অফিডিয়ান | পর্ব – ৩৪

34 Min Read

ক্রোধান্বিত চোখে তাকিয়ে ধীরে ধীরে জুবায়েরের দিকে এগোলো সাফওয়ান।
সাফওয়ান কে এভাবে আগাতে দেখে জুবায়ের ঠাই দাঁড়িয়ে গেছে, ভয়ে ওর পা সরছে না। জুবায়েরের গা কাপা শুরু হলো ওর নিজের অজান্তেই! ঢোক গিলল একটা বড় করে। সাফওয়ানের ওই জ্বলজ্বলে চোখ দুইটা থেকে চাইলেও যেন চোখ ফেরাতে পারছে না ও৷ কিসের এক আতঙ্ক গ্রাস করে ফেলেছে যেন ওকে৷

কিছুটা দূরে দাঁড়ানো আয়েশা ভীতসন্ত্রস্ত চাহনি নিয়ে সাফওয়ানের গতিবিধি নজর রাখছে আড়চোখে। জুলেখা ঘরের ভেতর থেকে দরজায় কান পেতে আছে, যদি কোনো অঘটন ঘটায় সাফওয়ান তার জন্য। বোনের থেকে শোনা সাফওয়ানের কীর্তিকলাপের বিবরণের পর থেকেই ওনার গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে, আর এখন খোদ শিকার তার ই ছেলে। মনে মনে সৃষ্টি কর্তার কাছে আর্জি জানাচ্ছেন যেন ছেলেটার কোনো বড়সড় ক্ষতি না হয়ে যায়।

সাফওয়ান জুবায়েরের ঠিক সামনে গিয়ে শীতল দৃষ্টি দিলো ওর চোখে! আর পরমুহূর্তেই চোয়াল শক্ত করে নিজের শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে জুবায়েরের নাক আর ঠোঁটের কোণ বরাবর ঘুষি মারলো একটা।

সাফওয়ানের ইস্পাত কঠিন হাতের ঘুষিটা সত্যি সত্যিই জুবায়েরের কাছে লোহার হাতুড়ির বাড়ির মতো লাগলো। ছিটকে গিয়ে পেছনের দেয়ালের সাথে মাথায় বাড়ি খেলো ও। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করেছে ওর। ঠোঁট ফেটে গেছে এক পাশ থেকে। চারদিকে অন্ধকার দেখছে ও। জীবনে কখনো এরকম আঘাত ও কারো কাছ থেকে পেয়েছে কিনা মনে পড়েনা ওর, আজ সাফওয়ানের এক ঘুষি খেয়ে মাথার ভেতর বন বন করে ঘুরছে ওর৷

জুবায়েরের নাক মুখ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত আসতে দেখে ভড়কে গেলেন আয়েশা। আতঙ্কে হতবাক হয়ে একবার তাকালেন তিনি সাফওয়ানের দিকে। সাফওয়ান এখনো তার শকুনি দৃষ্টি দিয়ে জুবায়েরের দিকেই তাকিয়ে আছে, ওর স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায়।

জুবায়ের নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিতেই সাফওয়ান তড়িৎ গতিতে ওর গাছে গিয়ে ওর শার্টের কলার ধরে উঁচু করলো ওকে; আর এরপরই এক হাত দিয়ে জুবায়েরের গলা ধরেই শূন্যে তুলে ধরলো। মেঝে থেকে দু ইঞ্চি উপরে সাফওয়ানের এক হাতের মুঠির ভেতর শুধু মাত্র গলার অবলম্বনে ঝুলে রইলো জুবায়ের।

সাফওয়ানের পেশিবহুল হাতের চাপে জুবায়ের ছটফট করতে শুরু করলো। চোখ মুখ উলটে যেতে শুরু করলো ওর, জিহবা বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমে! নাকের রক্ত মুখের লালা সব এক হয়ে পড়তে লাগলো ওর মুখ বেয়ে।

কিন্তু সেসব দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সাফওয়ানের। ও দাঁতে দাঁত চেপে জুবায়েরের এই ফুলে ওটা, বাচার আকুতি পূর্ণ মুখ টা ভিষণ উপভোগ করছে। এক পৈশাচিক আনন্দ ওর শরীরে আলোড়ন সৃষ্টি করছে।
জুবায়ের কয়েকবার হাতড়িয়ে সাফওয়ানের হাত খানাকে গলা থেকে সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ হলো ও৷

আয়েশা জুবায়েরের এমন অবস্থা দেখে উচ্চস্বরে কেদে উঠে রুমাইশার দিকে তাকালেন একবার সাহায্য পাবার আশায়, হতভম্ব রুমাইশা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে সাফওয়ান কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মিনতি করে বলল,
— ছেড়ে দিন ওকে! নইলে মরে যাবে ও, ছেড়ে দিন প্লিজ! ওর কিছু হয়ে গেলে আপনি বিপদে পড়ে যাবেন, ছেড়ে দিন ওকে!

আয়েশা সমানে কেদেই যাচ্ছে, জুলেখা বাইরে এত হুটোপুটি শুনে ভয় পেয়ে গেলেন, কিন্তু দরজা খোলার সাহস করলেন না। কান পেতে রইলেন, আর চোখ বুঝে ওপর ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করতে থাকলেন, যেন কোনো অঘটন না ঘটে!

