারলেন না। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে রুমাইশার রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। রুমের ভেতরে ঢুকলেন না। বাইরে থেকেই আয়েশার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
— আয়েশা, ও শাড়ি পরতে না চাইলে জোর কইরো না। যেভাবে আছে ওভাবেই থাকুক। কাল যখন যাবে জুলেখা দের সাথে তখন পরাইয়ো। এখন এমন জোর জবরদস্তি করলে ব্যাপার টা আর ও খারাপের দিকে যাবে। ছেড়ে দাও ওকে। পাড়া প্রতিবেশী দের বাসা বাড়ি একটু দূরে দূরে বলে বেচে যাচ্ছো। নইলে ও এইভাবে চিৎকার করলে কেউ যদি শোনে তাহলে মান সম্মান কোথায় যাবে ভেবেছো!
বাবার কথা শুনে রুমাইশা চিৎকার করে কাদলো এবার। প্রাণ পণে চিল্লাতে চিল্লাতে বলল,
— বাবা! তুমিও এদের সাথে মিলে আমাকে এইভাবে ওই অসভ্যের হাতে তুলে দিতে চাও বাবা! আমি বিয়ে করবো না বাবা! আমি সাফওয়ান কে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না। মরে যাবো আমি তোমরা এমন জোর করলে। ওই জুবায়ের যদি আমাকে ছোয় তবে আমি আত্মহত্যা করবো আজকেই৷ শেষ করে দেবো নিজেকে বাবা! তখন তুমি কি করো আমিও দেখবো! তোমার কাছে তোমার মেয়ের থেকে তোমাদের মানসম্মান বড়ো হয়ে গেলো! তোমরা আমাকে তোমাদের মানসম্মানের জন্য কোরবানি করে দিচ্ছো! তোমাদের মতো বাবা মায়ের আমার কোনো প্রয়োজন নেই৷ আমি পালাবো ওদের বাড়ি থেকে। আমি রাস্তায় পচে মরবো তবুও তোমাদের বাড়িতে আর ফিরবো না কোনোদিন। তখন তোমরা দেইখো!
শামসুল রুমাইশা কে শান্ত করার জন্য কোনো কথা খুজে পেলেন না। আয়েশা কে আবার ও বললেন,
— ওকে জোর কোইরো না। যা পরা ছিলো তাই পরিয়ে দাও। পরিস্থিতি আর খারাপ কইরো না তোমরা।
তারপর চলে গেলেন আবার নিজের রুমে। পেছন থেকে রুমাইশা চিৎকার করে বলতে লাগলো,
— বাবা, আমার সাথে এমন অবিচার কইরো না তোমরা৷ আমাকে জোর করে বিয়ে দিও না। এইরকম কইরো না তোমরা! আমাকে এই জাহান্নামে ফেলে যাইয়ো না বাবা! বাবা, তুমি বলেছিলে তুমি সাফওয়ানের সাথে আমাকে বিয়ে দিবা, তোমার কোনো আপত্তি নেই, তাহলে তুমি এখন আমার সাথে এমন করলে কেন? আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা কেন করলে তুমি! তুমি কথা দিয়ে কথা রাখোনি বাবা! কেমন বাবা তুমি! তোমার কি আমার জন্য একটুও মায়া হচ্ছে না বাবা! বাবা!
শামসুলের চোখের কোণা ভিজে উঠলো। কোনো কথা না বলে তিনি নিজের রুমে গিয়ে আবার বসলেন বিছানায়৷
রুমাইশা সমানে কান্না করে যাচ্ছে। আর সেই সাথে চিৎকার করছে। জুলেখা কয়েকবার শান্ত করার চেষ্টা করলেন ওকে, কিন্তু ও শান্ত হলো না। জুবায়ের মাঝে মাঝে এসে এই রুমে উকি দিয়ে যাচ্ছে। রুমাইশার এসব কান্নাকাটি ওর পছন্দ হচ্ছে না। এসব ভালোবাসা ফাসার দাম আছে নাকি? এসব নিয়ে এত আদিখ্যেতা করার কি আছে ভেবে পেলো না ও। বিয়ে টা একবার হয়ে গেলেই হয়। সাফওয়ান সহ সাফওয়ানের বাবার নাম টাও ভুলিয়ে দেবে ও৷
শামসুল আর একবার ফোন দিলো ইমামের কাছে। ইমাম আসছে বলল, হেটে আসছে, সময় লাগবে একটু। এখন তো আর কেউ ওকে গাড়িতে করে পৌছে দেবে না।
সাফওয়ান আর শাফিন রাস্তাতে। সাফওয়ান ড্রাইভ করছে। চোখ মুখ ওর ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। সমস্ত মুখে হিংস্রতা ফুটে উঠেছে ওর। দাঁতে দাঁত চেপে আছে। শাফিন ভয় পেয়ে যাচ্ছে ভাই কে দেখে। মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে ভাইয়ের মুখের অভিব্যক্তি দেখছে ও৷ ভয়ঙ্কর রকমের কাঠিন্যতার ছাপ পড়েছে সাফওয়ানের মুখে৷ ওরা কোথায়, যাচ্ছে কেন যাচ্ছে কিছুই জানে না শাফিন। কয়েকবার জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করেনি ভাইয়ের এমন কাঠিন্য পূর্ণ চেহারা দেখে। সাহসে কুলাচ্ছে না ওর।
এমন সময় গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ওপর রাখা সাফওয়ানের ফোন টা বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে কলার এর নাম দেখে সাফওয়ানের মুখে বাকা হাসি ফুটে উঠলো। শাফিন খেয়াল করলো সেটা। সাফওয়ান বাম হাতে ফোন টা তুলে রিসিভ করেই বলে উঠলো,
— উইস করার জন্য ফোন দিয়েছিস? কর, উইস কর৷
ফোনের ওপাশ থেকে রাফসান ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
— তোমার ব্যাপারে আমি সব জেনে গেছি। তুমি সিঙ্গাপুরে ঠিক কি কাজ করতে সেটা আমি জেনে গেছি। হন্যে হয়ে খুজছে ওরা তোমাকে৷ আমি খুব শীঘ্রই তোমার খবর ওদের দিয়ে দেবো। তোমাকে ওরা শেষ করে ফেলবে সেখানেই নিয়ে গিয়ে। তোমাকে অন স্পট শ্যুট করতেও তাদের পারমিশন দেওয়া আছে। বেচে ফিরতে পারবে না তুমি। আর আজ আমার বোনের বিয়ে। শুভকামনা জানাতে ভুলো না।
রাফসানের এমন কাচা হুমকিতে অট্টহাসি দিলো সাফওয়ান। তারপর হঠাৎ চোখ মুখ শক্ত করে তাছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
— তুই রাফসান আমাকে হুমকি দিচ্ছিস! তুই! হা হা! আমার সম্পর্কে খোজ খবর নেওয়ার পর ও যে তুই হুমকি দেওয়ার সাহস পাচ্ছিস ভেবে ভালো লাগছে খুব। জানা, যাকে পারিস জানা! কেউ আমার একটা চুল ও ছিড়তে পারবে না। আচ্ছা যাই হোক, শুভকামনা তুই আমাকে জানাবি, কারণ রিমুর বিয়ে টা আমার সাথেই হবে, শালাবাবু!
(তাড়াহুড়ো করে লিখেছি, ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন। 😐)