রুমাইশা বলার পর ও সাফওয়ান ছাড়লো না জুবায়ের কে। আর ও কিছুক্ষন ওভাবেই মাটি থেকে উচু করে রাখলো ওকে। আর তারপর ই ধাম করে ছেড়ে দিলো।

শব্দ করে মেঝেতে আছড়ে পড়লো জুবায়ের। ছাড়া পেয়ে নিজের গলায় হাত দিয়ে হাসফাস করতে লাগলো ও।মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়েও যেন ফিরে আসলো ও! আয়েশা অবিশ্বাস্য চোখে সাফওয়ানের কঠিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সামনে থাকা সোফার ওপরের অংশ হাত দিয়ে খামচে ধরে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

সাফওয়ান সেইখানে স্থির হয়ে দাঁড়ানো অবস্থাতেই মাথা ঘুরিয়ে আয়েশার দিকে তাকালো। আয়েশা ফুপিয়ে কাদতে শুরু করলেন।
রুমাইশা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে সাফওয়ান কে, যেন সাফওয়ান মায়ের দিকে ভুলেও না আগায়৷

সাফওয়ান সত্যিই আগালো না৷ ওইখানে দাড়িয়েই আয়েশার উদ্দ্যেশ্যে বজ্র কঠিন কন্ঠে বলে উঠলো,
— আপনাকে বলেছিলাম, আমার বাগদত্তার চোয়ালে যেন আমি আর কোনো আঘাতের চিহ্ন না দেখি। এরপর ও আপনি ওর গায়ে হাত তুলেছেন কেন? জবাব দিন! এই মুহুর্তে!

আয়েশা কোনো কথা বললেন না, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চোখের পানি ফেললেন শুধু। আয়েশার নিরবতায় সাফওয়ান দাঁত মুখ খিচিয়ে বলল,
— রিমু কে বলা আপনার প্রতিটা কথা শুনেছি আমি, আর এই কুকুরটার বলা প্রতিটা কথাও! কে কি বলেছে সব শুনেছি আমি। আপনি যদি রিমুর মা না হতেন, তাহলে এই মুহুর্তে আপনার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলতাম আমি!
হ্যা, ওর মানুষে হবে না, জানোয়ার লাগবে। মানুষ রুপি জানোয়ারের সাথে আপনার যদি ওর বিয়ে দিতে আপত্তি না হয়, তাহলে আমি জানোয়ারের সাথে বিয়ে দিতে আপনার এত কিসের আপত্তি?
আজ থেকে রিমু আমার স্ত্রী, আপনাদের সাথে ওর সম্পর্ক নষ্ট হোক সেটা আমি কখনোই চাইবনা। তবে! আমি বেচে থাকাকালিন রিমু যতদিন এই বাড়িতে এসে থাকবে ততদিন আপনি, ওকে যদি সামান্য কোনো আঘাত ও করেন, হোক সেটা ফিজ্যিক্যাল ওর মেন্টাল, আমি আপনাকে সেদিন আর ছেড়ে দেবো না! মাইন্ড ইট।

রুমাইশা পেছন থেকে সাফওয়ানকে আর ও জোরে আকড়ে ধরে বলল,
— চুপ করুন আপনি, পায়ে ধরি আপনার, থামুন এইবার। বিয়ে তো হয়েই গেছে, কোনো ঝামেলা নেই আর! আর কিছু করবেন না আপনি প্লিজ!

সাফওয়ান আয়েশার দিকে তখন ও চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইলো। আয়েশা চোখ নামিয়ে ফেললেন, সাফওয়ানের ওই অগ্নি চক্ষু তে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না তিনি।

চোখ দুইটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো সাফওয়ান। কিন্তু পারলো না। রুমাইশার হাত দুইটা ধীরে ধীরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো ও৷
আর তারপর ই রুমাইশা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিদ্যুৎ গতিতে গিয়ে ফ্লোরে বসা জুবায়েরের গলা ধরে পেছন দিকে ঘুরিয়ে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে টেনে আনলো সাফওয়ান। তারপর ওর গলা চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
— খুব আদর করার ইচ্ছে না তোর! রিমুকে আদর করে আমার এক্সিস্টেন্স ভুলিয়ে দিবি তুই! খুব শখ না অন্যের বউ কে আদর করার! তোর শখ আমি আজ মিটিয়ে দেবো! চিরতরে!

বলেই জুবায়েরের ডান হাত টা হ্যাচকা টেনে পেছন দিকে নিয়ে মুচড়ে দিলো সাফওয়ান, কলার বোনে খট করে শব্দ হয়ে উঠলো ওর, আকাশ বাতাস কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো জুবায়ের!

রুমাইশা দ্রুত গিয়ে সাফওয়ানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আবার, ওর কালো স্যুটের বোতামের স্থান টা দুই হাতে মুঠি করে সরিয়ে নিয়ে আসতে চাইলো জুবায়েরের থেকে,
— ছেড়ে দিন ওকে প্লিজ, মরে যাবে ও, ওর মা আছে এইখানে, ছেড়ে দিন প্লিজ, খালার ছেলের কিছু হলে খালা বাচবে না, ছেড়ে দিন ওকে দয়া করে, ছেড়ে দিন৷

এদিকে ছেলের চিৎকার শুনে জুলেখা আর রুমে থাকতে পারলেন না, দ্রুত পায়ে দরজার লক খুলে দৌড়ে বাইরে এলেন, এ পাশ থেকে শামসুল ও বাইরে বেরিয়ে এলেন।

ছেলের এমন অবস্থা দেখে জুলেখা উচ্চস্বরে কেদে উঠলেন, সাফওয়ানের উদ্দ্যেশ্যে মিনতি করে বললেন,
— ছেড়ে দাও আমার ছেলে কে, ও আর কখনো রুমি কে কিছু বলবে না! ও আর কখনো রুমির দিকে ফিরেও তাকাবে না, যতদ্রুত সম্ভব ইতালি চলে যাবে ও, ছেড়ে দাও আমার ছেলে কে তুমি!

কিন্তু কারো কথায় সাফওয়ানের কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না, ও এইবার জুবায়েরের হাত টা হ্যাচকা টান দিয়ে পেছনে নিয়ে এসে আবার ও মুচড়ে ধরলো, ককিয়ে উঠলো জুনায়ের!
শামসুল তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সাফওয়ানের হাত থেকে জুবায়ের কে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন, মিনতির সুরে বললেন,
— সাফওয়ান, বাবা, ছেড়ে দে ওকে। হাত ভেঙে যাবে ওর, ওকে ছেড়ে দে, ও দরকার হলে তোর কাছে মাফ চাইবে, তারপর ও ছেড়ে দে তুই ওকে!

সাফওয়ান দাঁতে দাঁত চেপে শামসুলের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
— মামা, আপনার ধারনাই নেই, এই কুকুর টা আমার রিমু কে কি কি বলেছে! ওর নোংরা কথা বলার শখ আমি মিটিয়ে দেবো একদম!

শামসুল রুমাইশার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে সাফওয়ান কে থামাতে ইশারা করলো, কিন্তু সাফওয়ান যে রুমাইশার কথা ও শুনছে না!
শামসুল সাফওয়ানের হাত থেকে জুবায়েরের হাতের কবজি ছাড়ানোর চেষ্টা করতে কর‍্যে বললেন,
— ওর ভুল হয়ে গেছে সাফওয়ান, ছেড়ে দে তুই ওকে, ও আর করবে না এমন, ছেড়ে দে বাপ! ওর ভালো মন্দ একটা কিছু হয়ে গেলে পুলিশি মামলায় পড়তে হবে, ছেড়ে দে ওকে

সাফওয়ান জুবায়েরের হাত টা ওই অবস্থাতেই আবার নিজের দিকে টান দিলো, তারপর ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
— আজ যদি আমার স্ত্রী আমাকে বাধা না দিতো, তবে তোর হাত ছিড়ে আমি তোর গলা দিয়ে নামিয়ে দিতাম! বেচে গেলি এবারের মতো!

কিন্তু জুবায়ের কে ছেড়ে দিলো না সাফওয়ান৷ ডান হাত ছেড়ে এবার ওর বাম হাত টা শক্ত করে ধরে পিছমোড়া করে আবার ও জোরে মুচড়ে ধরলো, আর সাথে সাথে বাম পাশের হাতের কলার বোনে খট করে শব্দ হলো ওর।

জুবায়ের এবার আগের চাইতেও জোরে চিৎকার করে উঠলো, ঘর কেপে উঠলো যেন সে চিৎকারে!
জুলেখা হাউমাউ করে এসে সাফওয়ানের পায়ের কাছে বসে পড়লো,
— বাবা, ছেড়ে দাও আমার ছেলেকে, ও আর কিছু করবে না আজকের পর থেকে, কোনো বাজে কাজ করবে না। রুমির কথা মাথাতেও আনবে না ও কোনোদিন! ছেড়ে দাও গো বাবা!

বাইরে থেকে তখন শাফিন প্রবেশ করলো মেইন ডোর দিয়ে। এখানের এমন অবস্থা দেখে চোখ কপালে উঠলো ওর!

জুলেখার কাকুতি মিনতিতে সাফওয়ান ছেড়ে দিলো এবার জুবায়ের কে! আর তারপর সোফার পেছনে দাঁড়ানো ভয়ে পাংশুটে হয়ে যাওয়া আয়েশার দিকে আর একবার তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো।

সাফওয়ান জুবায়ের কে ছাড়তেই জুবায়ের অতিরিক্ত যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো, জুলেখা হাউমাউ করে কেদে উঠলেন। শামসুল তাড়াতাড়ি গিয়ে ধরলো জুবায়ের কে৷ আয়েশাও হুড়মুড়িয়ে আসলেন জুবায়েরের কাছে।

জুবায়ের রুমাইশার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শামসুলের উদ্দ্যেশ্যে গমগমে কণ্ঠে বলল,
— হাত কলার বোন থেকে খুলে গেছে, হাসপাতালে নিয়ে ট্রিটমেন্ট দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। মরা কান্না জুড়ে দেওয়ার মতো কিছু হয়নি। আর পনেরো বিশ মিনিট পরেই জ্ঞান ফিরে আসবে। মেরে ফেলিনি ওকে, আফসোস!

রুমাইশা সাফওয়ানের দিকে অসহায় চোখে তাকালো একবার। চোখের ভাষায় বুঝালো যে আপনার এইরকম করা টা মোটেও ঠিক হয়নি!
আর তার প্রতিউত্তরে সাফওয়ান তীর্যক চোখে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, যে সে এখন ওর বিবাহিতা স্ত্রী, তাই কাউকে পরোয়া করার মতো কোনো ইস্যু আর বাকি নেই।

সাফওয়ান সোফার কাছে ফিরে এসে নিজের মাস্ক আর গগলস পরে নিলো। তারপর শাফিনের দিকে তাকিয়ে ওকে ভেতরে এগিয়ে আসতে বলল।
শাফিন এগিয়ে এসে সাফওয়ানের পাশে দাড়ালো।

শামসুল আর জুলেখা জুবায়ের কে ধরাধরি করে নিয়ে গেলেন গেস্ট রুমে, বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলেন ওকে। রাত প্রায় দুইটার কাছাকাছি, সকাল হতে আর দেরি নেই বেশি। ভোরেই জুবায়ের কে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দিবেন শামসুল।

জুবায়ের কে বিছানায় রেখে বাইরে বেরিয়ে এলেন শামসুল। জুলেখা ভেতরে ছেলের কাছেই রইলেন। শামসুল বের হয়ে সোফায় এসে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন একটা।

সাফওয়ান শামসুল কে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
— আমি রিমু কে নিয়ে রওনা হবো মামা, এখনি। বিয়ের অন্যান্য প্রসিজর পরবর্তীতে পালন করা হবে। সে পর্যন্ত রুমি আমার কাছেই থাকবে। দুয়া করবেন আমাদের জন্য। আর হ্যা, আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আপনি অনুমতি দিলে আমরা এখন বেরোবো।

এরপর আয়েশার দিকে একবার তাকিয়ে রুমিরকে ইশারা করলো শামসুলের থেকে বিদায় নিতে।
রুমি সাফওয়ানের ইশারা বুঝে শামসুলের নিকট এগিয়ে গেল, এরপর বলল,
— আমি যাচ্ছি বাবা, আমাকে আপনার দুয়ায় রাখবেন, আমাকে যেন আর কখনো এই রকমের বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সহ্য করতে না হয়! আমি যেন সুখে থাকতে পারি। আপনার জামাই অনুমতি দিলেই আমি আপনাকে দেখতে আসবো আবার! ভালো থাকবেন আপনি, শরীরের যত্ন নিবেন। আর ওষুধ যেন একটাও মিস না হয়!

বলতে বলতে কান্না করে দিলো রুমাইশা। সাফওয়ান দূরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা।

শামসুল রুমাইশা কে নিজের কাছে এগিয়ে নিয়ে এসে ওর কপালে স্নেহের চুম্বন একে দিলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে মায়ের থেকে বিদায় নেওয়ার ইশারা দিলেন।

রুমাইশা শামসুল কে ছেড়ে আয়েশার দিকে এগিয়ে গেল, আয়েশার সামনে গিয়ে আয়েশার হাত দুইটা ধরে বলল,
— আমাকে মাফ করে দিও মা, আমি তোমার সাথে অনেক বেয়াদবি করেছি আজ৷ আমাকে বদদুয়া দিও না যেন তুমি, মায়ের দুয়া সর্বদাই আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা কবুল করে নেন! হোক সেটা ভালো কিংবা খারাপ! আমাকে তোমার ভালো দুয়া তেই রাইখো মা! তোমার প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগ নেই। আমি যাকে চেয়েছিলাম তাকে পেয়ে গেছি! তোমার করা সব আঘাতই ভুলে গেছি আমি মা, তুমিও আমার করা দুর্ব্যাবহার গুলো ভুলে যাইয়ো, ওগুলো মনে করে কষ্ট পেয়ো না, নইলে আল্লাহ তায়ালা আমাকে কখনো সুখে রাখবেন না৷ অনেক ভালোবাসি তোমাকে মা!

রুমাইশার চোখের কোণ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো,
আয়েশা প্রতিউত্তরে কিছু বললেন না রুমাইশা কে৷ শুধু নিজের হাত টা রুমাইশার মাথায় বুলিয়ে দিলেন। রুমাইশা চোখ বুজে নিলো, মায়ের এই আদর টুকুর সবটুকু নিজের ভেতর শুষে নেওয়ার চেষ্টা করলো যেন!

ধীরে ধীরে আয়েশার হাত টা ছেড়ে দিলো রুমাইশা। তারপর মায়ের চোখে তাকিয়ে বলল,
— আসছি আমি মা, তোমার মেয়ের জামাইকে কখনো অন্য নজরে দেখোনা আর! ও বাইরে থেকে জংলি হলেও ভেতর থেকে পুরোপুরি একজন দায়িত্বশীল পুরুষ মানুষ। সে আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

মায়ের দিকে আর একবার কান্না চোখে তাকিয়ে সাফওয়ানের দিকে তাকালো রুমাইশা।
সাফওয়ান শামসুলের দিকে তাকিয়ে রুমাইশা কে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলো।

শামসুল অনুমতি দিলে রুমাইশার হাত ধরে বাইরের যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে পা বাড়ালো সাফওয়ান। আয়েশার সাথে কোনো কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না।
সাফওয়ানের পেছন পেছন শাফিন ও এলো শামসুল আয়েশা কে বিদায় জানিয়ে৷

শামসুল শাফিনের সাথে সাথে এগিয়ে এলেন ওদের কে গাড়ির কাছে দিয়ে আসতে। গাড়ির কাছে এসে সাফওয়ান রুমাইশাকে গাড়িতে ওঠার জন্য গাড়ির সামনের দরজা খুলে দিলো। রুমাইশা উঠে বসলো। শাফিন গিয়ে পেছনের সিটে উঠলো। ড্রাইভিং সিটে বসার আগে সাফওয়ান শামসুলের দিকে ফিরে দাড়ালো আর ও একবার৷
শামসুল সাফওয়ানের ডান হাত টা নিজের হাতে নিয়ে বললেন,
— আমার মেয়ে টা কে দেখে শুনে রাখিস, একটা মাত্র মেয়ে আমার! ও অনেক পাগলি, আগে খুব শান্ত শিষ্ট ছিলো, কিন্তু এখন কিছু বললেই ছ্যাত করে উঠে। ওর ওপরে কখনো চড়াও হোস না! সহ্য করে নিস! আর ও যখন রেগে যায়, তখন কি বলে ও নিজেও জানে না। তাই কখনো অযৌক্তিক কিছু বলে ফেললে ক্ষমা করে দিস ওকে, কিছু মনে রাখিস না!

সাফওয়ান নিজের বাম হাত টা শামসুলের হাতের ওপর রেখে বলল,
— আপনি কোনো চিন্তা করবেন না মামা, আপনার মেয়ের কোনো অযত্ন হবে না। আপনাদের মতো করেই ওর খেয়াল রাখার চেষ্টা করবো আমি৷ আপনি শুধু দুয়া করবেন আমাদের জন্য!

শামসুল চোখ মুছে মাথা নাড়ালেন৷ সাফওয়ান মামার হাত ছেড়ে আসি’ বলে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। শামসুল গেইট খুলে দিলেন। সাফওয়ান, রুমি আর শাফিন কে নিয়ে বেরিয়ে গেলো গাড়িতে করে।

শামসুল সেদিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার রুমের দিকে পা বাড়ালেন৷
এদিকে আয়েশা নিজেকে ধাতস্থ করে রুমে গিয়ে নিজের ফোন টা হাতে নিয়ে সুইচ চাপলেন রাফসান কে এসব কথা বলার জন্য। কিন্তু সুইচ টিপতেই দেখলেন রাফসানের সাতান্ন টা মিসডকল!#অফিডিয়ান
#পর্ব_৩৪
#আ_মি_না

ক্রোধান্বিত চোখে তাকিয়ে ধীরে ধীরে জুবায়েরের দিকে এগোলো সাফওয়ান।
সাফওয়ান কে এভাবে আগাতে দেখে জুবায়ের ঠাই দাঁড়িয়ে গেছে, ভয়ে ওর পা সরছে না। জুবায়েরের গা কাপা শুরু হলো ওর নিজের অজান্তেই! ঢোক গিলল একটা বড় করে। সাফওয়ানের ওই জ্বলজ্বলে চোখ দুইটা থেকে চাইলেও যেন চোখ ফেরাতে পারছে না ও৷ কিসের এক আতঙ্ক গ্রাস করে ফেলেছে যেন ওকে৷

কিছুটা দূরে দাঁড়ানো আয়েশা ভীতসন্ত্রস্ত চাহনি নিয়ে সাফওয়ানের গতিবিধি নজর রাখছে আড়চোখে। জুলেখা ঘরের ভেতর থেকে দরজায় কান পেতে আছে, যদি কোনো অঘটন ঘটায় সাফওয়ান তার জন্য। বোনের থেকে শোনা সাফওয়ানের কীর্তিকলাপের বিবরণের পর থেকেই ওনার গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে, আর এখন খোদ শিকার তার ই ছেলে। মনে মনে সৃষ্টি কর্তার কাছে আর্জি জানাচ্ছেন যেন ছেলেটার কোনো বড়সড় ক্ষতি না হয়ে যায়।

সাফওয়ান জুবায়েরের ঠিক সামনে গিয়ে শীতল দৃষ্টি দিলো ওর চোখে! আর পরমুহূর্তেই চোয়াল শক্ত করে নিজের শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে জুবায়েরের নাক আর ঠোঁটের কোণ বরাবর ঘুষি মারলো একটা।

সাফওয়ানের ইস্পাত কঠিন হাতের ঘুষিটা সত্যি সত্যিই জুবায়েরের কাছে লোহার হাতুড়ির বাড়ির মতো লাগলো। ছিটকে গিয়ে পেছনের দেয়ালের সাথে মাথায় বাড়ি খেলো ও। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করেছে ওর। ঠোঁট ফেটে গেছে এক পাশ থেকে। চারদিকে অন্ধকার দেখছে ও। জীবনে কখনো এরকম আঘাত ও কারো কাছ থেকে পেয়েছে কিনা মনে পড়েনা ওর, আজ সাফওয়ানের এক ঘুষি খেয়ে মাথার ভেতর বন বন করে ঘুরছে ওর৷

জুবায়েরের নাক মুখ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত আসতে দেখে ভড়কে গেলেন আয়েশা। আতঙ্কে হতবাক হয়ে একবার তাকালেন তিনি সাফওয়ানের দিকে। সাফওয়ান এখনো তার শকুনি দৃষ্টি দিয়ে জুবায়েরের দিকেই তাকিয়ে আছে, ওর স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায়।

জুবায়ের নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিতেই সাফওয়ান তড়িৎ গতিতে ওর গাছে গিয়ে ওর শার্টের কলার ধরে উঁচু করলো ওকে; আর এরপরই এক হাত দিয়ে জুবায়েরের গলা ধরেই শূন্যে তুলে ধরলো। মেঝে থেকে দু ইঞ্চি উপরে সাফওয়ানের এক হাতের মুঠির ভেতর শুধু মাত্র গলার অবলম্বনে ঝুলে রইলো জুবায়ের।

সাফওয়ানের পেশিবহুল হাতের চাপে জুবায়ের ছটফট করতে শুরু করলো। চোখ মুখ উলটে যেতে শুরু করলো ওর, জিহবা বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমে! নাকের রক্ত মুখের লালা সব এক হয়ে পড়তে লাগলো ওর মুখ বেয়ে।

কিন্তু সেসব দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সাফওয়ানের। ও দাঁতে দাঁত চেপে জুবায়েরের এই ফুলে ওটা, বাচার আকুতি পূর্ণ মুখ টা ভিষণ উপভোগ করছে। এক পৈশাচিক আনন্দ ওর শরীরে আলোড়ন সৃষ্টি করছে।
জুবায়ের কয়েকবার হাতড়িয়ে সাফওয়ানের হাত খানাকে গলা থেকে সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ হলো ও৷

আয়েশা জুবায়েরের এমন অবস্থা দেখে উচ্চস্বরে কেদে উঠে রুমাইশার দিকে তাকালেন একবার সাহায্য পাবার আশায়, হতভম্ব রুমাইশা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে সাফওয়ান কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মিনতি করে বলল,
— ছেড়ে দিন ওকে! নইলে মরে যাবে ও, ছেড়ে দিন প্লিজ! ওর কিছু হয়ে গেলে আপনি বিপদে পড়ে যাবেন, ছেড়ে দিন ওকে!

আয়েশা সমানে কেদেই যাচ্ছে, জুলেখা বাইরে এত হুটোপুটি শুনে ভয় পেয়ে গেলেন, কিন্তু দরজা খোলার সাহস করলেন না। কান পেতে রইলেন, আর চোখ বুঝে ওপর ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করতে থাকলেন, যেন কোনো অঘটন না ঘটে!

রুমাইশা বলার পর ও সাফওয়ান ছাড়লো না জুবায়ের কে। আর ও কিছুক্ষন ওভাবেই মাটি থেকে উচু করে রাখলো ওকে। আর তারপর ই ধাম করে ছেড়ে দিলো।

শব্দ করে মেঝেতে আছড়ে পড়লো জুবায়ের। ছাড়া পেয়ে নিজের গলায় হাত দিয়ে হাসফাস করতে লাগলো ও।মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়েও যেন ফিরে আসলো ও! আয়েশা অবিশ্বাস্য চোখে সাফওয়ানের কঠিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সামনে থাকা সোফার ওপরের অংশ হাত দিয়ে খামচে ধরে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

সাফওয়ান সেইখানে স্থির হয়ে দাঁড়ানো অবস্থাতেই মাথা ঘুরিয়ে আয়েশার দিকে তাকালো। আয়েশা ফুপিয়ে কাদতে শুরু করলেন।
রুমাইশা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে সাফওয়ান কে, যেন সাফওয়ান মায়ের দিকে ভুলেও না আগায়৷

সাফওয়ান সত্যিই আগালো না৷ ওইখানে দাড়িয়েই আয়েশার উদ্দ্যেশ্যে বজ্র কঠিন কন্ঠে বলে উঠলো,
— আপনাকে বলেছিলাম, আমার বাগদত্তার চোয়ালে যেন আমি আর কোনো আঘাতের চিহ্ন না দেখি। এরপর ও আপনি ওর গায়ে হাত তুলেছেন কেন? জবাব দিন! এই মুহুর্তে!

আয়েশা কোনো কথা বললেন না, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চোখের পানি ফেললেন শুধু। আয়েশার নিরবতায় সাফওয়ান দাঁত মুখ খিচিয়ে বলল,
— রিমু কে বলা আপনার প্রতিটা কথা শুনেছি আমি, আর এই কুকুরটার বলা প্রতিটা কথাও! কে কি বলেছে সব শুনেছি আমি। আপনি যদি রিমুর মা না হতেন, তাহলে এই মুহুর্তে আপনার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলতাম আমি!
হ্যা, ওর মানুষে হবে না, জানোয়ার লাগবে। মানুষ রুপি জানোয়ারের সাথে আপনার যদি ওর বিয়ে দিতে আপত্তি না হয়, তাহলে আমি জানোয়ারের সাথে বিয়ে দিতে আপনার এত কিসের আপত্তি?
আজ থেকে রিমু আমার স্ত্রী, আপনাদের সাথে ওর সম্পর্ক নষ্ট হোক সেটা আমি কখনোই চাইবনা। তবে! আমি বেচে থাকাকালিন রিমু যতদিন এই বাড়িতে এসে থাকবে ততদিন আপনি, ওকে যদি সামান্য কোনো আঘাত ও করেন, হোক সেটা ফিজ্যিক্যাল ওর মেন্টাল, আমি আপনাকে সেদিন আর ছেড়ে দেবো না! মাইন্ড ইট।

রুমাইশা পেছন থেকে সাফওয়ানকে আর ও জোরে আকড়ে ধরে বলল,
— চুপ করুন আপনি, পায়ে ধরি আপনার, থামুন এইবার। বিয়ে তো হয়েই গেছে, কোনো ঝামেলা নেই আর! আর কিছু করবেন না আপনি প্লিজ!

সাফওয়ান আয়েশার দিকে তখন ও চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইলো। আয়েশা চোখ নামিয়ে ফেললেন, সাফওয়ানের ওই অগ্নি চক্ষু তে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না তিনি।

চোখ দুইটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো সাফওয়ান। কিন্তু পারলো না। রুমাইশার হাত দুইটা ধীরে ধীরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো ও৷
আর তারপর ই রুমাইশা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিদ্যুৎ গতিতে গিয়ে ফ্লোরে বসা জুবায়েরের গলা ধরে পেছন দিকে ঘুরিয়ে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে টেনে আনলো সাফওয়ান। তারপর ওর গলা চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
— খুব আদর করার ইচ্ছে না তোর! রিমুকে আদর করে আমার এক্সিস্টেন্স ভুলিয়ে দিবি তুই! খুব শখ না অন্যের বউ কে আদর করার! তোর শখ আমি আজ মিটিয়ে দেবো! চিরতরে!

বলেই জুবায়েরের ডান হাত টা হ্যাচকা টেনে পেছন দিকে নিয়ে মুচড়ে দিলো সাফওয়ান, কলার বোনে খট করে শব্দ হয়ে উঠলো ওর, আকাশ বাতাস কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো জুবায়ের!

রুমাইশা দ্রুত গিয়ে সাফওয়ানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আবার, ওর কালো স্যুটের বোতামের স্থান টা দুই হাতে মুঠি করে সরিয়ে নিয়ে আসতে চাইলো জুবায়েরের থেকে,
— ছেড়ে দিন ওকে প্লিজ, মরে যাবে ও, ওর মা আছে এইখানে, ছেড়ে দিন প্লিজ, খালার ছেলের কিছু হলে খালা বাচবে না, ছেড়ে দিন ওকে দয়া করে, ছেড়ে দিন৷

এদিকে ছেলের চিৎকার শুনে জুলেখা আর রুমে থাকতে পারলেন না, দ্রুত পায়ে দরজার লক খুলে দৌড়ে বাইরে এলেন, এ পাশ থেকে শামসুল ও বাইরে বেরিয়ে এলেন।

ছেলের এমন অবস্থা দেখে জুলেখা উচ্চস্বরে কেদে উঠলেন, সাফওয়ানের উদ্দ্যেশ্যে মিনতি করে বললেন,
— ছেড়ে দাও আমার ছেলে কে, ও আর কখনো রুমি কে কিছু বলবে না! ও আর কখনো রুমির দিকে ফিরেও তাকাবে না, যতদ্রুত সম্ভব ইতালি চলে যাবে ও, ছেড়ে দাও আমার ছেলে কে তুমি!

কিন্তু কারো কথায় সাফওয়ানের কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না, ও এইবার জুবায়েরের হাত টা হ্যাচকা টান দিয়ে পেছনে নিয়ে এসে আবার ও মুচড়ে ধরলো, ককিয়ে উঠলো জুনায়ের!
শামসুল তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সাফওয়ানের হাত থেকে জুবায়ের কে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন, মিনতির সুরে বললেন,
— সাফওয়ান, বাবা, ছেড়ে দে ওকে। হাত ভেঙে যাবে ওর, ওকে ছেড়ে দে, ও দরকার হলে তোর কাছে মাফ চাইবে, তারপর ও ছেড়ে দে তুই ওকে!

সাফওয়ান দাঁতে দাঁত চেপে শামসুলের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
— মামা, আপনার ধারনাই নেই, এই কুকুর টা আমার রিমু কে কি কি বলেছে! ওর নোংরা কথা বলার শখ আমি মিটিয়ে দেবো একদম!

শামসুল রুমাইশার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে সাফওয়ান কে থামাতে ইশারা করলো, কিন্তু সাফওয়ান যে রুমাইশার কথা ও শুনছে না!
শামসুল সাফওয়ানের হাত থেকে জুবায়েরের হাতের কবজি ছাড়ানোর চেষ্টা করতে কর‍্যে বললেন,
— ওর ভুল হয়ে গেছে সাফওয়ান, ছেড়ে দে তুই ওকে, ও আর করবে না এমন, ছেড়ে দে বাপ! ওর ভালো মন্দ একটা কিছু হয়ে গেলে পুলিশি মামলায় পড়তে হবে, ছেড়ে দে ওকে

সাফওয়ান জুবায়েরের হাত টা ওই অবস্থাতেই আবার নিজের দিকে টান দিলো, তারপর ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
— আজ যদি আমার স্ত্রী আমাকে বাধা না দিতো, তবে তোর হাত ছিড়ে আমি তোর গলা দিয়ে নামিয়ে দিতাম! বেচে গেলি এবারের মতো!

কিন্তু জুবায়ের কে ছেড়ে দিলো না সাফওয়ান৷ ডান হাত ছেড়ে এবার ওর বাম হাত টা শক্ত করে ধরে পিছমোড়া করে আবার ও জোরে মুচড়ে ধরলো, আর সাথে সাথে বাম পাশের হাতের কলার বোনে খট করে শব্দ হলো ওর।

জুবায়ের এবার আগের চাইতেও জোরে চিৎকার করে উঠলো, ঘর কেপে উঠলো যেন সে চিৎকারে!
জুলেখা হাউমাউ করে এসে সাফওয়ানের পায়ের কাছে বসে পড়লো,
— বাবা, ছেড়ে দাও আমার ছেলেকে, ও আর কিছু করবে না আজকের পর থেকে, কোনো বাজে কাজ করবে না। রুমির কথা মাথাতেও আনবে না ও কোনোদিন! ছেড়ে দাও গো বাবা!

বাইরে থেকে তখন শাফিন প্রবেশ করলো মেইন ডোর দিয়ে। এখানের এমন অবস্থা দেখে চোখ কপালে উঠলো ওর!

জুলেখার কাকুতি মিনতিতে সাফওয়ান ছেড়ে দিলো এবার জুবায়ের কে! আর তারপর সোফার পেছনে দাঁড়ানো ভয়ে পাংশুটে হয়ে যাওয়া আয়েশার দিকে আর একবার তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো।

সাফওয়ান জুবায়ের কে ছাড়তেই জুবায়ের অতিরিক্ত যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো, জুলেখা হাউমাউ করে কেদে উঠলেন। শামসুল তাড়াতাড়ি গিয়ে ধরলো জুবায়ের কে৷ আয়েশাও হুড়মুড়িয়ে আসলেন জুবায়েরের কাছে।

জুবায়ের রুমাইশার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শামসুলের উদ্দ্যেশ্যে গমগমে কণ্ঠে বলল,
— হাত কলার বোন থেকে খুলে গেছে, হাসপাতালে নিয়ে ট্রিটমেন্ট দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। মরা কান্না জুড়ে দেওয়ার মতো কিছু হয়নি। আর পনেরো বিশ মিনিট পরেই জ্ঞান ফিরে আসবে। মেরে ফেলিনি ওকে, আফসোস!

রুমাইশা সাফওয়ানের দিকে অসহায় চোখে তাকালো একবার। চোখের ভাষায় বুঝালো যে আপনার এইরকম করা টা মোটেও ঠিক হয়নি!
আর তার প্রতিউত্তরে সাফওয়ান তীর্যক চোখে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, যে সে এখন ওর বিবাহিতা স্ত্রী, তাই কাউকে পরোয়া করার মতো কোনো ইস্যু আর বাকি নেই।

সাফওয়ান সোফার কাছে ফিরে এসে নিজের মাস্ক আর গগলস পরে নিলো। তারপর শাফিনের দিকে তাকিয়ে ওকে ভেতরে এগিয়ে আসতে বলল।
শাফিন এগিয়ে এসে সাফওয়ানের পাশে দাড়ালো।

শামসুল আর জুলেখা জুবায়ের কে ধরাধরি করে নিয়ে গেলেন গেস্ট রুমে, বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলেন ওকে। রাত প্রায় দুইটার কাছাকাছি, সকাল হতে আর দেরি নেই বেশি। ভোরেই জুবায়ের কে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দিবেন শামসুল।

জুবায়ের কে বিছানায় রেখে বাইরে বেরিয়ে এলেন শামসুল। জুলেখা ভেতরে ছেলের কাছেই রইলেন। শামসুল বের হয়ে সোফায় এসে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন একটা।

সাফওয়ান শামসুল কে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
— আমি রিমু কে নিয়ে রওনা হবো মামা, এখনি। বিয়ের অন্যান্য প্রসিজর পরবর্তীতে পালন করা হবে। সে পর্যন্ত রুমি আমার কাছেই থাকবে। দুয়া করবেন আমাদের জন্য। আর হ্যা, আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আপনি অনুমতি দিলে আমরা এখন বেরোবো।

এরপর আয়েশার দিকে একবার তাকিয়ে রুমিরকে ইশারা করলো শামসুলের থেকে বিদায় নিতে।
রুমি সাফওয়ানের ইশারা বুঝে শামসুলের নিকট এগিয়ে গেল, এরপর বলল,
— আমি যাচ্ছি বাবা, আমাকে আপনার দুয়ায় রাখবেন, আমাকে যেন আর কখনো এই রকমের বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সহ্য করতে না হয়! আমি যেন সুখে থাকতে পারি। আপনার জামাই অনুমতি দিলেই আমি আপনাকে দেখতে আসবো আবার! ভালো থাকবেন আপনি, শরীরের যত্ন নিবেন। আর ওষুধ যেন একটাও মিস না হয়!

বলতে বলতে কান্না করে দিলো রুমাইশা। সাফওয়ান দূরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা।

শামসুল রুমাইশা কে নিজের কাছে এগিয়ে নিয়ে এসে ওর কপালে স্নেহের চুম্বন একে দিলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে মায়ের থেকে বিদায় নেওয়ার ইশারা দিলেন।

রুমাইশা শামসুল কে ছেড়ে আয়েশার দিকে এগিয়ে গেল, আয়েশার সামনে গিয়ে আয়েশার হাত দুইটা ধরে বলল,
— আমাকে মাফ করে দিও মা, আমি তোমার সাথে অনেক বেয়াদবি করেছি আজ৷ আমাকে বদদুয়া দিও না যেন তুমি, মায়ের দুয়া সর্বদাই আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা কবুল করে নেন! হোক সেটা ভালো কিংবা খারাপ! আমাকে তোমার ভালো দুয়া তেই রাইখো মা! তোমার প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগ নেই। আমি যাকে চেয়েছিলাম তাকে পেয়ে গেছি! তোমার করা সব আঘাতই ভুলে গেছি আমি মা, তুমিও আমার করা দুর্ব্যাবহার গুলো ভুলে যাইয়ো, ওগুলো মনে করে কষ্ট পেয়ো না, নইলে আল্লাহ তায়ালা আমাকে কখনো সুখে রাখবেন না৷ অনেক ভালোবাসি তোমাকে মা!

রুমাইশার চোখের কোণ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো,
আয়েশা প্রতিউত্তরে কিছু বললেন না রুমাইশা কে৷ শুধু নিজের হাত টা রুমাইশার মাথায় বুলিয়ে দিলেন। রুমাইশা চোখ বুজে নিলো, মায়ের এই আদর টুকুর সবটুকু নিজের ভেতর শুষে নেওয়ার চেষ্টা করলো যেন!

ধীরে ধীরে আয়েশার হাত টা ছেড়ে দিলো রুমাইশা। তারপর মায়ের চোখে তাকিয়ে বলল,
— আসছি আমি মা, তোমার মেয়ের জামাইকে কখনো অন্য নজরে দেখোনা আর! ও বাইরে থেকে জংলি হলেও ভেতর থেকে পুরোপুরি একজন দায়িত্বশীল পুরুষ মানুষ। সে আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

মায়ের দিকে আর একবার কান্না চোখে তাকিয়ে সাফওয়ানের দিকে তাকালো রুমাইশা।
সাফওয়ান শামসুলের দিকে তাকিয়ে রুমাইশা কে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলো।

শামসুল অনুমতি দিলে রুমাইশার হাত ধরে বাইরের যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে পা বাড়ালো সাফওয়ান। আয়েশার সাথে কোনো কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না।
সাফওয়ানের পেছন পেছন শাফিন ও এলো শামসুল আয়েশা কে বিদায় জানিয়ে৷

শামসুল শাফিনের সাথে সাথে এগিয়ে এলেন ওদের কে গাড়ির কাছে দিয়ে আসতে। গাড়ির কাছে এসে সাফওয়ান রুমাইশাকে গাড়িতে ওঠার জন্য গাড়ির সামনের দরজা খুলে দিলো। রুমাইশা উঠে বসলো। শাফিন গিয়ে পেছনের সিটে উঠলো। ড্রাইভিং সিটে বসার আগে সাফওয়ান শামসুলের দিকে ফিরে দাড়ালো আর ও একবার৷
শামসুল সাফওয়ানের ডান হাত টা নিজের হাতে নিয়ে বললেন,
— আমার মেয়ে টা কে দেখে শুনে রাখিস, একটা মাত্র মেয়ে আমার! ও অনেক পাগলি, আগে খুব শান্ত শিষ্ট ছিলো, কিন্তু এখন কিছু বললেই ছ্যাত করে উঠে। ওর ওপরে কখনো চড়াও হোস না! সহ্য করে নিস! আর ও যখন রেগে যায়, তখন কি বলে ও নিজেও জানে না। তাই কখনো অযৌক্তিক কিছু বলে ফেললে ক্ষমা করে দিস ওকে, কিছু মনে রাখিস না!

সাফওয়ান নিজের বাম হাত টা শামসুলের হাতের ওপর রেখে বলল,
— আপনি কোনো চিন্তা করবেন না মামা, আপনার মেয়ের কোনো অযত্ন হবে না। আপনাদের মতো করেই ওর খেয়াল রাখার চেষ্টা করবো আমি৷ আপনি শুধু দুয়া করবেন আমাদের জন্য!

শামসুল চোখ মুছে মাথা নাড়ালেন৷ সাফওয়ান মামার হাত ছেড়ে আসি’ বলে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। শামসুল গেইট খুলে দিলেন। সাফওয়ান, রুমি আর শাফিন কে নিয়ে বেরিয়ে গেলো গাড়িতে করে।

শামসুল সেদিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার রুমের দিকে পা বাড়ালেন৷
এদিকে আয়েশা নিজেকে ধাতস্থ করে রুমে গিয়ে নিজের ফোন টা হাতে নিয়ে সুইচ চাপলেন রাফসান কে এসব কথা বলার জন্য। কিন্তু সুইচ টিপতেই দেখলেন রাফসানের সাতান্ন টা মিসডকল!

Share This Article
Leave a comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।